আইন নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না সিকিউরিটি কোম্পানি- ০ ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে০ ভুয়া পরিচয়ে ঢুকে পড়ছে পেশাদার অপরাধী ০ আইনজীবীর খুনী গ্রেফতারের পর কোম্পানিই লাপাত্তা by গাফফার খান চৌধুরী
নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই চলছে প্রাইভেট সিকিউরিটি কোম্পানিগুলো। ফলে সারাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে এসব কোম্পানি। সিকিউরিটি কোম্পানির সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই সরকারের কাছে।
এসব সিকিউরিটি কোম্পানিতে কোন প্রকার যাচাই-বাছাই ছাড়াই লোক ভর্তি হয়। এমন সুযোগে এসব কোম্পানিতে চাকরি পাচ্ছে পেশাদার অপরাধী। এসব অপরাধী একের পর এক ঘটিয়ে যাচ্ছে মারাত্মক ধরনের অপরাধ। সিকিউরিটি কোম্পানির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেরিত সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার বিষয়েও কোন সুরাহা হয়নি। বহুল আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের আইনজীবী স্ত্রী খুনের সঙ্গে জড়িত দুই নিরাপত্তাকর্মী গ্রেফতারের পর বেসরকারী নিরাপত্তা বিধিমালা, ২০০৭-এর কার্যকারিতা আবারও আলোচনায় চলে এসেছে।প্রসঙ্গত, বহুল আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী এনামুলকে গ্রেফতার করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। অদ্যাবধি তার হদিস মেলেনি। কারণ এনামুল সঠিক নামঠিকানা ব্যবহার না করেই বেসরকারী সিকিউরিটি কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছিল। বেসরকারী সিকিউরিটি কোম্পানিতে জমা দেয়া এনামুলের সব কাগজপত্র ও তথ্য পুরোপুরি ভুয়া।
সর্বশেষ গত ৩১ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় রাজধানীর মিরপুর মডেল থানাধীন ৬ নম্বর সেকশনের এ ব্লকের ৩ নম্বর রোডের ৪ নম্বর শেলটেক টিউলিপ নামে আবাসিক ভবনের তৃতীয় তলার সি/৩ নম্বর ফ্ল্যাটে খুন হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ (ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ)-এর সহযোগী অধ্যাপক মাহবুব-ই-সাত্তারের স্ত্রী আইনজীবী রওশন আক্তার।
ডিবি পুলিশ বৃহস্পতিবার দুই খুনী রাসেল ও তাজুলকে গ্রেফতার করে। তারা শেলটেক টিউলিপ আবাসিক ভবনের নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কর্মরত ছিল। রাজধানীর মৌচাকের একটি নামসর্বস্ব সিকিউরিটি প্রতিষ্ঠানের কাছে ১০ হাজার টাকা জমা রেখে তারা ভুয়া কাগজপত্র ও ঠিকানা ব্যবহার করে এমিকন সিকিউরিটি কোম্পানিতে চাকরি নেয়। তারা অল্প দিনে বড়লোক হতে প্রথমে গাড়ি চুরির সিদ্ধান্ত নেয়। এতে ব্যর্থ হয়ে তারা বাসাবাড়ি থেকে টাকা-পয়সা সোনাদানা লুণ্ঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই পরিকল্পনা মোতাবেক তারা সিকিউরিটি কোম্পানিতে চাকরি নেয়। এরপর সুযোগ বুঝে অপরাধ সংঘটিত করে। যে কোম্পানির নামে গ্রেফতারকৃতরা চাকরি নিয়েছিল সেই কোম্পানির কোন হদিস করতে পারেনি গোয়েন্দারা। আসামিরা ভুয়া এসএসসি পাসের সনদ এবং ভুয়া নামঠিকানা ব্যবহার করে সিকিউরিটি কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছিল।
একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারী নিরাপত্তা বিধিমালা-২০০৭-এর কার্যকারিতা নিয়ে অনেক আগে থেকেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিধিমালায় দেশের প্রতিটি বেসরকারী সিকিউরিটি কোম্পানির একই পোশাক ব্যবহারের কথা। শুধু পোশাকে নির্দিষ্ট সিকিউরিটি কোম্পানির উজ্জ্বল মনোগ্রাম বা লোগো ব্যবহৃত হবে। মাথার টুপিতে কোন মনোগ্রাম থাকতে পারবে না। সিকিউরিটি কোম্পানিতে কর্মরতরা নিয়মমাফিক সুবিধা পাবে। শুধু লাইসেন্সপ্রাপ্ত সিকিউরিটি কোম্পানিগুলো সরকার নির্ধারিত পোশাক ব্যবহার করবে। যা কোন সরকারী বাহিনীর পোশাকের মতো হতে পারবে না। এমনকি সরকারী বাহিনীর পোশাকের সাদৃশ্যপূর্ণও হতে পারবে না। কোন সরকারী বাহিনীর মতো র্যাঙ্ক বা র্যাঙ্কব্যাজ ব্যবহার করতে পারবে না। পোশাকে ও বাহিনীর সদস্যের বুকে লাইসেন্সিং প্রতিষ্ঠানের নাম, মনোগ্রাম স্থায়ী কালি বা সুতো দ্বারা লিখতে হবে। যা সহজেই দেখা যায়। কোন প্রকার মনোগ্রাম ছাড়া সিকিউরিটি কোম্পানির সদস্যরা টুপি ব্যবহার করতে পারবে। তবে টুপির রং কোন সরকারী বাহিনীর মতো হতে পারবে না। কোন সিকিউরিটি কোম্পানির পোশাক সরকারী বাহিনীর পোশাকের মতো বা সাদৃশ্যপূর্ণ হলে তা বেআইনী। তা অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে। অন্যথায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিধি মোতাবেক ওইসব সিকিউরিটি কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। কোম্পানিতে লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে যথাযথ বিধিমালা মানতে হবে।
অথচ দেশের বেসরকারী সিকিউরিটি কোম্পানির সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে। কোম্পানিগুলো তেমন কোন নীতিমালাই মানছে না। এ সংক্রান্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি কমিটিও রয়েছে। কমিটি দফায় দফায় বৈঠকও করেছে। বৈঠকে পুলিশ, আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়, বিজিবি, র্যাব, আনসার ও ভিডিপি, ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার, ডিএমপি কমিশনার, কোস্টগার্ড, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), ঢাকা জেলার প্রশাসক ও মেট্রোপলিটন সিকিউরিটি ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস গ্রুপসহ প্রতিটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকেন।
সভায় প্রায় প্রতিটি সংস্থার তরফ থেকে অভিযোগ উঠেছে, বেসরকারী সিকিউরিটি কোম্পানিগুলো বিধিমালা মানছে না। তারা বিধিমালা অমান্য করে ইচ্ছেমতো পোশাক ব্যবহার করছে। যা কোন কোন সরকারী বাহিনীর মতো। এতে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক সময় সিকিউরিটি কোম্পানির সদস্যরা চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি বা অন্যান্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এতে বিভিন্ন সরকারী বাহিনী সম্পর্কে মানুষের মনে নেতিবাচক ধারণা জন্ম নিচ্ছে। বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে দেখভাল করতে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতরকে (ডিজিএফআই) গুরুত্বসহকারে কাজ করতে বলা হয়।
সিকিউরিটি কোম্পানিতে লোক নিয়োগ ও ট্রেনিংসহ আনুষঙ্গিক বিষয়াদিতে একটি নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন ও নীতিমালার মধ্যে আনতে বলা আছে নীতিমালায়। সিকিউরিটি কোম্পানিগুলোকে সরকার নির্দেশিত পোশাক ব্যবহার করতে বলা হয়। সারাদেশের প্রতিটি সিকিউরিটি কোম্পানির একই পোশাক ব্যবহারের প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু সঠিক মনিটরিংয়ের অভাবে বেসরকারী সিকিউরিটি কোম্পানিগুলোতে ঢুকে পড়ছে পেশাদার অপরাধী। যারা সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী এবং আইনজীবী রওশন আক্তারসহ অসংখ্য আলোচিত অপরাধের জন্ম দিচ্ছে।
No comments