সাংবাদিকদের যেন কোন মহল ব্যবহার করতে না পারে- জহুর হোসেন স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি
রাষ্ট্রপতি জিলস্নুর রহমান বলেছেন, সাংবাদিকদের সতর্ক থাকতে হবে যাতে কান মহল অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে না পারে। রাষ্ট্রের চতুর্থ সত্মম্ভ ও পর্যবেৰক হিসেবে সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরীর মতো সমকালীন সংবাদকর্মীদের পেশাদার ও আদর্শবাদ হতে হবে।
জহুর হোসেন চৌধুরী স্মারক বক্তব্য ২০১০ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাষ্ট্রপতি জিলস্নুর রহমান এসব কথা বলেন। প্রয়াত জহুর হোসেন চৌধুরী স্মরণে 'গণতন্ত্রের নবযাত্রায় গণমাধ্যমের ভূমিকা' মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ভারতের সাংবাদিক কলামিস্ট কুলদীপ নায়ার। মূল প্রবন্ধে তিনি গণতন্ত্রের জন্য বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সংগ্রামকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, এই সময়ে গণতন্ত্রায়নের পথে মূল বাধা ধর্মীয় উগ্রপন্থা বা মৌলবাদ এবং অন্যটি হচ্ছে সামরিক হসত্মৰেপ। এই পরিস্থিতিতে গণমাধ্যম কখনও বাধ্য হয়ে কখনও বা পারিতোষিকের স্বার্থে এসব অগণতান্ত্রিক শাসনে সমর্থন যোগায়। যা পৰানত্মরে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা গণমাধ্যমের আত্মপরিচয়ের সঙ্কট তৈরি করে। আত্মপরিচয়ের বিরম্নদ্ধে গিয়ে গণমাধ্যমের কখনও সমঝোতা করা উচিত নয়। তিনি বলেন, উদীয়মান গণতন্ত্রে সরকার গণমাধ্যমের সহায়তা না পেলে গণতন্ত্রের যাত্রা ব্যাহত হয় এবং মিডিয়াও অগণতান্ত্রিক শাসনের পরিণতি ভোগ করে। আসলে গণতন্ত্রের নবযাত্রায় সরকারের দুর্বল দিক তুলে ধরেই গণমাধ্যম তার গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখতে পারে। মঙ্গলবার নগরীর একটি অভিজাত হোটেলে দৈনিক ভোরের কাগজ এই স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী ১৯২২ সালে চট্টগ্রামের জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতা ছিলেন তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাদাত হোসেন চৌধুরী। মা মোহসেনা খাতুন তাঁর জন্মের দু'বছরের মাথায় মারা যান। নানি ও খালাদের কাছে তিনি বড় হন। ১৯৪০ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আইএ পাস করেন এবং ১৯৪২ সালে তিনি কলকাতার জনপ্রিয় দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকায় শিৰানবিস হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৪৫ সালে আজাদ গ্রম্নপ পাবলিকেশন্সের পত্রিকা 'কমরেড'-এর সম্পাদক নিযুক্ত হন। দেশভাগের পর তিনি কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে তৎকালীন পাকিসত্মান অবজারভারের সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৫৪ সালে তিনি দৈনিক সংবাদের সম্পাদক নিযুক্ত হন এবং ১৯৭১'র ২৫ মার্চ সংবাদের প্রকাশনা বন্ধ হওয়া পর্যনত্ম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতা উত্তরকালে তিনি 'কাউন্টারপয়েন্ট' নামে একটি ইংরেজী সাপ্তাহিকের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে তিনি 'দরবার-ই-জহুর' নামে তাঁর বিখ্যাত কলাম লেখা শুরম্ন করেন। ১৯৮০ সালের ১১ ডিসেম্বর তিনি পরলোকগমন করেন। মাত্র ৫৮ বছর বয়সে তিনি পৃথিবী ছেড়ে যান। ৩০ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে তিনি নিজের বিশ্বাস ও আস্থায় ছিলেন অবিচল। ১৯৮১ সালে তাঁকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান মরণোত্তর একুশে পদক দেয়া হয়।
এ বছর প্রথমবারের মতো জহুর হোসেন স্মারক বক্তৃতা আয়োজন করে দৈনিক ভোরের কাগজ। 'গণতন্ত্রের নব যাত্রায় গণমাধ্যমের ভূমিকা' মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিখ্যাত সাংবাদিক কলামিস্ট কুলদীপ নায়ার। কুলদীপ নায়ারের কর্মজীবন বৈচিত্র্যময়। তিনি একাধারে সাংবাদিক, লেখক, শানত্মিদূত। রাজ্যসভার সদস্যও ছিলেন। ১৯৭৫ থেকে '৭৭ সালে ভারতে জরম্নরী অবস্থার সময় তিনি বন্দী জীবন যাপন করেন। ১৯৮৫ সালে থেকে কুলদীপ নায়ার সিন্ডিকেটেড কলাম লিখছেন। যা পৃথিবীর ১৪টি ভাষায় ৮০টি পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। নায়ারের লেখা বইয়ের সংখ্যা ১১টি। এর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হচ্ছে-'বিটুইন দ্য লাইনস', 'ডিসট্যান্ট নেইবরস'. 