আদমশুমারি-২০১১-ডিজিটাল লোকগণনা যেন নির্ভুল হয় by এ কে এম নূর-উন-নবী
গণনা থেকে প্রাপ্ত তথ্য কাজে লাগানো হবে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং স্বাস্থ্য-পুষ্টি-শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে কর্মসূচি চূড়ান্ত করার জন্য। গোড়ায় গলদ থাকলে পদে পদে সমস্যা সৃষ্টি হবে, সেটা যে কেউ বুঝতে পারে। কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী খাদ্য উৎপাদন সংক্রান্ত পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।
এটাকে আমরা এ প্রতিষ্ঠানের প্রতি গুরুতর চ্যালেঞ্জ বলেই ধরে নিতে পারি বাংলাদেশে লোকগণনা হবে ১৪ মার্চ গভীর রাত থেকে। চলবে ১৯ মার্চ পর্যন্ত। দশ বছর পরপর এ ধরনের গণনা করা হয়। প্রথম গণনা করা হয় ১৯৭৪ সালে। ব্রিটিশ শাসন ও পাকিস্তানের লোকগণনার ধারাবাহিকতায় এ কাজ ১৯৭১ সালেই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটা ছিল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বছর। তাই নতুন সময় নির্ধারণ করতে হয়। দ্বিতীয় সেন্সাস ১৯৮১ সালে করা হয় এবং পরেরগুলো সময়মতোই অনুষ্ঠিত হয়। চতুর্থ লোকগণনা সম্পন্ন হয় ২০০১ সালের জানুয়ারি মাসে।
এবারের লোকগণনা ডিজিটাল পদ্ধতিতে করা হবে। প্রতিটি বাড়িতে নির্দিষ্ট ফরম নিয়ে কর্মীরা যাবেন এবং ২৫টি প্রশ্নের উত্তর জানবেন। এর মধ্যে ১৪টি ব্যক্তিগত এবং ১১টি পারিবারিক ও বাসগৃহ সংক্রান্ত। আমার মতো আরও অনেকেরই তথ্য ফরমে একটি বিষয়ে প্রশ্ন অন্তর্ভুক্ত করার তাগিদ ছিল_ নাগরিকদের স্থানান্তর। গ্রাম থেকে শহরে এবং শহর থেকে গ্রামে কতসংখ্যক লোক স্থায়ীভাবে চলে যাচ্ছে। এটা জানা জরুরি হয়ে পড়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ স্থানান্তর গ্রাম থেকে শহরেই ঘটছে। নানা পেশা ও শ্রেণী এবং নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে এটা ঘটছে বলেই ধারণা করা হয়। এ স্থানান্তর বা মাইগ্রেশনের বিস্তারিত জানা সম্ভব হলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ সহজ হতে পারে।
পরিসংখ্যান ব্যুরো এ সংক্রান্ত প্রশ্ন অন্তর্ভুক্ত না করার একটি কারণ হতে পারে যে, তারা আদর্শ বা নমুনা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্সাস ব্যুরোর ফরমকে বেছে নিয়েছে এবং সেখান থেকে সরে আসতে অনীহা। অতীতে যে রকমের ফরম ব্যবহার করা হয়েছে এবারেও সেটাই অনুসরণ করা হচ্ছে_ এমন যুক্তিও তারা দেখাতে পারেন। তবে আমার ধারণা, ফরমটি নিয়ে সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে সিরিয়াস আলোচনা হলে মাইগ্রেশন ইস্যুটি রাখার পক্ষে মতামত পাওয়া যেত।
রাজধানী ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য প্রতিদিন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী-পুরুষ-শিশু আসছে। এদের সংখ্যা কত, তার প্রকৃত হিসাব কারও জানা আছে বলে মনে হয় না। এ স্থানান্তরের কারণ কী, সেটা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে পারলে ভালো হয়। এর সঙ্গে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান সূত্র বের করার প্রশ্ন জড়িত। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, পল্লী উন্নয়ন, স্থানীয় সরকার পরিচালনা, স্বাস্থ্য সুবিধার সম্প্রসারণ ইত্যাদি বিষয়ে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার জন্য এর প্রয়োজন রয়েছে।
