বাংলাদেশের চলচ্চিত্র রম্নচিহীনতা ও আত্মধ্বংসের বাণিজ্য by ইকবাল আজিজ
সংস্কৃতির নানা মাধ্যমের মতো আমরা যারা সিনেমা ভালোবাসি তাদের জন্যে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র রম্নচিহীনতা ও নোংরামির একটি নির্লজ্জ দলিল। তবে এ কাজের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের কোনো লজ্জা নেই।
তারা বছরের পর বছর এ বিষয়ে সরকারের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়ে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। বিনোদনের নামে তারা মানুষকে রম্নচিহীনতা ও নোংরামি উপহার দিচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের আলোকিত রাজধানী ঢাকায় বসে এইসব সিনেমাওয়ালারা আধুনিক ক্যামেরার সাহায্যে এক ধরনের অর্থহীন ও উদ্ভট অপকর্ম করছেন যাকে কিছুতেই সিনেমা বলা যায় না। আর ক্যামেরায় গৃহীত 'যাত্রা' বলেও বাঙালীর শত শত বছরের পুরনো শিল্প মাধ্যমটিকে অপমান করার দুঃসাহস আমার নেই। তাহলে প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে সিনেমার নামে কী তৈরি হচ্ছে। এর জবাব হলো, তৈরি হচ্ছে উদ্ভট ও অর্থহীন অশিল্প। হয়ত আমাদের সামাজিক নৈরাজ্যের মতো এও এক কঠিন বাসত্মবতা।আকাশ সংস্কৃতির এই বর্ণাঢ্য যুগে দেশের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণী তাদের পছন্দ মতো সিনেমা দেখার জন্য এখন স্যাটেলাইট টিভি ও সিডির ওপর নির্ভরশীল। ইচ্ছে মতো পৃথিবীর যে কোনো দেশের যে কোনো যুগের কাসিক ছবি তারা দেখতে পারেন। বাংলাদেশের সিনেমা ব্যবসায়ীরা কখনই দেশের শিৰিত উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত দর্শকের কথা ভাবেন না; তাদের লৰ্য বাকি শতকরা আশিভাগ অর্ধশিৰিত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী। সাধারণ মানুষের অশিৰা ও সারল্যকে পুঁজি করে তারা সিনেমার মতো একটি অতিশয় শক্তিশালী মাধ্যমকে ব্যবহার করছেন লুটপাটের ব্যবসা হিসেবে। এই গরিব দেশে সিনেমা ব্যবসায়ীদের তৎপরতাকে এক ধরনের লুটপাটের ব্যবসা ও নির্লজ্জ অপরাধকর্ম হিসেবে অভিহিত করা যায়। স্বাধীনতার পর গত ৩৯ বছর ধরে দেশে সরকার এসেছে এবং সরকার চলে গেছে, কিন্তু সিনেমা জগতের এই ভয়ঙ্কর ৰমতাশীল মাফিয়ারা সমাজে টিকে থেকেছে জগদ্দল পাথরের মতো। তারা অর্থের বিনিময়ে দেশের ৰমতাসীনদের সন্তুষ্ট রেখেছে এবং এ ভূখ-ের গরিব সাধারণ জনগোষ্ঠীকে বিভ্রানত্ম ও শোষণ করেছে। আমার ধারণা, ভূমি দসু্যদের অপতৎপরতা কিংবা খাদ্য ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের মতো এই অপরাধও সমানভাবে দ-নীয় ও নিন্দনীয়। তবে পার্থক্য হলো, দেশের ভূমিদসু্য ও দুনর্ীতিপরায়ণ খাদ্য ব্যবসায়ীদের কখনও কখনও শাসত্মি হয়, কিন্তু সিনেমাজগতের এই তস্কর ব্যবসায়ীদের কখনই শাসত্মি হয় না। অর্থের জোরে তারা এ সমাজে খুব সচ্ছলভাবে বেঁচে থাকেন। তারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। আর তাদের উদ্ভট অপকর্মসমূহ শহর ও গাঁয়ের সিনেমা হলগুলোতে অবাধে প্রদর্শিত হচ্ছে। একের পর এক এসব ছবি নির্মিত হচ্ছে। এসব ছবির নামও সাহিত্যরম্নচি বর্জিত। একবিংশ শতকের