বিশেষ সাক্ষাৎকার : অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী-কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা নৈতিকতার অবক্ষয়কেই দেখিয়ে দেয়
দেশের শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা, অবনতিশীল শিক্ষার মান, সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতিসহ নানা বিষয়ে কালের কণ্ঠের সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্ড কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন মোস্তফা হোসেইন
কালের কণ্ঠ : অভিযোগ আছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক ও উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয়করণের প্রভাব পড়েছে লক্ষণীয়ভাবে। কিভাবে দেখছেন বিষয়টিকে?
এ কে আজাদ চৌধুরী : এটা সব সময়ই হয়ে আসছে। তবে উপাচার্যসহ যাঁরা নির্বাচিত হন, তাঁদের সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হতে দেখা যায় না। আদর্শিকভাবে কাছাকাছি হয়ে থাকেন। এটা কিন্তু অলিখিত একটা নিয়ম বলতে পারেন। যখন অস্থায়ী ভিত্তিতে উপাচার্য নিয়োগ হন, তখন রাজনৈতিক প্রভাব থাকতে পারে। কিন্তু সে তো অল্প সময়ের জন্য। তবে উপাচার্য হওয়ার পর তাঁকে সব মত ও পথের মানুষকেই যোগ্য মর্যাদা দিতে হবে। তা ছাড়া উপাচার্য, উপ-উপাচার্যসহ আরো কিছু পদে তো নির্বাচন পদ্ধতি মেনে চলতে হয়।
কালের কণ্ঠ : নির্বাচন পদ্ধতির বিষয়টিও তো দলীয় চিন্তার বাইরে নয়। সেখানেও ফাঁক রয়ে গেছে।
এ কে আজাদ চৌধুরী : সিনেট উপাচার্যের তিনটি প্যানেল নির্বাচন করে। সেই প্যানেল একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আচার্য অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি বরাবর যায়। তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, নির্বাচিতদের মধ্যে কাকে উপাচার্য নিয়োগ দেবেন।
কালের কণ্ঠ : কিন্তু রাষ্ট্রপতিকে সিদ্ধান্ত নিতে হলে সংবিধানের বিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ প্রয়োজন হবে। তিনি কি রাজনৈতিক বিবেচনাকে অগ্রাধিকার দেবেন না?
এ কে আজাদ চৌধুরী : শিক্ষামন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতি_সবাইকে তো সিনেটের নির্বাচনকে প্রাধান্য দিতে হবে। যে তিনজনের প্যানেল নির্বাচিত হবে, তাদের মধ্য থেকেই তো একজনকে বাছাই করবেন তাঁরা। ফলে পুরোপুরি রাজনৈতিক বিবেচনাকে এখানে স্থান দেওয়া কি ঠিক হবে? সিনেটের কিন্তু পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। তারা যোগ্য লোককেই নির্বাচিত করে। এর বাইরে সরকার কিছু করতে পারবে না।
কালের কণ্ঠ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কি এর ব্যত্যয় ঘটেনি কখনো?
এ কে আজাদ চৌধুরী : নির্বাচন পদ্ধতিতে কখনো হয়নি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু খুন হওয়ার পর সামরিক শাসন আমলের কথাও যদি বলেন তাহলেও না। সে সময় ড. আবদুল মতিন চৌধুরীকে অন্যায়ভাবে সামরিক শাসকরা শাস্তিও প্রদান করেছিলেন; কিন্তু সিনেটের নির্বাচনে তিনি সবার চেয়ে বেশি ভোট পেলেন। দ্বিতীয় হলেন কবীর চৌধুরী, তৃতীয় হলেন ফজলুল হালিম চৌধুরী। তিনজনই ছিলেন সামরিক শাসনের বিপক্ষে। তার পরও জেনারেল জিয়াউর রহমান তৃতীয়জনকে বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন আইনের কারণে। এরপর সামরিক শাসক হিসেবে এলেন জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তখন নির্বাচিত হলেন আবার ফজলুল হালিম চৌধুরী। কিন্তু একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সামরিক সরকারের লেলিয়ে দেওয়া বাহিনী উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করলে তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলেন। তখন তিন হাজার শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরবর্তী সময় অধ্যাপক শামসুল হক নির্বাচিত হয়েছিলেন। শামসুল হক সাহেবকেও পদত্যাগ করতে হয়। সেখানে ছাত্রদলকে দুই ভাগ হয়ে ভিসির বাড়ির সামনে অগি্নসংযোগ করতে দেখা যায়। এদের এক ভাগ এরশাদ সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত হয়। অধ্যাপক মান্নান সাহেব চালালেন তিন-চার বছর। এভাবেই অধ্যাপক মনিরুজ্জামান, অধ্যাপক এমাজউদ্দীন সাহেবও ভিসি হলেন। এমাজউদ্দীন সাহেব পদত্যাগ করেছিলেন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর। আমিও তাঁকে বলেছিলাম, তিনি যেন পদত্যাগ না করেন। শেখ হাসিনাও বলেছিলেন, পদত্যাগের প্রয়োজন নেই। কিন্তু তিনি পদত্যাগ করেন। ব্যক্তিগতভাবেও তাঁকে শেখ হাসিনা সম্মান করতেন। একসময় সিনেটের নির্বাচনে আমি উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি।
কালের কণ্ঠ : আপনি তো আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ছিলেন।
এ কে আজাদ চৌধুরী : আমি যখন জানতে পারি, আমাকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তখনই আমি রাজনীতি থেকে পদত্যাগ করি। সুতরাং উপাচার্য হওয়ার পর আমার আর কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংস্রব ছিল না। আমি পদত্যাগকালে প্রধানমন্ত্রীকে আমার অভিপ্রায়ের কথা অবহিত করি। তিনি আমার সিদ্ধান্তকে সঠিক বলেন।
কালের কণ্ঠ : তাহলে কি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসি নিয়োগ কিংবা শিক্ষক নিয়োগকালে কোনো পক্ষপাতিত্ব কিংবা দলীয়করণের কোনো ঘটনাই নেই?
এ কে আজাদ চৌধুরী : দলীয় পক্ষপাতিত্ব একেবারেই হয় না এটা আমি বলি না। প্রশ্ন হচ্ছে, কতটা হচ্ছে। সহনশীল পর্যায়ে থেকে হচ্ছে কি না। আবার অসহনীয় আচরণকেও কিভাবে এড়িয়ে যাব। বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর রাতের অন্ধকারে ১১ জন উপাচার্যকে সরিয়ে দিল। এটা কি খুব জরুরি ছিল? কম যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগের ঘটনাও ঘটেছে। আবার কেয়ারটেকার সরকার আমলে কিংবা বিএনপি আমলে নিয়োগকৃত উপাচার্যদের অনেকেই এই সরকার আমলেও মেয়াদ পূরণ করে চাকরি করেছেন। নজরুল ইসলাম সাহেবের কথাই ধরা যাক। প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলাম, আপনি চাইলে তিনি পদত্যাগ করতে রাজি আছেন। প্রধানমন্ত্রী সায় দেননি। যে কারণে নজরুল সাহেব মেয়াদ পূর্ণ করা পর্যন্ত ভিসি ছিলেন।
কালের কণ্ঠ : আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হওয়ার আগে থেকেই প্রচণ্ড অসন্তোষ ছিল। গোলাগুলি-খুন লেগেই থাকত।
এ কে আজাদ চৌধুরী : আমি যোগ দেওয়ার আগে প্রতিবছর কমপক্ষে ৭০-৮০টি সহিংস ঘটনা ঘটত বিশ্ববিদ্যালয়ে। গুলি-চাপাতি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক বিষয়। আমি শক্ত হাতে দমন করি এসব। সে ক্ষেত্রে পুলিশ ও প্রশাসন আমাকে সহযোগিতা করে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী আমাকে এ ব্যাপারে যথেষ্ট সাহস জুগিয়েছেন। সহিংসতা নেমে আসে শূন্যের কোঠায়। আড়াই বছরের সেশনজট নেমে আসে শূন্যে। ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হয়েছিল ওই সময়, টিএসসি সংস্কার, ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে হল নির্মাণ_এমন আরো কিছু কাজ হয়। প্রচুর স্কলারশিপের ব্যবস্থা করি। অর্ধেক টিউশন ফির মাধ্যমে পিএইচডি করার সুযোগ গ্রহণ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক। বেশ কিছু নতুন বিভাগ খোলা হয় সে সময়। উল্লেখযোগ্য শিক্ষামানের কারণে এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ৩৭ নম্বর অবস্থানে পৌঁছার কৃতিত্ব অর্জন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
