শীত কমছে না, তীব্র শৈত্যপ্রবাহ চলবে- ০ সর্বনিম্ন তাপমাত্রা সৈয়দপুরে আরও ১৮ জনের মৃত্যু ০ বোরো আবাদ ও সবজি চাষের ক্ষতি
সারাদেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১ ডিগ্রী বৃদ্ধি পাওয়া ছাড়া তীব্র শৈত্যপ্রবাহ ও শীত পরিস্থিতি উন্নতির সুখবর নেই। গত তিনদিন ধরে একই অবস্থা বিরাজ করছে। শুক্রবারও দেশের কোথাও কোথাও তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি এবং কোথাও কোথাও সামান্য হ্রাস পেয়েছে।
তবে সার্বিক পরিস্থিতির তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। শুক্রবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১ ডিগ্রী বৃদ্ধি পেয়ে ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াসে এসে দাঁড়িয়েছে সৈয়দপুরে। আগের দিন বৃহস্পতিবার সৈয়দপুরে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস। বুধবার দিনাজপুরে এ তাপমাত্রা ছিল ৩.২ ডিগ্রী। আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন, আজ শনিবার দিনের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে শীত পরিস্থিতির বড় ধরনের উন্নতির সম্ভাবনা নেই। দেশের ওপর দিয়ে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ আরও কয়েকদিন অব্যাহত থাকতে পারে। তীব্র শীতের কবলে পড়ে সারাদেশে নতুন করে আরও ১৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে নওগাঁয় ৭ জন, কুড়িগ্রামে ৫ জন, নীলফামারীতে ৩ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২ জন এবং নরসিংদীতে ১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।এদিকে কৃষিবিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন শীতের এমন অবস্থা চলতে থাকলে দেশে শীতকালীন শস্য উৎপাদনের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়তে পারে। ইতোমধ্যে বোরো ও আলু চাষের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে গেছে। এ ছাড়াও পেঁয়াজ, মরিচ ও শীতকালীন সবজি চাষের ওপর প্রভাব পড়তে পারে বলে জানিয়েছেন তাঁরা। তাঁদের মতে, এ বছর পৌষের শুরুতেই শীত জ জেঁকে বসার কারণে অনেক ফসলের ক্ষতি হয়ে গেছে। ডিসেম্বরের ২১ তারিখ থেকে একটানা ১০ দিন শৈত্যপ্রবাহ অব্যাহত ছিল। ফলে তখন দেশের তাপমাত্রা কোথাও কোথাও ৬ ডিগ্রীতে নেমে আসে। এর পর আবার গত ৭ জানুয়ারি থেকে দ্বিতীয়বারের মতো শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছে। তীব্র শৈত্যপ্রবাহের কারণে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রার গড়ে ৫ ডিগ্রীর নিচে নেমে গেছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এ ধরনের শীত অব্যাহত থাকলে দেশের কৃষি ও কৃষকের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শুরু হয়েছে বোরো আবাদ। পরিপূর্ণ বোরো ধানের জন্য তাপমাত্রার প্রয়োজন ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে। বীজতলার বীজ অঙ্কুরোদগমের জন্য প্রয়োজন ১২ ডিগ্রী এবং বীজতলার জন্য প্রয়োজন ১০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা। কিন্তু সারাদেশে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রীর অনেক নিচে নেমে গেছে এবং তা কয়েকদিন ধরে অব্যাহত রয়েছে। ফলে বীজতলা এবং যে সকল জমিতে ইতোমধ্যে বোরো ধান রোপণ করা হয়েছে শীতের কারণে তা চাষের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। তাঁদের মতে, শাকসবজি চাষের জন্য উপযোগী তাপমাত্রা ১২ থেকে ৩২ ডিগ্রী। এ ক্ষেত্রে তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রীর নিচে নেমে গেলে অথবা ৩২ ডিগ্রীর ওপরে চলে গেলে তা সবজি চাষের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। আর আলু চাষের ক্ষেত্রে তাপমাত্রা ১০ থেকে ১৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস থাকা প্রয়োজন। সরিষা গাছ তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে ৫ থেকে ৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর ৪৭ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো, চার লাখ হেক্টর জমিতে আলু এবং প্রায় পাঁচ লাখ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ হয়েছে। শৈত্যপ্রবাহের কারণে ইতোমধ্যে এই তিনটি ফসলেরই ৭ থেকে ৮ শতাংশ ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে তিনদিন পরও সারাদেশের তাপমাত্রার কোন উন্নতি হয়নি। শুক্রবার তা কোথাও কোথাও সামান্য হ্রাস পেয়েছে এবং কোথাও কোথাও সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু বড় ধরনের তাপমাত্রার উন্নতির কোন খবর পাওয়া যায়নি। শুক্রবার ঢাকা বিভাগের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। ঢাকার তাপমাত্রা বৃহস্পতিবার ৭.৬ ডিগ্রী রেকর্ড হলে শুক্রবার তা সামান্য বেড়ে দাঁড়ায় ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াসে। এ বিভাগের অন্যান্য এলাকার তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ময়মনসিংহে ৫.