ডিজিটাল যুগে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র নির্মাণের দিক দিয়ে এখনও যেন গত শতকের বটতলার সংস্কৃতির যুগে পড়ে আছে। ভাবতেই পারা যায় না, সাম্প্রতিক সিনেমার নাম হতে পারে কাজের মানুষ, মনে বড় কষ্ট, আমার প্রাণের প্রিয়া প্রভৃতি। অর্থাৎ দেশের মাুনষের রম্নচিকে যত নিম্নগামী করা যায় তারই প্রতিযোগিতা চলছে সর্বত্র। দেশে সরকার আছে, বিরোধী দল আছে সুশীল সমাজ আছে, সাংস্কৃতিক জোট আছে, কিন্তু কারোই কোন মাথাব্যথা নেই। সিনেমার মাফিয়ারা ছলে-বলে-কৌশলে দেশের সব ৰমতাসীন গোষ্ঠীকেই হাতের পুতুল বানিয়ে রেখেছেন। আমাদের অনেক ব্যর্থতার মতো এও এক স্মরণীয় ব্যর্থতা।
অথচ আমাদের সিনেমার শুরম্নটা ছিল খুবই সম্ভাবনাময়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে বলা যায় বাঙালীর প্রথম সাংস্কৃতিক বিপস্নব। এই মহান ঘটনাটি আমাদের সচেতন ও সুসংহত করেছিল বৃহত্তর রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের লৰ্যে এগিয়ে যেতে। আমি বহুবারই লিখেছি, পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের সুস্পষ্ট তফাৎ রয়েছে। ১৯৪৭ সালের পর থেকে পূর্ববঙ্গের মানুষের রাজনৈতিক সংগ্রামের মূল ভিত্তিই বাঙালীর সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ। কেবলমাত্র ধর্ম ছাড়া আমরা ভাষা, আচার-আচরণ ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে যে পশ্চিম পাকিসত্মানীদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা তা ক্রমেই সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। বাঙালীর জাতীয়তাবাদী বোধের সূচনাও তখন থেকে। ভাষা আন্দোলনের পর এই সাংস্কৃতিক বোধের ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলা একাডেমী। এবং ১৯৫৭ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পূর্ববঙ্গের প্রথম চলচ্চিত্র স্টুডিও ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (এফডিসি)। প্রথমদিকে এই প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা ছিল যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক। আব্দুল জব্বার খান, ফতেহ লোহানী, এহতেশাম, মুসত্মাফিজ, জহির রায়হান, সালাউদ্দীন, খান আতাউর রহমান প্রমুখ সৃজনশীল চলচ্চিত্রকার এগিয়ে এসেছিলেন সেদিন ছায়াছবি নির্মাণে। পূর্ববঙ্গীয় সমাজ, সংস্কৃতি ও জীবনকাহিনী এই প্রথম চলচ্চিত্রায়িত হলো এই এলাকার নিজস্ব স্টুডিওতে। এ এক বিশাল বিপস্নব। কারণ তিরিশের দশক থেকে কলকাতাই ছিল বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণের মূল কেন্দ্র। সে সময় ঢাকার নবাব পরিবারের উদ্যোগে 'দি লাস্ট কিস' নামে ঢাকায় যে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল তাকে একটি বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা বলে অভিহিত করা যায়। প্রকৃতপৰে পঞ্চাশ দশকের শেষদিকে ঢাকায় এফডিসি স্টুডিও স্থাপন পূর্ববঙ্গ কিংবা বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখেছে।