কালের কণ্ঠ : সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টর একজন ছাত্রীকে ঘুষি মেরেছেন, যা কালের কণ্ঠ প্রকাশ করে। এ ঘটনা কিভাবে মূল্যায়ন করবেন।
এ কে আজাদ চৌধুরী : অনেকেই বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার সঙ্গে মিল রেখে এখানেও ঘটনা ঘটবে। আমি এই মতের সঙ্গে এক হতে পারি না। বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যই আর দশটা প্রতিষ্ঠান থেকে আলাদা। মর্যাদার দিক থেকে সে অনেক ওপরে। সেখানকার পরিস্থিতি এমন হবে_এটা অপ্রত্যাশিত। যা করা হয়েছে তা ওনার পদমর্যাদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এটা নৈতিকতার অবক্ষয়কেই দেখিয়ে দেয়। মুষ্টিমেয় মানুষের জন্য আজকে গোটা শিক্ষক সমাজ প্রশ্নের মুখে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলো বিচ্ছুরিত হবে। সব কূপমণ্ডূকতা থেকে বাইরে থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়।
কালের কণ্ঠ : সেখানে ছাত্রলীগের কর্মীদের ডেকে এনেছেন প্রক্টর_এমন সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
এ কে আজাদ চৌধুরী : এটা কখনো গ্রহণ করতে পারি না। আমি জানি না, ছাত্রলীগকে ডেকে আনা হয়েছে কি না। অনেক সময় সংবাদ স্পর্শকাতর করার জন্য কিছু বিষয় যোগ করা হয়। কিন্তু তাই বলে ছাত্রীর গায়ে হাত তোলাটা আমি মেনে নেব_এটা হতে পারে না। আর ছাত্রলীগকে যদি ডেকে আনা হয়ে থাকে, তাহলে এটা আরো নিন্দনীয়।
কালের কণ্ঠ : সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের কিছু উচ্ছৃঙ্খল সদস্য টেন্ডারবাজি থেকে শুরু করে প্রতিপক্ষকে পেটানোর মতো কাজে জড়িত। শিক্ষায়তনসহ নানা স্থানে তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রধানমন্ত্রীও বিরক্ত। কিভাবে দেখছেন?
এ কে আজাদ চৌধুরী : কিছুটা বয়সের ব্যাপার আছে। কৈশোর আর যৌবনের সন্ধিক্ষণে তাদের কারো কারো মনে শক্তি প্রদর্শনের মানসিকতা কাজ করে। সব কোমলমতি মানুষের মধ্যেই এমন মানসিকতা কমবেশি থাকে। এর সঙ্গে যদি ক্ষমতার সম্পৃক্ততা থাকে, তাহলে তাদের প্রবণতা বেড়ে যায়। তাদের মধ্যে যে চ্যালেঞ্জের মন থাকে, তা ভালো কাজের দিকে যেমন লাগানো যায় আবার ধ্বংসাত্মক কাজেও জড়িয়ে পড়তে পারে। তবে এই বয়সের তরুণরা যদি আশ্রয়-প্রশ্রয় পায়, তাহলে কিছুটা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর ছাত্রলীগের ব্যাপারটা যদি বলেন তাহলে আমি বলব, এটা ধারাবাহিকতা। তবে যে কারণেই হোক, প্রতিফল ভোগ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে যে কাউকে। যে যেমন করবে, তার প্রতিফলও তেমনি হবে। রাজনৈতিক টানাপড়েন চললে তার প্রতিফলন বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়তে পারে। আমাদের ছাত্ররা অনেক সময় রাজনৈতিক ঢাল হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। সব সরকারের আমলেই এটা হয়েছে। এর অবসান হওয়া উচিত। সহনশীল হতে হবে সবাইকে। মনে রাখার প্রয়োজন আছে, মাসল পাওয়ার কোনো সমাধানের পথ নয়।
কালের কণ্ঠ : আপনি উপাচার্য থাকাকালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। তখনো ছাত্রলীগের দুর্নাম ছিল। কিভাবে দেখেছেন বিষয়টি?
