সময়ের কথা-অব্যবস্থাপনা ও মানবিকতার দ্বন্দ্ব by অজয় দাশগুপ্ত
প্রিয় একজন মানুষের জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত কয়েকটি দিন কাটাতে হয়েছে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বীর ছিলেন এবং তা আক্ষরিক অর্থেই। নাম তার মিহির দাশগুপ্ত।
মন্টুুুদা বা বড়দা নামেও অনেকে চিনতেন। তিনি মানুষের জন্য যেমন করেছেন, তেমনি তার জীবনের শেষ সময়ে সবাই যেন তার প্রতিদান দিতেও ব্যগ্র হয়ে উঠেছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২১৯ নম্বর ওয়ার্ডে বরিশাল থেকে তাকে নিয়ে আসা হয় কোরবানির ঈদের দিন। পথে পড়েছে কাওড়াকান্দি-মাওয়া ফেরিঘাট। দুপুরে ফেরিঘাটে যখন তাকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স পেঁৗছে তখন ফেরি পেতে সমস্যা হয়নি। ঈদের জামায়াত শেষে জরুরি এ সার্ভিস চালু রাখার জন্য অনেক কর্মীই হাজির। আগের কয়েকটি দিন তাদের প্রচণ্ড ধকল গেছে। আরিচা-দৌলতদিয়া ফেরি এলাকায় যানবাহনের চাপ ছিল আরও বেশি। অতীতে কোনো কোনো বছর ফেরির অব্যবস্থাপনার কারণে ফেরিঘাটে ঈদের জামায়াতের আয়োজন করতে হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তেমনটি হচ্ছে না। এ জন্য যারা অশেষ পরিশ্রম করছেন, তাদের প্রতি আমরা সবাই আরও একটু দরদ-সহানুভূতি কি দেখাতে পারি না? শারদীয় দুর্গোৎসবে বরিশাল গিয়েছিলাম মাওয়া ফেরিপথে। পূজা শেষ হতে না হতেই ছিল ঈদ। এ সময় সড়ক, রেল ও নৌপথ ব্যবস্থাপনা_ এক কঠিন কাজ। প্রিয়জনের কাছে ফিরে যেতে সবার তাগিদ থাকে এবং প্রতিটি মানুষের আশা থাকে সর্বোত্তম সেবা পাওয়ার। রাস্তায় কষ্ট যে হবে, সেটা মেনে নিতে কমবেশি প্রস্তুতি থাকে সবার। কিন্তু এটা যেন সহ্যের সীমা অতিক্রম না করে, সেটা দেখার দায়িত্ব প্রধানত সরকার এবং জনপ্রতিনিধিদের। তারা এ দায়িত্ব পালন করতে তৎপরও থাকেন। কিন্তু যারা বাড়ি ফেরেন, তাদের প্রত্যাশা আরও বেশি। ঈদ, পূজা কিংবা এ ধরনের উৎসব বছরের কোন সময়ে পড়বে, পঞ্জিকার সুবাদে সেটা জানা থাকে অনেক আগে থেকেই। আগামী দশ বা বিশ বছর কেন, একশ' বছর পরেও ঈদের তারিখ এখনই মোটামুটি বলে দেওয়া সম্ভব। এ কারণে এ ধরনের অতিরিক্ত ভিড়ের সময়ের পরিকল্পনা আগেভাগে প্রণয়ন করা কঠিন নয়। কিন্তু বাস্তবতা এই যে, আমাদের প্রশাসন যতটা পারে, ততটা করে না।
এবারে বর্ষায় মাওয়া ফেরিঘাটে পদ্মার ভাঙন ছিল ভয়াবহ। ঘাট চালু রাখতে সেখানকার কর্মীরা রাতদিন পরিশ্রম করেছেন। তাদের অনেককে ঈদের আনন্দও কোরবানি দিতে হয়েছে ঘরমুখো যাত্রীদের সেবা প্রদানের কারণে। এ ত্যাগের জন্য তাদের প্রতি সবার সহানুভূতি বাড়তে থাকুক_ এটা কাম্য। ফেরিঘাট কিংবা এ ধরনের ঝামেলাপূর্ণ এলাকার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব যেসব সরকারি সংস্থার, যারা অনেকের জন্য নিজের সুখ-আনন্দ বিসর্জন দিচ্ছে, তাদের জন্য বিশেষ অর্থ বরাদ্দ অবশ্যই থাকা চাই। সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শেষেরটির ক্ষেত্রে ঘাটতি যথেষ্ট রয়েছে বলেই মনে হয়। হাট-বাজার, গরুর হাট কিংবা ফেরিঘাট ও সেতুর টোল ধার্যের ডাক যখন হয় তখন এমপি, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানরা দারুণ তৎপর হয়ে ওঠেন। এসব সূত্র থেকে প্রচুর আয় হয় এবং তার বখরা নিতে এমনকি সংঘাতে লিপ্ত হতেও দ্বিধা বা ভয় নেই অনেকের। কিন্তু ফেরিঘাটে যখন অব্যবস্থাপনা চলে কিংবা যানবাহন ও মানুষের অতিরিক্ত চাপের কারণে বিশৃঙ্খলা চরমে ওঠে, তখন অকুস্থলে তাদের উপস্থিতি কিন্তু একেবারেই সীমিত কিংবা আদৌ থাকে না। মানুষের ভোটে যারা নির্বাচিত হন এবং এ ভোটের জন্য বারবার তাদের মানুষের দ্বারস্থ হতে হয়, তারা কেন মানুষের অসুবিধার সময় পাশে দাঁড়াবেন না? ফেরির কর্মী কিংবা সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর দায়বদ্ধতার প্রধান কারণ চাকরি। তাদের পোস্টিং যেখানে, সেখানে কাজ করতে হয়। ঈদ বা পূজায় ছুটি না পেলে স্টেশন ছাড়ার উপায় নেই। কিছু লোক ফাঁকি যে দেয় না কিংবা গাফিলতি করে না, সেটা বলা যাবে না। এসব কাজে নিযুক্তদের ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়মের ঘটনাও যথেষ্ট। তারপরও তাদের কাছ থেকে এক ধরনের সেবা মানুষ পায়। জনপ্রতিনিধিদের দায়বদ্ধতার প্রধান কারণ ভোটের গরজ। মানুষের জন্য নিবেদিতপ্রাণ না থাকলে ভোটে টান পড়তে পারে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, অনেক জনপ্রতিনিধিই এ বিষয়টিকে হাল আমলে গৌণ করে দেখছেন। তাদের কাছে মানি অ্যান্ড মাস্ল পাওয়ারই মুখ্য হয়ে উঠছে। এ প্রবণতা নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় নয়, বরং শহর-বন্দর-গ্রাম সর্বত্রই এবং এটাই বড় শঙ্কার দিক। কোনো নির্দিষ্ট দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেও এটা সীমিত নেই। ক্ষমতার লড়াইয়ে যেসব দল শামিল থাকে তাদের নেতাকর্মীরা এ মারাত্মক ব্যাধিতে প্রবলভাবে আক্রান্ত। নেতৃত্বের কোনো পর্যায় থেকে তাদের সৎ উপদেশ দেবেন_ এমন কেউ যেন নেই। স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, হাট-বাজার, বাস কাউন্টার, লঞ্চঘাট, রিকশা-নসিমন (ভটভটি) স্ট্যান্ড_ কত কিছুই না তাদের আয়ের উৎস! জনপ্রতিনিধি হলে আরও বাড়তি সুবিধা। পুলিশ তাদের ঘাঁটায় কম। শুধু তাই নয়, পুলিশ দিয়ে অন্যকেও শায়েস্তা করে নিজের জন্য বাড়তি কিছু সুবিধার লাইসেন্স হিসেবে ব্যবহার করা চলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি পদটিকে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশে ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটে চললেও দায়বদ্ধতা-জবাবদিহিতার বড়ই অভাব নির্বাচিতদের মধ্যে। সততা, নিঃস্বার্থপরতা তো সোনার হরিণ! এ অবস্থা কবে বদলাবে? আদৌ কি বদলাবে?
