বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ঐতিহাসিক রায় বাংলায় রূপান্তর : by এনামুল হক
প্রথম সা্যটির কাজ আমরা কিছুণ আগে উল্লেখ করেছি। ব্রিটিশ রাজের প থেকে যুক্তি সহকারে বলা হয়েছে যে ঐ বক্তব্যটা ভারতীয় সা্য আইনের ১০ ধারার বিধানাবলীর আওতার মধ্যে আসে এবং সেই হেতু সেটিকে অবনীর সহবন্দীদের বিরুদ্ধে সা্য বলে গণ্য করতে হবে।
বলা হয়েছে যে ঐ বক্তব্যটি যদি কোনক্রমেই ১০ নং ধারার মধ্যে না পরে তাহলে ৩০ নং ধারার বিধানাবলীর অধীনে এটা সহ আসামিদের অন্যতম একজনের স্বীকারোক্তি এবং বিচার চলাকালে এই স্বীকারোক্তির উল্লেখ করা যেতে পারে। মি. রায় যথেষ্ট মাত্রায় যুক্তি সহকারে বলেছেন যে, যে অবস্থাই হোক না কেন এর গুরুত্ব তার সহযোগীর বক্তব্যের গুরুত্বের চেয়ে বেশি হতে পারে না এবং বস্তুতপ েএর গুরুত্ব একজন সহযোগীর সা্যের গুরুত্বের চেয়ে কম। কারণ একজন সহযোগীকে তার বক্তব্যের সঠিকতা যাচাই করার জন্য জেরা করা যেতে পারে। অন্যদিকে বন্দী থাকাকালে অবনীর দেয়া এই স্বীকারোক্তির সঠিকতা পরীা করার উপায় নেই। সেই যুক্তির মধ্যে যথেষ্ট সারবত্তা থাকায় আমরা এই উপসংহারে পেঁৗছেছি যে অবনীর বক্তব্যকে সা্য আইনের ১০ নং ধারার অধীনে সা্য বলে যথা সঙ্গতভাবে গণ্য করা চলে না। আমাদের মতে ঐ ধারাটির উদ্দেশ্য হলো ষড়যন্ত্র চলাকালে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রকারীর মধ্যে ষড়যন্ত্র কার্যকর করা নিয়ে যে যোগাযোগ ঘটেছিল সে সংক্রান্ত সা্যপ্রমাণ দেয়া। ষড়যন্ত্রের মামলায় সা্য প্রমাণের ব্যাপারে ১০ নম্বর ধারার ব্যাপ্তি ইংল্যান্ডের আইনের চেয়েও বেশি সন্দেহ নেই। তবে আমরা মনে করি না যে ঐ ধারাটির উদ্দেশ্য হচ্ছে সা্যকে সহ আসামির স্বীকারোক্তিতে পরিণত করা এবং একে ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে কিংবা ষড়যন্ত্রকারী ও অন্যান্য ব্যক্তির মধ্যে ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে যোগাযোগ বা কথাবার্তা আদান-প্রদানের মতো একই অবস্থানে ফেলা। তবে ৩০ ধারার ব্যাপারে আমাদের মত হলো বক্তব্যটা একজন সহ আসামির স্বীকারোক্তি হওয়ায় সেটাকে ঐ ধারার আওতায় দেখা যেতে পারে। কিন্তু জেরার মাধ্যমে এই বক্তব্যকে যাচাই করে দেখা সম্ভব হয় না বিধায় এর গুরুত্ব খর্ব হয়ে যায়। আমরা এক মুহূর্তের জন্য এমন সা্যকে ষড়যন্ত্রের সহযোগীর বক্তব্যের চেয়ে বেশি কিছু বলে স্থান দিচ্ছি না তেমনি আবার নিরপে সা্যের দ্বারা সমর্থিত ঐসব বক্তব্যের যে যে অংশের মধ্য দিয়ে আসামি বা তাদের বিরুদ্ধে আনীত ষড়যন্ত্রের অভিযোগে জড়িয়ে পড়ে সেগুলো ব্যতীত ওসব বক্তব্যের দ্বারা কোনভাবে নিজেদেরকে প্রভাবিত হতে দিতেও পারি না।"এই বিষয়টি তখন মির্জা আকবর বনাম ব্রিটিশ রাজ এআইআর ১৯৪০ (পিসি) ১৭৬ মামলায় বিবেচনা করা হয়েছিল। প্রিভি কাউন্সিলের মাননীয় সদস্যরা বিভিন্ন মতা ও সা্য আইনের ১০ ধারা বিচার বিবেচনা করে নিম্নোক্ত অভিমত দিয়েছিলেন :
