জামায়াতের বিরুদ্ধে লড়াই কি ইঁদুর-বিড়াল খেলা? by মইনুল ইসলাম
‘জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে লড়াইয়ে কেউ নিরপেক্ষ থাকতে পারে না।’ বাক্যটি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের ২৯ সেপ্টেম্বরের একটা বক্তৃতা থেকে নিয়েছি, যেটা বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের ২০১৩-১৪ সালের আন্দোলনে ধ্বংসাত্মক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও জামায়াত-শিবিরের কথিত ‘গৃহযুদ্ধে’ তাদের বেপরোয়া খুন, জখম ও জাতিদ্রোহী ধ্বংসলীলার সচিত্র প্রতিবেদনসংবলিত ডিভিডি ‘বিএনপি-জামায়াতের তাণ্ডব: রক্তাক্ত বাংলাদেশ’-এর মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে তিনি দিয়েছেন। তিনি সাহসের সঙ্গে আরও বলেছেন, ‘এরা মানবতার শত্রু, মনুষ্যত্বের শত্রু। যেখানে সুযোগ পাওয়া যাবে, সেখানেই তাদের রুখে দাঁড়াতে হবে।’
এই নিঃসংকোচ সত্য উচ্চারণ এবং সাহসী আহ্বানের জন্য তাঁকে অভিনন্দন। জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাংলাদেশের কোনো বিবেকবান ও দেশপ্রেমিক নাগরিকেরই নিরপেক্ষ থাকার কোনো অবকাশ নেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে জামায়াত-শিবির আজও স্বীকার করেনি। পাকিস্তানের ঘাতক সেনাবাহিনীকে সমর্থন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই দলের পূর্বসূরি পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা-কর্মী-ক্যাডাররা যে গণহত্যা-লুণ্ঠন-ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগ-ধর্মান্তরিতকরণের মতো যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছিল, তার জন্য এখনো তারা দায় স্বীকার বা জাতির কাছেÿ ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। তাই এই স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির এ দেশে থাকার অধিকার নেই বলে অর্থমন্ত্রী সম্প্রতি যে মত ব্যক্ত করেছেন, তার সঙ্গেও আমি সম্পূর্ণ একমত।
জামায়াত-শিবির একটি ফ্যাসিবাদী ‘কিলিং স্কোয়াড’। তারা ইসলাম ধর্মের অত্যন্ত বিকৃত ব্যাখ্যাকে পুঁজি করে এ দেশের রাজনীতিতে সন্ত্রাস ও হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা জবরদখলের অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনালে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় হওয়ার পর টিভি ক্যামেরার সামনে সাংবাদিকদের উদ্দেশে জামায়াতের জনৈক নেতা দম্ভভরে এই গৃহযুদ্ধ শুরুর ঘোষণা দিয়েছিলেন। ওই গৃহযুদ্ধের গত দেড় বছরে জামায়াত-শিবিরের পক্ষ থেকে কোনো যুদ্ধবিরতির ঘোষণা শোনা যায়নি, কিন্তু তার পরও ওই নেতাকে তো বেশ কয়েকবার প্রকাশ্যে বক্তৃতা-বিবৃতি দিতে দেখা গেছে। তাঁর বহাল তবিয়তে থাকার রহস্য কী? গৃহযুদ্ধের ঘোষণা দিয়েও তাঁর গ্রেপ্তার না হওয়া কিসের আলামত?
