কিবরিয়া হত্যা_ শিবিরের সম্পৃক্ততা নিয়ে ফের আলোচনার ঝড়- ৫ বছরেও বিচার হয়নি by রফিকুল হাসান চৌধুরী
তুহিন, হবিগঞ্জ থেকে আজ সেই ২৭ জানুয়ারি। হবিগঞ্জের ভয়াল এক সন্ধ্যা-রাতের বৈদ্যের বাজার ট্র্যাজেডি। আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা ও মাটি-মানুষের প্রাণপ্রিয় ব্যক্তিত্ব সাবেক সফল অর্থমন্ত্রী শামস্ কিবরিয়া হত্যাকা-ের ৫ম বর্ষপূতি, যা কখনও ভোলার নয়, বাংলাদেশের মানুষ তা ভুলতেও পারবে না। এদিন হবিগঞ্জের ওই স্থানের মাটিতে ঘাতকরা ঘটায় এমনই এক নির্মম পৈশাচিক হত্যাকা-।
সৃষ্টি করা হয়েছিল বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বে ইতিহাসের আরেক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা। অথচ ওই ট্র্যাজেডির সঙ্গে এক সাবেক ডিসির পাশাপাশি জামায়াতের ছাত্র সংগঠন শিবির ক্যাডারের সম্পৃক্ততা নিয়ে হবিগঞ্জে শুরম্ন হয়েছে নতুন করে এক আলোচনার ঝড়। শুধু তাই নয়, দীর্ঘ এ সময় পেরিয়ে বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলেও এই হত্যাকা-ের মোটিভ, মামলার প্রকৃত তদনত্ম ও আসামি শনাক্তকরণসহ বিচার কাজের অগ্রগতি না হওয়ায় সাধারণ মানুষের মাঝে দেখা দিয়েছে চরম হতাশা ও ােভ।২০০৫ সালের এই দিনে একদল দুষ্কৃতকারী হবিগঞ্জের বৈদ্যের বাজার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীর গেটে গ্রেনেড ছুড়ে সাবেক অর্থমন্ত্রী শামস্ কিবরিয়াকে নির্মমভাবে হত্যা করে। আর এ ঘটনায় নিহত হন সাবেক অর্থমন্ত্রী অতিপ্রিয় আপনজন ও সকল সময়ের সফর সঙ্গী ভাতিজা শাহ মঞ্জুর হুদাসহ হতদরিদ্র ৩ আওয়ামী লীগ কর্মী আবুল হোসেন, সিদ্দিকুর রহমান ও আব্দুর রহিম। আহত হন আওয়ামী লীগ নেতাকমর্ীসহ অনত্মত ৭০ জন। এদের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুলস্নাহ সরদারসহ বেশ কয়েকজন এখন পর্যনত্ম পঙ্গুত্ব অবস্থায় জীবন সংগ্রামে অবতীর্ণ। তবে পুরো দেহে অসংখ্য স্পিস্নন্টার নিয়ে তীব্র যন্ত্রণায় ভরপুর হবিগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা এ্যাডভোকেট আবু জাহির জনগণের ভোটে সিলেট বিভাগে রের্কড সৃষ্টিকারী একমাত্র ব্যক্তিত্ব এখন হবিগঞ্জ সদর-লাখাই আসনের এমপি। তারপরও তিনি শারীরিকভাবে শঙ্কামুক্ত নন। অথচ দীর্ঘ ৫ বছরেও এমন এক নির্মম হত্যাকা-ের বিচার শুরম্ন না হওয়ায় সাধারণ মানুষের মাঝে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে ােভ ও হতাশা। হবিগঞ্জের সাধারণ মানুষের মনে এখন শুধু একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, দেশবাসী ও নিহত শামস কিবরিয়া পরিবারের দাবি উপো করে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট ও ১/১১-এ আসা তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ওই আলোচিত হত্যাকা-ের বিচার নানা অজুহাতে করা না হলেও জনগণের বিপুল ভোটে আসা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারও কি গেল এক বছরে তেমন কোন জোরালো উদ্যোগ নিতে পারল না, তার হেতুইবা কি?