'এ টেল অব দ্য সাবকন্টিনেন্ট', 'ইন্ডিয়া আফটার নেহেরম্ন', 'ওয়াল এট ওয়াগাহ','দ্য মার্টায়ার','স্কোপ','ইন্ডিয়া হাউস'। আমেরিকার নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয় নায়ারকে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ 'এলামনাই মেরিট এওয়ার্ড' প্রদান করে। আশি উর্ধ বয়সে এ বরেণ্য ব্যক্তিত্ব এখনও নিরলস ও কর্মচঞ্চল। তিনি এবার জহুর হোসেন স্মারক বক্তব্য প্রদান করেন।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ। এতে স্বাগত বক্তৃতা করেন ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত। জহুর হোসেন চৌধুরীর পরিবারের পৰে বক্তৃতা করেন তাঁর খালাত ভাইয়ের মেয়ে তাজীন চৌধুরী।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাষ্ট্রপতি মোঃ জিলস্নুর রহমান বলেন,জহুর হোসেন চৌধুরীর লেখায় গণমানুষের সুখ-দুঃখের কথা ফুটে উঠত। তিনি সমাজ ও দরিদ্র মানুষের ভাগ্যবদলের হাতিয়ার হিসেবে সাংবাদিকতাকে গ্রহণ করেছিলেন। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতে মেধায় নিষ্ঠায় সাহসে ও সৃজনশীলতায় সমৃদ্ধ করেছেন জহুর হোসেন চৌধুরী। তিনি বলেন, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার বিকাশে আজ জহুর হোসেন চৌধুরীর মতো দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ সাংবাদিক বড়ই প্রয়োজন।
মূল প্রবন্ধের শুরম্নতেই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী কুলদীপ নায়ার গণতন্ত্রের জন্য বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সংগ্রামকে অভিনন্দন জানান। 'গণতন্ত্রের নব যাত্রায় গণমাধ্যমের ভূমিকা' শীর্ষক স্মারক বক্তব্যে তিনি উপমহাদেশের সাধারণ চিত্র তুলে ধরেন বলেন, এই সময়ে গণতন্ত্রায়নের পথে মূল বাধা ধর্মীয় উগ্রপন্থা বা মৌলবাদ এবং অন্যটি হচ্ছে সামরিক হসত্মৰেপ। অল্প সময়ে ভাল ফলাফল এবং শক্তিশালী শাসনের নামেই খাকি পোশাক ৰমতা নেয়। পাকিসত্মানে দু'টিই প্রকট। নেপালেও আকস্মিক উদ্ভব ঘটে। বাংলাদেশের মানুষও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্কট কাটিয়ে বার বার গণতন্ত্রমুখী হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে গণমাধ্যম কখনও বাধ্য হয়ে কখনও বা পারিতোষিকের স্বার্থে এসব অগণতান্ত্রিক শাসনে সমর্থন যোগায়। বিশেষ সমর্থনের নামে ব্যক্তি বিশেষের লাভবান হওয়া গণতন্ত্রের জন্য ৰতিকর। যা পৰানত্মরে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা গণমাধ্যমের আত্মপরিচয়ের সঙ্কট তৈরি করে। আত্মপরিচয়ের বিরম্নদ্ধে গিয়ে গণমাধ্যমের কখনও সমঝোতা করা উচিত নয়। গণমাধ্যম জাতীয় ঐকমত্য ও সংহতির পরিবেশ তৈরি করতে পারে।
তিনি বলেন, গণতন্ত্রের যাত্রায় সরকারী কর্মকা-ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সংবাদপত্রের। উদীয়মান গণতন্ত্রে সরকার গণমাধ্যমের সহায়তা না পেলে গণতন্ত্রের যাত্রা ব্যাহত হয় এবং মিডিয়াও অগণতান্ত্রিক শাসনের পরিণতি ভোগ করে। আসলে গণতন্ত্রের নবযাত্রায় সরকারের দুর্বল দিক তুলে ধরেই গণমাধ্যম তার গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখতে পারে। সাংবাদিকতায় রাজনৈতিক প্রতিবেদনে উদ্দেশ্য প্রণোদিত প্রভাব সংবাদকর্মী ও রাজনীতিকদের মধ্যে ক্রমাগত দূরত্ব বাড়িয়ে চলছে। বিশেষ করে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাজনৈতিক সংবাদ পরিবেশিত হয়। সমাজ এবং রাষ্ট্রের বিবর্তনে দায়িত্বশীল গণমাধ্যমই হতে পারে পথনির্দেশক।
তিনি বলেন,সন্ত্রাস একবার শুরম্ন হলে সেটির বিষবৃৰ যেমন নির্মূল করা দুঃসাধ্য, তেমনি সংবাদপত্র একবার স্বকীয়তা, পরিচিতি থেকে দূরে সরে গেলে যেমন পাঠকের বিশ্বাস হারায়, তেমনি নিজের স্থানে আবার ফিরে আসা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। বিশিষ্ট সাংবাদিক কূুলদীপ নায়ার তাঁর আশাবাদের কথা জানিয়ে বলেন, গণমাধ্যম সমাজ, অর্থনীতি রাজনীতি আর সংস্কৃতির মূল্যবোধ এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব সংবাদপত্রই পালন করে। একদিন দৰিণ এশিয়ার মানুষ নিজ নিজ সরকারের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে জাতীয় স্বার্থে কাজ করবে এবং দৰিণ এশিয়ার সকল মিডিয়া গণতন্ত্রের স্বার্থে কাজ করবে_ সেই দিনের প্রত্যাশা করছি।
No comments