এ কে আজাদ চৌধুরী : আমি উপাচার্য থাকাকালে ছাত্রলীগের ৫০ জনকে সাময়িক বহিষ্কার করেছিলাম। অথচ ছাত্রদলের করেছিলাম মাত্র ১৭ জনকে। অনেকে এসে আমার কাছে অভিযোগ করেছিল, স্যার আপনি তো ছাত্রলীগকে শেষ করে দিচ্ছেন। আমি তাদের বলেছিলাম, তোমরা ক্ষমতায়। ওরা দুর্বল। ওদের নিরাপত্তা দেওয়া তোমাদেরও দায়িত্ব। তারা কথা শুনেছে। সহযোগিতা করেছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনাকালে প্রধানমন্ত্রী কখনো আমার কাজে হস্তক্ষেপ করেননি।
কালের কণ্ঠ : ১৯৭৩ বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী বেশ কিছু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। এতে দলীয়করণের প্রভাব পড়ে। এত নির্বাচন না করে চালানো যায় না?
এ কে আজাদ চৌধুরী : সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য নির্বাচন হয়। এটা অবশ্যই ভালো দিক। এটার প্রয়োজন আছে। অনেকে বলেন, উপাচার্য নিয়োগের জন্য চার-পাঁচজনের একটা সার্চ কমিটি করা যেতে পারে। আমি মনে করি, এর চেয়ে বর্তমান পদ্ধতি অনেক ভালো। বিভিন্ন দেশে সিন্ডিকেট কিংবা সিনেট আছে। তবে এত নির্বাচন না হলেও বোধ হয় চলে। চেয়ারম্যান পদগুলো পর্যায়ক্রমে হলে ক্ষতি কী? ডিনের নির্বাচন সর্বজনীন না হলে ভালো। ফ্যাকাল্টি মেম্বারের মাধ্যমে নির্বাচন হলে রাজনীতি অনেক কমে যাবে।
কালের কণ্ঠ : অনেকেই বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশটি সংশোধন প্রয়োজন_আপনি কী মনে করেন?
এ কে আজাদ চৌধুরী : ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অবশ্যই যুগান্তকারী। পাকিস্তান আমলে যে কালাকানুন ছিল তা রদ হয়ে যায় এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে। আমরা স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিলাম। আমরা এই অধ্যাদেশটি পেয়েছি। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ঠিক রেখে যুগের প্রয়োজনে অধ্যাদেশটি সংশোধন হতে পারে। বলুন, এখনো কি ১০ টাকা বেতন দিয়ে পড়ার সময় আছে? অর্থায়নের দিকটি ভাবতে হবে। উচ্চশিক্ষার জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে। জ্বালানি কিনতে হয় ১৭ হাজার কোটি টাকা দিয়ে। দেশের আলো প্রজ্বলিত করার জন্য আমরা কত টাকা ব্যয় করছি।
কালের কণ্ঠ : ছাত্র বেতন বাড়ালে গরিব শিক্ষার্থীদের কী অবস্থা হবে?
এ কে আজাদ চৌধুরী : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে হারে বেতন নেয়, এটা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। সে কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিড় বেশি। সেখানেও আয় বাড়াতে গেলে বেতন পরিবর্তন না করে উপায় নেই। তবে বাড়ালেও এমন পর্যায়ে নিতে হবে, যাতে গরিব মানুষের অসুবিধা না হয়। শিক্ষার মান বাড়াতে হবে। তা না হলে আমাদের দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমাদের দেশে শত শত পাকিস্তানি, ভারতীয় কিংবা শ্রীলঙ্কার তরুণ কাজ করছে। অথচ আমাদের যুবকদের মেধা কম নয়। বিকশিত হওয়ার পথ করে দিতে পারলে আমাদের যুবকরা অনেক কিছু করে দেখাতে পারে। শিক্ষার জন্য বর্তমান সরকার আন্তরিক। প্রধানমন্ত্রী ট্রাস্ট ফান্ড করেছেন। তিনি এই খাতের জন্য এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন। এটা আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষা খাতকে সহায়তা প্রদান করবে। গত চার বছরে সাতটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। এতেও সাধারণ মানুষের উপকার হচ্ছে।
কালের কণ্ঠ : আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি থাকাকালেও ডাকসু নির্বাচন হয়নি, এখনো হচ্ছে না। দেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ উন্নয়নে এ ধারাকে কিভাবে দেখেন?