কিন্তু এমনটি যে হতে পারে এবং হওয়া সম্ভব, তার ইঙ্গিত তো সমাজ বারবার দিচ্ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ঘটনায় ফিরে যাই। ঈদের দিন আমার ওই প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে বিকেলের দিকে যখন হাসপাতালে পেঁৗছাই, তখন ২১৯ নম্বর ওয়ার্ডে রোগীর ভিড় কম। কিন্তু একাধিক জুনিয়র চিকিৎসক এবং নার্স ও অন্য কর্মীরা হাজির। কিছু সময় পর সন্ধ্যার দিকেই রোগীর চাপ বেড়ে যায়। খালি বেডগুলো পূর্ণ হয়ে যায়, মেঝে-করিডোরে রোগীদের স্থান মেলে। আরও চার-পাঁচজন তরুণ চিকিৎসক এসে হাজির হন। তারা জনে জনে রোগীদের পাশে যাচ্ছেন। ব্যবস্থাপত্র লিখে দিচ্ছেন। অনেক রোগী যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। উচ্চস্বরে চিৎকার করছেন কেউ কেউ। বেশিরভাগ রোগী গরিব বা স্বল্পবিত্তের, সেটা বোঝা যায় সহজেই। তাদের ভরসা সরকারি হাসপাতাল। ক্লিনিকে কেউ তাদের ঠাঁই দেবে না। ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে দিনের ভাড়া ৩০০ টাকা। কিন্তু একই সুবিধা পেতে প্রাইভেট ক্লিনিকে দিনে ২৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় করতে হয়। প্রাইভেট ক্লিনিকে ৫-৭ লাখ টাকা ব্যয় করে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে রোগী নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের 'অব্যবস্থাপনার পরিবেশে' হাজির হয়েছেন_ এমন অনেকের দেখা মিলেছে। এখানে আমি এমন একটি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরতে চাই, যা 'আপাতভাবে নিষ্ঠুর' শোনাবে। আমার ধারণা যে, এই প্রতিষ্ঠানটিতে যদি সবকিছু ঠিকঠাক চলে_ যেমন ইমার্জেন্সিতে রোগী হাজির হলেই ডাক্তারের দেখা মিলবে এবং দেওয়া হবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা, ওয়ার্ডে মিলবে বেড, যেখানে রয়েছে পরিষ্কার চাদর ও বালিশ, সর্বক্ষণ হাসিমাখা মুখে নার্স থাকবে দরদ ও সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে, রক্ত-মলমূত্র, এক্স-রে এবং অন্যান্য পরীক্ষার জন্য স্বল্প চার্জে মিলবে দ্রুত ও সর্বোত্তম সেবা, প্রতিদিন দুই-তিনবার করে বড় ডাক্তাররা এসে গুরুতর ব্যাধিতে আক্রান্তদের দেখে যাবেন, সবাইকে বিনামূল্যে প্রয়োজনমতো সব ধরনের ওষুধ দেওয়া হবে, সকালের নাশতা ও দুপুর-রাতের জন্য রোগীর উপযোগী মানসম্পন্ন খাবার মিলবে_ সরকারি হাসপাতালের জন্য এমন আদর্শ চিত্র আমাদের অনেকের প্রত্যাশা। শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজ বা মিটফোর্ড হাসপাতালের জন্য নয়, দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে যত সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে, সর্বত্রই এমন সুব্যবস্থাপনা কে না চায়! সবার জন্য স্বাস্থ্য_ এমন স্লোগান রয়েছে সরকারের। এটা নিশ্চিত করতে হলে সরকারকেই সব নারী-পুরুষ-শিশুর চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে হয়। কিন্তু এমন ব্যবস্থা বিশ্বের কোনো দেশেই নেই। রাশিয়াসহ সমাজতান্ত্রিক কয়েকটি দেশ এ চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সফল হয়নি। বাংলাদেশ বিশ্বের গরিব দেশগুলোর তালিকায় প্রায় শেষের দিকে। সরকারের স্বাস্থ্য বাজেট মোট বাজেটের তুলনায় কম। শিক্ষাক্ষেত্রেও একই সমস্যা। সরকারি হাসপাতালের কাছে উত্তম চিকিৎসা সেবা চাইতে দোষের কিছু নেই, কিন্তু সেটা মিলবে না। যত উদ্যমী ও মানবপ্রেমী লোক নিয়োগ দেওয়া হোক না কেন, তাদের সীমাবদ্ধতা প্রকটভাবে ধরা পড়বেই। তদুপরি রয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনা। তারপরও বলব, সরকারি হাসপাতাল এখনও তার দুয়ার গরিব-নিম্নবিত্তদের জন্য সর্বক্ষণ খোলা রেখেছে। ঢাকা মেডিকেলে কয়েক দিন গিয়ে দেখেছি, করিডোরের অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে গাদাগাদি করে থাকা রোগীকেও পরম যত্নে দেখছেন তরুণ নারী ও পুরুষ চিকিৎসকরা। তাদের ওষুুধ লিখে দিচ্ছেন, সান্ত্বনার বাণী শোনাচ্ছেন। যদি এই হাসপাতালসহ সব সরকারি হাসপাতালে সর্বোত্তম সেবা মেলে এবং পরিবেশ হয়ে যায় স্কয়ার, ইউনাইটেড বা অ্যাপোলোর মতো, তাহলে কি গরিবরা সেখানে প্রবেশাধিকার পাবে? যেসব ধনবান সুব্যবস্থাপনার আশায় নামি-দামি বেসরকারি ক্লিনিকে আশ্রয় নেয়, তারা কি তখন ঢাকা মেডিকেলে ভিড় জমাবে না? তাদের প্রভাব-দাপটের কাছে অন্য সবাই কি হার মানবে না? সুব্যবস্থাপনা এবং আধুনিক ও উন্নত চিকিৎসা সেবাযুক্ত সরকারি হাসপাতাল কেবল দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য_ আমাদের রাষ্ট্র কি সেটা নিশ্চিত করতে পারবে? এটা যতদিন পারা যাবে না, ততদিন যেন সরকারি হাসপাতালে 'অব্যবস্থাপনাই বহাল থাকে'_ সেটা কেউ চাইলে তাতে দোষের কিছু হবে না। তাতে অন্তত কিছু গরিব লোকের ব্যাধি-ব্যামোতে চিকিৎসা মিলবে। আর এর প্রধান কারণ 'মানুষ মানুষের জন্য'_ এ আহ্বানে সাড়া দেওয়ার মতো অনেক নারী-পুরুষ এখনও আমাদের সমাজে রয়েছেন। তারা দরিদ্রদের জন্য একটু দরদ ও সহানুভূতির হাত বাড়াতে সদা ব্যাকুল। আমাদের রাষ্ট্রের দুর্ভাগ্য যে, তাদের যথাযথভাবে মানুষের সেবায় কাজে লাগানো যায় না। তাদের জন্য সৃষ্টি হয় না সুযোগের। এ কারণে মানুষ যা সহজে পেতে পারে সেটাও পায় না।
অজয় দাশগুপ্ত :সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
এবারে বর্ষায় মাওয়া ফেরিঘাটে পদ্মার ভাঙন ছিল ভয়াবহ। ঘাট চালু রাখতে সেখানকার কর্মীরা রাতদিন পরিশ্রম করেছেন। তাদের অনেককে ঈদের আনন্দও কোরবানি দিতে হয়েছে ঘরমুখো যাত্রীদের সেবা প্রদানের কারণে। এ ত্যাগের জন্য তাদের প্রতি সবার সহানুভূতি বাড়তে থাকুক_ এটা কাম্য। ফেরিঘাট কিংবা এ ধরনের ঝামেলাপূর্ণ এলাকার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব যেসব সরকারি সংস্থার, যারা অনেকের জন্য নিজের সুখ-আনন্দ বিসর্জন দিচ্ছে, তাদের