ক্ষুদ্রঋণ-মানুষ নিয়ে খেলা! by জিয়াউর রহমান সেলিম

বলা হচ্ছে, আইন পরিবর্তন না করলে গ্রামীণ ব্যাংকের কোনো অনিয়ম প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। এই অনিয়মের শিকড় এত গভীরে যে, আজীবন একজনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে থাকা যাবে ফলবতী মেঘের নীরব কান্না আর সুখের প্রতারক জ্যামিতিক ব্যাখ্যা দেখে বহু বছর আগেই আঁতকে উঠেছিলাম।


তখন মহান-মঙ্গলচিন্তা আচ্ছাদিত পরিকল্পনা ও বিপুল কাণ্ড-কারখানা যেমন ছিল, তেমনি ছিল উন্নয়ন আকাঙ্ক্ষী গ্রামীণ মহিলাদের মুখে অদ্ভুত এক আলোর আভা। তারপর কিছুদিন যেতে না যেতেই শুনি রাত জেগে থাকা অতৃপ্ত নক্ষত্রের মতো, শত-লাখো বেহুলা লখিন্দরের পুণ্যতম মুখে হাজারো ব্যথা আর দুঃখের জারি। তিনদিন আগে গ্রাম সাজিয়ে ভিনদেশি রানী-ফার্স্ট লেডিদের নিয়ে মাঠ সফরে আলাপচারিতার নাটকগুলো কি এ দেশ ভুলে গেছে? আজ যখন গ্রামীণ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপকের কণ্ঠে 'গ্রামীণ ব্যাংকে ড. ইউনূসের একটি শেয়ারেরও মালিকানা নেই' জাতীয় বক্তব্য-বিবৃতি শুনি, তখন ভেতর থেকেই অন্য মানুষ বলে ওঠে_ গ্রামের মানুষ নিয়ে খেলা, এ বড় ভয়ঙ্কর খেলা। মেয়াদোত্তীর্ণ ব্যবস্থাপনা পরিচালক সম্পর্কে হয়তো একদিন শুনব_ ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের একজন ঋণগ্রহীতা মাত্র। এও সম্ভব। এ দেশে সবই সম্ভব!
ঘরের পরে ঢেঁকির ঋণ, গাভীর পরে জমির ঋণ, জমির পরে উচ্ছেদ এবং উদ্বাস্তু করার প্রক্রিয়া যেভাবে জ্বালিকা বিস্তার লাভ করেছে, তাতে জানি না সম্মুখে আরও কী সর্বনাশ অপেক্ষা করছে। কাগজের পরতে পরতে কাগুজে হিসাব লেপ্টে আছে বহুদিন, যাতে সাফল্য ছাড়া ব্যর্থতার একটি শব্দও নেই। অথচ কে বোঝাবে_ আজও আঁতুড় ঘরেই ঘুচে যায় জীবনের দূরত্ব, কিছুদূরে শুয়ে থাকে শব্দহীন কান্নার ঝাপসা চোখে অবলা জননী। এমন গ্রাম দেশের প্রতিটি গ্রাম এবং সেই গ্রামের মহিলাদের 'পল্লী ফোন' দিয়ে আর ফ্যাশন শোর বাহারি সজ্জা দেখিয়ে_ তাদের জীবনে বিপর্যয়হীন কোনো লাভ হলো, তার ব্যাখ্যা কিসে মিলবে?
