প্রফেসর ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক by ড. মোহাম্মদ ভূঁইয়া
২০১০
সালের ডিসেম্বরে যখন বর্তমান বাংলাদেশি সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রফেসর
ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করে, তখন দেশবাসী নীরব ও
স্তম্ভিত দর্শকের ভূমিকা পালন করে।
একই সময় বেশ কিছু দেশি পত্রপত্রিকা ও
টেলিভিশন চ্যানেলও সরকারের অপপ্রচারের সমর্থন করে। অথচ একই সময়ে বাংলাদেশের
বাইরে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায় সরকারের এই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে।
আড়াই বছর পর বাংলাদেশের মানুষ প্রকৃত অবস্থার উপলব্ধি করতে পেরে বর্তমানে
ব্যাপকভাবে প্রফেসর ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের সমর্থনে এগিয়ে আসছে। বর্তমানে
এটা সবার কাছেই সন্দেহাতীত যে গ্রামীণ ব্যাংক বা প্রফেসর ইউনূসকে আক্রমণ
করা দেশের সম্মানকে আক্রমণেরই সমতুল্য।
ওয়ান-ইলেভেনের সময় প্রফেসর ইউনূসকে সরকারের ভার গ্রহণ করার জন্য প্রচণ্ডভাবে চাপ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু একজন সৎ নাগরিক ও গণতন্ত্রের সমর্থনকারী হিসেবে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। গণতন্ত্রের স্বার্থে প্রফেসর ইউনূস একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিলেও পরবর্তী সময়ে তা না করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই থেকে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণভাবে দূরে থাকার কথা বহুবার জোর দিয়ে ব্যক্ত করেছেন।
প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে বাংলাদেশে ও যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ ও কাজ করার বিরল সম্মানের সুযোগ আমি পেয়েছি। অন্যান্য বাংলাদেশির মতো আমিও বহুবার প্রফেসর ইউনূসকে বাংলাদেশকে এই দুরবস্থা থেকে উদ্ধার করার উপায় দেশবাসীকে দেখানোর অনুরোধ জানিয়েছি। কিন্তু প্রতিবারই প্রফেসর ইউনূস অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে আমাদের জানিয়েছেন যে তিনি সব ধরনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার উর্ধ্বে থাকতে চান। সাংবাদিকদের একই প্রশ্নের উত্তরেও তিনি ওই একই জবাব দিয়ে আসছেন। প্রফেসর ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক ও গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর বর্তমান সরকার ও তার সমর্থকদের আক্রমণের জবাব অত্যন্ত মার্জিত ভাষায় দিয়ে এসেছেন এ পর্যন্ত। কিন্তু গত সপ্তাহে এই প্রথমবারের মতো তিনি সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছেন যে গ্রামীণ ব্যাংককে ধ্বংসের যেকোনো প্রচেষ্টা দেশবাসী প্রতিহত করবে। এই কঠোর প্রতিবাদ অন্যদেরও আশাবাদী করে তুলেছে। গ্রামীণ ব্যাংক বললেই আমরা সবাই প্রফেসর ইউনূসের কথা বলি। কিন্তু অনেকেই জানেন না যে গ্রামীণ ব্যাংক অর্থ হলো, ৮৫ লাখ ঋণগ্রহীতা, তাদের স্বামী ও নিকটতম আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব। এর অর্থ হচ্ছে, তিন থেকে চার কোটি ভোটার- তারা সবাই সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সচেতন এবং এরা সবাই ভোট দেন। এবার যদি হিসাব করে দেখেন তা হলেই বুঝবেন যে এই মোট গ্রামীণ ভোটের সংখ্যা সারা বাংলাদেশের ভোটের সংখ্যার প্রায় অর্ধেক। বর্তমান সরকার ও সরকারদলীয় নেতারা বুঝতে ভুল করেছেন যে গ্রামীণ ব্যাংক গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভাঙা বা ধ্বংস করার প্রচেষ্টার অর্থ হলো, সারা দেশের প্রায় অর্ধেকের মতো ভোট হারানো। সুতরাং সরকার যদি এই নিশ্চিত ভরাডুবির