বর্তমান আধুনিক যুগে সংস্কৃতির সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও গণমুখী মাধ্যম হলো সিনেমা। গত শতাব্দীর সূচনা থেকে সারা পৃথিবীর মানুষের জীবনচর্চাকে তা সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। জীবনের ছন্দময় কাহিনী এখন শুধু বইয়ের পাতায় বন্দী হয়ে নেই, তারা বরং দৃশ্যমান, জীবনত্ম, জাগ্রত এবং কখনও কখনও গীতিময়। চলচ্চিত্রের প্রায় সূচনালগ্নেই কাহিনী চলচ্চিত্রের পাশাপাশি আর্বিভাব ঘটেছিল ডকুমেন্টারি ফিল্ম বা প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ও সংবাদ চলচ্চিত্রের। প্রথম যুগে সিনেমায় কথা ছিল না, শুধু ছিল ছবি ও কাহিনী। সেই নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগেই মানুষ উপলব্ধি করেছিল, এর একটি নিজস্ব সার্বজনীন ভাষা রয়েছে যা পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই বুঝতে পারে। বিশ শতক কিংবা একবিংশ শতকে আমরা সবাই আমাদের বিকাশের জন্য সিনেমার কাছে ঋণী। পঞ্চাশ দশকের শেষদিকে কিংবা ষাট দশকের শুরম্নতে আমার শৈশবে এদেশে মানুষের প্রধান বিনোদন ছিল সিনেমা। শৈশবের কিছুই ভোলা যায় না, মা খালাদের সঙ্গে প্রতিসপ্তাহে একবার মফস্বলের সেই রহস্যময় সিনেমা হলে যাওয়া ছিল একটি নিয়মিত ঘটনা। দীলিপ-নার্গিস কিংবা উত্তম-সুচিত্রা যুগের সেই পরিচ্ছন্ন গীতিময় ছায়াছবিগুলো আমাদের শৈশবের বিস্ময়ের জগতকে আরও পরিশীলিত করেছিল। শুধু আমি নই, আমার বয়সী অনেকেই হয়ত শৈশবের সেই স্বর্ণালী সন্ধ্যার কথা স্মরণ করবেন যখন ছবি শুরম্নর আগে সিনেমা হলের মাইকে গান বাজতো, 'কতো যে কথা ছিলো, কতো যে ছিলো গান'_ লতা মুঙ্গেশকরের সেই অসাধারণ গান, কিংবা হেমনত্মর গাওয়া মেলোডি 'অলির কথা শুনে বকুল হাসে।' এসব কিছুই আমাদের শৈশবকে সমৃদ্ধ করেছে, যা কোন রাজনীতি কিংবা শিৰা পরিকল্পনার সাহায্যে বাসত্মবায়ন করা সম্ভব নয়।
একটি বিষয় সুস্পষ্ট যে, ছায়াছবিতে সুচিত্রা সেন ও উত্তম কুমার সেই পাকিসত্মানী দুঃশাসনের দিনগুলোতে বাঙালীর নিজস্ব জীবনবোধের রঙে আমাদের চেতনাকে বর্ণাঢ্য করে তুলেছিলেন। পাশাপাশি ঢাকার চলচ্চিত্রের রহমান-শবনমের কথা ভোলার নয়। 'হারানো দিন' ছায়াছবির সেই গানটির কথা কি মনে পড়ে? 'আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের জাদু এনেছি।' রবীন ঘোষের সুর ও ফেরদৌসী বেগমের গান আমাদের পাগল করেছিল। পাশাপাশি প্রতি রবিবার মর্নিং শোতে বিদেশী ছবি আমাদের বোধকে আনত্মর্জাতিক করে তুলেছিল। সেই শৈশবে দেখা টারজান, সান অব জরো কিংবা হলিউডের ওয়েস্টার্ন ছবিগুলোর কথা মনে পড়ে। এসব কথা লিখছি এ কারণে যে, স্বাধীন বাংলাদেশে এখন আমরা চলচ্চিত্র জগতে রম্নচিহীনতার সর্বনিম্ন সত্মরে অবস্থান করছি। একদল অর্ধশিৰিত গরম্নর দালাল কিংবা ভদ্রবেশী ডাকাত আমাদের স্বাধীন বাংলার চলচ্চিত্রের ভাগ্য নিয়ন্ত্রক। তারা অতিশয় রম্নচিহীন সিনেমা নির্মাণের মাধ্যমে প্রতিমুহূর্তে আমাদের সাধারণ মানুষকে বিপদগ্রসত্ম করছেন। মুম্বাইয়ের সিনেমাকে নকল করে এমন উদ্ভট সব ছায়াছবি তৈরি করা হচ্ছে যার কাহিনী কিংবা চিত্রনাট্য কিছুর সঙ্গে বাংলাদেশের জনজীবনের মিল নেই। স্বাধীনতার পর থেকে শুরম্ন হয়েছে উল্টোদিকে পথ হাঁটা, বাংলাদেশের দর্শকদের সামনে পৃথিবীর সব দরজাই সেদিন বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল একচেটিয়া ব্যবসা। অথচ স্বাধীনতার পর একটু সুস্থ ব্যবস্থাপনা কিংবা পরিকল্পনা থাকলে এদেশের চলচ্চিত্রকে একটি কার্যকর শিল্পমাধ্যম হিসেবে গড়ে তোলা যেত, কিংবা চলচ্চিত্রই হতে পারত এদেশের গণমানুষের মানসিক ও আত্মিক মুক্তির মাধ্যম। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়ের অব্যবহিত করে জহির রায়হান রহস্যজনকভাবে চিরতরে হারিয়ে যান। ধারণা করা হয়, স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে তার জীবনের অবসান হয়েছে। হয়ত দেশপ্রেমিক জহির রায়হান আমাদের স্বাধীন বাংলার চলচ্চিত্র উন্নয়নে নেতৃত্ব দিতে পারতেন। তার শূন্যতা বাসত্মবিকই পূরণ হয়নি। স্বাধীনতার পর তৎকালীন সরকারের উদারতার সুযোগে এদেশে সিনেমা নিয়ে যে স্বেচ্ছাচার শুরম্ন হয়েছিল, তা এখনও অব্যাহত আছে। অথচ প্রতিবছর ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সুনির্দিষ্ট সংখ্যক পুরস্কারপ্রাপ্ত ছায়াছবি বিনিময়ের ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারত। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ছবি ও বাংলাদেশের বাংলা ছবির বিনিময় ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে দুই বাংলার সাংস্কৃতিক বন্ধন হয়ত একদিনে আরও দৃঢ় হতো। কারণ গত ৩৯ বছরে বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের জন্য সংরৰণবাদী নীতি এতটুকু সুফল বয়ে আনতে পারেনি।
আলমগীর কবীর এদেশের সুস্থ ও সৃজনশীল চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, কমার্শিয়াল চলচ্চিত্রের পাশাপাশি এদেশে একটি শুদ্ধ চলচ্চিত্র আন্দোলন গড়ে তুলতে। তিনি ছিলেন একজন সত্যিকার সুশিৰিত মানুষ ও চলচ্চিত্রের একজন মেধাবী শিৰক। কিন্তু এদেশে ছায়াছবির জগতের অর্থলোভী ব্যবসায়ীরা সর্বদাই তার বিরোধিতা করেছেন। আলমগীর কবীরের স্বপ্ন ছিল, এদেশে একদিন একটি পূর্ণাঙ্গ ফিল্ম ইনস্টিটিউট গড়ে উঠবে। তিনি তার এ স্বপ্নের কথা আমাকে বহুবার বলেছেন। দুর্ঘটনায় তার আকস্মিক মৃতু্য বাংলাদেশে সুস্থধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের ৰেত্রে এক বিরাট ৰতি।
তবু এদেশের চলচ্চিত্র জগতে এত অনাচারের পরও মহৎ চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। সরকারী সহযোগিতা ছাড়া এ ব্যাপারে এতটুকু অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি ঢাকায় একাদশ আনত্মর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব উদ্বোধন করতে গিয়ে দেশের চলচ্চিত্রের মান নিম্নগামী বলে মনত্মব্য করেছেন। এছাড়া তিনি দেশে শিৰিত চলচ্চিত্রকার ও দৰ টেকনিশিয়ান গড়ে তুলতে একটি পূর্ণাঙ্গ ফিল্ম ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন। দেরিতে হলেও তার এ ঘোষণা এদেশের চলচ্চিত্র বিষয়ে আমাদের কিছুটা আশাবাদী করেছে। আমি মনে করি, সিনেমার মতো একটি অতিশয় শক্তিশালী শিল্প মাধ্যম বিষয়ে সরকারের সার্বৰণিকভাবে অনেক কিছু করার রয়েছে। কিন্তু এদেশের প্রায় প্রতিটি সরকার চলচ্চিত্রকে অবহেলা