এমন একটা দল দে না!- খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
দেশের গান শুনছিলাম, 'এমন একটা মা দে না, যে মায়ের সন্তানেরা কাঁদতে আবার হাসতে জানে'। বাংলা মায়ের কথাই গানে বলা হয়েছে। বাংলা মায়ের দামাল সন্তানেরা মাতৃমুক্তির প্রত্যয়ে মুক্তিযুদ্ধে হাসতে হাসতে প্রাণ দিয়েছে।
আবার ভাই হারানোর ব্যথায় কেঁদে উঠেছে। মনে মনে প্যারোডি বানিয়ে গাইতে লাগলাম, 'এমন একটি দল দে না, যে দলের সদস্যরা জিততে আবার হারতে জানে!' কোন দল ভোটের মাধ্যমে জিততে জানে। কোন দল অস্ত্রের জোরে সন্ত্রাস করে জিততে জানে। কোন দল আবার ভোট কারচুপি করে জিততে জানে। জেতার পর মতায় গিয়ে সব দলই খুশি। কিন্তু অনেক দলই হারতে জানে না। অর্থাৎ হেরে গিয়ে হার মানতে সম্মত হয় না। বরং হারকে অস্বীকার করে। দেশ-বিদেশে স্বীকৃত সুষ্ঠু নির্বাচনকেও মানতে চায় না হারার পর। হেরে গিয়ে বিরোধী দলের দায়িত্ব পালনেও অনীহা তাদের। সংসদে অংশগ্রহণের জন্য জনগণের ভোট ভিা করে এবং বিজয়ী হয়েও তারা অঙ্গীকার রা করে না। সংসদ বর্জন করে শুধু দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতাই প্রকাশ করে না, বরং ভোটদাতা জনগণকে অবমাননা করে। এক পর্যায়ে ঝুঁকে পড়ে রাস্তার চিৎকারে, অস্ত্রের মহড়ায়, বোমাবাজির নৃশংসতায়। এভাবে তারা জনগণকে শাস্তি দেয় ভোট না দেয়ার অপরাধে। মানুষ হত্যা করে যারা হারের প্রতিশোধ নিতে চায়, তারা গণতান্ত্রিক দল নয়, বাংলামায়ের মাতৃভক্ত সন্তান নয়। এরা মাতৃহন্তা, যেমন একাত্তরে ছিল রাজাকার-আলবদরেরা। এরা গ্রেনেড ছুড়ে উল্লাস করতে জানে, ভ্রাতৃহত্যায় কাঁদতে জানে না। না, এমন দল আমরা চাই না। আমরা এমন একটা দল চাই, যারা জিততে এবং হারতে জানে। উভয় অবস্থাতে গণরায় মেনে নেয়। যারা জয়ী হয়ে সরকারের দায়িত্ব পেলে নম্রতা প্রদর্শন করে। হেরে গিয়ে বিরোধী দলের দায়িত্ব পেলে ভদ্রতা বজায় রাখে। জনগণকে আস্থায় রেখে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির মধ্যে কর্ম পরিচালনা করে।গণতন্ত্র চাই, অথচ গণতন্ত্রের রীতিনীতি মেনে চলব না_ এমনটা তো হতে পারে না। দেশের গণতান্ত্রিক দল হতে হলে গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনে চলার মানসিকতা থাকতে হবে। ভুল হতে পারে, কিন্তু ভুল স্বীকার করে পুনরায় পথ চলতে হবে।
বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে, আমরা হোঁচট খাচ্ছি কেন? আমরা মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েই কিন্তু হাঁটতে শিখি না। পা দুটো একটু শক্ত হলে দাঁড়াতে চেষ্টা করি। হোঁচট খাই. পড়ে যাই. আবার দাঁড়াতে চাই। আবার আছড়ে পড়ি। এমনি প্রচেষ্টার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দাঁড়াতে শিখি। তারপর মায়ের হাত ধরে বা দেয়ালে হাত রেখে পা চালাতে চেষ্টা করি। এমনি করে আমরা সবাই হাঁটতে শিখেছি। কিন্তু দু'-একবার আছড়ে পড়ার পর যদি সিদ্ধান্ত আসে_ "শিশু হাঁটতে অম, বার বার হোঁচট খেলে পা ভেঙ্গে যাবে, বিকলাঙ্গ হয়ে পড়বে। অতএব শিশুকে দড়ি দিয়ে বিছানায় বেঁধে রাখতে হবে। তাহলে পা ভাংবে না। বিকলাঙ্গ হবে না"। ঐ শিশু কোনদিন আর হাঁটতে শিখবে না। হাঁটতে শিখতে হলে দু'টি পায়ে (এক পায়ে নয়) ভারসাম্য বজায় রাখার দতা রফ্ত করতে হয়। তাও সে অর্জন করবে না। ফলে শিশু ধীরে ধীরে শারীরিক শক্তি অর্জন করলেও দু'পায়ে ভারসাম্য রার চর্চা না থাকায় আছড়ে পড়বে। দোষ কি শিশুর, নাকি পালনকারীর?