৪ ডিগ্রী, টাঙ্গাইলে ৬.২ ডিগ্রী সেলসিয়াস, ফরিদপুরে ৭.৬ এবং মাদারীপুরে ৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিভাগেরে তাপমাত্রায় সামান্য হ্রাসবৃদ্ধি ছাড়া বড় ধরনের কোন হেরফের হয়নি। এদিনে চট্টগ্রামের তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৯.২ ডিগ্রী, সন্দ্বীপে ৭.৯, সীতাকু-ে ৫.৫, রাঙ্গামাটিতে ৮, কুমিল্লায় ৬.৪, চাঁদপুরে ৮ ডিগ্রী, মাইজদীকোটে ৯, ফেনীতে ৬.৮, হাতিয়ায় ৮.৫, কক্সবাজারে ১০.৩, কুতুবদিয়ায় ১০.১ এবং টেকনাফে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১১.৪ ডিগ্রী। এদিন টেকনাফে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ২২.৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস। সিলেট বিভাগের তাপমাত্রার আরও অবনতি হয়েছে। শ্রীমঙ্গলে তাপমাত্রা ৪.১ ডিগ্রী রেকর্ড করা হয়েছে। এ ছাড়া সিলেটে আগের দিনের চেয়ে প্রায় ২ ডিগ্রী কমে দাঁড়িয়েছে ৬.৪ ডিগ্রীতে। রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের তাপমাত্রা গত কয়েকদিন ধরেই ৫ ডিগ্রীর আশপাশে সীমাবদ্ধ রয়েছে। শুক্রবার রাজশাহীর তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৫.৪ ডিগ্রী, ঈশ্বরদীতে ৫.৯ ডিগ্রী, বগুড়ায় ৬ ডিগ্রী, রংপুরে ৪.৫ ডিগ্রী, দিনাজপুরে ৪.৫ ডিগ্রী, সৈয়দপুরে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস।
খুলনা বিভাগের তাপমাত্রা সামান্য হ্রাসবৃদ্ধি ছাড়া অনেকটাই অপরিবর্তিত অবস্থায় রয়েছে। এদিন খুলনায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৮.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস, মংলায় ৭.৮ ডিগ্রী, যশোর ৫.৬ ডিগ্রী, চুয়াডাঙ্গায় ৪.৭ ডিগ্রী, বরিশাল বিভাগের বরিশালে ৭.৬ ডিগ্রী, পটুয়াখালীতে ৮.৫ ডিগ্রী, খেপুপাড়ায় ৮.৩ ডিগ্রী এবং ভোলায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস।
স্টাফ রিপোর্টার কুড়িগ্রাম থেকে জানান, ব্রহ্মপুত্রবিধৌত রৌমারী-রাজিবপুর উপজেলায় তীব্র শীতে গত ২৪ ঘন্টায় আরও ৫ জনের মৃত্যু সংবাদ পাওয়া গেছে। তীব্র ঠা-ায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে হাঁস, মুরগি ও গবাদিপশু। দিনমজুররা কাজে যেতে পারছে না। বোরো আবাদ, আলু ও সবজি চাষসহ কৃষি কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। সদর হাসপাতাল সূত্র জানায়, শীতজনিত রোগে চিকিৎসাধীন রয়েছে ৪২ শিশু।
নিজস্ব সংবাদদাতা নওগাঁ থেকে জানান, শীতের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় নওগাঁ অঞ্চলে ৭ জনের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে। কুয়াশার কারণে জেলার আলু ক্ষেত ও বোরো ধানের বীজতলা কোল্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়েছে। জেলার যে সব বোরো বীজতলা আগাম তৈরি করা হয়েছে, সেসব বীজতলার চারা হলুদ বর্ণ হয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। আর সদ্য তৈরি করা বীজতলায় ধান থেকে অঙ্কুরোদগম হচ্ছে না তীব্র ঠা-ার কারণে। ফলে মৌসুমের শুরুতেই জেলার বোরো চাষীরা হোঁচট খেল অর্থনৈতিকভাবে। জেলা কৃষি বিভাগ জানায়, চলতি বোরো মৌসুমে নওগাঁ জেলায় ২ লাখ ৯৬ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়। কৃষক ১৩ হাজার ৬শ’ ৭৩ হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরি করেছে। ইতোমধ্যেই ৫শ’ ৫০ হেক্টর জমিতে বোরো লাগানো হয়েছে। তবে কনকনে শীতের কারণে বোরো চাষ স্থবির হয়ে পড়েছে। নিজস্ব সংবাদদাতা নীলফামারী থেকে জানান, ডিমলা উপজেলার পল্লীতে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ও রাতে শীতের কাঁপুনিতে আরও ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে গত চারদিনে নীলফামারী জেলায় শীতজনিত কারণে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১৬ জনে। মৌলভীবাজার থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, প্রচ- শীত আর কুয়াশার প্রকোপে শ্রীমঙ্গলসহ গোটা জেলায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। কয়েক দিনের ব্যবধানে তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় মৌলভীবাজার জেলার সর্বত্র জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। শীতে সদর হাসপাতালে গত ১০ দিনে ৩ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া কমলগঞ্জে ৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। নিজস্ব সংবাদদাতা নরসিংদী থেকে জানান, প্রচ- শীতে জেলার রায়পুর উপজেলায় ইংরেজেরনেছা নামে ৬০ বছরের এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে।
নিজস্ব সংবাদদাতা ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে জানান, জেলার সদর হাসপাতাল ও প্রাইভেট ক্লিনিকে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ২ শতাধিক শিশু ভর্তি হয়েছে। প্রচ- শীতে আক্রান্ত হয়ে জেলায় ২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
No comments