চরাচর-রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত দক্ষিণডিহি by স্বপন কুমার দাস
অবশেষে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুরবাড়ির সংস্কারকাজ শুরু হয়েছে। বহু প্রতীক্ষিত এ সংস্কারকাজ শুরু হয়েছে এ মাসের গোড়া থেকে। আগামী ২৫ বৈশাখ বিশ্বকবির সার্ধশত জয়ন্তী। কবিগুরুর জয়ন্তী উৎসব বাংলাদেশ ও ভারত যৌথভাবে উদ্যাপন করবে। বিশ্বকবির জন্মবার্ষিকী সুষ্ঠু, সুন্দর ও জাঁকজমকের সঙ্গে পালনের জন্য নেওয়া হয়েছে নানা পরিকল্পনা।
তারই অংশ হিসেবে খুলনা জেলার ফুলতলা উপজেলার দক্ষিণডিহি গ্রামে অবস্থিত কবির শ্বশুরবাড়ির সংস্কারকাজে হাত দেওয়া হয়েছে। তবে স্থানীয় রবীন্দ্রপ্রেমীদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল রবীন্দ্র কমপ্লেঙ্ নির্মাণের। বাংলাদেশে কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোর মধ্যে দক্ষিণডিহি অন্যতম। নানা কারণে এ গ্রামটি গুরুত্ব বহন করে। এ গ্রামেরই মেয়ে ভবতারিণী দেবীকে (মৃণালিনী দেবী) বিয়ে করে (২৪ অগ্রহায়ণ, ১২৯০ বঙ্গাব্দ) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রলম্বিত কুমারজীবনের অবসান ঘটান। রবিঠাকুরের বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও এ গ্রামের মেয়ে সারদা দেবীকে বিয়ে করেন। সে হিসেবে দক্ষিণডিহি রবীন্দ্রনাথের মাতুলালয়ও বটে। শৈশবে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মায়ের সঙ্গে এ গ্রামে বেড়াতে আসেন। বিয়ের আগে কনে দেখা উপলক্ষেও তিনি এ গ্রামে আসেন। জনশ্রুতি আছে, বিয়ের পর আরো একবার তিনি এ গ্রামে আসেন, ওঠেন তাঁর শ্বশুরবাড়িতে। তবে জমিদারি থাকায় শিলাইদহ, শাহজাদপুর ও পতিসরের সঙ্গে তাঁর যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এবং এসব স্থানে দীর্ঘদিন ধরে তিনি যেসব সাহিত্যকর্ম রচনা করেছিলেন, দক্ষিণডিহির ক্ষেত্রে তেমনটি হয়নি। তবে গাছগাছালিপূর্ণ এই গ্রাম রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করেছিল। তাঁর আঁকা বহু চিত্রে গ্রাম্য দৃশ্যের সঙ্গে এ গ্রামের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুর বেনী মাধব রায় চৌধুরী ভবতারিণীকে বিয়ে দেওয়ার পর সপরিবারে কলকাতায় গিয়ে বসবাস শুরু করেন। তাঁর আত্মীয়স্বজনরাই দক্ষিণডিহির এ বাড়িতে বাস করতেন, জমিজমা দেখাশোনা করতেন। তাঁর একমাত্র ছেলে নগেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী মাঝেমধ্যে দক্ষিণডিহি এসে জমিজমার খোঁজখবর নিতেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর তিনিও আর দক্ষিণডিহি আসেননি। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর তাঁদের আত্মীয়স্বজনরাও দেশ ত্যাগ করে ভারত চলে যান। ফলে রবিঠাকুরের শ্বশুরবাড়িসহ অন্যান্য জায়গাজমি অরক্ষিত পড়ে থেকে একসময় বেদখল হয়ে যায়। ইতিহাস থেকে মুছে যায় দক্ষিণডিহি। অবশেষে এগিয়ে আসেন ফুলতলারই সংস্কৃতিসেবী একদল মানুষ ও স্থানীয় সাংবাদিকরা। তাঁরা রবিঠাকুরের শ্বশুরবাড়িটি দখলমুক্ত করে একটি বহুমুখী সংস্কৃতিকেন্দ্র (রবীন্দ্র কমপ্লেঙ্) নির্মাণের জন্য আন্দোলন শুরু করেন। দক্ষিণডিহি নিয়ে প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি প্রদান, মানববন্ধন কর্মসূচি পালন, পত্রপত্রিকায় লেখালেখি_সবই তাঁরা করেন। তাঁরা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে দক্ষিণডিহিতে প্রতিবছর রবীন্দ্রজয়ন্তী ঘটা করে উদ্যাপন শুরু করেন। তাঁদের এ উদ্যোগ মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। অবশেষে টনক নড়ে প্রশাসনের। এগিয়ে আসেন খুলনার তৎকালীন জেলা প্রশাসক কাজী রিয়াজুল হক। তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টায় প্রায় ৪০ বছর পর দখলমুক্ত হয় কবিগুরুর শ্বশুরবাড়ি ও তৎসংলগ্ন কিছু জমি। তিনি ১৯৯৫ সালের ১৪ নভেম্বর বাড়িটির দ্বার উন্মোচন করেন। ১৯৯৯ সালে দক্ষিণডিহি সরকারের স্বীকৃতি লাভ করে। সে বছর থেকে শিলাইদহ, শাহজাদপুর ও পতিসরের পাশাপাশি দক্ষিণডিহিতে সরকারি উদ্যোগে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্যাপন শুরু হয়। বসে মেলা। এরপর থেকে প্রতিবছর এখানে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করা হচ্ছে। জয়ন্তীর সময় এখানে দূর-দূরান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে। মেলার সময় বৃদ্ধি পেয়ে হয় তিন দিন। তা ছাড়া সারা বছরই দেশ-বিদেশ থেকে এখানে হাজার হাজার মানুষের আসা-যাওয়া লেগেই থাকে। তবে রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়িটিই এখানকার মূল আকর্ষণ। দ্বিতল এই বাড়ির নির্মাণশৈলী খুবই সুন্দর। তবে সংস্কারের অভাবে বাড়িটি জীর্ণ হয়ে পড়েছিল। সংস্কৃতিকর্মীদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল বাড়িটিকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্র কমপ্লেঙ্ নির্মাণের, তা তো হয়নি বরং বাড়িটির সংস্কারকাজও ছিল দীর্ঘকাল উপেক্ষিত। এবার রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জয়ন্তী উপলক্ষে তাঁর শ্বশুরবাড়িটির সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ সংস্কারকাজ যথাযথ ও সময়মতো শেষ হলে দক্ষিণডিহি নতুন প্রেরণার সৃষ্টি করবে এবং আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্রেও পরিণত হবে।
স্বপন কুমার দাস
স্বপন কুমার দাস
No comments