সংসদীয় গণতন্ত্র দু'পায়ে হাঁটা শেখার মতো। সংসদীয় গণতন্ত্রে দু'পায়ের মতো দু'টি প্রধান দল থাকে। প্রথম পর্যায়ে বহু দলের সমন্বয়ে দু'টি গ্রুপ থাকতে পারে, যা ধীরে ধীরে সংহত শক্তিতে, এমনকি দু'টি দলে পরিণত হয়। প্রথম পর্যায়ে গ্রুপ থাকলেও গ্রুপের একটি প্রধান চালিকা দল থাকে। তাকে কেন্দ্র করেই গ্রুপ গড়ে ওঠে ও সংহত হয়।
আমাদের প্রথম স্বাধীন দেশটি ছিল পাকিস্তান। দেশটিতে গণতন্ত্র চর্চা করতে দেয়া হলো না। পেশীশক্তি আর অসিশক্তি দেশটির ঘাড়ে সওয়ার হয়ে বসল। আইউব খান আর ইয়াহিয়া খান পর্যায়ক্রমে দেশটির শিরদাঁড়া ভেঙ্গে দিল। মার্শাল ল' দিয়ে দেশ দখল তারপর সেনাছাউনিতে বসে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে একটি তাঁবেদার দল গঠন করে নির্বাচনে কারচুপি করে 'গণতন্ত্রের লেবাস' পরানো হয়। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন করতে পারলেও সামরিক তরিকা থেকে স্বাধীন হওয়া যায়নি। ৭৫ সাল পর্যন্ত ভাল হোক, মন্দ হোক_ গণতান্ত্রিক সরকার ছিল। পঁচাত্তরে পাকিস্তানী ভূত চেপে বসল বাংলাদেশের ঘাড়ে। আইউব খানের আদলে জিয়াউর রহমান আবির্ভূত হলেন। সেনাধ্য হিসাবে সরকারী চাকুরে থেকে 'হাঁ'-'না' নির্বাচনের প্রহসন করে মতা দখল পোক্ত করলেন। তার মর্মন্তুদ হত্যার পর উদয় হলেন এরশাদ। জিয়া সেনাছাউনিতে বসে গড়েছিলেন প্রথমে জাগদল, পরে জাতীয়তাবাদী দল। একই প্রক্রিয়ায় এরশাদ মতারোহণ করে গড়লেন জাতীয় পার্টি। দু'পার্টিরই মতা এক হাতে; জাল ফেলা হয়েছে জনতার মাঝে; খাদ্য-খোরাক দিয়ে লোক ধরার জন্য। এ জন্মগত ত্রুটির জন্য দল দু'টি জনতার রাজনৈতিক দলের রূপ পেলো না। হয়ে উঠল ষড়যন্ত্র কার্যকর করার হাতিয়াররূপে। তবে আওয়ামীবিরোধী মানসিকতার সাধারণ মানুষও এসব দলে ধীরে ধীরে অবস্থান নেয়। গণচরিত্রও লাভ করে। কিন্তু ঘুড়ির নাটাই ধরা রয়েছে এক হাতে, যে হাত থেকে ষড়যন্ত্র মুছে যায়নি।
এমন অবস্থায় অনেক সংগ্রাম করে একানব্বইতে গণতান্ত্রিক চর্চা শুরু করা হলো। কিন্তু জ্বীনের আছর তখনও কাটেনি। ভুয়া ভোটারের ভুতুড়ে তালিকা থেকে নির্বাচন মুক্ত হলো না। তবু একটা সূচনা হলো। পর পর দু'টি নির্বাচনে পালাবদল হলো। তৃতীয়বার থেকে ষড়যন্ত্র পোক্ত হতে শুরু করল। ততণে জামায়াতে ইসলামী জনপ্রিয় দল বিএনপির ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে। বদজ্বীনের আছরের মতো। চারদলীয় জোট মতায় গিয়ে সকল গণতান্ত্রিকতা বিসর্জন দিয়ে হত্যা, লুণ্ঠন, সন্ত্রাসের মাধ্যমে জনগণের টুঁটি চেপে ধরল। আওয়ামী লীগ কমর্ীদের ঘরছাড়া করল, হত্যা-নির্যাতন করল। সংখ্যালঘুদের বাস্তু ভিটাছাড়া করে ভারতে পালাতে বাধ্য করলো। সংখ্যালঘুদের হত্যা, নির্যাতন, অগি্নসংযোগ, বলাৎকারসহ অমানুষিক অত্যাচারে জর্জরিত করে ফেলল। সেই সঙ্গে মাঠে নামালো হুজিসহ সন্ত্রাসীদের। তাদের পরিয়ে দেয়া হলো ধর্মের মুখোশ।
