সিলেট শহরের পরিবেশ-সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলি: একটি পর্যালোচনা by কাজী মোহাম্মদ মাসুম ও ফজলে এলাহী মোহাম্মদ ফায়সাল
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত সিলেট শহর ধীরে ধীরে বৃদ্ধি লাভ করেছে। শহরের কোল ঘেঁষে বয়ে গেছে সুরমা নদী। পাহাড়-টিলা, সমভূমি, হাওর, নদী, বন, প্রাকৃতিক সম্পদ ইত্যাদি সিলেটকে করেছে স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। প্রাকৃতিক সম্পদ, যেমন গ্যাস, চুনাপাথর, বালু ছাড়াও পাহাড়ি বনাঞ্চল সিলেটের তথা বাংলাদেশের এক অমূল্য সম্পদ।
চা বাগান, রাবার বাগান, জলাশয়, পাথর প্রভৃতি পর্যটকদের আকর্ষণ করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে।
সুস্থভাবে জীবনধারণ ও বসবাসের উপযোগী আবহাওয়া সিলেটে বিদ্যমান। বর্তমানে কিছু কারণে সিলেট শহর ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার পরিবেশ ক্রমান্বয়ে দূষিত ও কলুষিত হচ্ছে। সিলেটের পরিবেশ-সংক্রান্ত কিছু বিষয় তুলে ধরা হলো।
অসম্পূর্ণ ও অপর্যাপ্ত আবর্জনা অপসারণ ব্যবস্থা: শহরের সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখার সঙ্গে সময়োপযোগী আবর্জনা অপসারণ ব্যবস্থা ও এর নিয়মিত কার্যকারিতার গুরুত্ব অপরিসীম। এদিক বিবেচনায় সিলেট শহরের আবর্জনা নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা আরো উন্নত হওয়া প্রয়োজন। সিলেট সিটি করপোরেশন শহরে প্রায় ১৬০টি ডাস্টবিন নির্মাণ করেছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত নয়। এক রিপোর্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সিলেট শহরে গৃহস্থালি, ক্লিনিক ও বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিদিন প্রায় ২৪০ টন আবর্জনা ও বর্জ্য ফেলে দেওয়া হয়। এর মধ্যে ১৩৫ টন আবর্জনা ও বর্জ্য সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে শহরের প্রধান প্রধান এবং অন্যান্য সড়ক থেকে অপসারিত হয়ে থাকে। বাকি ৪৪ শতাংশ শহরের সমিতির মাধ্যমে আখালিয়া এলাকায় অবস্থিত একটি বড় পুকুরে নিক্ষিপ্ত হয়, যা সম্পূর্ণ অস্বাস্থ্যকর।
এক জরিপে দেখা গেছে, সিলেট শহরের প্রায় ২২ শতাংশ অধিবাসী পার্শ্ববর্তী কোনো পুকুরে আবর্জনা নিক্ষেপ করে এবং প্রায় ২৪ শতাংশ অধিবাসী নিকটবর্তী ড্রেনে আবর্জনা ফেলে থাকে। রাস্তার পাশে ও খোলা ড্রেনে পড়ে থাকা আবর্জনা বিভিন্ন ধরনের রোগ ও বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ।
ট্রাফিক সমস্যা: সিলেট শহরের ট্রাফিক জ্যাম একটি সমস্যা। এর ফলে সময়, কর্মশক্তি ও সম্পদের অপচয় ঘটে থাকে। ট্রাফিক জ্যামের কারণ হিসেবে জনসংখ্যা ও বিভিন্ন ধরনের পরিবহনের সংখ্যা বৃদ্ধি, যোগাযোগ ও অবকাঠামোগত পরিকল্পনার অভাব, একই সড়কে যান্ত্রিক ও মানুষচালিত পরিবহনের চাপ বৃদ্ধি, ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা, ট্রাফিক নিয়ম ও আইন ভঙ্গ, জনবলের অভাব ইত্যাদিকে চিহ্নিত করা যায়।
সিলেট শহরে চলাচলের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে রিকশা। তা ছাড়া টেম্পো, মোটরসাইকেল, গাড়ি, বেবিট্যাক্সি, বাস, ভাড়ায় চালিত গাড়ি ইত্যাদি শহরে চলাচল করে। সিলেট শহরে রেজিস্টার্ড রিকশার সংখ্যা প্রায় এক লাখ দুই হাজার ৪০। সিলেটে ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার রিকশা চলাচল করে এবং এর বেশির ভাগই অনুমোদনহীন।
