মৃত্যুতে নও নিঃশেষ by জোবাইদা নাসরীন
জীবন নিংড়ে ভালোবাসা, আদর্শ আর চেতনা সবাই ধারণ করতে পারেন না এবং সেটি অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার স্পর্ধিত সাহস অনেকেরই থাকে না, কিন্তু সেই সাহসী নির্লোভ জীবনের অধিকারী ছিলেন সাংবাদিক বজলুর রহমান। সময়ের হাত ধরে ৬৭ বছরের যাপিত জীবনে বিলাসী জীবনের ওপর ভর করেননি কখনও, বরং কর্মে, চিন্তায়, ঋজুতায় এবং ধীশক্তিতে ছিলেন প্রাচুর্যময়।
ভালোবেসেছেন যেমন মানুষকে, তেমনি ভালোবাসা পেয়েছেনও। কিন্তু পৃথিবীর সঙ্গে তার সব লেনদেন, ভালোবাসার সব বন্ধন ছিন্ন করেছিলেন ২০০৮ সালের ২৬ এপ্রিল রাতের কিছুটা বিলম্বিত প্রহরে, একেবারেই হৃদয় কাঁপানো আকস্মিকতায়। এই বিদীর্ণতার শোক লেপ্টে থাকে সারাজীবন।
জীবনবাদী মানুষ ছিলেন এই সাংবাদিক। তাই তো তার জীবনের প্রতিটি বাঁকই কীর্তিতে জড়ানো, আদর্শে মোড়ানো। ষাটের দশকে সময়ের দাবিতে, অস্তিত্বশীল জীবনের তাড়নায় রাজপথে হাজির করেছিলেন নিজেকে। ভীষণভাবে চিনে ছিলেন নিজের সত্তাকে। এই চেনা ছিল তার ফেলে আসা জীবন থেকে ভিন্ন। কেননা তখন দেশে চলছে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন। যুক্ত করেছিলেন নিজেকে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে। আর নিজেকে যেন শাণিত করা শুরু করেছিলেন যুক্তির সোপানে, মুক্তির সাম্পানে। সে এক উত্তাল সময়। এদেশের মানুষের অন্যতম সেরা সময়। পরে নিজেকে পুরোপুরিই জড়িয়ে ছিলেন বাম রাজনীতির সঙ্গে। আশির দশক থেকেই শারীরিকভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও বাংলাদেশের প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তার বক্তব্য, বিশ্লেষণ বাংলাদশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে নিঃসন্দেহে। এমনকি সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যে কয়েকজন সাংবাদিক নিজের অবস্থান সমুন্নত রেখে এবং দেশে গণতন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা পালন করেছেন, তিনি তাদের একজন। প্রতিবাদমুখী জীবনবোধ রাজপথের সঙ্গে ভর করেছিল কলমে। সেই ষাটের দশকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সাংবাদিকতাকে। হয়ে উঠেছিলেন চিন্তা-চেতনা আর সৃজনশীলতার একতারা। সব মানুষই প্রায় জীবনকে টেনে নিয়ে যেতে চায় 'আকর্ষণীয়' ক্যারিয়ার, খ্যাতি আর প্রাচুর্যের দরবারে। কিন্তু তিনি সেখানেও অনড়। কোথাও যাননি। বাংলাদেশের প্রাচীনতম পত্রিকা 'দৈনিক সংবাদ'কে আঁকড়ে ধরেছিলেন আমৃত্যু। দীর্ঘদিন ছিলেন এই পত্রিকার সম্পাদক। শুধু তাই নয়, তিনি 'দর্শক' শিরোনামে দেশের বিভিন্ন হালহকিকত নিয়ে কলাম লিখেছেন দীর্ঘদিন। লিখেছেন সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতার নীতিমালা প্রণয়নের জন্যও। 'সিক্রেসি অ্যাক্ট' বাতিল করার জন্যও তার কলম ছিল অত্যন্ত ধারালো। সংবাদ যদি হয় এদেশে সাংবাদিক তৈরির পাঠশালা, অবশ্যই বজলুর রহমান সেই পাঠশালা প্রধান। বাংলাদেশের বর্তমানে খ্যাতিমান সাংবাদিকের বেশিরভাগই তার হাতে তৈরি। এর বাইরে করেছেন আরও একটি যুগান্তকারী কাজ। এদেশের নারী সাংবাদিকতার অন্যতম পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন তিনি। এদেশে 'সংবাদ' পত্রিকাতেই প্রথম রাতের শিফটে নারীরা কাজ করা শুরু করে। তিনি এদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন। তার সম্পাদনায় মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রকাশিত হতো 'মুক্তিযুদ্ধ' পত্রিকা। সেখানে থাকত মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন বীরত্বপূর্ণ খবর, যা অনুপ্রাণিত করত স্বাধীনতাকামী মানুষকে। ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয়ে থাকা মানুষের মধ্যে এই পত্রিকা অনেকটাই মনোবল ফিরিয়ে দিত। এদেশে শিশু সংগঠন গড়ে তোলা সহজ নয়। সেই দুঃসাধ্য কাজটিও করেছেন তিনি। শিশু সংগঠন খেলাঘর তার হাতে বিকশিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। তিনি সব সময়ের জন্য ছিলেন খেলাঘরের শিশু-কিশোরদের অতি আপনজন। 'ভাইয়া' সম্বোধনে অধিক পরিচিত বজলুর রহমান চেয়েছেন শিশুদের দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে গড়ে তুলতে।