কিস্তি ঋণে উৎপাদন তত্ত্বজনিত (চৎড়ফঁপঃ গবঃযড়ফ) হিসাব, এই অর্থনীতির অধ্যাপকের চেয়ে ভালো কে জানেন সুনিপুণ? বিষয়টি একটু খুলে বলা যাক। মনে করি ৫২ সপ্তাহের জন্য কেউ ১০০০ টাকা ঋণ নিতে চাইল। তারপর কাগজ তৈরি, সাপ্তাহিক ছুটি, মিটিং, সিদ্ধান্ত এসবে দু'সপ্তাহ পার হয়ে ফাইনালি টাকা হাতে আসে। বলা হচ্ছে_ শতকরা ১০ টাকা সুদ (সার্ভিস চার্জ) দিতে হবে। তার মানে টাকা নেওয়ার পর প্রথম সপ্তাহেই ২০ টাকা আসল আর ২ টাকা সার্ভিস চার্জ দিতে হয়। এভাবে ৩৫তম সপ্তাহে ২০ টাকা এবং ২ টাকা, ৫০তম সপ্তাহেও ২০ টাকা এবং ২ টাকা। কারিগরি সর্বনাশা ফাঁকিটি হচ্ছে গ্রহীতার মূলধন কমে গেলেও সার্ভিস চার্জ আদায় কিন্তু কমে না। যখন হাতে মূলধন ১০০ টাকা তখনও যা, যখন হাতে মূলধন ২০ টাকা তখনও তা-ই। অথচ সঠিক হিসাবে ক্রমহ্রাসে শেষ সপ্তাহে সার্ভিস চার্জ আদায় হওয়ার কথা ৯ পয়সা মাত্র। এভাবেই প্রায় ৪০ টাকা সুদ আদায় করা হয় এবং মাত্র তিন বছরেরও কম সময়ে শুধু সুদের টাকাতেই একটি এলাকার (পূর্বের লগি্নকৃত) আসল টাকা পূরণ হয় এবং ওই এলাকার টাকা অন্য এলাকায় সরিয়ে নেওয়া হয়। আজ যে টাকা সরাবার বিষয় সবার সামনে এসেছে, ওই ধারায় ধরতে গেলে টাকা সরানোর প্রক্রিয়া আরও পুরনো, তা সে নরওয়ে বা গ্রামীণ শক্তি_ যা-ই হোক না কেন!
জীর্ণ দেহের মানুষের শীর্ণ কুটিরে ঋণে, চারটা কংক্রিটের পিলার গড়িয়ে ঘরের বাসনা দেখানোর খেলাটাও বেশ মজার। হায়! এও এক মহাজনি প্রথার আধুনিকীকরণ! তিনি যখন বলছেন_ গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষতি হলে জাতির বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে, তখন হলফ করে তিনি জাতির সামনে দেখিয়ে দেন কীভাবে শতকরা কত ভাগ সুদ গরিব মানুষের ঋণের নামে কত হাজার টাকায় মিটে যায়! গরিব মানুষের রক্ত যে গ্রামীণ ধারায় মিশেছে, সেই রক্তিম ধারায় দাঁড়িয়েছে প্রায় হুমকিজনিত, তিনি আর এমন কী ক্ষতির কথা শোনাবেন।
মধ্যরাতে যখন ঘুমহীন মানুষ কোঁকায়, হাজারো লেটেস্ট নির্যাতনগত কৌশলে তারা যখন ভীষণ অসহায়, সে রাতের শেষে ভোরে বিশাল কর্মীবাহিনী কিস্তি ঋণের তাগাদাকে মনে হয় গোখরোর ছোবল। ৯৮ শতাংশ ঋণ আদায়ের ভেলকিবাজি এখন আর কারও অজানা নয়। কোথাও নেই কিন্তু কাগজে আছে_ এই হচ্ছে এর মূলমন্ত্র। 'আমার দল'-এর মেনিফেস্টো পড়েছিলাম একটি আপাত জনপ্রিয় সাপ্তাহিকীতে। সে রাজনীতি আর সফল হয়নি। তারপর আরও সব চেয়ার, আরও উচ্চপদে যাওয়ার আলোচনা কাগজে পড়েছি-শুনেছিলাম। আর এরই মাঝে পৃথিবীর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে পুরস্কার গ্রহণের হিড়িক দেখি। দু'একটি দেশে একই স্টাইলে (মডেলে) ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প চালুরও খবর পাই।
আজ যেমন খোদ নরওয়ে সরকার/নোরাড বহু কিছু বুঝছে না_ তেমনি আমিও বুঝিনি, গ্রামীণ ব্যাংক কোন শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ করেছে, যে জন্য শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এ দেশের কোনো মাড়ি-মড়ক, খরা-বন্যা-ঘূর্ণি-জলোচ্ছ্বাসে গ্রামীণ ব্যাংক পাশে দাঁড়িয়েছে, এমন নজির নেই। গ্রামীণ ব্যাংক কোনো হাসপাতাল বা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় (গরিবের নাম দিয়েই না হয় হলো) গড়ে তোলেনি। এখন গড়ে তুলতে চাচ্ছে টেলিভিশন আর সংবাদপত্র। নইলে সুখ্যাতি, গ্রামীণ উন্নয়নের সংবাদ, বক্তব্য-বিপরীত বক্তব্য দেওয়া যাচ্ছে না! দেখানো যাচ্ছে না শান্তির চালচিত্র!
