রাজনীতি-দিলি্লর দরবারে বিএনপির ধরনা by এম আবদুল হাফিজ

বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক ভারত সফর ঘিরে গুঞ্জন এখনও থামেনি। একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর তাৎপর্য বিশ্লেষণ অব্যাহত রয়েছে। যতই এ সফরের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং মাঝে মধ্যে দলের অভ্যন্তরেই পরস্পরবিরোধী ভাষ্য পাওয়া যাচ্ছে, ক্রমেই বিষয়টি দুর্বোধ্য হয়ে উঠছে।


দলের একটি অংশের দাবি অনুযায়ী, দলের ভারতনীতি অপরিবর্তিতই আছে। কিন্তু আমরা যারা কালের সাক্ষী তারা তো স্বাধীনতা-উত্তর ঘটনা পরম্পরায় প্রত্যক্ষভাবেই দেখেছি এবং বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছি যে, বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের কর্তৃত্ব ও আধিপত্যবাদ বিএনপির জন্মলগ্ন থেকেই দলটির গতিধারা নির্ধারণে ভূমিকা রেখেছিল। তবে তারও অনেক আগে থেকেই, বস্তুত স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই আমরা বাংলাদেশিরা ভারত-বন্ধুত্বের অনাকাঙ্ক্ষিত আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম।
পাকিস্তানি শাসনের জোয়ালমুক্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ভারতের মুরবি্বয়ানা এবং এ দেশ নিয়ে অতি তৎপরতা কেউ সুনজরে দেখেনি। সম্ভবত সে কারণেই ভারতের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মাত্রাতিরিক্ত সৌহার্দ্য তার পতনকে ত্বরান্বিত করে থাকবে। উল্লেখ্য, পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনেও বঙ্গবন্ধু একইভাবে বল্গাহীন আবেগের শিকার ছিলেন। পাকিস্তানে থাকতেই সে দেশের এক জাঁদরেল সাংবাদিক জেডএ সুলেরির একটি নিবন্ধে পড়েছিলাম, মুসলিম লীগের কোনো এক কাউন্সিল অধিবেশনে যোগ দিতে আর্থিক সামর্থ্যের অভাবে সাইকেলে করে বঙ্গবন্ধু কলকাতা থেকে দিলি্ল গিয়েছিলেন। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর শেখ মুজিবের অতীত বিবেচনায় তারই হাতে ক্ষমতা অর্পণের ওকালতি এই কাহিনীর জের ধরেই সুলেরি করেছিলেন বলেই আমার ধারণা।
একই রকমের আবেগ বঙ্গবন্ধুর মধ্যে পরিলক্ষিত হলো সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে, যেখানে তিনি ভারতীয়দের ব্যাপারে অন্ধ। স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছিল বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ কমান্ডের অধীনে এবং ১৬ ডিসেম্বর তাত্তি্বকভাবে এ কমান্ডের কাছেই পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করেছিল। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া বিপুল অস্ত্রভাণ্ডার ভারতীয়রা একতরফা তাদের দখলে নিয়ে নেয়। এত বছরেও শেখ মুজিবসহ বাংলাদেশের কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। কেন আমাদের নেতৃত্বের এই বশংবদতা? নাকি আমাদের কষ্টার্জিত দেশে আমরাই অনাহূত আগন্তুক বা পরবাসী।
স্বাধীনতার প্রথম প্রহরেই আমাদের নেতৃত্বের অন্ধ ভারতপ্রীতিতে মর্মাহত হয়েছিল এ দেশের স্বদেশপ্রেমিক মানুষ। হত্যা, ক্যু এবং নানা মুখোশে একাধিক অপশক্তির উত্থান অবশ্যই কাম্য নয়। কিন্তু দেশের স্বাধীনতা ও স্বার্থের প্রশ্নে কোনো দেশপ্রেমিক আপস করতে পারে না। সুশৃঙ্খল সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সম্পর্কে তো তা চিন্তাই করা যায় না। বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে মর্মান্তিক মৃত্যুর পর ক্ষমতা দখলে ক্যু ও পাল্টা ক্যুর ধারায় জিয়াউর রহমান ক্ষমতার শীর্ষে উন্নীত হয়েছিলেন, যখন ভারতবিরোধী একটি মনোভাব এ দেশে তুঙ্গে। একইভাবে ভারতেও তখন চলছে মুজিব-উত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারা-প্রকৃতি নিয়ে এক ধরনের স্নায়ু বৈকল্য। এমনই একটি স্পর্শকাতর সময়ে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বিনা প্রতিবন্ধকতায় ভারতের তৎকালীন নেতৃত্বের সঙ্গে এক সমীকরণে পেঁৗছতে সক্ষম হন। তখনও দিলি্লতে প্রধানমন্ত্রিত্বের আসনে ইন্দিরা গান্ধী। বিস্ময়কর যে, কোনো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছাড়াই জিয়াউর রহমান কোনো তোষামোদ বা আনুগত্য প্রকাশ না করেই ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে সখ্য গড়ে তোলেন। তখন ভারতীয় নেতৃত্বে জিয়াউর রহমান সম্পর্কে কোনো তির্যক প্রশ্ন ওঠেনি, কেউ তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেনি বা তার শাসনকালে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো উৎকণ্ঠা দেখা যায়নি। যদিও