মিসর কোন পথে by মুহাম্মাদ রুহুল আমিন

গত ৩০ জুন মিসরের গণতান্ত্রিক যাত্রার প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্‌যাপিত হয়েছে তাহরির স্কয়ারে সরকার ও বিরোধী দলের বিক্ষোভের রোষাগ্নি ছড়িয়ে। পরের দিন ১ জুলাই দেশটির অভিজাত সামরিক বাহিনী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মিসরের ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বচ্ছ মানচিত্র নির্মাণে সরকারকে আলটিমেটাম দেয়।
অতঃপর ক্ষমতাচ্যুত করা হলো তাঁকে।
ঐতিহাসিকভাবে মিসরের সেনাবাহিনী দেশটির রাজনীতিতে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে আসছে। সামরিক ও বিচারিক এলিটদের সহযোগিতায় হোসনি মুবারক ও তাঁর পূর্বসূরিরা দীর্ঘ স্বৈরশাসন বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। আরব বসন্তের প্রাক্কালে ২০১১ সালে তাহরির স্কয়ারের বিপ্লবের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক যুগের নতুন অধ্যায় শুরু হলেও দেশটির ইতিহাসে প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডক্টর মোহাম্মদ মুরসিকেও সামরিক বাহিনী ও বিচার বিভাগের ইচ্ছায় নির্বাচিত পার্লামেন্টের অধিবেশন স্থগিত করতে হয় এবং একপর্যায়ে তা ভেঙে দিতে হয়। গণতান্ত্রিক উন্মেষের প্রথম বছর পার হতে না হতেই মুরসিবিরোধীদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মুখে আবারও মিসরে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করল।
প্রবল অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধকতার মুখেও প্রেসিডেন্ট মুরসি আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ভিত্তি রচনা করতে সক্ষম হয়েছেন। মিসরের জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ছিল সংবিধানের, তারও সমাধান করা হয়েছে। সংবিধানে মুরসি প্রণীত ধারা-উপধারা অবিনশ্বর নয়, চিরন্তন নয়। যেকোনো সময়ে তা সংশোধন, পরিমার্জন করা সম্ভব। অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রীরা সেই সংবিধান প্রণয়ন নিয়ে অভিযোগ তুললেন, মিসরকে ইসলামীকরণের। মিসরকে ইসলামীকরণ বা সেই সংবিধানের ধারা-উপধারা নিয়ে যুক্তি-তর্ক-বিতর্ক সৃষ্টিকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। এসব ইস্যুতে বিতর্ক থাকবে, আলোচনা-সমালোচনা থাকবে, সংশোধনী থাকবে- এটাই তো গণতন্ত্রের সংস্কৃতি। কিন্তু তথাকথিত গণতন্ত্রী-সেক্যুলার-উদারবাদীরা দাবি করলেন সংবিধান বাতিলের; কিন্তু তাঁরা বললেন না, ওই সংবিধানের কোনো কোনো ধারা মিসরের আপামর জনগণের সংস্কৃতিবিরোধী, স্বার্থবিরোধী।
কারা আছেন ৩০ জুনের তাহরির বিদ্রোহে? শহুরে পুরুষ, উদারবাদী (liberal), সেক্যুলার, সংখ্যালঘু খ্রিস্টান সম্প্রদায়। একটি অপ্রসিদ্ধ, অপরিচিত, ক্ষুদ্র গোষ্ঠী নিজেদের 'বিদ্রোহী' (তামারুদ) বলে পরিচয় দিয়ে দাবি করে যে ২২ মিলিয়ন মিসরীয় মুরসির পদত্যাগের দাবিতে স্বাক্ষরদান করেছে। তাঁরা তলিয়ে দেখলেন না, বছরের পর বছর ধরে, শতবর্ষ ধরে তিল তিল নির্যাতন, জুলুমে পিষ্ট হয়ে যে ব্রাদারহুড আরব বিশ্বসহ সব মুসলিম এবং অমুসলিম বিশ্বে কোটি সমর্থনের যে বৈশ্বিক ভিত্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে, সেই ব্রাদারহুডের আপনভূমি মিসরে তাদের ঘাঁটি কত শক্ত, কত জটিল হতে পারে! গত প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচনে মিসরের যে উচ্ছ্বসিত প্রান্তিক জনগণ পাগলের মতো ভোট দিয়েছে, সেই তৃণমূল জনউচ্ছ্বাস কি শহুরে কায়েমি স্বার্থবাদীদের ফুৎকারে এমনিতেই উবে যাবে?
