শর্ষেতে ভূত! পুলিশের সোর্সদের হাতে জনগণ জিম্মি by শংকর কুমার দে
যেই পুলিশ সোর্স দিয়ে অপরাধ দমন করা হয় সেই পুলিশ সোর্সরাই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এ যেন শর্ষেতে ভূত! কার্যত এখন পুলিশ সোর্সরাই চালাচ্ছে থানা। পুলিশ কর্মকর্তারা হয়ে পড়ছেন সোর্স নির্ভরশীল।
রাজধানীর ৪৯ থানায় পুলিশের সোর্সদের দৌরাত্ম, হয়রানি, চাঁদাবাজি উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে। এতে থানা পুলিশের ভাবমূর্তি মারাত্মক ক্ষুণœ হচ্ছে। সোর্সদের দৌরাত্ম্যে থানার কার্যক্রম বেহাল হয়ে পড়েছে। সোর্সরাই এখন বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের নাম ভাঙ্গিয়ে চাঁদাবাজিতে নেমে পড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেদের পুলিশ সদস্য পরিচয় দেন। আর এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট থানা এলাকার সাধারণ মানুষ তাঁদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। এলাকার ফুটপাথের দোকান থেকে চাঁদাবাজি, জমি দখল নিয়ে মধ্যস্থতা, এমনকি কাঁচামালের আড়ত থেকেও এরা চাঁদাবাজি করছেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ৪৯ থানা ও এর আশপাশের থানাগুলোতে এখন পুলিশের চেয়ে সোর্সদের দৌরাত্ম্য বেশি হয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রে এই সোর্সরাই থানার ওসির ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। অনেক সোর্স মামলার আসামিদের পক্ষ নিয়ে পুলিশের নাম পরিচয় ব্যবহার করে বাদীকে হুমকি দেন। মূলত থানা চালাচ্ছেন পুলিশ সোর্সরা। যাত্রাবাড়ী থানা এলাকায় পুলিশের সোর্সদের দৌরাত্ম্য সবচেয়ে বেশি। এলাকায় সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল, যাত্রাবাড়ী মোড়, যাত্রাবাড়ী মাছের আড়ত, সবজির আড়তসহ বিবিরবাগিচার বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে পুলিশের সোর্সরা যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশের পরিচয় দিয়ে চাঁদাবাজি করেন। যাত্রাবাড়ী মাছের আড়তে থানার পুলিশ সোর্স দেলু, কাশেম ও খোকন চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন। যাত্রাবাড়ী মাছের আড়তে প্রায় ১২শ’ দোকান রয়েছে। এসব দোকান থেকে প্রতিদিন পুলিশের নামে ১০ হাজার টাকা চাঁদা ওঠে। যাত্রাবাড়ী মাছের আড়তের একজন ভুক্তভোগী মৎস্য ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, পুলিশ সোর্সদের কাজ প্রতিদিন ভোরে মাছের আড়তে এসে থানার নামে চাঁদা তোলা। বিশেষ করে মাছের আড়তে রাক্ষসী পিরানহা মাছ অথবা আকারে ছোট মাছের অভিযোগ তুলে অনেক মাছ তারা পুলিশের নামে জব্দ করে নিয়ে যান। কয়েকদিন আগে পুলিশ সোর্স কাশেম একটি মাছের দোকানে আট ইঞ্চির ছোট মাছ বলে প্রায় এক মণ মাছ জব্দ করে। পরে এক হাজার টাকা চাঁদা দিলে ঐ মাছ ছেড়ে দেয়া হয়। এমনকি এসব সোর্স যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশের ভয় দেখিয়ে মাছ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রায়ই চাঁদা তোলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কামরাঙ্গীরচর থানায় কয়েকদিন আগে পুলিশের এক সোর্স মামলার বাদীকে হুমকি দিয়েছেন।কামরাঙ্গীরচরের লোহারব্রিজের ঢালে বালুরমাঠ সংলগ্ন নিজ বাড়ির সামনে সন্ত্রাসীদের হামলায় আহত আবুল হোসেন থানায় একটি মামলা করেন। এই মামলায় পুলিশ দুই সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করে। পরে মামলাটি তুলে নেয়ার জন্য কামরাঙ্গীরচর থানার পুলিশের সোর্স রমজান তাঁকে হুমকি দেন। বিষয়টি নিয়ে আবুল হোসেন থানার সেকেন্ড অফিসার এসআই জামাল উদ্দিনের কাছে অভিযোগ দেন। পুলিশ ঘটনা তদন্তে নেমে দেখতে পায় যে, পুলিশ সোর্স রমজানের সঙ্গে এলাকার সন্ত্রাসী জাফরের গভীর সখ্য রয়েছে। মূলত রমজান সন্ত্রাসী জাফরের পক্ষ নিয়ে পুলিশের পরিচয় ব্যবহার করে আবুল হোসেনকে হুমকি দিয়েছেন।
খিলগাঁও থানার সোর্স হিসেবে কাজ করে আব্দুল আজিজ। খিলগাঁও রেলগেট এলাকার ফুটপাথের বিভিন্ন দোকান থেকে আব্দুল আজিজ থানার নামে প্রতিদিন ২০ টাকা করে তোলেন। এসব চাঁদাবাজি করার সময় আব্দুল আজিজ খিলগাঁও থানার সোর্স হিসেবে পরিচয় দেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া খিলগাঁও থানা পুলিশের সিভিল টিমের গাড়িতে সোর্স ওহাব চলাফেরা করেন। কয়েকদিন আগে গোড়ান এলাকা থেকে এক স্বর্ণের দোকানের কর্মচারীকে ওহাব থানায় ডেকে নেন। একজন সাব-ইন্সপেক্টরের মাধ্যমে মামলার ভয় দেখিয়ে বলা হয় যে, অবৈধ স্বর্ণের বেচাকেনা হয় ঐ দোকানে। পরে দোকান থেকে ৩ ভরি স্বর্ণ পুলিশ রেখে দিয়ে ঐ কর্মচারীকে ছেড়ে দেয়া হয়।
শাহজাহানপুর থানার সোর্স নাইটগার্ড জলিলকে কয়েকদিন আগে র্যাব-৩ এর খিলগাঁও ক্যাম্পে ডেকে নেয় র্যাব। জলিলের বিরুদ্ধে খিলগাঁও এলাকায় বিভিন্ন মাদকের স্পট থেকে থানার নামে চাঁদাবাজি করার অভিযোগ রয়েছে। র্যাব নাইটগার্ড জলিলকে মারধর করে ছেড়ে দেয়।
মতিঝিল থানা এলাকায় সুমন নামে এক সোর্স শাপলা চত্বরে ফুটপাথের দোকান থেকে থানা পুলিশের নামে চাঁদাবাজি করেন। ফুটপাথের দোকানদাররা অভিযোগ করেন, শাপলা চত্বরে সোনালী ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ের সামনে ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে সুমনকে প্রায় আড্ডা দিতে দেখা যায়।
মিরপুর থানা এলাকায় মাহবুব নামে পুলিশের এক সোর্স খোদ পুলিশ কমিশনারের আত্মীয় পরিচয় দিয়ে চাঁদাবাজি করেন। এ ব্যাপারে কিংশুক বহুমুখী সমবায় সমিতির কর্মকর্তা শফিকুল আলম টিটন মিরপুর থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। মাহবুব নিজেকে পুলিশের সোর্স পরিচয় দিয়ে টিটনের কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা আত্মসাত করেছেন।
No comments