‘যা হারিয়ে যায় তা আগলে রেখে রইবো কত আর by গোলাম কুদ্দুছ
যা হারিয়ে যায় তা আগলে রেখে রইবো কত আর’Ñরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের এ বাণী বর্ষবিদায়ের ক্ষণে অবচেতনভাবেই মনের দুয়ার খুলে বেরিয়ে এলো। মানুষ কল্পনাবিলাসী হলেও নিজে তো কাল্পনিক নয়Ñসত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি মুহূর্তে।
এই যে মুখোমুখি দাঁড়ানো বাস্তবতাকে উপলব্ধি করা, কঠিনেরে অতিক্রম করাÑএর কোন সীমা-পরিসীমা নেই। প্রতিটি মুহূর্ত সিঁড়ি অতিক্রম করে এগিয়ে চলার নিরন্তর সংগ্রামের মধ্যদিয়েই সভ্যতা এগিয়ে চলেÑআগামীর স্বপ্নের বীজ রোপিত হয়।হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের এই যে এগিয়ে চলা, বিবর্তন তা কখনও মসৃণ পথে এগোয়নি। প্রতিনিয়ত সংগ্রাম, লড়াই করেই মানুষকে তার অধিকার ছিনিয়ে নিতে হয়েছে মানুষরূপী দানবদের কাছ থেকে। যে মানুষরা অস্ত্র, পেশীশক্তি আর কূটচালে বেশিরভাগ মানুষের সমস্ত অধিকার কেড়ে নিয়ে বিপুল সম্পদ মজুদ, বিলাসী জীবন আর ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে নেয় তাদের মানুষ না বলে মানুষরূপী দানব বলাই শ্রেয়। এই দানবদের সঙ্গে মানুষের রক্তাক্ত সংগ্রামের কত না কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে ইতিহাসের পাতাজুড়ে।
শুরু করেছিলাম রবি ঠাকুরের ‘যা হারিয়ে যায় তা আগলে রেখে রইবো কি’ এই বাণী দিয়ে। এই যে হারিয়ে যাওয়া তা বহুবিধ অর্থেই ব্যবহৃত হতে পারে। সত্য-সুন্দর-কল্যাণের আদর্শকে মানুষ ধারণ করতে চায়। পশ্চাদপদ, মনুষ্যত্ববিনাশী, শোষক-পীড়কচক্র- রাজনীতি, রাষ্ট্র, সমাজ থেকে বিতাড়িত হোক, চিরতরে হারিয়ে যাক সত্যাশ্রয়ী জীবনমুখী মানুষের এ প্রত্যাশা কখনও অবিবেচনাপ্রসূত নয়। অতীতকে জানা প্রয়োজন বর্তমানকে বোঝা এবং ভবিষ্যতের করণীয় নির্ধারণের জন্য। যাঁরা অতীতকে এড়িয়ে যেতে চান তাঁরা সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে ভয় পান। জীবন থেকে পালিয়ে নিয়তির ওপর নিজের ভাগ্যকে ছেড়ে দেয়া সক্ষম, সাহসী-সংগ্রামী মানুষের কাজ হতে পারে না।
এ ভূখ-ের কয়েক শ’ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এ সত্যেরই প্রতিধ্বনি পাওয়া যাবে। মোগলদের কথা বাদ দিলেও ব্রিটিশ শাসনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ বহু মানুষ এখনও জীবিত আছে। ইতিহাস তো রম্যকাহিনী নয়; সময়ের দলিল, জীবনের চালচিত্র, শিল্পীর আঁকা তৈলচিত্র যেন। ইতিহাস বলে মোগল, পাঠান, তুর্কীরা ভারতবর্ষ শাসন করতে এসে এদেশকে নিজের দেশ হিসেবেই ভাবতে শিখেছিল। অপরদিকে ইংরেজশক্তি ভারতবর্ষকে তাদের শোষণের উর্বর ভূমি হিসেবে বিবেচনা করেই গায়ের জোরে প্রায় দুই শ’ বছর শাসন করেছে। বাণিজ্যের নামে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ গঠিত হলেও তা যে শাসক এবং পীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে ভারতবর্ষের তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী রাজা-বাদশারাও বুঝতে পারেননি। বাণিজ্য এবং শোষণের প্রয়োজনে রেললাইন স্থাপন এবং সতীদাহ প্রথা বিলোপ ব্যতীত ভারতবাসীর কল্যাণে ব্রিটিশদের তেমন কোন অবদান নেই। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকা-, মসলিন কাপড় তৈরির নিপুণ কারিগরদের আঙ্গুল কেটে নেয়া, আন্দামানের সেলুলার জেলে আটক রাজবন্দীদের অমানবিক নির্যাতন ও হত্যা, দেশপ্রেমিক হাজী শরীয়তউল্লা, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, ক্ষুদিরাম, মাস্টারদা সূর্যসেন, বাঘা যতিন, বিনয়-বাদল, দিনেশ, শহীদ-ই-আযম, ভগৎ সিংদের হত্যা করেই সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশশক্তি ভারতবর্ষে তাদের দ্বিশত বছরের শাসন জারি রেখেছিল। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার এ সংগ্রাম পরবর্তীতে দু’পথে অগ্রসর হয়। মহাত্মা গান্ধী, প-িত জওয়াহেরলাল নেহরু, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, বল্লভভাই প্যাটেল, মহম্মদ আলী জিন্নাহ শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আদায়ের পথে অগ্রসর হন। অপরদিকে এমএন রায়, নেতাজী সুভাষ বসু বেছে নিলেন সশস্ত্র সংগ্রামের পথ। ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশী আন্দোলন, বিপ্লবীদের অনুশীলন ও যুগান্তর সংগঠন গড়ে তোলার ধারাকে সত্যিকার অর্থেই পূর্ণরূপ দিলেন নেতাজী সুভাষ বসু। গড়ে তুললেন ভারতের স্বাধীনতার জন্য ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’Ñ চাপ বেড়ে গেল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ওপর। একদিকে গান্ধী-জিন্নার নেতৃত্বে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের গণতান্ত্রিক অহিংস আন্দোলন; অপরদিকে সুভাষ বসুর সশস্ত্র সংগ্রাম ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করে। সিপাহী বিদ্রোহ, নৌবিদ্রোহ ব্রিটিশদের মনোবল আরও ভেঙ্গে দেয়। অবশেষে ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট ক্রিপ্স মিশনের পরিকল্পনা এবং র্যাডক্লিফের সীমানা নির্ধারণের ফর্মুলা মোতাবেক ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
হাজারেরও অধিক মাইল দূরত্বের দু’টি অঞ্চলের স্বীয় পরিচয় মুছে ফেলে ধর্মীয় আবেগে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান নাম নিয়ে দু’টি অঞ্চলকে সমন্বিত করে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি। ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে বটে, এতে কারো কিছু বলার বা করারও থাকে না। তবে রাষ্ট্রের সঙ্গে যদি ধর্ম বিশ্বাসকে যুক্ত করা হয় তবে তা কত বড় সঙ্কট তৈরি করে তা পাকিস্তানী শাসনামলের তেইশ বছর বাঙালীরা প্রত্যক্ষ করেছে। দ্বিজাতিতত্ত্বের নামে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালীর ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক, গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদেরকে শোষণের যন্ত্রে পরিণত করা হয়। ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের ফলে ধর্মের মৌল বাণী ও মাহাত্ম্যকে বিতর্কিত করা হয়। বিশেষ করে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় সহযোগী রাজাকার, আলবদর-আল শামস্ বাহিনী ধর্মরক্ষার নামে যেভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে; পৃথিবীর ইতিহাসে তা এক বিরল ঘটনা। নিরপরাধ ও নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট এবং নারী ধর্ষণকে পবিত্র ইসলাম ধর্মই শুধু নয় পৃথিবীর কোন ধর্মই অনুমোদন করে না। অথচ ধর্ম রক্ষার নামে পাকিস্তানকে অন্যায়ভাবে টিকিয়ে রাখার জন্য ত্রিশ লাখ মানুষকে হত্যা এবং কয়েক লাখ নারীর সম্ভ্রম কেড়ে নেয়া হয়। মানবতাবিরোধী এই জঘন্য অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিচার ও শাস্তি প্রদান যেকোন দেশের জন্য অবশ্যই করণীয়। ধর্মের নামে রাজনীতি, গণহত্যা এবং নারীর ইজ্জত লুটে নেয়ায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয় এবং ১৯৭৩ সালে দালাল আইন গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-বিরোধী শক্তি এবং ক্ষমতালোভী চক্র স্বাধীনতার মৌলচেতনা এবং সংবিধানের ভিত্তিকে কেটে-ছিঁড়ে এবড়োথেবড়ো করতে শুরু করে। অবৈধ ক্ষমতাদখলকারী জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন সামরিক সরকার ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর এক ফরমান জারি করে দালাল আইন বাতিল করে দেয়। কারাবন্দী প্রায় ত্রিশ হাজার অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীকে কারাগার থেকে মুক্তি এবং অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধ করার জন্য কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ জারি করা হয় এবং স্বাধীনতাবিরোধী শাহ আজিজুর রহমানকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেয়া হয়। সংবিধান সংশোধন করে পুনরায় ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু করা হয়। এরপর থেকে বিদেশে পালিয়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী শীর্ষ যুদ্ধপরাধীরা একে একে বাংলাদেশে ফিরে আসতে শুরু করে। যাদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছিল তাদেরকে বিনাবাধায় দেশে রাজনীতি করারও সুযোগ করে দেয়া হয়। সংবিধানে বাঙালী জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ সন্নিবেশিত করা হয়। চিহ্নিহ্নত যুদ্ধপরাধীদের শুধু রাজনীতি এবং প্রশাসনে পুনর্বাসিতই করা হয়নি, জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদ এবং বেগম খালেদা জিয়া কয়েক শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীকে দেশের মন্ত্রিত্ব প্রদান করে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত লাল-সবুজ পতাকা তাদের গাড়িতে তুলে দিয়েছে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এ ধরনের পরিহাস পৃথিবীর আর কোন দেশে হয়েছে কিনা আমার জানা নেই।
ধর্মের নামে পুনরায় রাজনীতি করার সুযোগে দেশে আবার নতুন করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা শুরু হয়। বিশেষ করে তরুণ এবং গ্রামের দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের নানাভাবে প্রভাবিত করে জঙ্গীবাদের সঙ্গে যুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। নানা নামে নানা পরিচয়ে মূলত এক কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে এই সংগঠনগুলো দেশব্যাপী জঙ্গী হামলা চালিয়ে বহু মানুষকে হত্যা করে। প্রগতিবাদী অসাম্প্রদায়িক মানুষরাই হলো এই জঙ্গী হামলার মূল টার্গেট। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বর্ষবরণ, যাত্রা, সার্কাস, সিনেমা হল বার বার বোমা হামলায় আক্রান্ত হয়েছে। সাংবাদিক রতন সেন, হুমায়ুন কবির বালু, মোশাররফ হোসেন, রাজনৈতিক নেতা ও মন্ত্রী শাহ্ এএমএস কিবরিয়া, আহসানউল্লা মাস্টার এমপি, কাজী আরেফ আহমেদ, এ্যাডভোকেট মঞ্জুরুল ইমাম, এ্যাডভোকেট মমতাজউদ্দিন সন্ত্রাসীদের আক্রমণে নিহত হন। সবচাইতে ভয়াবহ ঘটনা ছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে শেখ হাসিনার সমাবেশে