ভগ্ন অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের দ্বারস্থ হতে হয় নতুন প্রেসিডেন্টকে। ১৯৭৯ সালের সামরিক চুক্তির পর যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সাহায্য অব্যাহত থাকলেও মিসরে তার বেসামরিক সাহায্য একাধিকবার হ্রাস করা হয়েছে। মিসরের বৈদেশিক ঋণ গত এক বছরে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১২ সালের জুন মাসে ৪২ বিলিয়ন ডলারে পরিণত হয়েছে। মুরসির শাসনের প্রথম ছয় মাসে অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলারে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে সর্বসাকল্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৯১ বিলিয়ন ডলারে। জাতীয় অর্থনীতির মতো ভয়ংকর জাতীয় নিরাপত্তাও মুরসির উত্তরাধিকার সম্পদ। মিসরের সর্বত্র লাইসেন্সপ্রাপ্ত আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রির দোকানের পাশাপাশি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের দোকান গড়ে উঠেছে। অনেকটা দৃশ্যমান গোপনীয়তা রক্ষা করেই বিভিন্ন রকমের অস্ত্রশস্ত্র যেমন পিস্তল, চাকু, ছুরি, ক্ষুদ্রাস্ত্র, সুইচব্লেড, শটগান দেদার ক্রয়-বিক্রয় চলছে। ২০-২২ বছরের কিশোরের ভাবনা হলো, 'প্রত্যেক মিসরীয়ের পিস্তল প্রয়োজন'। ফলে খুন, ডাকাতি, রাহাজানি, ছিনতাই দিন দিন বেড়ে চলেছে। এ অবস্থা পরিবর্তনে যে মনোজাগতিক প্রস্তুতি দরকার, যে সামাজিক মূল্যবোধের পরিকাঠামো দরকার তার জন্য কি মিসরীয়দের অপেক্ষা করতে হবে না? তাহরিরের দ্বিতীয় বিপ্লবের প্লট রচিত ও দ্রোহ উদগীরিত হয়েছে ক্ষয়িঞ্চু অর্থনীতি ও ভয়ংকর নিরাপত্তাঝুঁকির প্রচার চালিয়ে। শতবর্ষের বৈশ্বিক ঔপনিবেশিক আগ্রাসন, অভ্যন্তরীণ স্বৈরতান্ত্রিক নিষ্পেষণে জর্জরিত মিসরের অর্থনীতি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, সুদৃঢ় জাতীয় ঐক্য, শৃঙ্খলা ও পরিশীলিত সামাজিক মূল্যবোধ সময়ের দাবি। এ দাবি অগ্রাহ্য করে সরকার ও বিরোধী দলের যেকোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত ও কর্মসূচি মিসরকে আবারও স্বৈরশাসনের আজনবি অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত করবে।
সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে, জাতীয় খণ্ডতা দূর করে, গোষ্ঠী বিভাজন ত্যাগ করে মিসরকে সুদৃঢ় জাতীয় ঐক্যের পথেই হাঁটতে হবে। গণতান্ত্রিক মহাযাত্রার দ্বারপ্রান্তে তারা, প্রথমে আমরা নিশ্চিত যে মুরসি বা এনএসএফের এল বারাদি বা হামদিদ সাব্বাহিসহ কোনো রাজনৈতিক নেতাই চান না, মিসরে সামরিক শাসন জারি হোক। তাহরির স্কয়ারে জাগরিত দ্বিতীয় বিপ্লবীরা সদ্য ঘোষিত সামরিক আলটিমেটামকে স্বাগত জানালেও যেকোনো সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। ইতিপূর্বে প্রতিরক্ষামন্ত্রী আল শাশির সঙ্গে উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের মিটিংয়ের পর এনএনএফ সামরিক বাহিনীর সামরিক হস্তক্ষেপকে সমর্থনের কথা জানালেও দীর্ঘ সামরিক শাসনের বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছেন। অনতিবিলম্বে ক্ষমতাচ্যুত মুরসি ও এনএনএফসহ বিরোধী দলগুলোকে তাদের রাজনৈতিক দলাদলি বিস্মৃত হয়ে গণতন্ত্রের বিকাশে অকৃত্রিম ও একাগ্র হতে হবে। আমরা জানি, ক্ষমতার ভাগাভাগিতে ব্রাদারহুড, এনএনএফ এবং অন্য দলগুলো এত দ্রুত সময়ে কৌশল অবলম্বনে কোনোভাবেই সক্ষম হবে না। সে ক্ষেত্রে কি মিসরে দীর্ঘস্থায়ী সেনাশাসনই অনিবার্য হয়ে উঠবে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অপেক্ষা করতে হবে মাত্র কয়েক দিন। তবে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নিরসনে হলগুলোর চৌকস ও স্বচ্ছ ভূমিকাই কেবল মিসরকে আরেকটি স্বৈরশাসন অধ্যায়ের হাতছানি থেকে রক্ষা করতে পারে।
লেখক : শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
mramin68@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.