পার্কিং সুবিধার অভাবে, শহরের অনেক এলাকায় রাস্তায় গাড়ি পার্ক করা হয়ে থাকে এবং এর ফলে রাস্তার প্রশস্ততা ও পরিবহন ধারণক্ষমতা অনেকাংশে হ্রাস পায়।
বনাঞ্চল হ্রাস : আবহাওয়াজনিত কারণে ও জমির অপব্যবহারের ফলে বনাঞ্চলের পরিমাণ ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। পরিকল্পিত বৃক্ষনিধন সিলেট অঞ্চলের আবহাওয়ায় বিরূপ প্রভাব ফেলছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর গৃহস্থালির কাজে জ্বালানি কাঠের প্রয়োজন হয় এবং এর ফলে বৃক্ষনিধন একটি নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। তা ছাড়া বনের অভ্যন্তরে জোর করে জমি দখলের ফলে বনাঞ্চল ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হচ্ছে। বনাঞ্চলের সংকোচন বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রাকে প্রভাবিত করছে এবং এর মাধ্যমে ভূমিধসের পরিমাণও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। আবহাওয়াজনিত এসব পরিবর্তনের ফলে সিলেট অঞ্চলের কোনো কোনো স্থানে ধীরে ধীরে মরুকরণ সুস্পষ্ট হয়ে মরুভূমিতে পরিণত হতে পারে।
সিলেট অঞ্চলের গড় তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত সম্পর্কিত তথ্য তুলে ধরা হলো।
ত্রুটিপূর্ণ ও সীমিত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা : সামান্য বৃষ্টিতে সিলেট শহরের কিছু কিছু এলাকায় পানি জমে থাকতে দেখা যায়। অপরিকল্পিত বড় বাড়ি নির্মাণ ও পর্যাপ্ত ড্রেনেজ সুবিধা না থাকায় পানি জমে রাস্তা চলাচল বিঘি্নত হওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে পড়েছে। সিলেট শহরে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট খালগুলোতে মাটি ভরাটের পাশাপাশি শহরের নোংরা আবর্জনা নিক্ষেপ করা হচ্ছে। এতে স্বাভাবিক পানির গতিপ্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। কিছুকাল আগে সিলেট শহরে ১৭টি পুকুর ছিল। সেগুলো প্রচুর পরিমাণ বৃষ্টির পানি ধারণে সক্ষম ছিল। এদের মধ্যে অনেক কয়টিই বিভিন্ন কারণে ভরাট করা হয়েছে। ধোপাদীঘি-ওসমানী শিশু পার্কের জন্য, লালদীঘি হকার্স মার্কেটের জন্য, মাসুদীঘি ও রামের দীঘি বাড়ি নির্মাণের জন্য এরই মধ্যে ভরাট করা হয়েছে। আগে শহরের বিভিন্ন খাল ও পুকুর বৃষ্টির পানি এবং বর্জ্য পানি ধারণে ব্যবহৃত হতো এবং সুরমা নদীর সঙ্গে এগুলোর সংযোগ ছিল। বর্তমানে এগুলোর কার্যকারিতা ব্যাপকাংশে হ্রাস পেয়েছে।
সুরমা নদীর পানি দূষণজনিত সমস্যা : সুরমা নদী সিলেট শহরের অন্যতম পানির উৎস প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এবং পাহাড়ি বালি পানিবাহিত হয়ে শহরের বর্জ্য পদার্থ ও আবর্জনা এবং কৃষিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ সুরমা নদীতে এসে পড়েছে ক্রমাগত। এর ফলে সুরমা নদীর পানি ক্রমান্বয়ে দূষিত হচ্ছে এবং পলি জমে সৃষ্টি হচ্ছে ছোট ছোট চর। সিলেট শহরের আশপাশের বিভিন্ন পাহাড় ও টিলা থেকে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট বিভিন্ন খালে কলকারখানা, হাসপাতাল ও গৃহস্থালি থেকে নিঃসৃত ও পরিত্যক্ত তরল ও কঠিন পদার্থ ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এ খালগুলোর সঙ্গে সুরমা নদীর সংযোগ থাকায় নদীর পানি দূষিত হয়ে উঠছে।