এ কে আজাদ চৌধুরী : সব উপাচার্য ক্ষমতায় আসার পর মনে করেন, ডাকসু নির্বাচন হওয়া জরুরি। সমস্যা হলো_একদল বলে পরিবেশ আছে, অন্য দল বলে পরিবেশ নেই। শিক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য যে কারণে ভিসিরা ডাকসু নির্বাচন এড়িয়ে যান। অথচ দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি সুষ্ঠু ধারায় পরিচালিত করতে হলে ছাত্র সংসদের নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন।
কালের কণ্ঠ : সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে এখন দেশে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার মান বাড়েনি সেই হারে। কী মনে করেন আপনি।
এ কে আজাদ চৌধুরী : সংখ্যা বৃদ্ধি যদি মানের সঙ্গে সম্পৃক্ত না হয়, তাহলে এই সংখ্যা বৃদ্ধিতে লাভ হবে না। মান বৃদ্ধি না হলে এই সংখ্যা বৃদ্ধিকে হাইব্রিডের সঙ্গে তুলনা করা যায়। ইউজিসি এ ব্যাপারে অত্যন্ত সজাগ। হায়ার এডুকেশন কোয়ালিটি এনহেন্সমেন্ট প্রকল্প নেওয়া হয়েছে এই চিন্তা করে। বিশ্বব্যাংক এই খাতে সহযোগিতা করছে। ৩৮৬ কোটি টাকার প্রকল্প এগিয়ে চলছে। উদ্ভাবনী প্রকল্পকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়েছে। ১৯৪৭ সালের পর থেকে দুই বছর আগ পর্যন্ত মাত্র দুই বছরে এত টাকা কখনো বরাদ্দ পায়নি এই খাতে। শিক্ষা কার্যক্রমে অনেক পরিবর্তন এসেছে।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ
এ কে আজাদ চৌধুরী : আপনাকেও ধন্যবাদ।
এ কে আজাদ চৌধুরী : এটা সব সময়ই হয়ে আসছে। তবে উপাচার্যসহ যাঁরা নির্বাচিত হন, তাঁদের সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হতে দেখা যায় না। আদর্শিকভাবে কাছাকাছি হয়ে থাকেন। এটা কিন্তু অলিখিত একটা নিয়ম বলতে পারেন। যখন অস্থায়ী ভিত্তিতে উপাচার্য নিয়োগ হন, তখন রাজনৈতিক প্রভাব থাকতে পারে। কিন্তু সে তো অল্প সময়ের জন্য। তবে উপাচার্য হওয়ার পর তাঁকে সব মত ও পথের মানুষকেই যোগ্য মর্যাদা দিতে হবে। তা ছাড়া উপাচার্য, উপ-উপাচার্যসহ আরো কিছু পদে তো নির্বাচন পদ্ধতি মেনে চলতে হয়।
কালের কণ্ঠ : নির্বাচন পদ্ধতির বিষয়টিও তো দলীয় চিন্তার বাইরে নয়। সেখানেও ফাঁক রয়ে গেছে।
এ কে আজাদ চৌধুরী : সিনেট উপাচার্যের তিনটি প্যানেল নির্বাচন করে। সেই প্যানেল একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আচার্য অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি বরাবর যায়। তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, নির্বাচিতদের মধ্যে কাকে উপাচার্য নিয়োগ দেবেন।
কালের কণ্ঠ : কিন্তু রাষ্ট্রপতিকে সিদ্ধান্ত নিতে হলে সংবিধানের বিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ প্রয়োজন হবে। তিনি কি রাজনৈতিক বিবেচনাকে অগ্রাধিকার দেবেন না?
এ কে আজাদ চৌধুরী : শিক্ষামন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতি_সবাইকে তো সিনেটের নির্বাচনকে প্রাধান্য দিতে হবে। যে তিনজনের প্যানেল নির্বাচিত হবে, তাদের মধ্য থেকেই তো একজনকে বাছাই করবেন তাঁরা। ফলে পুরোপুরি রাজনৈতিক বিবেচনাকে এখানে স্থান দেওয়া কি ঠিক হবে? সিনেটের কিন্তু পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। তারা যোগ্য লোককেই নির্বাচিত করে। এর বাইরে সরকার কিছু করতে পারবে না।
কালের কণ্ঠ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কি এর ব্যত্যয় ঘটেনি কখনো?
