বিনোদনের নতুন আকর্ষণ হাতিরঝিল- হাল্কা নীল বাহারি আলোতে রাতের দৃশ্য দেখলে মনে হবে পানিতে ভাসছে আরেকটি শহর
বিশাল উন্মুক্ত মঞ্চ, নৌঘাট, পর্যাপ্ত পার্কিং জোন, ওয়াটার ট্যাক্সি থেকে শুরু করে পর্যবেক্ষণের জন্য ডেকসহ ভ্রমণপিপাসুদের সুবিধার্থে সবকিছুই থাকছে হাতিরঝিল প্রকল্পে। ময়লা আবর্জনা ও দুর্গন্ধমুক্ত স্বচ্ছ পানিতে চলবে নৌকা।
নানা রঙের আলোতে ভিন্ন রং ধারণ করবে পানি। আনন্দের মাত্রা পরিপূর্ণ করতে লেকেই থাকবে রাজহাঁসের পাল। চারপাশজুড়ে ফলদ-বনজ, লতাজাতীয় গাছসহ রয়েছে নানা প্রজাতির ফুলের সমারোহ। ওয়াকওয়ে তো আছেই। তবে এ সবকিছু পরিপূর্ণভাবে পেতে আরও অপেক্ষা করতে হবে প্রায় এক বছর।কল্পনা করে দেখুন সিডনি কিংবা নিউইয়র্ক সিটির মতো কোন শহর। বাংলাদেশে থেকে এসব শহরের কাছাকাছি চিত্র উপভোগ করতে হলে আসতে হবে হাতিরঝিলে। এই প্রকল্পের সব কিছুই মনে হবে অনেকটা অন্যরকম। জীবনের সব চিন্তা-ভাবনাগুলো কিছুটা সময়ের জন্য হলেও দূরে সরে যাবে। দেবে প্রশান্তির ছোঁয়া। রাতের সৌন্দর্য আরও বেশি। ভ্রমণের ক্ষেত্রে যোগ করবে নতুন মাত্রা। হালকা নীলসহ বাহারি আলোতে হাতিরঝিলের রাতের দৃশ্য দেখলে মনে হবে পানির নিচে নতুন আরেকটি শহরের জন্ম হয়েছে। অথবা পুরো প্রকল্পটিই যেন পানির ওপরে নির্মাণ করা। অর্থাৎ দেখে মনে হবে পানিতেই ভাসছে সবকিছু। এসব দৃশ্য দেখতে হাজারো মানুষের সমাগম এখন হাতিরঝিলে।
বিড়ম্বনা! সত্যিই অবাক হওয়ার মতো। কারণ হাতিরঝিলের সঙ্গে পারিবারিক বিড়ম্বনার মিল কোথায়? প্রকল্পের মগবাজার প্রান্তের বাসিন্দা আমিরুল হক বলছিলেন এক মজার বিড়ম্বনার কথা। তিনি ভাড়া থাকেন রাস্তার পাশে একটি ছয়তলা বাড়ির চার তলায়। জানালা দিয়ে হাতিরঝিলের সবকিছুই দেখা সম্ভব। আর ছাদে যাওয়া মানেই মনে হবে পুরো প্রকল্পটিই হাতের মুঠোয়। তাঁর ভাষায় ২ জানুয়ারি প্রকল্প উদ্বোধন শেষে ১০ জানুয়ারি রাত পর্যন্ত বাসায় অতিথি এসেছেন অন্তত শতাধিক। তাদের কেউ থাকেন ঢাকায়-কেউবা ঢাকার বাইরে। ঢাকার বাইরে থেকে আসা অতিথির সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। উদ্দেশ্য একটাই তা হলো-হাতিরঝিলে ঘুরে বেড়ানো। অনেকেই হেঁটে ঘুরে বেড়িয়েছেন, কেউবা বাসার জানালা দিয়ে উপভোগ করেছেন রাতের সৌন্দর্য।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সৌন্দর্য রক্ষায় বিশ্বমানের ব্যবস্থাপনা এই প্রকল্পে নিশ্চিত করা হয়েছে। তা ঠিক রাখতে সেনাবাহিনীর হাতে ব্যবস্থাপনার সার্বিক দায়িত্ব দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। পাশাপাশি উন্নত দেশের সঙ্গে মিল রেখে ও মান নিশ্চিত করার স্বার্থে প্রকল্পের রাস্তা ব্যবহারে টোল আদায়েরও পরামর্শ দিয়েছেন অনেকেই।
হাতিরঝিল প্রকল্পের জিওটেকনিক্যাল পরামর্শক প্রফেসর ড. আবদুল জব্বার খান জনকণ্ঠকে বলেন, প্রকল্পের অসমাপ্ত কাজ শেষ করা ও রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। নতুন রাস্তার প্রটেকশনের ক্ষেত্রে দেশে প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হয়েছে জুট টেক্সটাইল প্রযুক্তি। যা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এছাড়া ওভারপাস ও ব্রিজের নিচে সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ শুরু হবে। অর্থাৎ পুরো প্রকল্পটি নয়নাভিরাম করতে সকল পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন করা হবে। আগামী ৩/৪ বছর পুরো প্রকল্পটি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রাখার পক্ষেও মত দেন তিনি।