হাত থেকে রক্ষা পেতে চায়, তাহলে অবিলম্বে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে সরকারকে গ্রামীণ ও প্রফেসর ইউনূসকে কোনো ধরনের হয়রানি না করার প্রতিজ্ঞা করতে হবে। অন্যদিকে বিএনপির নেতারা এই গ্রামীণ ভোট ভাণ্ডারের অঙ্কের হিসাব বুঝতে পেরে তাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রামীণ ব্যাংক ভবনে গিয়ে প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে আমেরিকান কনগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল পাওয়ার জন্য অভিনন্দন জানিয়ে এসেছেন এবং সেই সঙ্গে তাঁরা গ্রামীণ ব্যাংককে ভাঙার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে গ্রামীণের বিশাল ভোটভাণ্ডারকে নিজেদের পক্ষে নেওয়াটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছেন।
শুধু গত ১০ বছরের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলেই দেখা যায় যে চরিত্রগত দিক থেকে বাংলাদেশের দুই প্রধান দল ও তার নেতাদের সঙ্গে ভিন্নতা পেতে দুরবিনের প্রয়োজন হবে। গ্রামীণ ব্যাংক ও প্রফেসর ইউনূসের বিরুদ্ধে সরকার ও সরকারদলীয় শত্রুতার কারণে বিএনপি এখন গ্রামীণ ব্যাংকের মিত্র। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংক ও প্রফেসর ইউনূসকে কেউ বিএনপি সমর্থক হিসেবে ভুল বুঝুক, সেটাও দেশবাসীর কাম্য নয়। অধ্যাপক ইউনূস দেশবাসীকে সরকারি অপচেষ্টার হাত থেকে গ্রামীণ ব্যাংককে রক্ষা করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা দলকে আমন্ত্রণ জানাননি। বিএনপি নেতারা নিজেরাই নিজেদের উদ্যোগে গ্রামীণ ব্যাংকভবনে গিয়ে প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুরোধ করেছেন।
একজন সচেতন বাংলাদেশি এবং প্রফেসর ইউনূসের সমর্থক ও ভক্ত হিসেবে আমি তাঁর কাছে জানতে চাই যে আমি যদি নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাকে অনুরোধ করি যে গ্রামীণ ব্যাংকের এই দুঃসময়ে তাঁরা গ্রামীণ ভবনে এসে তাঁদের সমর্থন ও একাত্মতা ঘোষণা করেন, তাহলে তাঁর কোনো আপত্তি আছে কি না। প্রফেসর ইউনূস আমাকে সুস্পষ্টভাবে জানালেন যে তিনি নিজেকে ও গ্রামীণ ব্যাংককে সম্পূর্ণভাবে রাজনীতির বাইরে রাখতে চান। তবে তিনি জানালেন, গ্রামীণ ভোটাররা ভোটের মাধ্যমে যেকোনো অপচেষ্টার জবাব দেবে। তিনি আরো জানালেন, তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে কোনো দল বা নেতাকে আমন্ত্রণ জানাবেন না। তবে কোনো দল বা নেতা যদি স্বেচ্ছায় সত্যিকার সমর্থন প্রদর্শন করতে আসতে চান, তিনি তাঁদের সাদরে অভ্যর্থনা জানাবেন।
এবার প্রশ্ন উঠতে পারে, আমার এই উদ্যোগ নেওয়ার কী কারণ থাকতে পারে? অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশের জাতীয় গর্ব এবং সব রাজনীতির উর্ধ্বে। কেউ তাঁকে ভুল বুঝে বিএনপির সমর্থক ভাবুক বা কেউ তাঁর বিরুদ্ধে এ নিয়ে অপপ্রচার করুক, তা আমাদের কারো কাম্য নয়। তাই আমি নিজ উদ্যোগে জাতীয় পার্টির নেতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ, এলডিপি নেতা কর্নেল অলি আহমেদ, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নেতা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম ও বিকল্প ধারা নেতা সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজ্জা চৌধুরীকে ব্যক্তিগতভাবে আমন্ত্রণ জানাই। আমি সব নেতাকে সুস্পষ্টভাবে জানাই, আমি একজন গ্রামীণ ও ইউনূসভক্ত হিসেবে আমার নিজ উদ্যোগে সবাইকে আমন্ত্রণ ও অনুরোধ জানাচ্ছি, যাতে সবাই গ্রামীণ ব্যাংকের এই দুর্দিনে গ্রামীণ ব্যাংকে গিয়ে দুটো জিনিস করার বিবেচনা করেন। প্রথমত, আমেরিকান কনগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল পাওয়ার জন্য প্রফেসর ইউনূসকে অভিনন্দন জানানো। দ্বিতীয়ত, গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে সরকার ও সরকারি যেসব ব্যক্তি ধ্বংসাত্মক আচরণ করছে, তার তীব্র নিন্দা করা ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করা।