লোকগণনার কাজ ডিজিটাল হচ্ছে, এটা সুখবর। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে, তথ্য সংগ্রহের জন্য বাড়ি বাড়ি যাবে একদল মানুষ এবং প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নও হবে মানুষের হাতে। বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে যারা তাদের কাজ ঠিকভাবে হচ্ছে কি-না, সে জন্য পর্যবেক্ষক টিম গঠন করা প্রয়োজন। পরিসংখ্যান ব্যুরো কিংবা এ সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রশ্ন করা হলে তৈরি উত্তর মিলবে_ কমিটি তো রয়েছে এবং এতে জনপ্রতিনিধিদেরও রাখা হয়েছে। তারাই মনিটর করবে। কিন্তু আমাদের পরিসংখ্যান ব্যুরোর ভাবমূর্তি সংকট রয়েছে এবং তা থেকে বের হয়ে আসার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা অপরিহার্য। সাধারণ নির্বাচন কিংবা স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন সংস্থার নির্বাচনের সময় দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক দল সক্রিয় থাকে। তাদের রিপোর্টের ওপর নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা অনেক ক্ষেত্রে নির্ধারিত হয়ে থাকে। বিশেষভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে নির্বাচনের ফল কতটা গ্রহণযোগ্য হবে তার ভিত্তি হিসেবে অনেক ক্ষেত্রেই পর্যবেক্ষকদের রিপোর্টকে ধরে নিতে দেখা গেছে। এবারে লোকগণনা রিপোর্টকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে এ ধরনের পর্যবেক্ষক টিমের রিপোর্ট ভূমিকা রাখতে পারে। এর সময় চলে যায়নি। তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য হাতে সামান্য সময়ই রয়েছে যে!
দশ বছর আগে ২০০১ সালের লোকগণনার সময় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোককে গণনার বাইরে রাখার অভিযোগ উঠেছিল। হয়তো অনিচ্ছাকৃতভাবে সেটা হয়েছে, কিংবা ছিল কর্মীদের গাফিলতি। তখন সংবাদপত্রে 'আদম হইলাম, শুমার হইলাম না' শিরোনামে কলামও লেখা হয়েছিল। কয়েক বছর আগে সাধারণ নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রণীত হলে এক কোটির বেশি ভুয়া নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে এবং পরে জানা যায় যে, তা একেবারে অমূলক ছিল না। লোকগণনার ক্ষেত্রে দুই ধরনের সমস্যা হতে পারে_ এক লোককে একাধিকবার গণনা কিংবা কাউকে গণনা থেকে একেবারেই বাদ দেওয়া। এ ক্ষেত্রে সামান্য ভুল হয়তো মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু এ গণনা থেকে প্রাপ্ত তথ্য কাজে লাগানো হবে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং স্বাস্থ্য-পুষ্টি-শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে কর্মসূচি চূড়ান্ত করার জন্য। গোড়ায় গলদ থাকলে পদে পদে সমস্যা সৃষ্টি হবে, সেটা যে কেউ বুঝতে পারে। কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী খাদ্য উৎপাদন সংক্রান্ত পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। এটাকে আমরা এ প্রতিষ্ঠানের প্রতি গুরুতর চ্যালেঞ্জ বলেই ধরে নিতে পারি। আমাদের জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের বসবাস গ্রামে। কৃষিতে নির্ভরতা ব্যাপক। এ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীই যদি বলেন যে, সরকারি প্রতিষ্ঠানটির (পরিসংখ্যান ব্যুরো) কৃষি সংক্রান্ত তথ্য আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়, তাহলে যথেষ্ট উদ্বেগ সৃষ্টি হয় বৈকি। লোকগণনা নিয়ে এমন প্রশ্ন উঠলে বিপদের মাত্রা অনেক বেড়ে যাবে।