উপর্যুপরি গ্রেনেড হামলা চালানো। এই পরিকল্পিত হামলায় শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও নেত্রী আইভী রহমানসহ ২৪ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী নিহত হন। শেখ হাসিনাসহ পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী হন গুরুতর আহত। বিস্মিত-হতবাক দেশবাসী আরও প্রত্যক্ষ করল ২০০৫ সালে বাংলাদেশের ৬৩টি জেলায় ৫০০ স্থানে একই সঙ্গে বোমা হামলা চালিয়ে জঙ্গীগোষ্ঠী তাদের হামলার সক্ষমতা এবং শক্তি সম্পর্কে দেশবাসীকে জানান দেয়। এসব হামলা এবং সশস্ত্র কর্মকা-কে কেউই বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখেনি এবং এর পেছনে দেশী-বিদেশী মদদ এবং কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে বলে দেশবাসী ও সচেতন মহল দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি এদেশের মানুষের প্রাণের দাবি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে গত জাতীয় নির্বাচনে বিপুল গণরায়ের ফলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের পবিত্র দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে এই বিচারকার্য নিরপেক্ষভাবে দ্রুত সম্পন্ন করা। ইতোমধ্যে গ্রেফতারকৃত কয়েক শীর্ষ মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু হয়েছে। আসামিদের আইনজীবী নিয়োগ, সাক্ষীদের জেরা করা, আপীল করার সুযোগ প্রদানসহ সকল আইনী সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে। সম্পূর্ণ উন্মুক্ত, স্বচ্ছ এ বিচার প্রক্রিয়া পৃথিবীর অন্যান্য দেশের অনুরূপ অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার চাইতে অনেক স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য।
এ কথা সকলেরই উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং সাম্প্রদায়িক জঙ্গীগোষ্ঠী প্রতিরোধ কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলের একক দায়িত্ব হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এবং অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও আইনের শাসনে বিশ্বাসী সকল ব্যক্তি ও সংগঠনের নৈতিক দায়িত্ব হলো এই সকল বর্বর অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। কোন অজুহাতেই এদের পক্ষাবলম্বন হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত যার মাসুল দিতে হবে পুরো জাতিকে- নতুন প্রজন্মকে। আমরা অনেকেই অগ্রসর সমাজের কথা ভাবি, রাষ্ট্র-কাঠামোকে পরিবর্তন করে নতুন রাষ্ট্র বা সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার কথা বলি। যে বা যাঁরা এ সংগ্রামের সঙ্গে স্বেচ্ছায় যুক্ত হয়েছেন তাঁদের সম্মান জানাই। কিন্তু একশ্রেণীর মানুষ বা বুদ্ধিজীবী আছেন যাঁরা টক্শোতে, সেমিনারে এসে বিপ্লব ঘটাতে চান এবং ফুঁৎকারে রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়ার ভাব ব্যক্ত করেন। কিন্তু বাস্তবে নিজেরা কখনও কষ্টকর এ সংগ্রামে যুক্ত হন না। পুলিশের লাঠিপেটা কিংবা গায়ের ঘাম ঝরানো সংগ্রামের পথ থেকে সযতেœ নিজেকে সরিয়ে রেখে অন্যকে কষ্টকর সংগ্রামে অংশগ্রহণের আহ্বান জানানো এক ধরনের আত্মপ্রবঞ্চনা এবং শঠতা ছাড়া আর কিছু নয়। নিজেকে সমাজের বিজ্ঞজন ও অগ্রসর চিন্তার মানুষ হিসেবে জাহির করে কথার ফুলঝুরি ফোটানো, কিন্তু নিজে সে সংগ্রামে যুক্ত না হয়ে আরাম-আয়েসের জীবনযাপন