আমি সারা দেশ ও বিশ্ববাসীকে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাতে চাই, পূর্বোলি্লখিত সব নেতাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমার প্রস্তাবে রাজি হয়েছেন এবং আশাতিরিক্তভাবে সব নেতাই তাঁদের মহান নেতৃত্বের বহিঃপ্রকাশ করেছেন। এ জন্য দেশবাসীর পক্ষ থেকে আমি সব অংশগ্রহণকারী নেতার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমি আশা করব, বাকি রাজনৈতিক, এমনকি ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, শ্রমিক ও অন্য নেতারাও গ্রামীণ ব্যাংকে গিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক ও প্রফেসর ইউনূসের প্রতি তাঁদের সমর্থনের কথা বলে আসবেন।
প্রফেসর ইউনূস বাংলাদেশের রাজনীতির বাইরে থাকতে চান সংগত কারণেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর এই সিদ্ধান্তকে সম্মান করি। তিনি অত্যন্ত সহজ সরল ও সৎ জীবনযাপন করেন এবং বাংলাদেশ ও সারা বিশ্বের গরিবের বন্ধু হিসেবে তিনি অক্লান্তভাবে কাজ করেন। কিন্তু না চাইলেও বর্তমান সরকারের অপচেষ্টার কারণে প্রফেসর ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক এখন বাংলাদেশের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য পরিবেশ দেশবাসীকে এক অসহনীয় পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে। দেশবাসীর প্রত্যেকেই এই অসহনীয় অবস্থা থেকে মুক্তি খুঁজছে। জাতীয় ঐক্য গঠন করে দেশকে সত্যিকারভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কোনো রাজনৈতিক নেতা দেশে আছেন বলে আমার জানা নেই। দেশের এই দুর্দিনে সারা দেশের সবাই খুঁজছে এমন একজন নেতা, যিনি দেশে এবং সারা বিশ্বে পরিচিত, সমাদৃত এবং দুর্নীতি উচ্ছেদ করে দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব করে সত্যিকারের সোনার বাংলা গড়তে সক্ষম হবেন।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রের টাসকেগি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসক ও প্রফেসর
ওয়ান-ইলেভেনের সময় প্রফেসর ইউনূসকে সরকারের ভার গ্রহণ করার জন্য প্রচণ্ডভাবে চাপ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু একজন সৎ নাগরিক ও গণতন্ত্রের সমর্থনকারী হিসেবে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। গণতন্ত্রের স্বার্থে প্রফেসর ইউনূস একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিলেও পরবর্তী সময়ে তা না করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই থেকে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণভাবে দূরে থাকার কথা বহুবার জোর দিয়ে ব্যক্ত করেছেন।
প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে বাংলাদেশে ও যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ ও কাজ করার বিরল সম্মানের সুযোগ আমি পেয়েছি। অন্যান্য বাংলাদেশির মতো আমিও বহুবার প্রফেসর ইউনূসকে বাংলাদেশকে এই দুরবস্থা থেকে উদ্ধার করার উপায় দেশবাসীকে দেখানোর অনুরোধ জানিয়েছি। কিন্তু প্রতিবারই প্রফেসর ইউনূস অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে আমাদের জানিয়েছেন যে তিনি সব ধরনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার উর্ধ্বে থাকতে চান। সাংবাদিকদের একই প্রশ্নের উত্তরেও তিনি ওই একই জবাব দিয়ে আসছেন। প্রফেসর ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক ও গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর বর্তমান সরকার ও তার সমর্থকদের আক্রমণের জবাব অত্যন্ত মার্জিত ভাষায় দিয়ে এসেছেন এ পর্যন্ত। কিন্তু গত সপ্তাহে এই প্রথমবারের মতো তিনি সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছেন যে গ্রামীণ ব্যাংককে ধ্বংসের যেকোনো প্রচেষ্টা দেশবাসী প্রতিহত করবে। এই কঠোর প্রতিবাদ অন্যদেরও আশাবাদী করে তুলেছে। গ্রামীণ ব্যাংক বললেই আমরা সবাই প্রফেসর ইউনূসের কথা বলি। কিন্তু অনেকেই জানেন না যে গ্রামীণ ব্যাংক অর্থ হলো, ৮৫ লাখ ঋণগ্রহীতা, তাদের স্বামী ও নিকটতম আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব। এর অর্থ হচ্ছে, তিন থেকে চার কোটি ভোটার- তারা সবাই সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সচেতন এবং এরা সবাই ভোট দেন। এবার যদি হিসাব করে দেখেন তা হলেই বুঝবেন যে এই মোট গ্রামীণ ভোটের সংখ্যা সারা বাংলাদেশের ভোটের সংখ্যার প্রায় অর্ধেক। বর্তমান সরকার ও সরকারদলীয় নেতারা বুঝতে ভুল করেছেন যে গ্রামীণ ব্যাংক গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভাঙা বা ধ্বংস করার প্রচেষ্টার অর্থ হলো, সারা দেশের প্রায় অর্ধেকের মতো ভোট হারানো। সুতরাং সরকার যদি এই নিশ্চিত ভরাডুবির হাত থেকে রক্ষা পেতে চায়, তাহলে অবিলম্বে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে সরকারকে গ্রামীণ ও প্রফেসর ইউনূসকে কোনো ধরনের হয়রানি না করার প্রতিজ্ঞা করতে হবে। অন্যদিকে বিএনপির নেতারা এই গ্রামীণ ভোট ভাণ্ডারের অঙ্কের হিসাব বুঝতে পেরে তাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রামীণ ব্যাংক ভবনে গিয়ে প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে আমেরিকান কনগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল পাওয়ার জন্য অভিনন্দন জানিয়ে এসেছেন এবং সেই সঙ্গে তাঁরা গ্রামীণ ব্যাংককে ভাঙার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে গ্রামীণের বিশাল ভোটভাণ্ডারকে নিজেদের পক্ষে নেওয়াটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছেন।
শুধু গত ১০ বছরের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলেই দেখা যায় যে চরিত্রগত দিক থেকে বাংলাদেশের দুই প্রধান দল ও তার নেতাদের সঙ্গে ভিন্নতা পেতে দুরবিনের প্রয়োজন হবে। গ্রামীণ ব্যাংক ও প্রফেসর ইউনূসের বিরুদ্ধে সরকার ও সরকারদলীয় শত্রুতার কারণে বিএনপি এখন গ্রামীণ ব্যাংকের মিত্র। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংক ও প্রফেসর ইউনূসকে কেউ বিএনপি সমর্থক হিসেবে ভুল বুঝুক, সেটাও দেশবাসীর কাম্য নয়। অধ্যাপক ইউনূস দেশবাসীকে সরকারি অপচেষ্টার হাত থেকে গ্রামীণ ব্যাংককে রক্ষা করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা দলকে আমন্ত্রণ জানাননি। বিএনপি নেতারা নিজেরাই নিজেদের উদ্যোগে গ্রামীণ ব্যাংকভবনে গিয়ে প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুরোধ করেছেন।
একজন সচেতন বাংলাদেশি এবং প্রফেসর ইউনূসের সমর্থক ও ভক্ত হিসেবে আমি তাঁর কাছে জানতে চাই যে আমি যদি নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাকে অনুরোধ করি যে গ্রামীণ ব্যাংকের এই দুঃসময়ে তাঁরা গ্রামীণ ভবনে এসে তাঁদের সমর্থন ও একাত্মতা ঘোষণা করেন, তাহলে তাঁর কোনো আপত্তি আছে কি না। প্রফেসর ইউনূস আমাকে সুস্পষ্টভাবে জানালেন যে তিনি নিজেকে ও গ্রামীণ ব্যাংককে সম্পূর্ণভাবে রাজনীতির বাইরে রাখতে চান। তবে তিনি জানালেন, গ্রামীণ ভোটাররা ভোটের মাধ্যমে যেকোনো অপচেষ্টার জবাব দেবে। তিনি আরো জানালেন, তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে কোনো দল বা নেতাকে আমন্ত্রণ জানাবেন না। তবে কোনো দল বা নেতা যদি স্বেচ্ছায় সত্যিকার সমর্থন প্রদর্শন করতে আসতে চান, তিনি তাঁদের সাদরে অভ্যর্থনা জানাবেন।