এবারে লোকগণনার কাছাকাছি সময়েই মাতৃমৃত্যু এবং স্বাস্থ্য বিষয়ে দুটি জরিপ পরিচালনা করা হচ্ছে। অর্থাৎ তিন ধরনের রিপোর্ট আমরা পাচ্ছি। একটির সঙ্গে আরেকটির গরমিল থাকলে কোনো রিপোর্টই তেমন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। আমাদের প্রকৃত জনসংখ্যা কত, সেটা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এতে পরিকল্পনা প্রণেতারা সমস্যায় পড়েন, পরিসংখ্যান ব্যুরোর অন্যান্য তথ্যও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ডিজিটাল পদ্ধতির লোকগণনা প্রশ্নবিদ্ধ হোক, এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। দেশের সার্বিক উন্নয়নে একটি স্বচ্ছ পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে চাই আমরা। লোকগণনার রিপোর্ট ধোঁয়াশার মধ্যে না ফেলে।
বাংলাদেশের সামনে রয়েছে ভিশন ২০২১। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরে দেশ আর্থ-সামাজিক অনেক সূচকে ভালোর দিকে বদলে যাবে, এমনই প্রত্যাশা। লোকগণনার কাজ সঠিকভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে কি-না, সে বিষয়ে পর্যবেক্ষণ কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার বিষয়টি আগেই বলেছি। প্রাথমিক রিপোর্ট প্রকাশের পর তা পরীক্ষার কাজ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে। এটা সুসংবাদ হিসেবে ধরে নেব। তবে তারা কী মেথডোলজি ব্যবহার করছে, সেটা জানা থাকলে ভালো হয়। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে খোলামেলা আলোচনা হওয়া বাঞ্ছনীয়।
গণনাকর্মীরা বাড়ি বাড়ি যাওয়ার সময় সমস্যায় পড়বে, এটা স্বাভাবিক। ভোটার তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রেও এটা দেখা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র প্রফেসরের বাড়ির দরজা না খোলার ঘটনাও আমরা শুনেছি। বিশেষ করে বাড়িতে পুরুষ লোক না থাকলে অনেক মহিলা দরজা খুলতে রাজি হয় না। আবার দেখা যায় যে, বাড়িতে এমন লোকের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে ফরম পূরণ করা হয়, যাতে ভুল থাকার সম্ভাবনা বেশি। এ অবস্থায় কী করণীয়, সেটা নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে আলোচনা হওয়া দরকার। পরিসংখ্যান ব্যুরো জানিয়েছে, তারা এ সমস্যার সমাধানের জন্য নারীকর্মী বেশি নিয়োগ করেছে। তবে এ ধরনের সমস্যা বেশি হলে অনেক লোক গণনার বাইরে থেকে যেতে পারে। আবার উপযুক্ত তথ্যদাতা ঘরে না থাকলে ২৫টি প্রশ্নের কোনো কোনোটির ক্ষেত্রে গড় ধরনের গরমিল হতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, এর মাত্রা কতটা হতে পারে? এর উত্তর এখনই দেওয়া সম্ভব নয়। আমরা কেবল আশা ব্যক্ত করতে পারি যে এমনটি যেন অতি সীমিত পরিসরে ঘটে।