জন্য বিশেষ অর্থ বরাদ্দ অবশ্যই থাকা চাই। সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শেষেরটির ক্ষেত্রে ঘাটতি যথেষ্ট রয়েছে বলেই মনে হয়। হাট-বাজার, গরুর হাট কিংবা ফেরিঘাট ও সেতুর টোল ধার্যের ডাক যখন হয় তখন এমপি, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানরা দারুণ তৎপর হয়ে ওঠেন। এসব সূত্র থেকে প্রচুর আয় হয় এবং তার বখরা নিতে এমনকি সংঘাতে লিপ্ত হতেও দ্বিধা বা ভয় নেই অনেকের। কিন্তু ফেরিঘাটে যখন অব্যবস্থাপনা চলে কিংবা যানবাহন ও মানুষের অতিরিক্ত চাপের কারণে বিশৃঙ্খলা চরমে ওঠে, তখন অকুস্থলে তাদের উপস্থিতি কিন্তু একেবারেই সীমিত কিংবা আদৌ থাকে না। মানুষের ভোটে যারা নির্বাচিত হন এবং এ ভোটের জন্য বারবার তাদের মানুষের দ্বারস্থ হতে হয়, তারা কেন মানুষের অসুবিধার সময় পাশে দাঁড়াবেন না? ফেরির কর্মী কিংবা সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর দায়বদ্ধতার প্রধান কারণ চাকরি। তাদের পোস্টিং যেখানে, সেখানে কাজ করতে হয়। ঈদ বা পূজায় ছুটি না পেলে স্টেশন ছাড়ার উপায় নেই। কিছু লোক ফাঁকি যে দেয় না কিংবা গাফিলতি করে না, সেটা বলা যাবে না। এসব কাজে নিযুক্তদের ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়মের ঘটনাও যথেষ্ট। তারপরও তাদের কাছ থেকে এক ধরনের সেবা মানুষ পায়। জনপ্রতিনিধিদের দায়বদ্ধতার প্রধান কারণ ভোটের গরজ। মানুষের জন্য নিবেদিতপ্রাণ না থাকলে ভোটে টান পড়তে পারে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, অনেক জনপ্রতিনিধিই এ বিষয়টিকে হাল আমলে গৌণ করে দেখছেন। তাদের কাছে মানি অ্যান্ড মাস্ল পাওয়ারই মুখ্য হয়ে উঠছে। এ প্রবণতা নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় নয়, বরং শহর-বন্দর-গ্রাম সর্বত্রই এবং এটাই বড় শঙ্কার দিক। কোনো নির্দিষ্ট দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেও এটা সীমিত নেই। ক্ষমতার লড়াইয়ে যেসব দল শামিল থাকে তাদের নেতাকর্মীরা এ মারাত্মক ব্যাধিতে প্রবলভাবে আক্রান্ত। নেতৃত্বের কোনো পর্যায় থেকে তাদের সৎ উপদেশ দেবেন_ এমন কেউ যেন নেই। স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, হাট-বাজার, বাস কাউন্টার, লঞ্চঘাট, রিকশা-নসিমন (ভটভটি) স্ট্যান্ড_ কত কিছুই না তাদের আয়ের উৎস! জনপ্রতিনিধি হলে আরও বাড়তি সুবিধা। পুলিশ তাদের ঘাঁটায় কম। শুধু তাই নয়, পুলিশ দিয়ে অন্যকেও শায়েস্তা করে নিজের জন্য বাড়তি কিছু সুবিধার লাইসেন্স হিসেবে ব্যবহার করা চলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি পদটিকে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশে ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটে চললেও দায়বদ্ধতা-জবাবদিহিতার বড়ই অভাব নির্বাচিতদের মধ্যে। সততা, নিঃস্বার্থপরতা তো সোনার হরিণ! এ অবস্থা কবে বদলাবে? আদৌ কি বদলাবে?
