কালো দিবসের হোতাদেরই কালো দিবস পালন by শাহজাহান মিয়া
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সৃষ্টির আসল নায়করাই এখন উল্টো দোষারোপ করছেন তাদের প্রতিপকে। আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে সংঘটিত এই অভিশপ্ত দিনটির সব দায়-দায়িত্ব মহাজোট সরকারের নেতা-নেত্রীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে দিনটিকে 'কালো দিবস' আখ্যায়িত করে তারা অত্যন্ত উদ্যেগী হয়ে এই দিনটি ঘটা করে পালনও করে ফেলে তারা।
এই হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতিকদের মনোভাব ও আচরণ। বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত ঘরানার রাজনীতিকদের মনোবৃত্তি ও মনোভাব। ঘটনার আদ্যোপান্ত যেখানে এদেশের সাধারণ মানুষের কাছে দিবালোকের মতো স্পষ্ট সেখানে জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব কিভাবে লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে এরকম জঘন্য মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারে তা ভেবে দেশের মানুষ বিস্ময়ে হতবাক। ঘটনার মহানায়কদের মাছ দিয়ে শাক ঢাকার এই নগ্ন প্রয়াস মোটেই হালে পানি পায়নি। এই মনোভাব বরং জনগণকে বিভ্রান্ত না করে তাদের মধ্যে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে। ১/১১ নিয়ে বিএনপি নেতৃত্বের এই অবিমৃষ্যকারিতা ও অসত্যের বেসাতি জনগণকে নতুন করে আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে আমাদের দেশে কিছু রাজনৈতিক নেতা প্রায়ই তাদের বক্তব্যে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে থাকেন। অহেতুক মিথ্যাচারের বিষয়টি যে মানুষের কাছে খুবই পীড়াদায়ক হয়ে দাঁড়ায় সে সত্যটি তারা মোটেই আমলে নিতে চান না। অনেক সময় রাজনীতিকদের কথাবার্তায় মনে হয় যে জনগণ কিছুই বোঝে না। অথচ জনগণকে বোকা ভেবে ধোঁকা দেয়ার কৌশলটিও জনগণ খুব ভালভাবেই বোঝেন।বিএনপি ওয়ান ইলেভেনের হোতা ও তাদের সহযোগীদের বিচার চেয়েছে। জনতার আদালতে তাদের বিচার হবে বলে দম্ভোক্তি করেছে। বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন বলেছেন এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত রাজনীতিক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, বুদ্ধিজীবী এমনকি সাংবাদিকদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে। খোন্দকার সাহেব এখানেই থামেননি। তিনি আরও বলেছেন, মহাজোট সরকারের কোন শরিক দল ১১ জানুয়ারিকে কালো দিবস হিসেবে পালন না করায় তারাও এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত বলে প্রমাণ হয়ে গেছে। ১১ জানুয়ারি জরুরী অবস্থা জারিকে একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র হিসেবে অভিহিত করে এই চক্রান্তের সঙ্গে জড়িত ও মদদদাতাদের বিচার দাবি করেছে বিএনপি নেতৃবৃন্দ। তারা বলেছেন, বর্তমান মহাজোট সরকারও এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত এবং সে কারণেই বর্তমান সরকার ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচার না করে তাদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। তারা বলেন, এই সরকার এক-এগারোর সঙ্গে জড়িতদের বিচার না করলেও জনতার আদালতে তাদের বিচার হবেই। ১১ জানুয়ারির ঘৃণ্য ঘটনার আসল নায়ক-মহানায়করা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত এখন তাদের কল্পিত হোতা ও মদদদাতাদের জনতার আদালতে বিচারের কথা বলছেন। কিন্তু সব শক্তির উৎস দেশের জনগণ গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে তাদের আদালতে ইতোমধ্যে এই ন্যক্কারজনক ঘটনার চূড়ান্ত বিচার করে তাদের রায় দিয়ে দিয়েছেন। সেই ঐতিহাসিক গণরায়ে ১/১১ মূল হোতা বিএনপি-জামায়াত চক্রকে দেশবাসী অত্যন্ত সঠিকভাবে চিহ্নিত করে তাদের ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে তাদের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক রায় দিয়ে তাদের নির্দয়ভাবে ধরাশায়ী করেছেন। অপরদিকে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ও এর নেতৃবৃন্দ তাদের কাছে জনগণের প্রকৃত আশা-আকাঙ্া রূপায়ণের