এবারে একটি বিষয় লক্ষ্য করছি এবং তা হচ্ছে পর্যাপ্ত প্রচারের অভাব। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারে এ নিয়ে অনুষ্ঠান এবং বিজ্ঞাপন প্রচার হচ্ছে। কিন্তু সার্বিকভাবে গণমাধ্যমে লোকগণনা ইস্যু এখনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠতে পারেনি। বিশ্বকাপ ক্রিকেট নিয়ে গণমাধ্যমে যে উন্মাদনা, তেমনটি লোকগণনার ক্ষেত্রে আশা করা যায় না। কিন্তু এ বিষয়টি নিয়ে মানুষের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করতেই হবে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গকেও এ কাজে যুক্ত করা দরকার। কেন লোকগণনার এমন আয়োজন, সেটা বোঝাতে হবে। এখন পর্যন্ত এমনকি রাজধানী ঢাকাতেও লোকগণনা সংক্রান্ত পোস্টার ও ব্যানার আমার নজরে আসেনি। ঢাকার বাইরের চিত্রও ভিন্ন কিছু নয়। প্রাইভেট টেলিভিশন চ্যানেলে এ নিয়ে তেমন প্রচার নজরে আসছে না। সংবাদপত্রে কলাম নজরে এসেছে, কিন্তু নিউজের অংশ কম মনে হচ্ছে। আয়োজকরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, ১৫-১৬ কোটি লোক নিয়েই তাদের কাজ করতে হবে। কেউ যেন বাদ না পড়ে এবং কারও সম্পর্কে যে ভুল কিংবা বিভ্রান্তিকর তথ্য সংগ্রহ করা নয়। আগামী দশ বছর আমাদের অনেক পরিকল্পনার ভিত্তি হবে মধ্য মার্চে পাওয়া তথ্য। এখন এই বিশ্বকাপ ক্রিকেট উন্মাদনার মধ্যেও তাই অনুরোধ করব, বিষয়টি ব্যাপক প্রচারণায় আনুন। কেবল পরিসংখ্যান ব্যুরোর ওপর নির্ভর করলে এ লক্ষ্য অর্জন করা যাবে না। গোটা সরকারকে সর্বশক্তি দিয়ে সমন্বিতভাবে লাগতে হবে। লোকগণনা যে শুধু মাথাগণনার মধ্যে সীমিত নয়, নীতিনির্ধারকদের নিশ্চয়ই সে ধারণা স্পষ্ট। এ থেকে প্রাপ্ত তথ্য দশ বছর ধরে অনেক অনেক কাজে ব্যবহার করা হবে। বিষয়টি অনেকটা ঘরের বাজার করার মতো। আমরা বাজার থেকে যা কিনে আনি তা রান্না করে যথাযথভাবে পরিবেশন করা হয়। লোকগণনার মধ্য দিয়ে আমরা প্রথম ধাপ অতিক্রম করব। কিন্তু ভালো বাজার না হলে যেমন ভালো রান্না হয় না, তেমনি লোকগণনা ঠিকভাবে না হলেও তা ব্যবহার করে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে না।
২০০১ সালের লোকগণনার চূড়ান্ত রিপোর্ট সময়মতো প্রকাশ করা যায়নি। ফুলকাউন্ট রিপোর্ট তো আলোর মুখই দেখেনি। এ বছর তেমন হবে না তো? বলা হচ্ছে, ডিজিটাল পদ্ধতিতে কাজ হওয়ায় তিন মাসের মধ্যে প্রাথমিক রিপোর্ট মিলবে। এ সময়সীমা রক্ষা করতে হবে। পরবর্তী ধাপগুলোর কাজও হওয়া চাই সময়মতো। দেশ-বিদেশে লোকগণনা থেকে প্রাপ্ত তথ্য ব্যবহার করা হবে। উন্নয়নের জন্য এ তথ্য হবে অপরিহার্য। এ কারণে কাজের ক্ষেত্রে ভুলের মাত্রা সর্বনিম্ন পর্যায়ে কমিয়ে আনার প্রতি থাকা চাই সর্বোচ্চ মনোযোগ।
এ কে এম নূর-উন-নবী : অধ্যাপক পপুলেশন সায়েন্স বিভাগ, ঢাবি
এবারের লোকগণনা ডিজিটাল পদ্ধতিতে করা হবে। প্রতিটি বাড়িতে নির্দিষ্ট ফরম নিয়ে কর্মীরা যাবেন এবং ২৫টি প্রশ্নের উত্তর জানবেন। এর মধ্যে ১৪টি ব্যক্তিগত এবং ১১টি পারিবারিক ও বাসগৃহ সংক্রান্ত। আমার মতো আরও অনেকেরই তথ্য ফরমে একটি বিষয়ে প্রশ্ন অন্তর্ভুক্ত করার তাগিদ ছিল_ নাগরিকদের স্থানান্তর। গ্রাম থেকে শহরে এবং শহর থেকে গ্রামে কতসংখ্যক লোক স্থায়ীভাবে চলে যাচ্ছে। এটা জানা জরুরি হয়ে পড়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ স্থানান্তর গ্রাম থেকে শহরেই ঘটছে। নানা পেশা ও শ্রেণী এবং নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে এটা ঘটছে বলেই ধারণা করা হয়। এ স্থানান্তর বা মাইগ্রেশনের বিস্তারিত জানা সম্ভব হলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ সহজ হতে পারে।