করেছে। চলচ্চিত্র যেহেতু একটি সাংস্কৃতিক মাধ্যম, তাই একে অবিলম্বে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের আওতায় নিয়ে আসা দরকার। শিল্পকলা একাডেমীতে নাটকের জন্য হল আছে কিন্তু চলচ্চিত্র প্রদর্শনের কোনো ব্যবস্থা এখানে নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমার অনুরোধ, চলচ্চিত্রকে অবিলম্বে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনা হোক। শিল্পকলা একাডেমীতে চলচ্চিত্রবিষয়ক নানা ধরনের প্রশিৰণের আয়োজন করা যেতে পারে। এবং কলকাতার 'নন্দন'-এর মতো এখানে এমন একটি হল নির্মাণ করা দরকার, যেখানে বিশ্বের সেরা চলচ্চিত্রসমূহ দর্শনীর বিনিময়ে প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকবে।
সরকার যদি পদৰেপ গ্রহণ না করে, তবে এখানকার সিনেমায় অপরাধীচক্রের দখল অব্যাহত থাকবে। তারা নিজেদের লুটপাটের ব্যবসা অব্যাহত রাখতে এবং জনগণকে বিপথগামী করতে এদেশে সিনেমা নিয়ে স্বেচ্ছাচার অব্যাহত রাখবেন। তারা বন্ধনহীন, তারা অর্থের বিনিময়ে সব ৰমতাসীন ব্যক্তিকেই পকেটে পুরে রেখেছেন। প্রায়ই ভাবি, এদেশে কি আর সিনেমা হলে যাওয়া সম্ভব হবে না এইসব অপরাধীদের জন্য? অথচ এদেশে বলাকা, গুলিসত্মানসহ অনেক সিনেমা হলেই আমার কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। রাজশাহীর অলকা ও কল্পনা, সিরাজগঞ্জের লক্ষ্মী ও মমতাজ, নাটোরের মিনার, কুষ্টিয়ার রক্সী ও বনানী, খুলনার পিকচার প্যালেস, পাবনার রূপকথা, ময়মনসিংহের অলকা প্রভৃতি সিনেমা হলে শৈশব ও কৈশোরে কত ছবি দেখেছি। এসব সিনেমা হলকে আমার কাছে শিৰালয়ের মতো পবিত্র বলে মনে হয়। কারণ সিনেমা দেখে আমার চেতনায় যে এক অলৌকিক রূপানত্মর ঘটেছে তা আর অন্য কোনো মাধ্যমে সম্ভব নয়। সুইডিশ চলচ্চিত্র পরিচালক ইঙ্গমার বার্গম্যান তাই সিনেমা হলকে খ্রীস্টানদের প্রার্থনাগৃহের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। তিনি হয়ত সিনেমা দেখাকে ধ্যানের মতো একনিষ্ঠ উপাসনা বলে বিবেচনা করেছিলেন। দেশের ঐতিহ্যবাহী পুরনো সিনেমা হলগুলোকে সংরৰণের জন্যে আমি কতর্ৃপৰের কাছে আবেদন জানাচ্ছি_ এগুলো আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অঙ্গ।
তবে সবার আগে দরকার আমাদের চলচ্চিত্রকে লুটেরা ব্যবসায়ীদের কবল থেকে রৰা করা। চলচ্চিত্রকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতায় নিয়ে আসা এবং এই শক্তিশালী ও স্পর্শকাতর মাধ্যমের ওপর সর্বৰণিক নজরদারি প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের দেশে পূর্ণাঙ্গ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় গড়ে উঠবে কি ? মাঝে মাঝে মনে হয়, জীবনের মূল সত্য কি আমরা অবলোকন করি ? মহান জাপানী চলচ্চিত্রকার আকিরা কুরোশাওয়ার 'রশোমন' নামের কালজয়ী চলচ্চিত্রের কথা মনে পড়ে। ছবিতে দেখানো হয়েছে জীবনের সত্য আসলে আপেৰিক; প্রতিটি মানুষের কাছে জীবনের রূপ ভিন্ন রকম। বিশেষ করে আমি দেশের প্রতিটি রাজনীতিককে এই মহৎ সিনেমাটি দেখার অনুরোধ জানাচ্ছি। বাংলাদেশে চলচ্চিত্র নিয়ে রম্নচিহীনতা ও আত্মধ্বংসের বাণিজ্য কবে বন্ধ হবে ?
No comments