উত্তরাঞ্চলে মানুষ সঙ্কটে ॥ একদিকে পেটের চিন্তা, অন্যদিকে শীতবস্ত্রের অভাব
আকাশে উঁকি মারছে না সূর্য। তাই শরীরও কাঁপছে। ঘরের বাইরে বেরিয়ে আগুন পোহাচ্ছে দরিদ্র লোকজন। তীব্র শীতের সঙ্গে বসবাস করার অভ্যস্ত না থাকা উত্তরাঞ্চলের রংপুর বিভাগের আট জেলার জনগোষ্ঠী কাহিল হয়ে পড়েছে।
হিমালয়ের গর্ভে থাকা এ অঞ্চলের মানুষজন এই প্রথম হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে শীতের কামড়। ফলে তীব্র শীতের দাপটে বিশেষ করে দিন এনে দিন খাওয়া কায়িক শ্রমিক পরিবারগুলো পড়েছে বিপর্যয়ে। একদিকে শীতবস্ত্রের অভাব অন্যদিকে কাজে যেতে না পারায় খাদ্য কষ্ট। এ যেন তাদের কাছ মহা দুর্যোগ। মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ৪২ বছরের মধ্যে পর পর দুই দিন ধরে দেশের সর্বনি¤œ তাপমাত্রায় থেকে আরেকটি রেকর্ড গড়ল সৈয়দপুর। আবহাওয়া অধিদফতর উত্তরাঞ্চলীয় জেলা নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার বিমানবন্দর আবহাওয়া কেন্দ্র থেকে শুক্রবার সর্বনি¤œ তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস। যা বৃহস্পতিবার ছিল ৩ ও বুধবার ছিল ৩ দশমিক ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। সে ক্ষেত্রে তাপমাত্রা সামান্য ১ ডিগ্রী বৃদ্ধি পেলেও কনকনে শীতের দাপট একই ধরনের রয়ে গেছে। এর আগে দেশের আর কোথাও পর পর দুই দিন ধরে সর্বানিম্ন তাপমাত্রা ছিল না বলে জানা যায়।অপর দিকে রংপুর বিভাগের অন্যান্য জেলায় শুক্রবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল নীলফামারী ও কুড়িগ্রাম ৪ দশমিক ৯, লালমনিরহাটে ৫, ঠাকুরগাঁয়ে ৪ দশমিক ২, গাইবান্ধায় ৫ দশমিক ১, পঞ্চগড়ে ৫ দশমিক ২, দিনাজপুরে ৪ দশমিক ৫ ও রংপুরে ৪ দশমিক ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। আবহাওয়া অফিস এ তথ্য নিশ্চিত করে জানায় শীতের তীব্রতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে।
পর পর দুদিন দেশের সর্বনিম্ন তাপামাত্রা বিরাজ করায় উত্তরের বাণিজ্যিক ও রেলওয়ে শহর সৈয়দপুর ও আশপাশের এলাকায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। অব্যাহত তীব্র শীতে মানুষ কাহিল হয়ে পড়েছে। শরীরে হুল ফোটানে শীত আর ঘনকুয়াশা ও উত্তরের হিমেল হাওয়া মানুষকে সবচেয়ে বেশি কাবু করে। তীব্র শৈত্যপ্রবাহ আর কনকনে শীতে জনজীবন যেন থমকে দাঁড়িয়েছে এখানে। শুক্রবার দুপুরে সূর্য উঠলেও সেই সুর্যের আলো বেশিক্ষণ স্থায়ী ছিল না।
রংপুর বিভাগের আট জেলা থেকে খবর নিয়ে জানা যায়, এ ধরনের তীব্র শীতে এ অঞ্চলের মানুষজন কখনও অভ্যন্ত ছিল না। ফলে এমন শীত মোকাবেলা করা বিশেষ করে নিম্নআয়ের পরিবারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বাধ্য হয়ে তাদের শীত নিবারণে জন্য আগুনের ক-ুলীর ওপর ভরসা করতে হচ্ছে।
এ ছাড়া স্মরণকালের হাড় কাঁপানো শীতে এখন দিনমজুর শ্রেণীর মানুষের জনজীবন অনেকটাই দুর্বিষহ। তারা এখন উভয় সঙ্কটে পড়েছেন। একদিকে পেটের ভাতের চিন্তা, অন্যদিকে তীব্র শীত মোকাবেলার।
সৈয়দপুর উপজেলার উপজেলা কাশিরাম বেলপুকুর ইউনিয়নে ব্রহ্মোত্তর গ্রামের দিনমজুর গোলজার হোসেনের (৫৫) মতে তার জন্মেও এমন শীত দেখেননি। ঠা-ায় কাজে যেতে পারছেন না। হাতে টাকা না থাকায় চাল, ডাল, আলু কিনতে পারছে না। সংসারের ৪ জন মানুষ নিয়ে তার বড়ই কষ্ট। তাই বাধ্য হয়ে গ্রামের এক অবস্থাসম্পন্ন কৃষকের কাছে আগাম শ্রমের টাকা নিয়ে চালডাল কিনেছেন।