পরিসংখ্যান ব্যুরো এ সংক্রান্ত প্রশ্ন অন্তর্ভুক্ত না করার একটি কারণ হতে পারে যে, তারা আদর্শ বা নমুনা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্সাস ব্যুরোর ফরমকে বেছে নিয়েছে এবং সেখান থেকে সরে আসতে অনীহা। অতীতে যে রকমের ফরম ব্যবহার করা হয়েছে এবারেও সেটাই অনুসরণ করা হচ্ছে_ এমন যুক্তিও তারা দেখাতে পারেন। তবে আমার ধারণা, ফরমটি নিয়ে সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে সিরিয়াস আলোচনা হলে মাইগ্রেশন ইস্যুটি রাখার পক্ষে মতামত পাওয়া যেত।
রাজধানী ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য প্রতিদিন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী-পুরুষ-শিশু আসছে। এদের সংখ্যা কত, তার প্রকৃত হিসাব কারও জানা আছে বলে মনে হয় না। এ স্থানান্তরের কারণ কী, সেটা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে পারলে ভালো হয়। এর সঙ্গে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান সূত্র বের করার প্রশ্ন জড়িত। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, পল্লী উন্নয়ন, স্থানীয় সরকার পরিচালনা, স্বাস্থ্য সুবিধার সম্প্রসারণ ইত্যাদি বিষয়ে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার জন্য এর প্রয়োজন রয়েছে।
লোকগণনার কাজ ডিজিটাল হচ্ছে, এটা সুখবর। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে, তথ্য সংগ্রহের জন্য বাড়ি বাড়ি যাবে একদল মানুষ এবং প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নও হবে মানুষের হাতে। বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে যারা তাদের কাজ ঠিকভাবে হচ্ছে কি-না, সে জন্য পর্যবেক্ষক টিম গঠন করা প্রয়োজন। পরিসংখ্যান ব্যুরো কিংবা এ সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রশ্ন করা হলে তৈরি উত্তর মিলবে_ কমিটি তো রয়েছে এবং এতে জনপ্রতিনিধিদেরও রাখা হয়েছে। তারাই মনিটর করবে। কিন্তু আমাদের পরিসংখ্যান ব্যুরোর ভাবমূর্তি সংকট রয়েছে এবং তা থেকে বের হয়ে আসার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা অপরিহার্য। সাধারণ নির্বাচন কিংবা স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন সংস্থার নির্বাচনের সময় দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক দল সক্রিয় থাকে। তাদের রিপোর্টের ওপর নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা অনেক ক্ষেত্রে নির্ধারিত হয়ে থাকে। বিশেষভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে নির্বাচনের ফল কতটা গ্রহণযোগ্য হবে তার ভিত্তি হিসেবে অনেক ক্ষেত্রেই পর্যবেক্ষকদের রিপোর্টকে ধরে নিতে দেখা গেছে। এবারে লোকগণনা রিপোর্টকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে এ ধরনের পর্যবেক্ষক টিমের রিপোর্ট ভূমিকা রাখতে পারে। এর সময় চলে যায়নি। তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য হাতে সামান্য সময়ই রয়েছে যে!