মৃত্যুও কখনও কখনও পরাজিত হয় বিশেষ করে যখন মানুষ মৃত্যুর পরও উজ্জ্বল থাকে, দীপ্যমান থাকে। তিনি মৃত্যুকে হারিয়েছেন। তার কর্মময় জীবন, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, অতুলনীয় জীবনবোধ মৃত্যুকে পরাজিত করে জ্বলজ্বল করছে এদেশের মানুষের কাছে। তিনি ছিলেন এবং থাকবেন। তাই তো তার মৃত্যু একটা শারীরিক বিচ্ছেদ মাত্র, তার ভালোবাসার উত্তরাধিকারদের কাছে এর চেয়ে আর কিছুই নয়।
জোবাইদা নাসরীন : শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
zobaidanasreen@gmail.com
জীবনবাদী মানুষ ছিলেন এই সাংবাদিক। তাই তো তার জীবনের প্রতিটি বাঁকই কীর্তিতে জড়ানো, আদর্শে মোড়ানো। ষাটের দশকে সময়ের দাবিতে, অস্তিত্বশীল জীবনের তাড়নায় রাজপথে হাজির করেছিলেন নিজেকে। ভীষণভাবে চিনে ছিলেন নিজের সত্তাকে। এই চেনা ছিল তার ফেলে আসা জীবন থেকে ভিন্ন। কেননা তখন দেশে চলছে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন। যুক্ত করেছিলেন নিজেকে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে। আর নিজেকে যেন শাণিত করা শুরু করেছিলেন যুক্তির সোপানে, মুক্তির সাম্পানে। সে এক উত্তাল সময়। এদেশের মানুষের অন্যতম সেরা সময়। পরে নিজেকে পুরোপুরিই জড়িয়ে ছিলেন বাম রাজনীতির সঙ্গে। আশির দশক থেকেই শারীরিকভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও বাংলাদেশের প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তার বক্তব্য, বিশ্লেষণ বাংলাদশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে নিঃসন্দেহে। এমনকি সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যে কয়েকজন সাংবাদিক নিজের অবস্থান সমুন্নত রেখে এবং দেশে গণতন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা পালন করেছেন, তিনি তাদের একজন। প্রতিবাদমুখী জীবনবোধ রাজপথের সঙ্গে ভর করেছিল কলমে। সেই ষাটের দশকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সাংবাদিকতাকে। হয়ে উঠেছিলেন চিন্তা-চেতনা আর সৃজনশীলতার একতারা। সব মানুষই প্রায় জীবনকে টেনে নিয়ে যেতে চায় 'আকর্ষণীয়' ক্যারিয়ার, খ্যাতি আর প্রাচুর্যের দরবারে। কিন্তু তিনি সেখানেও অনড়। কোথাও যাননি। বাংলাদেশের প্রাচীনতম পত্রিকা 'দৈনিক সংবাদ'কে আঁকড়ে ধরেছিলেন আমৃত্যু। দীর্ঘদিন ছিলেন এই পত্রিকার সম্পাদক। শুধু তাই নয়, তিনি 'দর্শক' শিরোনামে দেশের বিভিন্ন হালহকিকত নিয়ে কলাম লিখেছেন দীর্ঘদিন। লিখেছেন সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতার নীতিমালা প্রণয়নের জন্যও। 'সিক্রেসি অ্যাক্ট' বাতিল করার জন্যও তার কলম ছিল অত্যন্ত ধারালো। সংবাদ যদি হয় এদেশে সাংবাদিক তৈরির পাঠশালা, অবশ্যই বজলুর রহমান সেই পাঠশালা প্রধান। বাংলাদেশের বর্তমানে খ্যাতিমান সাংবাদিকের বেশিরভাগই তার হাতে তৈরি। এর বাইরে করেছেন আরও একটি যুগান্তকারী কাজ। এদেশের নারী সাংবাদিকতার অন্যতম পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন তিনি। এদেশে 'সংবাদ' পত্রিকাতেই প্রথম রাতের শিফটে নারীরা কাজ করা শুরু করে। তিনি এদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন। তার সম্পাদনায় মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রকাশিত হতো 'মুক্তিযুদ্ধ' পত্রিকা। সেখানে থাকত মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন বীরত্বপূর্ণ খবর, যা অনুপ্রাণিত করত স্বাধীনতাকামী মানুষকে। ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয়ে থাকা মানুষের মধ্যে এই পত্রিকা অনেকটাই মনোবল ফিরিয়ে দিত। এদেশে শিশু সংগঠন গড়ে তোলা সহজ নয়। সেই দুঃসাধ্য কাজটিও করেছেন তিনি। শিশু সংগঠন খেলাঘর তার হাতে বিকশিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। তিনি সব সময়ের জন্য ছিলেন খেলাঘরের শিশু-কিশোরদের অতি আপনজন। 'ভাইয়া' সম্বোধনে অধিক পরিচিত বজলুর রহমান চেয়েছেন শিশুদের দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে গড়ে তুলতে।
মৃত্যুও কখনও কখনও পরাজিত হয় বিশেষ করে যখন মানুষ মৃত্যুর পরও উজ্জ্বল থাকে, দীপ্যমান থাকে। তিনি মৃত্যুকে হারিয়েছেন। তার কর্মময় জীবন, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, অতুলনীয় জীবনবোধ মৃত্যুকে পরাজিত করে জ্বলজ্বল করছে এদেশের মানুষের কাছে। তিনি ছিলেন এবং থাকবেন। তাই তো তার মৃত্যু একটা শারীরিক বিচ্ছেদ মাত্র, তার ভালোবাসার উত্তরাধিকারদের কাছে এর চেয়ে আর কিছুই নয়।
জোবাইদা নাসরীন : শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
zobaidanasreen@gmail.com
No comments