করা মানুষরা কখনও আলোর দিশারী কিংবা পথপ্রদর্শক হতে পারেন না। অন্য আরেক ধরনের মানুষ আছেন যাঁরা প্রশাসন এবং সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে এখন অবসরপ্রাপ্ত জীবনযাপন করছেন। এদের অনেকে বিভিন্ন এনজিও’র সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন এবং আবার অনেকে নানাসূত্রে টক্শোতে প্রায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করে বিশেষ উদ্দেশ্যে জাতিকে জ্ঞান বিতরণ করে যাচ্ছেন। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জরুরী অবস্থার সময় এদের কারও কারও মুখোশ উন্মোচিত হয়েছিল। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য, নানা উছিলায় রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এবং দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে সে সময় নির্লজ্জ অবস্থান নেয়ার পরও শুধু রাজনৈতিক সমঝোতার অভাবের কারণে এই মানুষগুলো পুনরায় গণমাধ্যমে আবির্ভূত হয়ে নিজেদের উচ্চাকাক্সক্ষা চরিতার্থ করার জন্য নানা তত্ত্ব এবং উপদেশ দেয়া শুরু করেছে। অনেকে এ উপদেশ দেয়ার পেছনে জামায়াতের হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের সম্পৃক্ততা আছে কিনা সে সম্পর্কেও সন্দেহ ব্যক্ত করছেন।
সম্প্রতি ভারতের দিল্লীতে এক মেডিক্যাল ছাত্রীকে গণধর্ষণ এবং পরবর্তীতে তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ভারতজুড়ে বিক্ষোভ এবং প্রতিবাদে শামিল হয় লাখ লাখ নারী-পুরুষ। বাংলাদেশেও এ অমানবিক কর্মকা-ের প্রতিবাদ হয়েছে। শুভ-বুদ্ধিসম্পন্ন প্রতিটি মানুষেরই উচিত এ ধরনের কর্মকা-ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। আমাদের সিভিল সোসাইটির কিছু বুদ্ধিজীবী আছেন যাঁরা নারীর অধিকার রক্ষায় কথা বলে সেমিনার, গোলটেবিল বৈঠক এবং টক্শো ফাটিয়ে দেন। কিন্তু সেই মানুষগুলোই আবার আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় সহযোগী রাজাকার-আলবদরদের দ্বারা ধর্ষিত কয়েক লাখ নারীর সম্ভ্রমহানির বিচার দাবি করেন না; ইনিয়েবিনিয়ে প্রকারান্তরে ধর্ষণকারীদের পক্ষাবলম্বন করেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার কোথায়ও একটু খুঁত ধরে একে বিতর্কিত করবার প্রচেষ্টা নেয়াই যেন তাদের একমাত্র কাজ। এই জ্ঞানপাপী মানুষগুলোর আচরণ, কথাবার্তা এবং কর্মকা- সম্পর্কে দেশবাসীকে বিশেষ সচেতন হবার প্রয়োজন রয়েছে।
‘যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে রইবো কত আর’- রবি ঠাকুরের এই বাণী দিয়ে শুরু করেছিলাম; শেষ করতে চাই এই প্রত্যয় ব্যক্ত করে যেÑ মানুষের জন্য যা কিছু কল্যাণকর তা কখনও হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য কল্যাণকর এক পৃথিবী রচনায় আমাদেরকে অবশ্যই পশ্চাদপদ কূপম-ুক ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে এসে মানবতাবিরোধী সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। মানব সভ্যতার ইতিহাসই হলো সংগ্রামের। সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-নীতির এ লড়াইয়ে শুভকর্ম শুভচিন্তার বিজয় কেতন উড়েছে এই ভূম-লের প্রতিটি লোকালয়ে। সংগ্রামের এই ধারাবাহিকতায় আমাদের দৃঢ়চিত্তে অগ্রসর হতেই হবে- এর কোন বিকল্প নেই।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও কলামিস্ট
ঊ-সধরষ: ময়ঁফফঁংনফ@মসধরষ.পড়স
No comments