কিন্তু এমনটি যে হতে পারে এবং হওয়া সম্ভব, তার ইঙ্গিত তো সমাজ বারবার দিচ্ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ঘটনায় ফিরে যাই। ঈদের দিন আমার ওই প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে বিকেলের দিকে যখন হাসপাতালে পেঁৗছাই, তখন ২১৯ নম্বর ওয়ার্ডে রোগীর ভিড় কম। কিন্তু একাধিক জুনিয়র চিকিৎসক এবং নার্স ও অন্য কর্মীরা হাজির। কিছু সময় পর সন্ধ্যার দিকেই রোগীর চাপ বেড়ে যায়। খালি বেডগুলো পূর্ণ হয়ে যায়, মেঝে-করিডোরে রোগীদের স্থান মেলে। আরও চার-পাঁচজন তরুণ চিকিৎসক এসে হাজির হন। তারা জনে জনে রোগীদের পাশে যাচ্ছেন। ব্যবস্থাপত্র লিখে দিচ্ছেন। অনেক রোগী যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। উচ্চস্বরে চিৎকার করছেন কেউ কেউ। বেশিরভাগ রোগী গরিব বা স্বল্পবিত্তের, সেটা বোঝা যায় সহজেই। তাদের ভরসা সরকারি হাসপাতাল। ক্লিনিকে কেউ তাদের ঠাঁই দেবে না। ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে দিনের ভাড়া ৩০০ টাকা। কিন্তু একই সুবিধা পেতে প্রাইভেট ক্লিনিকে দিনে ২৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় করতে হয়। প্রাইভেট ক্লিনিকে ৫-৭ লাখ টাকা ব্যয় করে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে রোগী নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের 'অব্যবস্থাপনার পরিবেশে' হাজির হয়েছেন_ এমন অনেকের দেখা মিলেছে। এখানে আমি এমন একটি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরতে চাই, যা 'আপাতভাবে নিষ্ঠুর' শোনাবে। আমার ধারণা যে, এই প্রতিষ্ঠানটিতে যদি সবকিছু ঠিকঠাক চলে_ যেমন ইমার্জেন্সিতে রোগী হাজির হলেই ডাক্তারের দেখা মিলবে এবং দেওয়া হবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা, ওয়ার্ডে মিলবে বেড, যেখানে রয়েছে পরিষ্কার চাদর ও বালিশ, সর্বক্ষণ হাসিমাখা মুখে নার্স থাকবে দরদ ও সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে, রক্ত-মলমূত্র, এক্স-রে এবং অন্যান্য পরীক্ষার জন্য স্বল্প চার্জে মিলবে দ্রুত ও সর্বোত্তম সেবা, প্রতিদিন দুই-তিনবার করে বড় ডাক্তাররা এসে গুরুতর ব্যাধিতে আক্রান্তদের দেখে যাবেন, সবাইকে বিনামূল্যে প্রয়োজনমতো সব ধরনের ওষুধ দেওয়া হবে, সকালের নাশতা ও দুপুর-রাতের জন্য রোগীর উপযোগী মানসম্পন্ন খাবার মিলবে_ সরকারি হাসপাতালের জন্য এমন আদর্শ চিত্র আমাদের অনেকের প্রত্যাশা। শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজ বা মিটফোর্ড হাসপাতালের জন্য নয়, দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে যত সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে, সর্বত্রই এমন সুব্যবস্থাপনা কে না চায়! সবার জন্য স্বাস্থ্য_ এমন স্লোগান রয়েছে সরকারের। এটা নিশ্চিত করতে হলে সরকারকেই সব নারী-পুরুষ-শিশুর চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে হয়। কিন্তু এমন ব্যবস্থা বিশ্বের কোনো দেশেই নেই। রাশিয়াসহ সমাজতান্ত্রিক কয়েকটি দেশ এ চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সফল হয়নি। বাংলাদেশ বিশ্বের গরিব দেশগুলোর তালিকায় প্রায় শেষের দিকে। সরকারের স্বাস্থ্য বাজেট মোট বাজেটের তুলনায় কম। শিক্ষাক্ষেত্রেও একই সমস্যা। সরকারি হাসপাতালের কাছে উত্তম চিকিৎসা সেবা চাইতে দোষের কিছু নেই, কিন্তু সেটা মিলবে না। যত উদ্যমী ও মানবপ্রেমী লোক নিয়োগ দেওয়া হোক না কেন, তাদের সীমাবদ্ধতা প্রকটভাবে ধরা পড়বেই। তদুপরি রয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনা। তারপরও বলব, সরকারি হাসপাতাল এখনও তার দুয়ার গরিব-নিম্নবিত্তদের জন্য সর্বক্ষণ খোলা রেখেছে। ঢাকা মেডিকেলে কয়েক দিন গিয়ে দেখেছি, করিডোরের অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে গাদাগাদি করে থাকা রোগীকেও পরম যত্নে দেখছেন তরুণ নারী ও পুরুষ চিকিৎসকরা। তাদের ওষুুধ লিখে দিচ্ছেন, সান্ত্বনার বাণী শোনাচ্ছেন। যদি এই হাসপাতালসহ সব সরকারি হাসপাতালে সর্বোত্তম সেবা মেলে এবং পরিবেশ হয়ে যায় স্কয়ার, ইউনাইটেড বা অ্যাপোলোর মতো, তাহলে কি গরিবরা সেখানে প্রবেশাধিকার পাবে? যেসব ধনবান সুব্যবস্থাপনার আশায় নামি-দামি বেসরকারি ক্লিনিকে আশ্রয় নেয়, তারা কি তখন ঢাকা মেডিকেলে ভিড় জমাবে না? তাদের প্রভাব-দাপটের কাছে অন্য সবাই কি হার মানবে না? সুব্যবস্থাপনা এবং আধুনিক ও উন্নত চিকিৎসা সেবাযুক্ত সরকারি হাসপাতাল কেবল দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য_ আমাদের রাষ্ট্র কি সেটা নিশ্চিত করতে পারবে? এটা যতদিন পারা যাবে না, ততদিন যেন সরকারি হাসপাতালে 'অব্যবস্থাপনাই বহাল থাকে'_ সেটা কেউ চাইলে তাতে দোষের কিছু হবে না। তাতে অন্তত কিছু গরিব লোকের ব্যাধি-ব্যামোতে চিকিৎসা মিলবে। আর এর প্রধান কারণ 'মানুষ মানুষের জন্য'_ এ আহ্বানে সাড়া দেওয়ার মতো অনেক নারী-পুরুষ এখনও আমাদের সমাজে রয়েছেন। তারা দরিদ্রদের জন্য একটু দরদ ও সহানুভূতির হাত বাড়াতে সদা ব্যাকুল। আমাদের রাষ্ট্রের দুর্ভাগ্য যে, তাদের যথাযথভাবে মানুষের সেবায় কাজে লাগানো যায় না। তাদের জন্য সৃষ্টি হয় না সুযোগের। এ কারণে মানুষ যা সহজে পেতে পারে সেটাও পায় না।
অজয় দাশগুপ্ত :সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
No comments