পানি সরবরাহ সুবিধার সীমাবদ্ধতা: সিলেট শহরে গৃহস্থালির জন্য প্রয়োজনীয় পানির স্বল্পতা পরিলক্ষিত হয়। সিলেট সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে সরবরাহ করা পানির মূল উৎস মাটির তলদেশ। শহরের অধিবাসীদের প্রয়োজনের মাত্র ৪০ শতাংশ মিটে থাকে এ উৎস থেকে। শহরের অধিবাসীদের একটি বিরাট অংশ সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে প্রাপ্ত পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত এবং টিউবওয়েলের ওপর নির্ভরশীল। আর্সেনিকের ফলে অনেক জায়গায় মাটির তলদেশের পানি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তোপখানা এলাকায় সুরমা নদীর পানি শোধনের জন্য ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট থাকলেও তা শহরের অধিবাসীদের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম নয়।
নিম্নগামী মাটির তলদেশের পানির স্তর : সিলেট শহরে বর্তমানে খোলা স্থানে বিভিন্ন ধরনের দালানকোঠা নির্মাণ করা হচ্ছে। এর ফলে মাটির উপরিভাগের পানি শোষণ ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। কারণ মাটির উপরিভাগের স্তর দিয়ে পানি মাটির নিচের স্তরে যেতে পারছে না। মাটির পানি শোষণ ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার ফলে মাটির তলদেশের পানির স্তর ধীরে ধীরে নিচে নেমে যাচ্ছে। মাটির তলদেশের পানির স্তর নেমে যাওয়ায় মাটির উপরিভাগের স্তরও নিম্নগামী হয়ে থাকে। বিভিন্ন দেশ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, কমপক্ষে ৯ মিটার মাটির তলদেশের পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার ফলে প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার মাটির উপরিভাগের স্তর নেমে যায়। মাটির উপরিভাগের স্তর নিচে নেমে যাওয়ার ফলে সিলেট শহরের কিছু স্থান বন্যায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যেতে পারে। সিলেট শহরের মাটির তলদেশের পানির স্তর বিগত কয়েক দশকে নিচে নেমে গেছে। মাটির তলদেশের পানি ৩৩৮০ মিলিমিটার থেকে নেমে এরই মধ্যে ৭৮৮০ মিলিমিটার নিচে নেমে গেছে।
শব্দদূষণ : শব্দদূষণ সিলেট শহরের অন্যতম একটি সমস্যা। অতিরিক্ত শব্দের মাধ্যমে একজন মানুষ শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বায়ু ও পানিদূষণের মতো শব্দদূষণও সিলেট শহরের নাগরিকদের একটি সমস্যা। শব্দদূষণের মাধ্যমে প্রধানত শিশুরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। যানবাহনের মাধ্যমে সৃষ্ট শব্দই শব্দদূষণের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত। শহরের বিভিন্ন হসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিকটবর্তী প্রধান সড়কগুলোয় শব্দের মাত্রা স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি।
স্টোন ক্রাশিং মেশিনের প্রভাব: সিলেট শহর ও আশপাশে পাথর ভাঙার কাজে স্টোন ক্রাশিং মেশিন ব্যবহৃত হচ্ছে। এর ফলে ধূলিময় হচ্ছে শহরের পরিবেশ। তা ছাড়া শহরের বিভিন্ন মোটরচালিত যানবাহনের বৃদ্ধিও বায়ুদূষণের একটি অন্যতম কারণ। সিলেট শিল্পাঞ্চল হিসেবে এখনো গড়ে না উঠলেও ক্রাশিং মেশিন ও যানবাহনের মাধ্যমে সৃষ্ট ধূলি বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ ও অন্যান্য রোগের কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
অপরিকল্পিত নগরায়ণ: সিলেট শহর বর্তমানে ঘনবসতিপূর্ণ। এ শহরে রয়েছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আবাসিক এলাকা, হোটেল, কমিউনিটি সেন্টার, রেস্টুরেন্ট, ব্যাংক ও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ফার্মেসি, অফিসবিল্ডিং-ক্লিনিক প্রভৃতি। এসব গড়ে উঠেছে পরিকল্পনাহীনভাবে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