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের গোপন সমঝোতা হয়েছে বলে রাজনৈতিক মহলে গুজব রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিল মামলার রায় দিতে অযৌক্তিকভাবে প্রায় পাঁচ মাস বিলম্ব করায় এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মতিউর রহমান নিজামীর মামলার রায় ঘোষণাও দীর্ঘ সাত মাস ঝুলিয়ে রাখায়, এই গুজবকে আরও জোরদার করেছে। এহেন কালক্ষেপণের পর অবশেষে ১৬ সেপ্টেম্বর সাঈদীর মামলার রায় ঘোষিত হলো, কিন্তু ট্রাইব্যুনাল-প্রদত্ত সাঈদীর ফাঁসির রায়কে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আমৃত্যু কারাদণ্ডে হ্রাস করেছেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছেন, সবাইকে মেনে নিতে হবে। গুজব সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী মহোদয়কে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করায় তিনি তাঁর বহুল উচ্চারিত গাল ‘রাবিশ’ বলে তা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন। জামায়াতকে ‘ব্লাডি পার্টি’ গাল দিয়ে তিনি ইংরেজিতে জবাব দিয়েছেন, ‘আই কান্ট টলারেট দ্য সাইট অব দিস পার্টি’ (এই দলটাকে দেখলেই আমার কাছে অসহ্য লাগে)। এ ধরনের খোলামেলা মন্তব্য করতে সততা, আত্মবিশ্বাস ও সাহস লাগে। এগুলো প্রাণ থেকে উৎসারিত বিশ্বাসের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। অর্থমন্ত্রী মহোদয়কে এ জন্য অভিনন্দন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্কের সাম্প্রতিক সংবাদ সম্মেলনেও ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা স্বাধীনভাবে সাঈদীর শাস্তি কমিয়েছেন, এতে আমার কী করার আছে’ বলে যে মন্তব্য করেছেন, তাতেও আমরা বিশ্বাস স্থাপন করতে চাই।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আরও একটি সত্যকে নিঃসংকোচে সামনে নিয়ে এসেছেন: জামায়াত-শিবির একটি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী মৌলবাদী সংগঠনের বাংলাদেশি চ্যাপ্টার। মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড, ইন্দোনেশিয়ার জামাহ ইসলামিয়া, পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামি, আফগানিস্তানের তালেবান, সৌদি আরব ও আফগানিস্তান থেকে উত্থিত আল-কায়েদা, সাম্প্রতিক কালের ইরাক ও সিরিয়ায় ‘ইসলামিক স্টেট’ (আইএস) প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধরত এবং টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে বেশ কয়েকজন পশ্চিমা নাগরিকের শিরশ্ছেদ করার মতো নারকীয় নিষ্ঠুরতার জন্মদাতা আইসিস বা আইসিল, আফ্রিকার আল-শাবাব ও বোকো হারাম—এগুলোর যে আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক, সেটাই জামায়াত-শিবিরেরও অভিন্ন নেটওয়ার্ক, যদিও বিভিন্ন দেশে অপারেশন পরিচালনায় এসব সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর কমান্ডে ভিন্নতা রয়েছে।
বাংলাদেশে জেএমবি, হুজি, জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), আনসারুল্লাহ, হিজবুত তাহরীর, হিজবুত তাওহীদ—এ ধরনের হরেক কিসিমের নাম নিয়ে একেক সময় একেক জঙ্গিগোষ্ঠীর যে তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাকে ভিন্ন ভিন্ন সংগঠনের আলাদা আলাদা অপারেশন হিসেবে বিবেচনা করা হলে মারাত্মক ভুল হবে। এগুলো একই বৃত্তের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা ছাড়া তো নয়! কথায় বলে, ‘রসুনের কোয়া অনেক হলেও গোড়া একটাই’—কথাটা সব সময় মনে রাখতে হবে। প্রয়োজনমাফিক এসব ‘পকেট সংগঠনের’ জন্ম দিতেই থাকবে জামায়াত-শিবির। এই সংগঠনটি একটি ‘সিভিল আর্মির’ মতোই কঠোর শৃঙ্খলার সঙ্গে পরিচালিত হয়। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা যে স্তরেই কোনো ক্যাডার ইসলামী ছাত্রশিবিরের জালে আটকা পড়ুক না কেন, জীবনে তার আর এর খপ্পর থেকে মুক্তি মিলবে না, দলত্যাগীদের খুন করাটাই এদের রীতি। শিবিরের একটি বহুল প্রচারিত স্লোগান ও দেয়াললিখন হলো, ‘ইসলামী ছাত্রশিবির একটি আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।’ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় নয়, শিবির হলো ক্যাডারদের ‘আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান’। প্রতিপক্ষের হাত-পায়ের রগ কাটা বা হাতের কবজি কেটে নেওয়া, কাটা কবজি ছুরির আগায় গেঁথে বিজয় মিছিল করা, জবাই করে মানুষ খুন করা, পুলিশের কাছ থেকে রাইফেল কেড়ে নেওয়া, মিলিটারি স্টাইলে ফ্লাইং কিক মারা, বোমা বানানো, গ্রেনেড ছুড়ে শত শত মানুষকে খুন-জখম করা, দেশের ৬৫টি স্থানে একই সঙ্গে বোমা ফাটানো, রেলের ফিশপ্লেট অপসারণ করে ট্রেন লাইনচ্যুত করা, ট্রেনের বগি পোড়ানো, হাজার হাজার গাছ নির্বিচারে ধ্বংস করে বিভিন্ন অঞ্চলকে দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে ব্রাশফায়ার করে নরহত্যা কিংবা শিক্ষকের বাসে বোমাবাজি করে শিক্ষকদের জখম করা—কী সুন্দর ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে ওই আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে!
