অভিমত ॥ জিপিএ-৫ বিড়ম্বনা!
মেধাতালিকা প্রথা চালু থাকাকালীন কোন ছাত্রছাত্রী মেধাতালিকায় স্থান পেলে ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকরা যেমন আনন্দ উৎসবে মেতে উঠতেন এবং ছাত্রছাত্রীরা মেধা তালিকায় স্থান পাওয়ার জন্য যেভাবে লেখাপড়া করতেন সে পরিস্থিতি এখন দেখা যায় না।
স্টার মার্ক (৭৫০ থেকে উর্ধে) পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের গুণগত মান এখনকার গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না। জিপিএ প্রথা চালু হওয়ার পূর্বের ফলপ্রথায় টেস্টিমোনিয়াল/সার্টিফিকেটের সঙ্গে মার্কশীট (শিক্ষাবোর্ড কর্তৃক সরবরাহকৃত) দেয়া হতো। মার্কশীট থেকে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রী প্রতিটি বিষয়ে তাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সমীকরণ মিলাত। দেখা গেছে, মার্কশীট তাদের পরবর্তী পরীক্ষার ফলের জন্য দিকনির্দেশনা বা পাথেয় বিবেচিত হতো। যারা মেধাতালিকায় স্থান পাওয়ার প্রচেষ্টা ও প্রত্যাশায় থাকত মার্কশীট পাওয়ার পর তার প্রকৃত অবস্থান বুঝতে পারত এবং তদনুযায়ী পরবর্তী পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিত। শিক্ষকতা জীবনে আমি কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে পরীক্ষকের দায়িত্বও পালন করেছি। তখন বোর্ড কর্তৃক সরবরাহকৃত নির্দেশনায় বলা হতো, কোন ছাত্রছাত্রী পাঠ্যপুস্তক অবলম্বন করে উত্তরপত্রে নির্ভুলভাবে উদ্ধৃত করলে তাকে ৬০% মার্ক দেয়া যাবে। তবে কোন ছাত্রছাত্রী পাঠ্যপুস্তক অবলম্বন করে উত্তরপত্রে নির্ভুলভাবে উদ্ধৃত করা ছাড়াও নিজস্ব স্বকীয়তার প্রমাণ রাখে এবং তা গ্রহণযোগ্য হলে তাকে ৮০% ও তদুর্ধ নম্বর দেয়া যেতে পারে। বর্তমানে পরীক্ষকদের প্রতি নির্দেশনার কি পরিবর্তন হয়েছে, তা জানা নেই।জিপিএ প্রথা চালু হওয়ার পর থেকে এ যাবত এ প্লাসের সংখ্যা যতই বাড়ছে পরবর্তী ধাপের জন্য ভর্তির বিড়ম্বনা ততই বাড়ছে। জিপিএ-৫ পেয়ে অনেকে হতাশায় ভোগে। কারণ মার্কশীটের অভাবে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সঠিক হিসাবটি মেলাতে পারে না। এখন দেখা যায় মার্কশীট নামে যে শীট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসে তাতে প্রত্যেকটি বিষয়ে এ+, এ, এ-, বি, সি, ডি ইত্যাদি লেটার গ্রেড হিসাবে দেখানো হয়। তদনুযায়ী বোর্ড কর্র্তৃক সরবরাহকৃত সার্টিফিকেটে প্রতিটি বিষয়ে প্রাপ্ত নম্বরের পরিবর্তে লেটার গ্রেড দেখানো হয়।
এতে ছাত্রছাত্রী ও তাদের অভিভাবকরা তাদের অবস্থান বুঝতে পারে। শিক্ষা বোর্ডসমূহে তাদের সরবরাহকৃত মার্কশীটে প্রত্যেকটি বিষয়ে ‘লেটার গ্রেড’-এর সঙ্গে তার প্রাপ্ত নম্বর উল্লেখ করলে প্রত্যেকটি ‘লেটার গ্রেডে’ ১০ নম্বরের রেঞ্জে তার অবস্থান দেখতে পাবে। এ+, এর রেঞ্জ ২০ (অর্থাৎ ৮০-১০০)। প্রাপ্ত নম্বর উল্লেখ থাকলে ছাত্রছাত্রী বুঝতে পারবে তার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ব্যবধান। একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক ট্রান্সক্রিপটের নমুনা এতদসঙ্গে প্রেরণ করা হলো। যে ছাত্রছাত্রী ৮০ পাবে এবং যে ১০০ পাবে দু’জনের মধ্যে এবং মান সমান হবে না। বর্তমান জিপিএ পদ্ধতিতে দেখা যায়, ক্যাডেট কলেজ ও প্রথিতযশা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে গোল্ডেন এ+ ও এ+ এর সংখ্যাধিক্যে ক্লাসের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয়স্থানের ছাত্রছাত্রীরা গড্ডলিকা প্রবাহে ভেসে যাচ্ছে। তারা উদ্যম হারিয়ে ফেলছে। ঘোড়া-গাধা একই মূল্যে বিবেচিত হচ্ছে। ৫ম ও ৮ম শ্রেণীতে সমাপনী পরীক্ষা বোর্ড কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হওয়া প্রশংসার দাবিদার। এতে প্রতিটি ধাপের সমাপনী পরীক্ষার জন্য ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ-উদ্দীপনা ও সচেতনতা বাড়ছে।
একজন অভিভাবক ও শিক্ষক হিসাবে শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা সচিব, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা বোর্ডসমূহের চেয়ারম্যান, সচিব ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকদের প্রতি আমার সবিনয় অনুরোধÑজিপিএ প্রথা চালু রেখে ও প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর পরীক্ষার মার্কশীটে প্রতিটি বিষয়ে লেটার গ্রেডের সঙ্গে তার প্রাপ্ত নম্বর উল্লেখ করার জন্য; যাতে ক্লাসের অসাধারণ মেধাবীরা সাধারণ মেধাবীদের মধ্যে তাদের অবস্থান বুঝতে পারে। এতে মেধা তালিকা প্রথা বিলুপ্ত হলেও মেধা তালিকায় স্থান ও স্টার মার্কপ্রাপ্তদের মতো অসাধারণ মেধাবীরা স্ব স্ব অবস্থান বুঝতে পারবে ও ফলাফলের প্রকৃত আনন্দ উপভোগ করতে পারবে। না হলে এ+ ও গোল্ডেন এ+ এর সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়লেও অসাধারণ মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা হতাশায় ভুগবে এবং তারা উৎসাহ ও উদ্যম হারিয়ে ফেলবে। বিষয়টি সদয় বিবেচনার জন্য সংশ্লিষ্ট সকল মহলের প্রতি সবিনয় অনুরোধ করছি।
No comments