সৈয়দপুরে শহরে রিক্সাচালক ইদ্রিস আলী (৪৮)। দুপুরে তাঁর সঙ্গে কথা হয় সৈয়দপুর শহরের ১২ নম্বর রেলওয়ে ঘুণ্টির রিক্সাস্ট্যান্ডে।
তিনি জানান, দুই দিনের চরম শীতে আয় রোজগাড় নেই। মানুষজন বাসাবাড়ি থেকে বের হচ্ছে না। শহরে মানুষের চলাচল নেই। দুদিনে রিক্সা চালিয়ে আয় হয়েছে ২৫ টাকা। এক কেজি মোটা চাল ২৪ টাকা, আলু ২৫ টাকা। আর তেল, নুন (লবণ), মরিচ তো আছে। কিভাবে চলবে সংসার। শীত সব কিছু কাবু করে দিয়েছে। শীতবস্ত্রের কথায় এই রিক্সা চালক বলেন, তার স্ত্রী ও সন্তানের জন্য লা-ার বাজারে সোয়েটার কিনতে গিয়ে তিনি পালিয়ে এসেছেন। কারণ যে সোয়েটারের দাম ছিল ২৫ টাকা তা এখন ২শ’ টাকা দাম হাকিয়েছে।
সৈয়দপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শফিকুল ইসলাম জানান, শীতে অসহায়, গরিব, দুস্থ মানুষেরা চরম দুর্ভোগে দিন কাটাছেন। সরকারীভাবে যে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে তা অপ্রতুল। শীতার্তদের দুরাবস্থার কথা চিন্তা করে উপজেলা পরিষদের জরুরী সভা করে এডিবির অর্থে ২ হাজার পিস কম্বল কিনে শীতার্তদের মাঝে বিলি করা হয়েছে বলে জানান। তিনি সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তশালীদের শীতার্তদের পাশে দাঁড়ানো আহ্বান জানান।
নীলফামারী চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আব্দুল ওয়াহেদ বলেন, হিমালয়ের হিম গর্ভে অবস্থান রংপুর বিভাগের আট জেলা এখন দার্জিলিংয়ের শীতের মতো এক হয়ে গেছে। এমন আবহাওয়ার সঙ্গে এ অঞ্চলের মানুষজন কোনভাবেই কখনও অভ্যস্ত ছিল না। যার প্রভাবে এলাকার মানুষজন নিদারুণ কষ্টভোগ করছে। চেম্বারের সভাপতি আরও বলেন, এখন নিম্নআয়ের পরিবারগুলোকে শীতবস্ত্রের পাশাপাশি খাদ্য বিতরণও করতে হবে। এ জন্য সরকারী বা বেসরকারীভাবে জরুরীভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
শীতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শীত পোশাকের দাম ॥ এদিকে শীতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শীত পোশাকের দাম। ফুটপাথসহ বিপণি-বিতানগুলোতে শীতের পোশাক বিক্রি হচ্ছে দেদার। সুযোগ বুঝে পোশাকের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন বিক্রেতারা। শীতবস্ত্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে কম্বল, কানটুপি ও মাফলারসহ আনুষাঙ্গিক পোশাক। শীতের লা-াবাজার নামে পরিচিত পুরান কাপড়ের হাটে মানুষের উপচেপড়া ভিড় থাকলেও দাম বেশি হওয়ায় অনেকে তা ক্রয় করতে পারছে না। এ ছাড়া ইলেক্ট্রনিকস দোকানগুলো থেকে রুম হিটার বিক্রি হচ্ছে দেদার। দাম বৃদ্ধি পেয়ে ২ হাজার ওয়ার্ডের একটি রুম হিটার বিক্রি হচ্ছে আড়াই হাজার টাকায়।
অসহায় মানুষের ভরসা আগুনের পরশমণি ॥ আকাশে উঁকি মারছে না সূর্য। তাই শরীরও কাঁপছে। ঘরের বাইরে বেরিয়ে আগুন পোহাচ্ছে দরিদ্র লোকজন। এ অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার চোখে পড়বে এমন দৃশ্য। একটু উষ্ণতা পেতে পথের পাশে কাগজ কিংবা ছেঁড়া কাপড়-খড়কুটো পুড়িয়ে দরিদ্ররা দল বেঁধে আগুন জ্বালাচ্ছে। কোন কোন দলে আছে চার-পাঁচ জন, কোথাও বা সংখ্যাটা আরও বেশি। নারী-পুরুষ-শিশু এক কাতারে, আগুনের চারপাশে ভিড় করছে সবাই। একটু উষ্ণতা চায় ওরা। ঠা-া অনেক বেশি। শীত থেকে বাঁচার পোশাকও তেমন নেই। এ জন্যই বাইরে এসে আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে শীত তাড়াচ্ছেন।
No comments