এ কে আজাদ চৌধুরী : নির্বাচন পদ্ধতিতে কখনো হয়নি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু খুন হওয়ার পর সামরিক শাসন আমলের কথাও যদি বলেন তাহলেও না। সে সময় ড. আবদুল মতিন চৌধুরীকে অন্যায়ভাবে সামরিক শাসকরা শাস্তিও প্রদান করেছিলেন; কিন্তু সিনেটের নির্বাচনে তিনি সবার চেয়ে বেশি ভোট পেলেন। দ্বিতীয় হলেন কবীর চৌধুরী, তৃতীয় হলেন ফজলুল হালিম চৌধুরী। তিনজনই ছিলেন সামরিক শাসনের বিপক্ষে। তার পরও জেনারেল জিয়াউর রহমান তৃতীয়জনকে বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন আইনের কারণে। এরপর সামরিক শাসক হিসেবে এলেন জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তখন নির্বাচিত হলেন আবার ফজলুল হালিম চৌধুরী। কিন্তু একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সামরিক সরকারের লেলিয়ে দেওয়া বাহিনী উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করলে তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলেন। তখন তিন হাজার শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরবর্তী সময় অধ্যাপক শামসুল হক নির্বাচিত হয়েছিলেন। শামসুল হক সাহেবকেও পদত্যাগ করতে হয়। সেখানে ছাত্রদলকে দুই ভাগ হয়ে ভিসির বাড়ির সামনে অগি্নসংযোগ করতে দেখা যায়। এদের এক ভাগ এরশাদ সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত হয়। অধ্যাপক মান্নান সাহেব চালালেন তিন-চার বছর। এভাবেই অধ্যাপক মনিরুজ্জামান, অধ্যাপক এমাজউদ্দীন সাহেবও ভিসি হলেন। এমাজউদ্দীন সাহেব পদত্যাগ করেছিলেন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর। আমিও তাঁকে বলেছিলাম, তিনি যেন পদত্যাগ না করেন। শেখ হাসিনাও বলেছিলেন, পদত্যাগের প্রয়োজন নেই। কিন্তু তিনি পদত্যাগ করেন। ব্যক্তিগতভাবেও তাঁকে শেখ হাসিনা সম্মান করতেন। একসময় সিনেটের নির্বাচনে আমি উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি।
কালের কণ্ঠ : আপনি তো আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ছিলেন।
এ কে আজাদ চৌধুরী : আমি যখন জানতে পারি, আমাকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তখনই আমি রাজনীতি থেকে পদত্যাগ করি। সুতরাং উপাচার্য হওয়ার পর আমার আর কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংস্রব ছিল না। আমি পদত্যাগকালে প্রধানমন্ত্রীকে আমার অভিপ্রায়ের কথা অবহিত করি। তিনি আমার সিদ্ধান্তকে সঠিক বলেন।
কালের কণ্ঠ : তাহলে কি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসি নিয়োগ কিংবা শিক্ষক নিয়োগকালে কোনো পক্ষপাতিত্ব কিংবা দলীয়করণের কোনো ঘটনাই নেই?