তাই ভাবি কুঁড়েঘর বুকে নিয়ে যারা ২৪ তলা সুরম্য অট্টালিকা বানান, কাশফুল ঘিরে খদ্দর ফতুয়া গায়ে দিয়ে যারা কোটি টাকার গাড়ি হাঁকান, তাদের দোষের তদন্ত রিপোর্ট কবে পেশ হবে? কবে জানতে পারব কত কিস্তি রক্ত গেলে গ্রামীণ স্বাদ পূরণ হবে এবং খুব সহজ ভাতের হিসাব পাওয়া যায়? তিনি আরও ২৫টি কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা। সত্যিই তো তিনি একজন গ্রুপ অব কোম্পানির মালিক বটে। তিনি গ্রামীণ ব্যাংক ছাড়াও এতগুলো প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। আর গ্রামীণ ব্যাংককে যারা (গরিব মহিলারা) একবার ধরেছে, সর্বনাশা ঋণ তাদের সারাজীবনেও ছাড়েনি।
সরকার বেশ কিছু ব্যাখ্যা চেয়েছে। তদন্ত হবে-হচ্ছে শোনা যাচ্ছে। ব্যাখ্যার জবাবদানে সময় নির্দিষ্ট করা নেই বলেও খবরে প্রকাশ। ব্যাংকের অ্যাসাইন্ড ক'জন কর্মকর্তা 'ব্যাকডেট' দিয়ে কাগজপত্র তৈরি করছে বলেও জানা গেছে। প্রতিষ্ঠানটি কাগুজে হিসাবদানে পটু সন্দেহ নেই। বলা হচ্ছে, আইন পরিবর্তন না করলে গ্রামীণ ব্যাংকের কোনো অনিয়ম প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। এই অনিয়মের শিকড় এত গভীরে যে, আজীবন একজনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে থাকা যাবে। এ ব্যাংকটি চলে তার নিজস্ব আইনে। গ্রামীণ ব্যাংক ১৯৮৩ সালে এক সরকারি আদেশে বিশেষায়িত ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় তাকে কোনো নির্দেশ দেওয়ার এখতিয়ার রাখে না বাংলাদেশ ব্যাংক। এই অর্ডিন্যান্স '৮৩-এর দোহাই দিয়ে অব্যাহত লাগামহীন পথচলা ব্যাংকটির লাগাম ধরতে পারে কেবল একটি গণতান্ত্রিক সরকার। হয়তো এ যাত্রায় ব্যাংকটি পারও পেয়ে যাবে (এ দেশে জন্মে এ আশঙ্কা করা অমূলক নয়)। তাহলে ওই ভয়ঙ্কর খেলার শেষ কী দিয়ে হবে_ কবে হবে, তার জবাব কবে পাব?

জিয়াউর রহমান সেলিম :কলাম লেখক
aziaurr@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.