লেখকদ্বয় : সহকারী অধ্যাপক, ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এবং সহকারী অধ্যাপক, ব্যবসা প্রশাসন বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
সুস্থভাবে জীবনধারণ ও বসবাসের উপযোগী আবহাওয়া সিলেটে বিদ্যমান। বর্তমানে কিছু কারণে সিলেট শহর ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার পরিবেশ ক্রমান্বয়ে দূষিত ও কলুষিত হচ্ছে। সিলেটের পরিবেশ-সংক্রান্ত কিছু বিষয় তুলে ধরা হলো।
অসম্পূর্ণ ও অপর্যাপ্ত আবর্জনা অপসারণ ব্যবস্থা: শহরের সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখার সঙ্গে সময়োপযোগী আবর্জনা অপসারণ ব্যবস্থা ও এর নিয়মিত কার্যকারিতার গুরুত্ব অপরিসীম। এদিক বিবেচনায় সিলেট শহরের আবর্জনা নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা আরো উন্নত হওয়া প্রয়োজন। সিলেট সিটি করপোরেশন শহরে প্রায় ১৬০টি ডাস্টবিন নির্মাণ করেছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত নয়। এক রিপোর্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সিলেট শহরে গৃহস্থালি, ক্লিনিক ও বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিদিন প্রায় ২৪০ টন আবর্জনা ও বর্জ্য ফেলে দেওয়া হয়। এর মধ্যে ১৩৫ টন আবর্জনা ও বর্জ্য সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে শহরের প্রধান প্রধান এবং অন্যান্য সড়ক থেকে অপসারিত হয়ে থাকে। বাকি ৪৪ শতাংশ শহরের সমিতির মাধ্যমে আখালিয়া এলাকায় অবস্থিত একটি বড় পুকুরে নিক্ষিপ্ত হয়, যা সম্পূর্ণ অস্বাস্থ্যকর।
এক জরিপে দেখা গেছে, সিলেট শহরের প্রায় ২২ শতাংশ অধিবাসী পার্শ্ববর্তী কোনো পুকুরে আবর্জনা নিক্ষেপ করে এবং প্রায় ২৪ শতাংশ অধিবাসী নিকটবর্তী ড্রেনে আবর্জনা ফেলে থাকে। রাস্তার পাশে ও খোলা ড্রেনে পড়ে থাকা আবর্জনা বিভিন্ন ধরনের রোগ ও বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ।
ট্রাফিক সমস্যা: সিলেট শহরের ট্রাফিক জ্যাম একটি সমস্যা। এর ফলে সময়, কর্মশক্তি ও সম্পদের অপচয় ঘটে থাকে। ট্রাফিক জ্যামের কারণ হিসেবে জনসংখ্যা ও বিভিন্ন ধরনের পরিবহনের সংখ্যা বৃদ্ধি, যোগাযোগ ও অবকাঠামোগত পরিকল্পনার অভাব, একই সড়কে যান্ত্রিক ও মানুষচালিত পরিবহনের চাপ বৃদ্ধি, ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা, ট্রাফিক নিয়ম ও আইন ভঙ্গ, জনবলের অভাব ইত্যাদিকে চিহ্নিত করা যায়।
সিলেট শহরে চলাচলের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে রিকশা। তা ছাড়া টেম্পো, মোটরসাইকেল, গাড়ি, বেবিট্যাক্সি, বাস, ভাড়ায় চালিত গাড়ি ইত্যাদি শহরে চলাচল করে। সিলেট শহরে রেজিস্টার্ড রিকশার সংখ্যা প্রায় এক লাখ দুই হাজার ৪০। সিলেটে ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার রিকশা চলাচল করে এবং এর বেশির ভাগই অনুমোদনহীন।
পার্কিং সুবিধার অভাবে, শহরের অনেক এলাকায় রাস্তায় গাড়ি পার্ক করা হয়ে থাকে এবং এর ফলে রাস্তার প্রশস্ততা ও পরিবহন ধারণক্ষমতা অনেকাংশে হ্রাস পায়।