এবার প্রশ্ন উঠতে পারে, আমার এই উদ্যোগ নেওয়ার কী কারণ থাকতে পারে? অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশের জাতীয় গর্ব এবং সব রাজনীতির উর্ধ্বে। কেউ তাঁকে ভুল বুঝে বিএনপির সমর্থক ভাবুক বা কেউ তাঁর বিরুদ্ধে এ নিয়ে অপপ্রচার করুক, তা আমাদের কারো কাম্য নয়। তাই আমি নিজ উদ্যোগে জাতীয় পার্টির নেতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ, এলডিপি নেতা কর্নেল অলি আহমেদ, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নেতা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম ও বিকল্প ধারা নেতা সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজ্জা চৌধুরীকে ব্যক্তিগতভাবে আমন্ত্রণ জানাই। আমি সব নেতাকে সুস্পষ্টভাবে জানাই, আমি একজন গ্রামীণ ও ইউনূসভক্ত হিসেবে আমার নিজ উদ্যোগে সবাইকে আমন্ত্রণ ও অনুরোধ জানাচ্ছি, যাতে সবাই গ্রামীণ ব্যাংকের এই দুর্দিনে গ্রামীণ ব্যাংকে গিয়ে দুটো জিনিস করার বিবেচনা করেন। প্রথমত, আমেরিকান কনগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল পাওয়ার জন্য প্রফেসর ইউনূসকে অভিনন্দন জানানো। দ্বিতীয়ত, গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে সরকার ও সরকারি যেসব ব্যক্তি ধ্বংসাত্মক আচরণ করছে, তার তীব্র নিন্দা করা ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করা।
আমি সারা দেশ ও বিশ্ববাসীকে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাতে চাই, পূর্বোলি্লখিত সব নেতাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমার প্রস্তাবে রাজি হয়েছেন এবং আশাতিরিক্তভাবে সব নেতাই তাঁদের মহান নেতৃত্বের বহিঃপ্রকাশ করেছেন। এ জন্য দেশবাসীর পক্ষ থেকে আমি সব অংশগ্রহণকারী নেতার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমি আশা করব, বাকি রাজনৈতিক, এমনকি ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, শ্রমিক ও অন্য নেতারাও গ্রামীণ ব্যাংকে গিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক ও প্রফেসর ইউনূসের প্রতি তাঁদের সমর্থনের কথা বলে আসবেন।
প্রফেসর ইউনূস বাংলাদেশের রাজনীতির বাইরে থাকতে চান সংগত কারণেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর এই সিদ্ধান্তকে সম্মান করি। তিনি অত্যন্ত সহজ সরল ও সৎ জীবনযাপন করেন এবং বাংলাদেশ ও সারা বিশ্বের গরিবের বন্ধু হিসেবে তিনি অক্লান্তভাবে কাজ করেন। কিন্তু না চাইলেও বর্তমান সরকারের অপচেষ্টার কারণে প্রফেসর ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক এখন বাংলাদেশের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য পরিবেশ দেশবাসীকে এক অসহনীয় পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে। দেশবাসীর প্রত্যেকেই এই অসহনীয় অবস্থা থেকে মুক্তি খুঁজছে। জাতীয় ঐক্য গঠন করে দেশকে সত্যিকারভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কোনো রাজনৈতিক নেতা দেশে আছেন বলে আমার জানা নেই। দেশের এই দুর্দিনে সারা দেশের সবাই খুঁজছে এমন একজন নেতা, যিনি দেশে এবং সারা বিশ্বে পরিচিত, সমাদৃত এবং দুর্নীতি উচ্ছেদ করে দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব করে সত্যিকারের সোনার বাংলা গড়তে সক্ষম হবেন।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রের টাসকেগি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসক ও প্রফেসর
No comments