এ কে আজাদ চৌধুরী : দলীয় পক্ষপাতিত্ব একেবারেই হয় না এটা আমি বলি না। প্রশ্ন হচ্ছে, কতটা হচ্ছে। সহনশীল পর্যায়ে থেকে হচ্ছে কি না। আবার অসহনীয় আচরণকেও কিভাবে এড়িয়ে যাব। বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর রাতের অন্ধকারে ১১ জন উপাচার্যকে সরিয়ে দিল। এটা কি খুব জরুরি ছিল? কম যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগের ঘটনাও ঘটেছে। আবার কেয়ারটেকার সরকার আমলে কিংবা বিএনপি আমলে নিয়োগকৃত উপাচার্যদের অনেকেই এই সরকার আমলেও মেয়াদ পূরণ করে চাকরি করেছেন। নজরুল ইসলাম সাহেবের কথাই ধরা যাক। প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলাম, আপনি চাইলে তিনি পদত্যাগ করতে রাজি আছেন। প্রধানমন্ত্রী সায় দেননি। যে কারণে নজরুল সাহেব মেয়াদ পূর্ণ করা পর্যন্ত ভিসি ছিলেন।
কালের কণ্ঠ : আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হওয়ার আগে থেকেই প্রচণ্ড অসন্তোষ ছিল। গোলাগুলি-খুন লেগেই থাকত।
এ কে আজাদ চৌধুরী : আমি যোগ দেওয়ার আগে প্রতিবছর কমপক্ষে ৭০-৮০টি সহিংস ঘটনা ঘটত বিশ্ববিদ্যালয়ে। গুলি-চাপাতি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক বিষয়। আমি শক্ত হাতে দমন করি এসব। সে ক্ষেত্রে পুলিশ ও প্রশাসন আমাকে সহযোগিতা করে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী আমাকে এ ব্যাপারে যথেষ্ট সাহস জুগিয়েছেন। সহিংসতা নেমে আসে শূন্যের কোঠায়। আড়াই বছরের সেশনজট নেমে আসে শূন্যে। ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হয়েছিল ওই সময়, টিএসসি সংস্কার, ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে হল নির্মাণ_এমন আরো কিছু কাজ হয়। প্রচুর স্কলারশিপের ব্যবস্থা করি। অর্ধেক টিউশন ফির মাধ্যমে পিএইচডি করার সুযোগ গ্রহণ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক। বেশ কিছু নতুন বিভাগ খোলা হয় সে সময়। উল্লেখযোগ্য শিক্ষামানের কারণে এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ৩৭ নম্বর অবস্থানে পৌঁছার কৃতিত্ব অর্জন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
কালের কণ্ঠ : সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টর একজন ছাত্রীকে ঘুষি মেরেছেন, যা কালের কণ্ঠ প্রকাশ করে। এ ঘটনা কিভাবে মূল্যায়ন করবেন।
এ কে আজাদ চৌধুরী : অনেকেই বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার সঙ্গে মিল রেখে এখানেও ঘটনা ঘটবে। আমি এই মতের সঙ্গে এক হতে পারি না। বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যই আর দশটা প্রতিষ্ঠান থেকে আলাদা। মর্যাদার দিক থেকে সে অনেক ওপরে। সেখানকার পরিস্থিতি এমন হবে_এটা অপ্রত্যাশিত। যা করা হয়েছে তা ওনার পদমর্যাদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এটা নৈতিকতার অবক্ষয়কেই দেখিয়ে দেয়। মুষ্টিমেয় মানুষের জন্য আজকে গোটা শিক্ষক সমাজ প্রশ্নের মুখে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলো বিচ্ছুরিত হবে। সব কূপমণ্ডূকতা থেকে বাইরে থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়।
কালের কণ্ঠ : সেখানে ছাত্রলীগের কর্মীদের ডেকে এনেছেন প্রক্টর_এমন সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
এ কে আজাদ চৌধুরী : এটা কখনো গ্রহণ করতে পারি না। আমি জানি না, ছাত্রলীগকে ডেকে আনা হয়েছে কি না। অনেক সময় সংবাদ স্পর্শকাতর করার জন্য কিছু বিষয় যোগ করা হয়। কিন্তু তাই বলে ছাত্রীর গায়ে হাত তোলাটা আমি মেনে নেব_এটা হতে পারে না। আর ছাত্রলীগকে যদি ডেকে আনা হয়ে থাকে, তাহলে এটা আরো নিন্দনীয়।
কালের কণ্ঠ : সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের কিছু উচ্ছৃঙ্খল সদস্য টেন্ডারবাজি থেকে শুরু করে প্রতিপক্ষকে পেটানোর মতো কাজে জড়িত। শিক্ষায়তনসহ নানা স্থানে তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রধানমন্ত্রীও বিরক্ত। কিভাবে দেখছেন?