বনাঞ্চল হ্রাস : আবহাওয়াজনিত কারণে ও জমির অপব্যবহারের ফলে বনাঞ্চলের পরিমাণ ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। পরিকল্পিত বৃক্ষনিধন সিলেট অঞ্চলের আবহাওয়ায় বিরূপ প্রভাব ফেলছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর গৃহস্থালির কাজে জ্বালানি কাঠের প্রয়োজন হয় এবং এর ফলে বৃক্ষনিধন একটি নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। তা ছাড়া বনের অভ্যন্তরে জোর করে জমি দখলের ফলে বনাঞ্চল ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হচ্ছে। বনাঞ্চলের সংকোচন বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রাকে প্রভাবিত করছে এবং এর মাধ্যমে ভূমিধসের পরিমাণও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। আবহাওয়াজনিত এসব পরিবর্তনের ফলে সিলেট অঞ্চলের কোনো কোনো স্থানে ধীরে ধীরে মরুকরণ সুস্পষ্ট হয়ে মরুভূমিতে পরিণত হতে পারে।
সিলেট অঞ্চলের গড় তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত সম্পর্কিত তথ্য তুলে ধরা হলো।
ত্রুটিপূর্ণ ও সীমিত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা : সামান্য বৃষ্টিতে সিলেট শহরের কিছু কিছু এলাকায় পানি জমে থাকতে দেখা যায়। অপরিকল্পিত বড় বাড়ি নির্মাণ ও পর্যাপ্ত ড্রেনেজ সুবিধা না থাকায় পানি জমে রাস্তা চলাচল বিঘি্নত হওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে পড়েছে। সিলেট শহরে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট খালগুলোতে মাটি ভরাটের পাশাপাশি শহরের নোংরা আবর্জনা নিক্ষেপ করা হচ্ছে। এতে স্বাভাবিক পানির গতিপ্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। কিছুকাল আগে সিলেট শহরে ১৭টি পুকুর ছিল। সেগুলো প্রচুর পরিমাণ বৃষ্টির পানি ধারণে সক্ষম ছিল। এদের মধ্যে অনেক কয়টিই বিভিন্ন কারণে ভরাট করা হয়েছে। ধোপাদীঘি-ওসমানী শিশু পার্কের জন্য, লালদীঘি হকার্স মার্কেটের জন্য, মাসুদীঘি ও রামের দীঘি বাড়ি নির্মাণের জন্য এরই মধ্যে ভরাট করা হয়েছে। আগে শহরের বিভিন্ন খাল ও পুকুর বৃষ্টির পানি এবং বর্জ্য পানি ধারণে ব্যবহৃত হতো এবং সুরমা নদীর সঙ্গে এগুলোর সংযোগ ছিল। বর্তমানে এগুলোর কার্যকারিতা ব্যাপকাংশে হ্রাস পেয়েছে।
সুরমা নদীর পানি দূষণজনিত সমস্যা : সুরমা নদী সিলেট শহরের অন্যতম পানির উৎস প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এবং পাহাড়ি বালি পানিবাহিত হয়ে শহরের বর্জ্য পদার্থ ও আবর্জনা এবং কৃষিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ সুরমা নদীতে এসে পড়েছে ক্রমাগত। এর ফলে সুরমা নদীর পানি ক্রমান্বয়ে দূষিত হচ্ছে এবং পলি জমে সৃষ্টি হচ্ছে ছোট ছোট চর। সিলেট শহরের আশপাশের বিভিন্ন পাহাড় ও টিলা থেকে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট বিভিন্ন খালে কলকারখানা, হাসপাতাল ও গৃহস্থালি থেকে নিঃসৃত ও পরিত্যক্ত তরল ও কঠিন পদার্থ ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এ খালগুলোর সঙ্গে সুরমা নদীর সংযোগ থাকায় নদীর পানি দূষিত হয়ে উঠছে।
পানি সরবরাহ সুবিধার সীমাবদ্ধতা: সিলেট শহরে গৃহস্থালির জন্য প্রয়োজনীয় পানির স্বল্পতা পরিলক্ষিত হয়। সিলেট সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে সরবরাহ করা পানির মূল উৎস মাটির তলদেশ। শহরের অধিবাসীদের প্রয়োজনের মাত্র ৪০ শতাংশ মিটে থাকে এ উৎস থেকে। শহরের অধিবাসীদের একটি বিরাট অংশ সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে প্রাপ্ত পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত এবং টিউবওয়েলের ওপর নির্ভরশীল। আর্সেনিকের ফলে অনেক জায়গায় মাটির তলদেশের পানি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তোপখানা এলাকায় সুরমা নদীর পানি শোধনের জন্য ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট থাকলেও তা শহরের অধিবাসীদের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম নয়।