তখন পর্যন্ত বাংলাদেশ-ভারতের পঁচিশ বছরের বন্ধুত্ব চুক্তি বহাল ছিল। আমার মনে পড়ে, সে সময়ে কোনো বিদেশি সাংবাদিক জিয়াকে এই চুক্তি সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তার সংক্ষিপ্ত মন্তব্য ছিল_ ঞযধঃ্থং ঃযবৎব, নঁঃ রঃ ফড়বংহ্থঃ নড়ঃযবৎ ঁং। বস্তুত ইতিমধ্যে চুক্তিটির কার্যকারিতা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। জিয়ার কূটনৈতিক প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের স্বীকৃতি মেলে যখন ওআইসি তাকে ইরাক-ইরান বিবাদ নিষ্পত্তির জন্য শুধু তাকে নিয়ে এক ব্যক্তি সমন্বিত দূতিয়ালির দায়িত্ব দেয়। ইতিমধ্যে সমগ্র আরব-মুসলিম বিশ্ব এই স্বল্প পরিচিত মানুষটিকে বুঝতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল।
সমগ্র বিশ্ব ব্যবস্থায়ই একটি অসমতা বিরাজ করলেও কেউ কেউ চাইলে তার ব্যক্তিত্বের জোরে বিরাজমান সমতার অভাবকে কাটিয়ে উঠতে পারে। জিয়াউর সহজেই সেটা করেছিলেন। আমরা যতদূর জানি, বাংলাদেশ-ভারত সমস্যা তখনও ছিল কিন্তু তা দুই দেশের সম্পর্কে অলঙ্ঘনীয় বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে জিয়াউর রহমান আবেগবর্জিত বাস্তবতার ভিতে দাঁড় করিয়ে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তন ঘটিয়ে এ দেশের মানুষকে একটি অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে মুক্তি দেন।
এখানে উপলব্ধির বিষয় এই যে, রাষ্ট্রপতি জিয়ার এবং বর্তমানের বিএনপি অভিন্ন নয়। যদিও জিয়ার প্রবর্তিত রাজনৈতিক ধারা অবলম্বন করে খালেদা জিয়া রাজনীতির পথে যাত্রা শুরু করেন, সময়ের সঙ্গে সেই ধারা থেকে অনেকটাই সরে আসেন তিনি। দৃষ্টান্তস্বরূপ জিয়ার সততাকে তিনি ধরে রাখতে পারেননি। তার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে পরিবারতন্ত্রও ঢুকে পড়েছে তার রাজনীতিতে। স্বাধীনতার পরের এক ক্রান্তিকালে জিয়া সব মত ও পথের রাজনীতিক, পেশাজীবী এবং বাম ও দক্ষিণপন্থিদের সমন্বয়ে তার গঠিত দলে সরাসরি কোনো জামায়াত নেতাকে স্থান দেননি। ২০০১ সালে খালেদা জিয়া ওই জামায়াতকে নিয়েই জোট গঠন করেছিলেন।
অতঃপর খালেদা জিয়া তার পুরো মেয়াদে দেশটাকে যথেচ্ছ লুটপাট করে ক্ষমতা থেকে এক প্রকার বিতাড়িত হয়েই জেলে যান। খালেদা জিয়ার ভাগ্য প্রসন্ন যে, তার উত্তরসূরিদের অর্থাৎ বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামীরা লুটপাটে তার শাসনামলের রেকর্ডকে ভাঙতে পারায় তার জন্য একটি সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। এই সম্ভাবনাকে ফলপ্রসূ করতেই চীন ও ভারতে তার ধরনা। যদিও এ কথা কে না জানে যে, বিএনপির রাজনীতির মূল স্লোগানই হলো_ 'দেশ বাঁচাও, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বাঁচাও' প্রতিবেশী ভারতের আধিপত্যবাদের ছোবল থেকে। যারা বিএনপিকে ভোট দেয় তারা বিএনপির এ স্লোগানে উজ্জীবিত হয়েই ভোট দেয়।
কিন্তু তবু সরকার দিলি্ল গিয়ে ভারতের সঙ্গে যেসব দেনদরবার করে বিএনপিও তা-ই করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ভারতের পরম বন্ধু আওয়ামী লীগই ভারতের চাণক্য বুদ্ধির দরিয়ায় যা পায় না, বিএনপি কী করে ভাবল যে সাউথ ব্লকের কুশলীর কাছে বিএনপি পাত্তা পাবে? নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। বিএনপি জানে যে, শুধু স্লোগান দিয়ে নির্বাচন জেতা যায় না। ক্ষমতাসীনদের তূণে যে পরিমাণ তীর মজুদ আছে তার কিয়দংশ প্রয়োগ করলেই বিএনপি কুপোকাত! তাই তাদের বিদেশি পৃষ্ঠপোষকতা ও আনুকূল্য দরকার। সে জন্যই হন্যে হয়ে বিএনপি নেত্রী 'আধিপত্যবাদী' ভারতের দ্বারস্থ হতেও লজ্জাবোধ করেন না। কিন্তু বিএনপি নেত্রী কি কখনও ভেবেছেন, তার ভারতীয় আধিপত্যবাদ ঠেকানোর স্লোগানেই শুধু এখন আধিপত্যবাদবিরোধী জনগণ তার দলকে ভোট দেয়? তিনি যদি কোনো আঙ্গিকে ভারতীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কিছু ভাগ বসাতেও পারেন, তার চেয়ে অধিক পরিমাণ জনসমর্থন তিনি দেশের অভ্যন্তরেই হারাবেন। আসলে দিলি্লর দরবার বা বেইজিংয়ের ড্রাগনপ্রীতি শুধুই মায়া, শুধুই মরীচিকা। বাংলাদেশে ক্ষমতার দুর্গে প্রবেশের চাবি একমাত্র জনগণের হাতে। এ দেশের যে জনগণ জিয়া-উত্তরাধিকারের বদৌলতে খালেদা জিয়াকে এত ভালোবাসে এবং দলের দুর্দিনেও পাঁচটি কেন দশটি আসনও তার হাতে তুলে দিতে প্রস্তুত থাকে_ তাদের ওপর তিনি নির্ভর করতে পারছেন না কেন?

ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস ও
কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.