পর্যটকের ঢল ॥ পর্যটক আকর্ষণের দিক থেকে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন কিংবা কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত থেকে হাতিরঝিল কম নয়। রাত দিন ঝিলের চারপাশে এখন মানুষের ঢল। যারা ঢাকায় বেড়াতে আসছেন, তাদের ক্ষেত্রে হাতিরঝিলে না আসলে সবকিছুই যেন অপূর্ণ থেকে যাবে। ‘সেন্টমার্টিন কিংবা পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত নানা প্রেক্ষাপটে পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। হাতিরঝিলও দিন দিন পর্যটকদের কাছে টানবে এতে কোন সন্দেহ নেই। এর বড় কারণ হলো ভ্রমনপিপাসুদের কাছে টানার মতো অনেক কিছুই আছে এখানে। তাই এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। সুদূর চট্টগ্রামের বাসিন্দা আনোয়ার ইসলাম এসব কথা বললেন হাতিরঝিলের লেকের পাড়ে দাঁড়িয়ে। তাঁর ভাষায়, লেকের পাড়ে পাকা ঘাটের কাজ শেষ হওয়ার পর এটিই হবে দেখার মতো কিছু। দিনের থেকে রাতের দৃশ্য মানুষকে কাছে টানবে সবচেয়ে বেশি। তিন সন্তান আর ভাই বোনদের নিয়ে ঢাকায় বেড়াতে এসেছেন নেত্রকোনা মোক্তারপাড়ার বাসিন্দা বিমল রায়। হাতিরঝিল দেখে তাঁর কথা একটিই- আমি মুগ্ধ। প্রায় ৪০ বছরের বেশি সময় নিয়মিত এই শহরে আসেন তিনি। বললেন, আগে এত আনন্দ ঢাকার মধ্যে আর কোথাও গিয়ে পাইনি। আমার কাছে মনে হয়েছে, সিডনির রাতের শহর।
কেউ গাড়ি। আবার কেউ হেঁটে ঘুরে দেখছেন লেকের চারপাশ। ওয়াকওয়ে ঘেঁষে বেঞ্চগুলোতে চলছে তরুণ-তরুণীদের জমপেশ আড্ডা। বয়স হয়েছে তাতে কি। ঘুরে বেড়ানোর ক্ষেত্রে বয়স কোন বিষয় নয়। এ শুধু মনের ইচ্ছা মাত্র। এরও প্রমাণ পাওয়া গেল হাতিরঝিলে। হাতে হাত ধরে স্বামী-স্ত্রী ঘুরে বেড়াচ্ছেন, দু’জনের মধ্যে চলছে না বলা হাজারো কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে বেসরকারী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাওয়া গেল লেকের বিভিন্ন প্রান্তে। তাদের জন্য ২০১৩ সালের এই উপহার যেন ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। সুন্দর পরিবেশে নিরিবিলি কথা বলা আর ঘুরে বেড়ানো দুটোই চলছে বন্ধুদের নিয়ে। পুরো এলাকা ঘুরে ঢাকাসহ ঢাকার বাইরের প্রায় সমান-সমান ভ্রমণপিপাসু মানুষদের খোঁজ পাওয়া গেল।
শিশুদের নিয়ে ঢাকার মানুষও প্রতিদিন ভিড় করছেন সেখানে। তবে রাতের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত অনেকে। প্রতিটি ব্রিজের কার্নিস ঘেঁষে লম্বা লাইন লাগানো হয়েছে। ওভারপাসের প্রতিটি পিলারের পুরো অংশেই রঙিন আলোর ঝলকানি। লাইটপোস্টসহ সার্বিকভাবে আলোর ব্যবস্থা সন্দোষজনক। তবু যেন ভয় অনেকের। বুধবার রাতে হাতিরঝিলে ঘুরতে দেখা গেল- মিরপুর ১০ নম্বরের বাসিন্দা আলি আহমদসহ তাঁর পরিবারের সদস্যদের। তিনি বললেন, রাতে বখাটে ছেলেদের উৎপাত মনে হচ্ছে। কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের খুব একটা চোখে পড়েনি। রামপুরার বাসিন্দা মসিউল করিম। তিনি প্রতিদিন হাতিরঝিলে হাঁটতে আসেন।