নব্বই-এ আন্দোলনের ফলে গণতন্ত্র শিশুটি আছাড় খেয়ে খেয়ে দাঁড়াতে শেখার যে কঠিন অনুশীলন শুরু করেছিল, তার পরিসমাপ্তি ঘটাল জামায়াতনির্ভর চারদলীয় জোট। অস্ত্র-বোমা-গ্রেনেডতন্ত্রের মহড়ায় গণতন্ত্রের অপমৃতু্য ঘটল। ২১ আগস্ট গ্রেনেড বৃষ্টি, রমনার বটমূলে বোমা হামলা, কোটালীপাড়ায় বোমা হামলার মহড়া, কিবরিয়া হত্যা, ব্রিটিশ হাইকমিশনার হত্যাচেষ্টা_ এ সবই এক সুতোয় গাঁথা। একই ষড়যন্ত্রের প্রকাশ, একই মোর্চার পৃষ্ঠপোষকতা। রাষ্ট্রযন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতায় যখন সন্ত্রাস হয় তখন গণতন্ত্র, নিয়মতান্ত্রিকতা বলে কিছু থাকে না। স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি এহেন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর পরো এমনকি প্রত্য সমর্থনের জন্য 'সুশীল সমাজে' লোকের অভাব হয়নি। বুদ্ধিজীবীদের একাংশের বুদ্ধি যোগ হয়েছিল সন্ত্রাস বিকাশে। চালিকাশক্তি ছিল অর্থ, বিত্ত ও লুটপাটের সুযোগ সৃষ্টি।
২০০৭ সালে গণতন্ত্র শিশুটির লাশের ওপর এবং সন্ত্রাসের ত্রাসের মধ্যে জরুরী আইন জারি হলো। কাঙ্তি ছিল না কিন্তু প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনেক দোষ পাওয়া যাবে। কিন্তু চারদলীয় নারকীয় কাণ্ডের কাছে তা ছিল নস্যি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারে আওয়ামী সমর্থক একজন উপদেষ্টাও ছিল না। অনেকেই বিএনপি সমর্থক। কেউ কেউ ঘোর আওয়ামীবিরোধী। দু'-একজন দলীয় মতামতের বাইরের মানুষ। তবে ঐ ধরনের বিএনপি সমর্থক বা আওয়ামী বিদ্বেষীদের নিয়ে মাথাব্যথার কারণ নেই। কারণ তারা সন্ত্রাস পালনকারী নন। ভিন্নমত ধারণের অবকাশ গণতন্ত্রে থাকবেই। অবশ্যই থাকবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বড় অবদান, সেনা সহায়তায় সোয়া কোটি ভুয়া ভোটার চিহ্নিত করা এবং একটি গ্রহণযোগ্য ভোটার তালিকা প্রণয়ন। সবশেষে সর্বাধিক ভোটারের সমাগম ঘটিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের কৃতিত্ব সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে দিতেই হবে।
২০০৯ থেকে পুনর্জন্মপ্রাপ্ত গণতন্ত্র শিশুটির দাঁড়ানো এবং হাঁটা শেখা পুনরারম্ভ হলো। যারা সন্ত্রাসতন্ত্র চায় তারা মতায় না থাকলেও শক্তিশালী। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নস্যাৎ করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। পঁচাত্তর থেকে গড়ে ওঠা হোন্ডাগুণ্ডা বাহিনী, অর্থ-বিত্ত, বোমা-গ্রেনেড, বিদেশী কানেকশন এসব বেশ সংহত। এর বিপরীতে জনসংহতিই বড় অস্ত্র। জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য এবং জনসংহতি দুর্বল করার জন্য মিথ্যা প্রচার ভালভাবেই চলছে। বুদ্ধি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন এমন বুদ্ধিজীবী শ্রেণী প্রচারণার মাধ্যমে জনগণকে প্রতারণার কাজে বেশ সিদ্ধহস্ত। তাঁরা জোরেশোরে মাঠে নেমেছেন। কাজেই প্রচারণার েেত্রও নীরব থাকার অবকাশ নেই।
শেষ কথা, সংসদীয় গণতন্ত্রে দু'টি গ্রহণযোগ্য দল বা গ্রুপ থাকতেই হয়। আওয়ামী লীগকেন্দ্রিক জোট জনতার মধ্য থেকে গড়ে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পরীতি। এখন দ্বিতীয় দল/গ্রুপটি প্রয়োজন। পঁচাত্তরের মরণখেলা না হলে এতদিন দ্বিতীয় দল দাঁড়িয়ে যেত। বিদেশ থেকে সুতা-টানা পুতুল দল এতটা সংঘবদ্ধ হতে পারত না। এখন তাই গুনগুনিয়ে গাইতে থাকব, 'এমন একটা দল দে না, যে দলের সদস্যরা জিততে আবার হারতে জানে।'
লেখক : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকার
No comments