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ নেতা এ্যাডভোকেট আবু জাহির এমপি জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমান সরকারসহ তার নিজেরও নির্বাচনী প্রতিশ্রম্নতি ছিল কিবরিয়া হত্যাকা-ের বিচার সম্পন্ন করা। আর সে কারণেই সরকার কিবরিয়া হত্যা মামলাটির কার্যক্রম নতুন করে হাতে নিয়েছে। তিনি জনকণ্ঠকে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে আশ্বসত্ম করে জানান, এ বছর লাগবে না, কয়েক মাসের মধ্যেই সুষ্ঠু তদনত্মের মাধ্যমে কিবরিয়া হত্যার বিচার সম্পন্ন হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের গেল এক বছরের মধ্যে এই বিচার কাজ সম্পন্নের কোন অগ্রগতি বা এক রকম উদ্যোগ নেয়া কেন হলো না_ এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রশাসনিক জটিলতা, লালফিতার দৌরাত্ম্যসহ নানা কারণে তা সম্ভব হয়নি। তবে ওই হত্যাকা-সহ তাঁকে তবিত করার জন্য বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানসহ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আরও কতিপয় ব্যক্তির হাত থাকার কথা উলেস্নখ করে, আসছে তদনত্মে হত্যাকা-ের প্রকৃত মোটিভ উদ্ঘাটন ও মূল হোতাদের শনাক্তকরণ সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এমনকি জামায়াত-শিবিরের কেউ যুক্ত থাকার কথা উড়িয়ে না দিয়ে তাও বের হবে বলে প্রত্যাশা করেন।
অপরদিকে সাবেক অর্থমন্ত্রী শামস্ কিবরিয়ার বিধবা পত্নী আছমা কিবিরিয়া জনকণ্ঠের এ প্রতিনিধিকে ওই পৈশাচিক হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত প্রকৃত আসামি শনাক্তকরণসহ বর্তমান সরকারের আমলেও বিচার কাজ না হওয়া নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তাঁর স্বামী হত্যার বিচার আদৌ হবে কিনা এ নিয়ে শংসয় প্রকাশ করেন। তবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো তাঁর মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও একই রকম শ্রদ্ধা করেন বলে তিনি কিবরিয়াসহ অন্যান্য হত্যার বিচার বর্তমান সরকারের আমলে হবে বলে আশা প্রকাশ করে অপো ছাড়া আর কোন পথ নেই বলে হতাশা প্রকাশ করেন। তিনি হবিগঞ্জের সাবেক ডিসি এমদাদুল হকের ওই হত্যাকা-ের সঙ্গে যুক্ত বলে আবারও দাবি করে বলেন, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে বলে শুনেছি, তবে কতটুকু সত্য তার প্রমাণ নেই। জামায়াত শিবিরের কোন ক্যাডার যুক্ত নিয়ে তাঁর স্পষ্ট মতামত দিয়ে বলেন, তখনকার সময়ের সকল কিছু তী্নভাবে পর্যবেণ করা হলেই তা বেরিয়ে আসবে। তাঁর পরিবারকে আওয়ামী লীগ মতায় এসে কেন একপেশে করে রেখেছে এমন প্রশ্নের জবাব তিনি এড়িয়ে বলেন, এটা হবিগঞ্জবাসীসহ সাধারণ মানুষের বিষয়। এদিকে কিবরিয়া হত্যার কার্যক্রমের অগ্রগতি ও প্রকৃত হোতাদের শনাক্তকরণ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মামলার বর্তমান তদনত্মকারী কর্মকর্তা সিআইডির এএসপি রফিকুল ইসলাম জনকণ্ঠের এ প্রতিনিধিকে জানান, ইতোমধ্যে আমরা কিবরিয়া হত্যার কু উদ্ঘাটন করতে পেরেছি। হরকত-উল-জিহাদ নেতা মুফতি হান্নান, আবু জানদাল, মহিবুল অভি, বদরম্নল আলম মিজান, সায়েদুল আলম বিপুল ও নাইম আহমেদ আরিফের নাম বেরিয়ে এসেছে। অচিরেই তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে এ বিচার কাজ সম্পন্ন হবে বলে আশা করি। তবে এরই মধ্যে কোন নতুন নাম আসতেও পারে। হবিগঞ্জের এক শিবির ক্যাডার জড়িত থাকার বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযুক্ত হবিগঞ্জের সাবেক ডিসি (বর্তমানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আইন কর্মকর্তা) এমদাদুল হককে ইতোমধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
তিনি বলেছেন, ওই হত্যাকা-ের সময়ে ডিসি থাকা অবস্থায় তার কিছু ভুলত্রম্নটি থাকতে পারে। কিন্তু ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তার এ বক্তব্য খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কিবরিয়া হত্যার মতো নির্মম একটি ঘটনার বিচার কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্নের জন্য তার সকল প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এদিকে হবিগঞ্জে শিবিরের রাজনীতি ও বতমানে একটি মৌলবাদী জাতীয় দৈনিক ও টিভি চ্যানেলের সঙ্গে যুক্ত 'ম' আদ্যরের নামধারী এক তরম্নণ আইনজীবীর তখনকার কর্মকা- নিয়ে নতুন করে সর্বত্র বইছে আলোচনা। কিবরিয়া হত্যার সময় তাকে তখন দেখা গেছে, সেই বৈদ্যের বাজার, হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতাল এবং সর্বোপরি ঢাকার বারডেম হাসপাতালে, যখন কিবরিয়াকে মুমূষর্ু অবস্থায় সেখানে প্রবেশ করানো হয়। টিভির পর্দায়ও তখন তাকে দেখা গেছে। এই শিবির ক্যাডারের বিরম্নদ্ধে রয়েছে হবিগঞ্জে একাধিক মামলা। সে অত্যনত্ম চতুর হিসেবে পরিচিত। প্রশ্ন উঠেছে, এই শিবির ক্যাডার কিবরিয়া পরিবারের কোন আত্মীয়স্বজনও নয়। অথচ ভিন্ন এক রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী এই ক্যাডারকে তখন কিবরিয়ার পাশে বার বার কেন সাধারণ মানুষের চোখে পড়েছিল। তারপরও এত বছর যাবত কিবরিয়া হত্যা মামমলার তদনত্মে তার নাম আসা তো দূরের কথা জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়নি। হবিগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের ধারণা, ওই ক্যাডারকে জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনা হলে হয়ত ওই হত্যাকা-ের মোটিভ নিতে পারে নতুন মোড়। বেরিয়ে আসতে পারে আরও রাঘববোয়ালদের নাম।
No comments