প্রতিভূ বলে প্রতীয়মান হওয়ায় দেশের মানুষ এই জোটকেই বিপুলভাবে ভোট দিয়ে বিজয়ী করে। সুতরাং এদেশের জনগণ তাদের বিচারের রায়তো ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর দিয়ে দিয়েছেন। তাই এ বিষয়ে বেশি কথা বলা বাতুলতা ছাড়া আর কিছু নয়। বিএনপি নেতৃবৃন্দের দাবি তাদের দলকে নেতৃত্ব শূন্য করার জন্যই তাদের প্রিয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার জোর করে বিদেশে পাঠানোর ফন্দি-ফিকিরও ব্যর্থ হয়। কিন্তু দেশবাসী বেশ ভাল করেই জানে যে দুর্নীতির শিরোমণি বলে খ্যাত তার বড় পুত্র তারেক রহমানকে দেশে ফেলে রেখে বেগম জিয়া নিজে বিদেশে যাওয়া কোনমতেই নিরাপদ মনে করেননি। তাই তিনি বিদেশ যাওয়ার প্রশ্নে নানা বাহানা তুলে তখন বড় বড় কথা বলেছিলেন। তবে এটাও জনগণের কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে তাঁর পুত্রধন তারেককে তার সঙ্গে যেতে দিলে তিনি বিদেশে যাওয়ার জন্য এক পায়ে খাড়া ছিলেন। বিএনপি নেতৃবৃন্দের দাবি মোতাবেক বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যদি শুধু বেগম জিয়া ও তার দলের ওপরই আঘাত হেনে থাকে তাহলে শেখ হাসিনাকে আগে গ্রেফতার করা হয়েছিল কেন? হিসেব মত তখন সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়া ও তাঁর দলের অন্যান্য নেতানেত্রীদের ওপরই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বেশি খড়গহস্ত হওয়ার কথা। কিন্তু ঘটনা তো ঘটেছিল উল্টো। আওয়ামী লীগ প্রধান ও ১৯৯৬-২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই আগে ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই গ্রেফতার করা হয় এবং পৌনে দুই মাস পরে ঐ বছরের সেপ্টেম্বরের ৩/৭ তারিখ বেগম জিয়াকে গ্রেফতার করা হয়।
একথাও মানুষের ভুলে যওয়ার কথা নয় যে, বিএনপি ও তার যোগ্য সহযোগী জামায়াতে ইসলামের অত্যন্ত অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী আচরণের জন্য দেশে চরম অরাজক ও বিশৃক্মখল পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার ফলেই ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরী অবস্থা জারি অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। তখনকার প্রধান নির্বাচন কমিশনার এম এ আজিজ ও অন্য নির্বাচন কমিশনারদের পদত্যাগের দাবিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সে আন্দোলনের কোনরূপ তোয়াক্কা না করে তাঁর নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ইশারায় ২২ জানুয়ারি একটি প্রহসনমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের সব প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেন। তাঁর বেপরোয়া সিদ্ধান্তের ফলে গোটা দেশ এক চরম অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত উপায়ান্তর না দেখে সাবেক রাষ্ট্রপতি তিন বাহিনী প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করে ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যার পর দেশে জরুরী অবস্থা জারি করে। পরদিন ১২ জানুয়ারী নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. ফখরুদ্দীন আহমদ শপথ গ্রহণ করেন এবং তারপরই শুরু হয় নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দীর্ঘ দুই বছরের শাসনকাল। ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বে পরিচালিত জোট সরকারের তল্পিবাহক তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে হটিয়ে নতুন করে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে জনগণ আন্তরিকভাবেই স্বাগত জানিয়েছিল। সামরিক বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট সরকারের ইতিবাচক কিছু করার দৃঢ়তা, প্রত্যয় ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণে কিছু কাজ হাতে নেয়ার সুস্পষ্ট ইঙ্গিতও ছিল। জনগণও প্রাণঢালা সমর্থন জানাতে কোন কার্পণ্য করেনি। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই তদের আশা ভঙ্গ হয়। সাধারণ মানুষের কাছে বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্ধগতির রাশ টেনে ধরতে সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে। দুর্নীতি দমনে ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশে অবাধ, নিরপে ও দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানই তাদের বড় সাফল্য। মজার কথা হলো, যে দলের নেতা-নেত্রীরা গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ও অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে তাদের অভীষ্ট ল্য বাস্তবায়নে এই বিশেষ দিনটির সৃষ্টি করলো তারাই আজ অন্যদের কালো দিবসের হোতা আখ্যায়িত করে ১১ জানুয়ারি কালো দিবস পালন করেছে। কি বিচিত্র এই দেশ এবং এই দেশের এক শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী। নির্ধারিত ল্য এবং তাদের ছক ও অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে প্রণীত নীলনকশা অনুযায়ী একটি পাতানো নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হয়ে তাদেরই পরমপ্রিয় রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমদ জরুরী অবস্থা জারি করে সেনাবাহিনীকে পর্দার অন্তরাল থেকে সব কিছু নিয়ন্ত্রণের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এর আগে জাতীয়তাবাদী দলের অত্যন্ত ত্বরিৎকর্মা তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদও সাবেক প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার পথ সুগম করার জন্য বিচারপতিদের বয়স বৃদ্ধি করে ১৪ দলকে অহেতুক উস্কে দিয়েছিলেন। অবশ্য আমাদের বিক্রমপুরের এই ভদ্রলোক বিরাজমান রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে একজন বিজ্ঞ বিচারপতির মতোই প্রধান উপদেষ্টার পদটি গ্রহণ করা থেকে বিরত থেকে কিছুটা হলেও বিদ্যমান রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমনে সচেষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু বিক্রমপুরেরই আরেক সন্তান রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন সাংবিধানিক বিধিবিধান ও বাধ্যকতা সঠিকভাবে পরিপূরণ না করেই তার দলের ইশারায় নির্লজ্জভাবে নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের দায়িত্ব নিয়ে কুরসিতে বসে পড়েন। এই ভদ্রলোকের অবিমৃষ্যকারিতা ও অযোগ্যতায়ই দেশে এক-এগারোর ঘটনা সৃষ্টির মূল কারণ। হঠাৎ হাইকোর্টের একটি একক বেঞ্চ হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে কারাদণ্ড দিয়ে নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করার জন্য অযোগ্য ঘোষণাও মহাজোটকে নির্বাচন বর্জনে কিছুটা হলেও প্ররোচিত করেছিল।
দেশ ও রাষ্ট্রকে দতার সঙ্গে পরিচালনা করে মানুষের আশা-আকাঙ্ার প্রতিফলন ঘটিয়ে সার্বিকভাবে মানব কল্যাণ নিশ্চিত করাই যে রাজনীতির প্রধান ল্য, দেশের সাধারণ জনগণ তাদের মনের গভীরে এরকম একটি মহৎ ধারণাই সাধারণত পোষণ করে থাকে। সে কারণেই রাজনীতির প্রতি সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের থাকবে প্রচণ্ড আগ্রহ এবং রাজনীতিবিদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এদেশে বিরাজমান রাজনৈতিক চিত্র এবং রাজনীতিকদের কর্মকাণ্ডে কি তার প্রকৃত প্রতিফলন দেখা যায়? না, অধিকাংশ েেত্রই তা ঘটছে না বলেই অনেকের ধারণা। প্রত্যাশার প্রতিফলন আশানুরূপভাবে ঘটছে না বলেই রাজনীতির প্রতি জনগণের হতাশা ও বিতৃষ্ণার মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর তাই সাধারণ মানুষ ধীরে ধীরে রাজনীতির প্রতি শুধু আগ্রহই হারিয়ে ফেলছে না অনেকটা রাজনীতিবিমুখও হয়ে উঠছে। এমনকি রাজনীতিকদের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস অটুট রাখতে তাদের বেশ কষ্ট হচেছ বলেই অনেকের ধারণা। বিরোধী দলের হোক আর সরকারী দলেরই হোক দেশকে সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে সার্বিকভাবে জনগণের স্বার্থ রা করাই রাজনীতিকদের প্রধান কাজ। শুধু শুধু অসত্য ও মিথ্যাচারে সময় অপচয় না করে আমাদের দেশের রাজনীতিকরা যদি জনকল্যাণই তাদের প্রধান কাজ_ এই কঠিন সত্যটি মনের গভীরে আন্তরিকভাবে লালন করে তাদের কর্মকাণ্ড সেভাবে পরিচালনা করলে দেশের মঙ্গল প্রত্যাশী মানুষের মুখে হাসি ফুটে উঠতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
No comments