"নীতিটা এই হওয়ায় মহামান্য বিচারপতিরা মনে করেন যে ১০ ধারার কথাগুলোকে এই নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ব্যাখ্যা করতে হবে। কথাগুলোর এমন বিশদ ব্যাখ্যা দেয়াও সম্ভব নয় যাতে করে একজন ষড়যন্ত্রকারীর অনুপস্থিতিতে অপর ষড়যন্ত্রকারীর দেয়া বিবৃতিকে তার অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। অতীতে একটা ষড়যন্ত্র সম্পন্ন হয়ে যাবার পর সেই ষড়যন্ত্র কার্যকর করার গতিপথে যেসব কাজ করা হয়েছিল বিবৃতি বা বক্তব্যটা হলো সেই সম্পর্কিত। অভিন্ন অভিপ্রায়টা হলো অতীতের। বিচারপতিদের রায়ে উল্লেখিত 'অভিন্ন অভিপ্রায়' কথাগুলোর দ্বারা সেই সময়ে অস্তিত্বমান অভিন্ন অভিপ্রায়কে বুঝানো হয়েছে যখন ষড়যন্ত্রকারীদের একজন এ বিষয়ে বলেছিল, করেছিল বা লিখেছিল। অভিন্ন অভিপ্রায়ের অস্তিত্বে বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি একবার দেখানো হয়ে গেলে ষড়যন্ত্র চালু থাকা অবস্থায় যে বিষয়গুলো সম্পর্কে বলা হয়েছিল, করা হয়েছিল কিংবা লেখা হয়েছিল সেগুলোই অভিন্ন অভিপ্রায়ের সা্যপ্রমাণ হিসেবে প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়ায়। তবে একথা বলা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে যে অভিন্ন অভিপ্রায় বা ষড়যন্ত্র যখন আর চালু নেই, যখন এর কোন অস্তিত্বই আর নেই, তখন তৃতীয় পরে কাছে ঘটনার বর্ণনা দেয়া হলে বা সে সম্পর্কে কোন বিবৃতি বা স্বীকারোক্তি দেয়া হলে তা অপর পরে বিরুদ্ধে গ্রহণযোগ্যতা পাবে। তাহলে এেেত্র ষড়যন্ত্রকারীদের কোন অভিন্ন অভিপ্রায় নেই যার প্রসঙ্গ ধরে এই বিবৃতিকে টানা যেতে পারে। মহামান্য বিচারপতিদের রায়ে ১০ ধারাটিতে এই নীতিমালা বিধৃত। এটাই হলো সেই ব্যাখ্যা যা ভারতে বিভিন্ন সিদ্ধান্তে সঠিকভাবেই ১০ ধারার েেত প্রয়োগ করা হয়েছে, যেমন_ ৫৫ বোম্বাই ৮৩৯ নং মামলা এবং ৩৮ কলকাতা ১৬৯ নং মামলা। এই মামলাগুলোয় ষড়যন্ত্র চলাকালে ষড়যন্ত্র কার্যকর করার প্রসঙ্গ নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের নিজেদের মধ্যেকার যোগাযোগ এবং গ্রেফতারের পর কিংবা ষড়যন্ত্র শেষ হয়ে যাবার পর তখনকার সেই অতীত ঘটনাবলীর বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রদত্ত বিবৃতির মধ্যে সঠিকভাবেই পার্থক্য টানা হয়েছিল।"