নিম্নগামী মাটির তলদেশের পানির স্তর : সিলেট শহরে বর্তমানে খোলা স্থানে বিভিন্ন ধরনের দালানকোঠা নির্মাণ করা হচ্ছে। এর ফলে মাটির উপরিভাগের পানি শোষণ ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। কারণ মাটির উপরিভাগের স্তর দিয়ে পানি মাটির নিচের স্তরে যেতে পারছে না। মাটির পানি শোষণ ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার ফলে মাটির তলদেশের পানির স্তর ধীরে ধীরে নিচে নেমে যাচ্ছে। মাটির তলদেশের পানির স্তর নেমে যাওয়ায় মাটির উপরিভাগের স্তরও নিম্নগামী হয়ে থাকে। বিভিন্ন দেশ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, কমপক্ষে ৯ মিটার মাটির তলদেশের পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার ফলে প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার মাটির উপরিভাগের স্তর নেমে যায়। মাটির উপরিভাগের স্তর নিচে নেমে যাওয়ার ফলে সিলেট শহরের কিছু স্থান বন্যায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যেতে পারে। সিলেট শহরের মাটির তলদেশের পানির স্তর বিগত কয়েক দশকে নিচে নেমে গেছে। মাটির তলদেশের পানি ৩৩৮০ মিলিমিটার থেকে নেমে এরই মধ্যে ৭৮৮০ মিলিমিটার নিচে নেমে গেছে।
শব্দদূষণ : শব্দদূষণ সিলেট শহরের অন্যতম একটি সমস্যা। অতিরিক্ত শব্দের মাধ্যমে একজন মানুষ শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বায়ু ও পানিদূষণের মতো শব্দদূষণও সিলেট শহরের নাগরিকদের একটি সমস্যা। শব্দদূষণের মাধ্যমে প্রধানত শিশুরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। যানবাহনের মাধ্যমে সৃষ্ট শব্দই শব্দদূষণের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত। শহরের বিভিন্ন হসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিকটবর্তী প্রধান সড়কগুলোয় শব্দের মাত্রা স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি।
স্টোন ক্রাশিং মেশিনের প্রভাব: সিলেট শহর ও আশপাশে পাথর ভাঙার কাজে স্টোন ক্রাশিং মেশিন ব্যবহৃত হচ্ছে। এর ফলে ধূলিময় হচ্ছে শহরের পরিবেশ। তা ছাড়া শহরের বিভিন্ন মোটরচালিত যানবাহনের বৃদ্ধিও বায়ুদূষণের একটি অন্যতম কারণ। সিলেট শিল্পাঞ্চল হিসেবে এখনো গড়ে না উঠলেও ক্রাশিং মেশিন ও যানবাহনের মাধ্যমে সৃষ্ট ধূলি বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ ও অন্যান্য রোগের কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
অপরিকল্পিত নগরায়ণ: সিলেট শহর বর্তমানে ঘনবসতিপূর্ণ। এ শহরে রয়েছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আবাসিক এলাকা, হোটেল, কমিউনিটি সেন্টার, রেস্টুরেন্ট, ব্যাংক ও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ফার্মেসি, অফিসবিল্ডিং-ক্লিনিক প্রভৃতি। এসব গড়ে উঠেছে পরিকল্পনাহীনভাবে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
লেখকদ্বয় : সহকারী অধ্যাপক, ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এবং সহকারী অধ্যাপক, ব্যবসা প্রশাসন বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
No comments