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-ছাত্রের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-স্নেহের সম্পর্ক শিবিরের ক্যাডারের কাছে কোনো গুরুত্ব বহন করছে না, তাদের সংগঠনের হাইকমান্ডের নির্দেশে তারা অবলীলাক্রমে শিক্ষকদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ চালাতে মোটেও কুণ্ঠিত হচ্ছে না। তাদের ওই হাইকমান্ডের মধ্যেও আবার একশ্রেণির জামায়াতি শিক্ষকদের অবস্থান লক্ষণীয়। কী ধরনের মস্তক ধোলাইয়ের শিকার হলে এই বিকৃতমনা ও চরম নিষ্ঠুর খুন-জখমের কাজগুলো অবলীলাক্রমে সংগঠনের কমান্ড মেনে দিনের পর দিন এই ক্যাডাররা চালিয়ে নিয়ে যায়, সেটা সবাইকে ভেবে দেখতে বলি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা থেকে দেখছি, গ্রাম এবং ছোট মফস্বল শহরের নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা ছাত্ররাই প্রধানত শিবিরের নেতা-কর্মী-ক্যাডার। সংগঠনের মাধ্যমেই তারা হলে বা ক্যাম্পাসের মেসগুলোতে সহজেই সিট পেয়ে যায়, তাদের পড়াশোনার ও ক্যাম্পাসে বসবাসের খরচ সংগঠনই চালায়। একই কায়দায় এই সংগঠনে ক্যাডারদের পদোন্নতি মেলে, বেতন-ভাতা বৃদ্ধি হয়, সুযোগ-সুবিধা বাড়ে। গ্রেপ্তার হলে পরিবারের দেখভাল করা হয়, বাজার পর্যন্ত করে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। মামলা চালানোর পুরো খরচ বহন করা হয়। কোনো ক্যাডার নিহত হলে পরিবারকে মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়, আহত হলেও চিকিৎসার খরচ এবং ভাতা দেওয়া হয়। মানে, এটা পুরোদস্তুর একটা সিভিল আর্মি। গত ৩৯ বছরে জামায়াতে ইসলামীর বিশাল এক অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ে তোলা হয়েছে এ দেশে। সৌদি আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে দেদার অর্থ পাচ্ছে তারা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই দলটিই নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বিত্তশালী।
ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য আওয়ামী লীগ যদি এহেন একটি বিপজ্জনক আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী দলকে শক্তি সঞ্চয়ের সুবর্ণ সুযোগ দিয়ে দেয়, তাহলে তাদের কপালেও দুঃখ আছে, দেশেও অচিরেই আবার ২০১৩ স্টাইলের খুন-জখম ও ধ্বংসের তাণ্ডব শুরু হয়ে যাবে। জামায়াত-শিবিরকে বিএনপি থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে বলে যেসব চাণক্য-প্রবর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে খোয়াব দেখাচ্ছেন, তাঁরা জামায়াতের চালাকির ফাঁদে আওয়ামী লীগকে আষ্টেপৃষ্ঠে আটক হওয়ার ব্যবস্থা করছেন। বিএনপি-জামায়াত—এই দুটো দলেরই আইএসআই কানেকশন সুদৃঢ়, এদের রাজনৈতিক দর্শনের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ পাকিস্তানপ্রেম এবং ভারতবিদ্বেষ।
পরিস্থিতির কারণে দলের মূল নেতাদের জীবন রক্ষার তাগিদে সুচতুর রণকৌশল হিসেবে জামায়াতের আওয়ামী লীগের সঙ্গে গোপন সমঝোতায় আসতে চাওয়াই স্বাভাবিক। জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা মাঠে-ময়দানে, সভা-মিছিলে না থাকলে বিএনপির আন্দোলন-সংগ্রামের তাবৎ লম্ফঝম্ফ মাঠে মারা যাচ্ছে—এটা বুঝতে পেরে আওয়ামী লীগ সাময়িক সমঝোতায় আগ্রহী হতেই পারে। বর্তমানে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে তুলনামূলক স্থিতি বিরাজমান, তাতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব কিছুটা স্বস্তি অনুভব করতে পারেন যে তাঁদের কৌশল সফল হয়েছে।