দেখা যাবে যে, 'তাদের অভিন্ন অভিপ্রায় প্রসঙ্গে' কথাটা অত্যন্ত ব্যাপক এবং দণ্ডবিধির ৩৪ ধারায় ব্যবহৃত 'অভিন্ন অভিপ্রায় অনুসারে' কথাগুলোর চাইতে বৃহত্তর অর্থগত পরিধি যোগানোর জন্য পূর্বপরিকল্পিতভাবে উপরের ঐ কথাগুলো ব্যবহার করা হয়েছিল। এর ফলে ষড়যন্ত্র প্রণীত হবার পর একজন ষড়যন্ত্রকারী যা কিছু বলেছেন, করেছেন বা লিখেছেন সেটাই অপর ষড়যন্ত্রকারী ষড়যন্ত্রের ময়দানে প্রবেশ করার আগে বা ষড়যন্ত্রের ময়দান ত্যাগ করার পর তার বিরুদ্ধে সা্যপ্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
১০ ধারা বিশ্লেষণ করে ভগবান স্বরূপ বনাম মহারাষ্ট্র রাজ্য এআইআর ১৯৬৫, এসসি ৬৮২ মামলায় নিম্নোক্ত অভিমত দেয়া হয়েছে :
"এমনিভাবে যা বলা হয়েছে, করা হয়েছে বা লেখা হয়েছে তা এমন ষড়যন্ত্রকারী বলে মনে করা প্রত্যেক ব্যক্তির বিরুদ্ধে একটা প্রাসঙ্গিক তথ্য মাত্র। সেই সঙ্গে ষড়যন্ত্রের অস্তিত্ব প্রমাণ করা এবং এমন যে কোন ব্যক্তি যে সেই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিল তা দেখিয়ে দেয়ার েেত্রও এটা প্রাসঙ্গিক তথ্য।" ষড়যন্ত্রের অস্তিত্ব প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে কিংবা এমন এক ব্যক্তি ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিল না প্রমাণ করার কাজেই শুধু এই তথ্যকে ব্যবহার করা যেতে পারে। সংেেপ বলতে গেলে এই ধারার মামলা নিম্নোক্তভাবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে : (১) "আদালতকে একথা বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি যোগানোর মতো আপাত গ্রহণযোগ্য সা্যপ্রমাণ থাকতে হবে যে দুই বা ততোধিক ব্যক্তি ষড়যন্ত্রের অংশীদার; (২) উক্ত শর্তটি পূরণ হলে ষড়যন্ত্রের অংশীদারদের যে কোন একজন তাদের অভিন্ন অভিপ্রায় সম্পর্কে বলেছেন, করেছেন বা লিখেছেন এমন যে কোন কিছু অপরজনের বিরুদ্ধে সা্যপ্রমাণ হয়ে দাঁড়াবে; (৩) তার বলা, করা বা লেখা যে কোন কিছু তাদের যে কোন একজনের দ্বারা অভিপ্রায় ব্যক্ত হবার পর সেই বলেছে, করেছে বা লিখেছে বলে ধরে নিতে হবে; (৪) ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হওয়া আরেকজনের বিরুদ্ধে উক্ত উদ্দেশ্য সাধনের জন্যেও ওটা প্রাসঙ্গিক হবে_তা সেই ব্যক্তি ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হবার আগে কিংবা সে ষড়যন্ত্র থেকে বেরিয়ে যাবার পর বলা, করা বা লেখা হোক; এবং (৫) একজন সহ-ষড়যন্ত্রকারীর অনুকূলে নয় বরং তাঁর বিরুদ্ধেই কেবল এটা ব্যবহার করা যাবে।" (ক্রমশ)
No comments