বালু নদীতে যাবে হাতিরঝিলের বর্জ্য ॥ হাতিরঝিলের পানি সারাবছরেই থাকবে স্বচ্ছ। প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে এখন ঝিলের পানিতে ময়লা, আবর্জনা জমে থাকার কোন সুযোগ নেই। কারণ লেকের বর্জ্য পৃথক লাইন দিয়ে বালু নদীতে ফেলে দেয়া হবে। ইতোমধ্যে বর্জ্য অপসারণের জন্য লাইন টানার কাজ শেষ হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, হাতিরঝিল প্রকল্পের বর্জ্য ফেলার কারণে বালু নদীর পানি যেন কোনভাবেই দূষিত না হয় সেজন্য পৃথক একটি লিংক প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের কাজ হলো বালু নদীর পানি পরিশোধন করা। সারাবছর হাতিরঝিলে সংরক্ষণ থাকবে বৃষ্টির পানি। শুষ্ক মৌসুমে পানি শুকিয়ে গেলে বিকল্প উপায়ে পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। অল্প দিনের মধ্যেই বদলে যাচ্ছে হাতিরঝিলের পানির রং। পানিতে থাকবে না দুর্গন্ধ। প্রাণ খুলে পানিতে নৌকা ভ্রমণ করতে পারবেন ভ্রমণপিপাসুরা। তবে পানিতে গোসল করা, কিংবা লেকের আশপাশের বাসা বাড়ি থেকে ময়লা আবর্জনা কিংবা দূষিত বর্জ্য যেন কোনভাবেই ফেলা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
পানিতে স্টেজ, গ্যালারি থাকবে ওপরে ॥ হাতিরঝিল প্রকল্পে নির্মাণ করা হবে এমপি থিয়েটার। দুই হাজারের বেশি দর্শক একসঙ্গে অনুষ্ঠান উপভোগ করার সুযোগ পাবেন এখানে। আকর্ষণীয় এই থিয়েটার নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলছে। থিয়েটারের মূল স্টেজ থাকবে পানির মধ্যে। দর্শকদের জন্য গ্যালারির বেশিরভাগ অংশ থাকবে প্রকল্পের পাড়ে। কিছু অংশ থাকবে পানির অংশে। প্রায় প্রতিদিন থিয়েটারে থাকবে নানা আয়োজন। দেখানো হবে দেশ-বিদেশের আলোচিত ছবি। সঙ্গীতানুষ্ঠান, নাটক, যাত্রাগানসহ থাকবে বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক আয়োজন।
রয়েছে প্রয়োজনীয় পার্কিং জোন ॥ উদ্বোধন শেষে হাতিরঝিলে এখন দিন-রাতে হাজারো মানুষের সমাগম। রাজধানীসহ ঢাকার বাইরে থেকে যারা বেড়াতে আসছেন তারাও এক নজর উপভোগ করে যাচ্ছেন হাতিরঝিলের সৌন্দর্য। কিন্তু বেড়াতে এসে অনেকে গাড়ি পার্কিং নিয়ে পড়ছেন বিড়ম্বনায়। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রকল্পজুড়েই থাকছে পর্যাপ্ত পার্কিং পকেট। কিন্তু কাজ অসম্পূর্ণ থাকায় তা এখনও দৃশ্যমান হয়নি। প্রকল্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। রামপুরা, গুলশান, কিংবা প্রকল্পের বিভিন্ন সেতুপ্রান্তে গাড়ি পার্কিং করা যাবে।
টোল আদায়ের ব্যবস্থা ও সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রাখার পরামর্শ ॥ সৌন্দর্য রক্ষায় বিশ্বমানের ব্যবস্থাপনা থাকছে হাতিরঝিল প্রকল্পে। তাছাড়া এ প্রকল্পে নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়েছেÑ যা বাংলাদেশে প্রথম। বিভিন্ন দেশ ঘুরে নতুন নতুন অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো হয়েছে। সাধারণ ব্যবস্থাপনায় প্রকল্পের সৌন্দর্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। দেশের অন্যান্য স্থাপনার চেয়ে এই স্থাপনার গুরুত্ব অনেক। তাছাড়া পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ধরে রাখতে হলে মানের ক্ষেত্রে কোনভাবেই আপোস করা যাবে না। এক্ষেত্রে প্রকল্পের পরামর্শকরা বলছেন, উন্নত দেশগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ এ ধরনের স্থাপনা ব্যবহারে রয়েছে টোল আদায়ের ব্যবস্থা। এজন্য সরকারের রাজস্ব বাড়ার পাশাপাশি ব্যবহারকারীরাও যতœবান হয়ে থাকেন। আগামী ৩/৪ বছর পুরো প্রকল্পটি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত বলেই মনে করেন তারা। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে প্রকল্প ব্যবহারে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে ওঠার পর কোন নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব নিতে পারে।
বাস্তবায়নের অপেক্ষায় ॥ প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে আড়াই হাজার আসনবিশিষ্ট দেশের বৃহত্তম উন্মুক্ত মঞ্চ নির্মাণ করা হবে। লেকের ওপর বিভিন্ন পয়েন্টে থাকছে ভিউইং ডেক। যা থেকে লেকের পুরো সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন দর্শনার্থীরা। মূল রাস্তা থেকেই ডেকে ওঠার সুযোগ রাখা হবে। লেকে ঘুরে বেড়াতে তৈরি করা হচ্ছে ওয়াটার ট্যাক্সি টার্মিনাল ও ফুটব্রিজ। নির্মাণ করা হচ্ছে ব্যবস্থাপনা ভবন। পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে সংযোগ সড়ক তৈরির কাজ এগিয়ে চলেছে। রামপুরাসহ লেকের দুই প্রান্তে দুটি ইউ লুপ থাকছে। এছাড়া ছোট ব্রিজসহ ওয়াকওয়ে নির্মাণের কাজ শেষ। চেকপোস্ট, পাবলিক টয়লেট, যাত্রী ছাউনি, পানির পাম্প চালুর কাজ এগিয়ে চলেছে।
রাজধানীর পূর্ব থেকে পশ্চিমের যোগাযোগ সহজ করতে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার হাতিরঝিল সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এই প্রকল্পের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসন। ২০০৭ সালের আট অক্টোবর একনেকে এক হাজার ৪৭৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকা অনুমোদন করা হয়। ভূমি অধিগ্রহণ ব্যয়সহ সবমিলে এক হাজার ১৭১ কোটি ৩০ লাখ টাকা প্রকল্পের সর্বমোট খরচ নির্ধারণ করা হয়। সর্বশেষ নতুন বছরের শুরুতে অর্থাৎ ২ জানুয়ারি প্রকল্পটি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
হাতিরঝিল প্রকল্পের দু’পাশ দিয়ে যানবাহন চলাচলের জন্য তৈরি করা হয়েছে ১৬ কিলোমিটার সড়ক। রয়েছে চারটি সেতু। চারটি ক্ষুদ্র সেতুসহ নির্মাণ করা হয়েছে চারটি ওভারপাস। বিনোদনের জন্য লেকের পানিতে থাকছে-নৌকা ভ্রমণের সুবিধাসহ পিকনিকের ব্যবস্থা। প্রকল্পের চারপাশ ঘুরে দেখা গেছে-বিভিন্ন পয়েন্টে গাড়ি চলাচলের দিকনির্দেশনা টানানো হয়েছে। লেকের চারপাশ ঘিরে নারকেল, ফলদ, বনজসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের গাছ লাগানো হচ্ছে। ওভারপাসের দু’পাশে লাগানো হয়েছে লতাজাতীয় গাছ।
মোট প্রকল্পের প্রায় ১০ ভাগ এখনও বাকি রয়েছে। তা শেষ হতে আগামী সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। লেকের সার্বিক ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কাঠামো তৈরি করতে বুয়েটের শিক্ষকদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে বুয়েট থেকে ব্যবস্থাপনা কাঠামো জমা দেয়া হবে রাজধানী উন্নয়ন কর্তপক্ষ রাজউকের হাতে। তারপর রাজউকের পক্ষ থেকে পূর্ণাঙ্গ কাঠামো অনুমোদন করতে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