ঠিক এখানেই আমি বিপদের আশঙ্কা করছি। আমার বিবেচনায়, কয়েক মাস ধরে দেশে যে আন্দোলন-সংগ্রামের ভাটার টান পরিলক্ষিত হচ্ছে, সেটা এ দেশের স্বাভাবিক ‘বর্ষাকালীন রাজনৈতিক বিরতি’ ছাড়া তো নয়। এই কয়েক মাসে জামায়াত-শিবির তাদের হারানো শক্তি পুনরুদ্ধার করে নিয়েছে। ডিসেম্বর মাসে আবার পূর্ণোদ্যমে তারা বিএনপির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামবে, দেশের সংঘাতমূলক রাজনৈতিক পরিস্থিতিও আবার বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। আওয়ামী লীগ এবং জামায়াত-শিবিরের বর্তমান ‘ক্ষণে কঠোর ক্ষণে পেলব’ ইঁদুর-বিড়াল খেলাকে দেশের লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক শাহরিয়ার কবির ‘টম অ্যান্ড জেরি শো’ অভিহিত করে তাঁর হতাশা ব্যক্ত করেছেন। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করলে তারা খুনখারাবি শুরু করে দেবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী। বোঝাই যাচ্ছে, বর্তমানে আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীরা জামায়াত-শিবিরের ব্যাপারে গরম গরম কথা বললেও এদের নিষিদ্ধ করা হবে না। আমার আশঙ্কা, একটা ঐতিহাসিক ভুল করছে ক্ষমতাসীন জোট। দেশের সর্বোচ্চ আদালত কি এ ব্যাপারে ‘সুয়োমোটো’ রুল জারি করতে পারেন?
মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি।
এই নিঃসংকোচ সত্য উচ্চারণ এবং সাহসী আহ্বানের জন্য তাঁকে অভিনন্দন। জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাংলাদেশের কোনো বিবেকবান ও দেশপ্রেমিক নাগরিকেরই নিরপেক্ষ থাকার কোনো অবকাশ নেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে জামায়াত-শিবির আজও স্বীকার করেনি। পাকিস্তানের ঘাতক সেনাবাহিনীকে সমর্থন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই দলের পূর্বসূরি পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা-কর্মী-ক্যাডাররা যে গণহত্যা-লুণ্ঠন-ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগ-ধর্মান্তরিতকরণের মতো যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছিল, তার জন্য এখনো তারা দায় স্বীকার বা জাতির কাছেÿ ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। তাই এই স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির এ দেশে থাকার অধিকার নেই বলে অর্থমন্ত্রী সম্প্রতি যে মত ব্যক্ত করেছেন, তার সঙ্গেও আমি সম্পূর্ণ একমত।
জামায়াত-শিবির একটি ফ্যাসিবাদী ‘কিলিং স্কোয়াড’। তারা ইসলাম ধর্মের অত্যন্ত বিকৃত ব্যাখ্যাকে পুঁজি করে এ দেশের রাজনীতিতে সন্ত্রাস ও হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা জবরদখলের অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনালে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় হওয়ার পর টিভি ক্যামেরার সামনে সাংবাদিকদের উদ্দেশে জামায়াতের জনৈক নেতা দম্ভভরে এই গৃহযুদ্ধ শুরুর ঘোষণা দিয়েছিলেন। ওই গৃহযুদ্ধের গত দেড় বছরে জামায়াত-শিবিরের পক্ষ থেকে কোনো যুদ্ধবিরতির ঘোষণা শোনা যায়নি, কিন্তু তার পরও ওই নেতাকে তো বেশ কয়েকবার প্রকাশ্যে বক্তৃতা-বিবৃতি দিতে দেখা গেছে। তাঁর বহাল তবিয়তে থাকার রহস্য কী? গৃহযুদ্ধের ঘোষণা দিয়েও তাঁর গ্রেপ্তার না হওয়া কিসের আলামত?