দশ বছর আগে ২০০১ সালের লোকগণনার সময় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোককে গণনার বাইরে রাখার অভিযোগ উঠেছিল। হয়তো অনিচ্ছাকৃতভাবে সেটা হয়েছে, কিংবা ছিল কর্মীদের গাফিলতি। তখন সংবাদপত্রে 'আদম হইলাম, শুমার হইলাম না' শিরোনামে কলামও লেখা হয়েছিল। কয়েক বছর আগে সাধারণ নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রণীত হলে এক কোটির বেশি ভুয়া নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে এবং পরে জানা যায় যে, তা একেবারে অমূলক ছিল না। লোকগণনার ক্ষেত্রে দুই ধরনের সমস্যা হতে পারে_ এক লোককে একাধিকবার গণনা কিংবা কাউকে গণনা থেকে একেবারেই বাদ দেওয়া। এ ক্ষেত্রে সামান্য ভুল হয়তো মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু এ গণনা থেকে প্রাপ্ত তথ্য কাজে লাগানো হবে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং স্বাস্থ্য-পুষ্টি-শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে কর্মসূচি চূড়ান্ত করার জন্য। গোড়ায় গলদ থাকলে পদে পদে সমস্যা সৃষ্টি হবে, সেটা যে কেউ বুঝতে পারে। কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী খাদ্য উৎপাদন সংক্রান্ত পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। এটাকে আমরা এ প্রতিষ্ঠানের প্রতি গুরুতর চ্যালেঞ্জ বলেই ধরে নিতে পারি। আমাদের জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের বসবাস গ্রামে। কৃষিতে নির্ভরতা ব্যাপক। এ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীই যদি বলেন যে, সরকারি প্রতিষ্ঠানটির (পরিসংখ্যান ব্যুরো) কৃষি সংক্রান্ত তথ্য আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়, তাহলে যথেষ্ট উদ্বেগ সৃষ্টি হয় বৈকি। লোকগণনা নিয়ে এমন প্রশ্ন উঠলে বিপদের মাত্রা অনেক বেড়ে যাবে।
এবারে লোকগণনার কাছাকাছি সময়েই মাতৃমৃত্যু এবং স্বাস্থ্য বিষয়ে দুটি জরিপ পরিচালনা করা হচ্ছে। অর্থাৎ তিন ধরনের রিপোর্ট আমরা পাচ্ছি। একটির সঙ্গে আরেকটির গরমিল থাকলে কোনো রিপোর্টই তেমন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। আমাদের প্রকৃত জনসংখ্যা কত, সেটা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এতে পরিকল্পনা প্রণেতারা সমস্যায় পড়েন, পরিসংখ্যান ব্যুরোর অন্যান্য তথ্যও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ডিজিটাল পদ্ধতির লোকগণনা প্রশ্নবিদ্ধ হোক, এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। দেশের সার্বিক উন্নয়নে একটি স্বচ্ছ পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে চাই আমরা। লোকগণনার রিপোর্ট ধোঁয়াশার মধ্যে না ফেলে।
বাংলাদেশের সামনে রয়েছে ভিশন ২০২১। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরে দেশ আর্থ-সামাজিক অনেক সূচকে ভালোর দিকে বদলে যাবে, এমনই প্রত্যাশা। লোকগণনার কাজ সঠিকভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে কি-না, সে বিষয়ে পর্যবেক্ষণ কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার বিষয়টি আগেই বলেছি। প্রাথমিক রিপোর্ট প্রকাশের পর তা পরীক্ষার কাজ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে। এটা সুসংবাদ হিসেবে ধরে নেব। তবে তারা কী মেথডোলজি ব্যবহার করছে, সেটা জানা থাকলে ভালো হয়। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে খোলামেলা আলোচনা হওয়া বাঞ্ছনীয়।