রাজউক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা, কারিগরি ব্যবস্থাপনা এবং প্রকল্প এলাকার সামগ্রিক ব্যবহার ব্যবস্থাপনা মূল কাঠামোতে স্থান পাবে। প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থাকবে সেনাবাহিনীর হাতে। তবে অত্যাধুনিক এই স্থাপনা সংরক্ষণের জন্য শেষ পর্যন্ত কাদের ওপর দায়িত্ব হস্তান্তর করা হবে তা এখনও অনিশ্চিত রয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন-কাঁচা মাটিতে নির্মাণ করা হয়েছে ১৬ কিলোমিটার রাস্তা। এর বেশিরভাগ মাটি বিভিন্ন স্থান থেকে আনা। তাই রাস্তা কিংবা সেতু ও ফুটওভারব্রিজগুলোর ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক কোন সমস্যা দেখা দিলে দক্ষ লোকজন ছাড়া তা সমাধান সম্ভব হচ্ছে না। যদিও প্রকল্পের সঙ্গে যুক্তদের বক্তব্য-হাতিরঝিলের রাস্তা নির্মাণে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়েছে। যা পুরোপুরি পরিবেশসম্মত। চীন-ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এমন কাজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো হয়েছে এই প্রকল্পে।
প্রকল্প শুরুর পরিকল্পনা ॥ মেগা সিটির মেগা প্রকল্প হাতিরঝিল। প্রকল্পের আওতায় প্রথমে ২৯৯.২৪ একর জমি অধিগ্রহণের কথা ছিল। যোগাযোগ অবকাঠামোর জন্য ৮ কিলোমিটার এক্সপ্রেস রোড, ৮ দশমিক আট কিলোমিটার সার্ভিস রোড মূল পরিকল্পনা রাখা হয়। ৮ দশমিক আট কিলোমিটার ফুটপাথ, ২৬০ মিটার ভায়াড্যাক্ট, ৯ দশমিক আট কিলোমিটার ওয়াকওয়ে, ৪০০ মিটার ওভারপাস, ৪৭৭ মিটার ব্রিজ নির্মাণ হওয়ার কথা ছিল। এছাড়াও ঢাকা ওয়াসা অংশের কাজ হিসেবে ১০ দশমিক ৪০ কিলোমিটার মেইন ডাইভারসন স্যুয়ার, ১৩ কিলোমিটার লোকাল ডাইভারসন স্যুয়ার, ১৩টি স্পেশাল ডাইভারসন স্ট্রাকচার নির্মাণকাজ যোগ হয়। এছাড়াও ল্যান্ডস্ক্যাপিং, গার্ডেনিং, পার্ক ফার্নিচার, প্লান্টেশন, লাইটিং, রোডমেকিং, বাসস্টপ, ওয়াটার ট্যাক্সি টার্মিনাল, ফুটব্রিজ ওভার লেক, পাবলিক টয়লেট, পুলিশ বক্স ছাড়াও আরও নতুন নতুন পরিকল্পনা প্রকল্পে যোগ হয়।
রক্ষণাবেক্ষণের অর্থ আসবে প্রকল্পের আয় থেকে ॥ হাতিরঝিল প্রকল্পে রক্ষণাবেক্ষণের কোন অর্থ রাখা হয়নি। উদ্বোধন শেষে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রকল্পের নানা বিষয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে রক্ষণাবেক্ষণের অর্থ যোগানোর বিষয়টি উত্থাপন করা হলে এ ব্যাপারে মন্ত্রী বলেন, এ জন্য সরকারীভাবে থোক বরাদ্দের কোন প্রয়োজন নেই। প্রকল্পের আয় থেকেই রক্ষণাবেক্ষণের অর্থ সংগ্রহের চিন্তা করা হচ্ছে। আয়ের প্রস্তাবিত উৎসের মধ্যে রয়েছে এমপি থিয়েটার থেকে আয়, কার পার্কিং, টোল আদায়সহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধা। তবে আয়ের উৎসের কোনটিই এখনও চূড়ান্ত হয়নি। চূড়ান্ত হওয়ার পর রাজউক কিংবা সিটি কর্পোরেশনকে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেয়া হতে পারে।
No comments