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের গোপন সমঝোতা হয়েছে বলে রাজনৈতিক মহলে গুজব রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিল মামলার রায় দিতে অযৌক্তিকভাবে প্রায় পাঁচ মাস বিলম্ব করায় এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মতিউর রহমান নিজামীর মামলার রায় ঘোষণাও দীর্ঘ সাত মাস ঝুলিয়ে রাখায়, এই গুজবকে আরও জোরদার করেছে। এহেন কালক্ষেপণের পর অবশেষে ১৬ সেপ্টেম্বর সাঈদীর মামলার রায় ঘোষিত হলো, কিন্তু ট্রাইব্যুনাল-প্রদত্ত সাঈদীর ফাঁসির রায়কে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আমৃত্যু কারাদণ্ডে হ্রাস করেছেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছেন, সবাইকে মেনে নিতে হবে। গুজব সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী মহোদয়কে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করায় তিনি তাঁর বহুল উচ্চারিত গাল ‘রাবিশ’ বলে তা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন। জামায়াতকে ‘ব্লাডি পার্টি’ গাল দিয়ে তিনি ইংরেজিতে জবাব দিয়েছেন, ‘আই কান্ট টলারেট দ্য সাইট অব দিস পার্টি’ (এই দলটাকে দেখলেই আমার কাছে অসহ্য লাগে)। এ ধরনের খোলামেলা মন্তব্য করতে সততা, আত্মবিশ্বাস ও সাহস লাগে। এগুলো প্রাণ থেকে উৎসারিত বিশ্বাসের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। অর্থমন্ত্রী মহোদয়কে এ জন্য অভিনন্দন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্কের সাম্প্রতিক সংবাদ সম্মেলনেও ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা স্বাধীনভাবে সাঈদীর শাস্তি কমিয়েছেন, এতে আমার কী করার আছে’ বলে যে মন্তব্য করেছেন, তাতেও আমরা বিশ্বাস স্থাপন করতে চাই।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আরও একটি সত্যকে নিঃসংকোচে সামনে নিয়ে এসেছেন: জামায়াত-শিবির একটি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী মৌলবাদী সংগঠনের বাংলাদেশি চ্যাপ্টার। মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড, ইন্দোনেশিয়ার জামাহ ইসলামিয়া, পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামি, আফগানিস্তানের তালেবান, সৌদি আরব ও আফগানিস্তান থেকে উত্থিত আল-কায়েদা, সাম্প্রতিক কালের ইরাক ও সিরিয়ায় ‘ইসলামিক স্টেট’ (আইএস) প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধরত এবং টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে বেশ কয়েকজন পশ্চিমা নাগরিকের শিরশ্ছেদ করার মতো নারকীয় নিষ্ঠুরতার জন্মদাতা আইসিস বা আইসিল, আফ্রিকার আল-শাবাব ও বোকো হারাম—এগুলোর যে আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক, সেটাই জামায়াত-শিবিরেরও অভিন্ন নেটওয়ার্ক, যদিও বিভিন্ন দেশে অপারেশন পরিচালনায় এসব সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর কমান্ডে ভিন্নতা রয়েছে।