গণনাকর্মীরা বাড়ি বাড়ি যাওয়ার সময় সমস্যায় পড়বে, এটা স্বাভাবিক। ভোটার তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রেও এটা দেখা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র প্রফেসরের বাড়ির দরজা না খোলার ঘটনাও আমরা শুনেছি। বিশেষ করে বাড়িতে পুরুষ লোক না থাকলে অনেক মহিলা দরজা খুলতে রাজি হয় না। আবার দেখা যায় যে, বাড়িতে এমন লোকের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে ফরম পূরণ করা হয়, যাতে ভুল থাকার সম্ভাবনা বেশি। এ অবস্থায় কী করণীয়, সেটা নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে আলোচনা হওয়া দরকার। পরিসংখ্যান ব্যুরো জানিয়েছে, তারা এ সমস্যার সমাধানের জন্য নারীকর্মী বেশি নিয়োগ করেছে। তবে এ ধরনের সমস্যা বেশি হলে অনেক লোক গণনার বাইরে থেকে যেতে পারে। আবার উপযুক্ত তথ্যদাতা ঘরে না থাকলে ২৫টি প্রশ্নের কোনো কোনোটির ক্ষেত্রে গড় ধরনের গরমিল হতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, এর মাত্রা কতটা হতে পারে? এর উত্তর এখনই দেওয়া সম্ভব নয়। আমরা কেবল আশা ব্যক্ত করতে পারি যে এমনটি যেন অতি সীমিত পরিসরে ঘটে।
এবারে একটি বিষয় লক্ষ্য করছি এবং তা হচ্ছে পর্যাপ্ত প্রচারের অভাব। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারে এ নিয়ে অনুষ্ঠান এবং বিজ্ঞাপন প্রচার হচ্ছে। কিন্তু সার্বিকভাবে গণমাধ্যমে লোকগণনা ইস্যু এখনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠতে পারেনি। বিশ্বকাপ ক্রিকেট নিয়ে গণমাধ্যমে যে উন্মাদনা, তেমনটি লোকগণনার ক্ষেত্রে আশা করা যায় না। কিন্তু এ বিষয়টি নিয়ে মানুষের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করতেই হবে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গকেও এ কাজে যুক্ত করা দরকার। কেন লোকগণনার এমন আয়োজন, সেটা বোঝাতে হবে। এখন পর্যন্ত এমনকি রাজধানী ঢাকাতেও লোকগণনা সংক্রান্ত পোস্টার ও ব্যানার আমার নজরে আসেনি। ঢাকার বাইরের চিত্রও ভিন্ন কিছু নয়। প্রাইভেট টেলিভিশন চ্যানেলে এ নিয়ে তেমন প্রচার নজরে আসছে না। সংবাদপত্রে কলাম নজরে এসেছে, কিন্তু নিউজের অংশ কম মনে হচ্ছে। আয়োজকরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, ১৫-১৬ কোটি লোক নিয়েই তাদের কাজ করতে হবে। কেউ যেন বাদ না পড়ে এবং কারও সম্পর্কে যে ভুল কিংবা বিভ্রান্তিকর তথ্য সংগ্রহ করা নয়। আগামী দশ বছর আমাদের অনেক পরিকল্পনার ভিত্তি হবে মধ্য মার্চে পাওয়া তথ্য। এখন এই বিশ্বকাপ ক্রিকেট উন্মাদনার মধ্যেও তাই অনুরোধ করব, বিষয়টি ব্যাপক প্রচারণায় আনুন। কেবল পরিসংখ্যান ব্যুরোর ওপর নির্ভর করলে এ লক্ষ্য অর্জন করা যাবে না। গোটা সরকারকে সর্বশক্তি দিয়ে সমন্বিতভাবে লাগতে হবে। লোকগণনা যে শুধু মাথাগণনার মধ্যে সীমিত নয়, নীতিনির্ধারকদের নিশ্চয়ই সে ধারণা স্পষ্ট। এ থেকে প্রাপ্ত তথ্য দশ বছর ধরে অনেক অনেক কাজে ব্যবহার করা হবে। বিষয়টি অনেকটা ঘরের বাজার করার মতো। আমরা বাজার থেকে যা কিনে আনি তা রান্না করে যথাযথভাবে পরিবেশন করা হয়। লোকগণনার মধ্য দিয়ে আমরা প্রথম ধাপ অতিক্রম করব। কিন্তু ভালো বাজার না হলে যেমন ভালো রান্না হয় না, তেমনি লোকগণনা ঠিকভাবে না হলেও তা ব্যবহার করে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে না।
২০০১ সালের লোকগণনার চূড়ান্ত রিপোর্ট সময়মতো প্রকাশ করা যায়নি। ফুলকাউন্ট রিপোর্ট তো আলোর মুখই দেখেনি। এ বছর তেমন হবে না তো? বলা হচ্ছে, ডিজিটাল পদ্ধতিতে কাজ হওয়ায় তিন মাসের মধ্যে প্রাথমিক রিপোর্ট মিলবে। এ সময়সীমা রক্ষা করতে হবে। পরবর্তী ধাপগুলোর কাজও হওয়া চাই সময়মতো। দেশ-বিদেশে লোকগণনা থেকে প্রাপ্ত তথ্য ব্যবহার করা হবে। উন্নয়নের জন্য এ তথ্য হবে অপরিহার্য। এ কারণে কাজের ক্ষেত্রে ভুলের মাত্রা সর্বনিম্ন পর্যায়ে কমিয়ে আনার প্রতি থাকা চাই সর্বোচ্চ মনোযোগ।
এ কে এম নূর-উন-নবী : অধ্যাপক পপুলেশন সায়েন্স বিভাগ, ঢাবি
No comments