বাংলাদেশে জেএমবি, হুজি, জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), আনসারুল্লাহ, হিজবুত তাহরীর, হিজবুত তাওহীদ—এ ধরনের হরেক কিসিমের নাম নিয়ে একেক সময় একেক জঙ্গিগোষ্ঠীর যে তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাকে ভিন্ন ভিন্ন সংগঠনের আলাদা আলাদা অপারেশন হিসেবে বিবেচনা করা হলে মারাত্মক ভুল হবে। এগুলো একই বৃত্তের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা ছাড়া তো নয়! কথায় বলে, ‘রসুনের কোয়া অনেক হলেও গোড়া একটাই’—কথাটা সব সময় মনে রাখতে হবে। প্রয়োজনমাফিক এসব ‘পকেট সংগঠনের’ জন্ম দিতেই থাকবে জামায়াত-শিবির। এই সংগঠনটি একটি ‘সিভিল আর্মির’ মতোই কঠোর শৃঙ্খলার সঙ্গে পরিচালিত হয়। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা যে স্তরেই কোনো ক্যাডার ইসলামী ছাত্রশিবিরের জালে আটকা পড়ুক না কেন, জীবনে তার আর এর খপ্পর থেকে মুক্তি মিলবে না, দলত্যাগীদের খুন করাটাই এদের রীতি। শিবিরের একটি বহুল প্রচারিত স্লোগান ও দেয়াললিখন হলো, ‘ইসলামী ছাত্রশিবির একটি আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।’ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় নয়, শিবির হলো ক্যাডারদের ‘আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান’। প্রতিপক্ষের হাত-পায়ের রগ কাটা বা হাতের কবজি কেটে নেওয়া, কাটা কবজি ছুরির আগায় গেঁথে বিজয় মিছিল করা, জবাই করে মানুষ খুন করা, পুলিশের কাছ থেকে রাইফেল কেড়ে নেওয়া, মিলিটারি স্টাইলে ফ্লাইং কিক মারা, বোমা বানানো, গ্রেনেড ছুড়ে শত শত মানুষকে খুন-জখম করা, দেশের ৬৫টি স্থানে একই সঙ্গে বোমা ফাটানো, রেলের ফিশপ্লেট অপসারণ করে ট্রেন লাইনচ্যুত করা, ট্রেনের বগি পোড়ানো, হাজার হাজার গাছ নির্বিচারে ধ্বংস করে বিভিন্ন অঞ্চলকে দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে ব্রাশফায়ার করে নরহত্যা কিংবা শিক্ষকের বাসে বোমাবাজি করে শিক্ষকদের জখম করা—কী সুন্দর ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে ওই আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে!
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-ছাত্রের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-স্নেহের সম্পর্ক শিবিরের ক্যাডারের কাছে কোনো গুরুত্ব বহন করছে না, তাদের সংগঠনের হাইকমান্ডের নির্দেশে তারা অবলীলাক্রমে শিক্ষকদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ চালাতে মোটেও কুণ্ঠিত হচ্ছে না। তাদের ওই হাইকমান্ডের মধ্যেও আবার একশ্রেণির জামায়াতি শিক্ষকদের অবস্থান লক্ষণীয়। কী ধরনের মস্তক ধোলাইয়ের শিকার হলে এই বিকৃতমনা ও চরম নিষ্ঠুর খুন-জখমের কাজগুলো অবলীলাক্রমে সংগঠনের কমান্ড মেনে দিনের পর দিন এই ক্যাডাররা চালিয়ে নিয়ে যায়, সেটা সবাইকে ভেবে দেখতে বলি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা থেকে দেখছি, গ্রাম এবং ছোট মফস্বল শহরের নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা ছাত্ররাই প্রধানত শিবিরের নেতা-কর্মী-ক্যাডার। সংগঠনের মাধ্যমেই তারা হলে বা ক্যাম্পাসের মেসগুলোতে সহজেই সিট পেয়ে যায়, তাদের পড়াশোনার ও ক্যাম্পাসে বসবাসের খরচ সংগঠনই চালায়। একই কায়দায় এই সংগঠনে ক্যাডারদের পদোন্নতি মেলে, বেতন-ভাতা বৃদ্ধি হয়, সুযোগ-সুবিধা বাড়ে। গ্রেপ্তার হলে পরিবারের দেখভাল করা হয়, বাজার পর্যন্ত করে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। মামলা চালানোর পুরো খরচ বহন করা হয়। কোনো ক্যাডার নিহত হলে পরিবারকে মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়, আহত হলেও চিকিৎসার খরচ এবং ভাতা দেওয়া হয়। মানে, এটা পুরোদস্তুর একটা সিভিল আর্মি। গত ৩৯ বছরে জামায়াতে ইসলামীর বিশাল এক অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ে তোলা হয়েছে এ দেশে। সৌদি আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে দেদার অর্থ পাচ্ছে তারা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই দলটিই নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বিত্তশালী।
ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য আওয়ামী লীগ যদি এহেন একটি বিপজ্জনক আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী দলকে শক্তি সঞ্চয়ের সুবর্ণ সুযোগ দিয়ে দেয়, তাহলে তাদের কপালেও দুঃখ আছে, দেশেও অচিরেই আবার ২০১৩ স্টাইলের খুন-জখম ও ধ্বংসের তাণ্ডব শুরু হয়ে যাবে। জামায়াত-শিবিরকে বিএনপি থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে বলে যেসব চাণক্য-প্রবর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে খোয়াব দেখাচ্ছেন, তাঁরা জামায়াতের চালাকির ফাঁদে আওয়ামী লীগকে আষ্টেপৃষ্ঠে আটক হওয়ার ব্যবস্থা করছেন। বিএনপি-জামায়াত—এই দুটো দলেরই আইএসআই কানেকশন সুদৃঢ়, এদের রাজনৈতিক দর্শনের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ পাকিস্তানপ্রেম এবং ভারতবিদ্বেষ।
পরিস্থিতির কারণে দলের মূল নেতাদের জীবন রক্ষার তাগিদে সুচতুর রণকৌশল হিসেবে জামায়াতের আওয়ামী লীগের সঙ্গে গোপন সমঝোতায় আসতে চাওয়াই স্বাভাবিক। জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা মাঠে-ময়দানে, সভা-মিছিলে না থাকলে বিএনপির আন্দোলন-সংগ্রামের তাবৎ লম্ফঝম্ফ মাঠে মারা যাচ্ছে—এটা বুঝতে পেরে আওয়ামী লীগ সাময়িক সমঝোতায় আগ্রহী হতেই পারে। বর্তমানে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে তুলনামূলক স্থিতি বিরাজমান, তাতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব কিছুটা স্বস্তি অনুভব করতে পারেন যে তাঁদের কৌশল সফল হয়েছে।
ঠিক এখানেই আমি বিপদের আশঙ্কা করছি। আমার বিবেচনায়, কয়েক মাস ধরে দেশে যে আন্দোলন-সংগ্রামের ভাটার টান পরিলক্ষিত হচ্ছে, সেটা এ দেশের স্বাভাবিক ‘বর্ষাকালীন রাজনৈতিক বিরতি’ ছাড়া তো নয়। এই কয়েক মাসে জামায়াত-শিবির তাদের হারানো শক্তি পুনরুদ্ধার করে নিয়েছে। ডিসেম্বর মাসে আবার পূর্ণোদ্যমে তারা বিএনপির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামবে, দেশের সংঘাতমূলক রাজনৈতিক পরিস্থিতিও আবার বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। আওয়ামী লীগ এবং জামায়াত-শিবিরের বর্তমান ‘ক্ষণে কঠোর ক্ষণে পেলব’ ইঁদুর-বিড়াল খেলাকে দেশের লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক শাহরিয়ার কবির ‘টম অ্যান্ড জেরি শো’ অভিহিত করে তাঁর হতাশা ব্যক্ত করেছেন। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করলে তারা খুনখারাবি শুরু করে দেবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী। বোঝাই যাচ্ছে, বর্তমানে আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীরা জামায়াত-শিবিরের ব্যাপারে গরম গরম কথা বললেও এদের নিষিদ্ধ করা হবে না। আমার আশঙ্কা, একটা ঐতিহাসিক ভুল করছে ক্ষমতাসীন জোট। দেশের সর্বোচ্চ আদালত কি এ ব্যাপারে ‘সুয়োমোটো’ রুল জারি করতে পারেন?
মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি।
No comments