এ কে আজাদ চৌধুরী : কিছুটা বয়সের ব্যাপার আছে। কৈশোর আর যৌবনের সন্ধিক্ষণে তাদের কারো কারো মনে শক্তি প্রদর্শনের মানসিকতা কাজ করে। সব কোমলমতি মানুষের মধ্যেই এমন মানসিকতা কমবেশি থাকে। এর সঙ্গে যদি ক্ষমতার সম্পৃক্ততা থাকে, তাহলে তাদের প্রবণতা বেড়ে যায়। তাদের মধ্যে যে চ্যালেঞ্জের মন থাকে, তা ভালো কাজের দিকে যেমন লাগানো যায় আবার ধ্বংসাত্মক কাজেও জড়িয়ে পড়তে পারে। তবে এই বয়সের তরুণরা যদি আশ্রয়-প্রশ্রয় পায়, তাহলে কিছুটা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর ছাত্রলীগের ব্যাপারটা যদি বলেন তাহলে আমি বলব, এটা ধারাবাহিকতা। তবে যে কারণেই হোক, প্রতিফল ভোগ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে যে কাউকে। যে যেমন করবে, তার প্রতিফলও তেমনি হবে। রাজনৈতিক টানাপড়েন চললে তার প্রতিফলন বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়তে পারে। আমাদের ছাত্ররা অনেক সময় রাজনৈতিক ঢাল হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। সব সরকারের আমলেই এটা হয়েছে। এর অবসান হওয়া উচিত। সহনশীল হতে হবে সবাইকে। মনে রাখার প্রয়োজন আছে, মাসল পাওয়ার কোনো সমাধানের পথ নয়।
কালের কণ্ঠ : আপনি উপাচার্য থাকাকালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। তখনো ছাত্রলীগের দুর্নাম ছিল। কিভাবে দেখেছেন বিষয়টি?
এ কে আজাদ চৌধুরী : আমি উপাচার্য থাকাকালে ছাত্রলীগের ৫০ জনকে সাময়িক বহিষ্কার করেছিলাম। অথচ ছাত্রদলের করেছিলাম মাত্র ১৭ জনকে। অনেকে এসে আমার কাছে অভিযোগ করেছিল, স্যার আপনি তো ছাত্রলীগকে শেষ করে দিচ্ছেন। আমি তাদের বলেছিলাম, তোমরা ক্ষমতায়। ওরা দুর্বল। ওদের নিরাপত্তা দেওয়া তোমাদেরও দায়িত্ব। তারা কথা শুনেছে। সহযোগিতা করেছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনাকালে প্রধানমন্ত্রী কখনো আমার কাজে হস্তক্ষেপ করেননি।
কালের কণ্ঠ : ১৯৭৩ বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী বেশ কিছু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। এতে দলীয়করণের প্রভাব পড়ে। এত নির্বাচন না করে চালানো যায় না?
এ কে আজাদ চৌধুরী : সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য নির্বাচন হয়। এটা অবশ্যই ভালো দিক। এটার প্রয়োজন আছে। অনেকে বলেন, উপাচার্য নিয়োগের জন্য চার-পাঁচজনের একটা সার্চ কমিটি করা যেতে পারে। আমি মনে করি, এর চেয়ে বর্তমান পদ্ধতি অনেক ভালো। বিভিন্ন দেশে সিন্ডিকেট কিংবা সিনেট আছে। তবে এত নির্বাচন না হলেও বোধ হয় চলে। চেয়ারম্যান পদগুলো পর্যায়ক্রমে হলে ক্ষতি কী? ডিনের নির্বাচন সর্বজনীন না হলে ভালো। ফ্যাকাল্টি মেম্বারের মাধ্যমে নির্বাচন হলে রাজনীতি অনেক কমে যাবে।
কালের কণ্ঠ : অনেকেই বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশটি সংশোধন প্রয়োজন_আপনি কী মনে করেন?
এ কে আজাদ চৌধুরী : ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অবশ্যই যুগান্তকারী। পাকিস্তান আমলে যে কালাকানুন ছিল তা রদ হয়ে যায় এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে। আমরা স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিলাম। আমরা এই অধ্যাদেশটি পেয়েছি। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ঠিক রেখে যুগের প্রয়োজনে অধ্যাদেশটি সংশোধন হতে পারে। বলুন, এখনো কি ১০ টাকা বেতন দিয়ে পড়ার সময় আছে? অর্থায়নের দিকটি ভাবতে হবে। উচ্চশিক্ষার জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে। জ্বালানি কিনতে হয় ১৭ হাজার কোটি টাকা দিয়ে। দেশের আলো প্রজ্বলিত করার জন্য আমরা কত টাকা ব্যয় করছি।
কালের কণ্ঠ : ছাত্র বেতন বাড়ালে গরিব শিক্ষার্থীদের কী অবস্থা হবে?
এ কে আজাদ চৌধুরী : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে হারে বেতন নেয়, এটা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। সে কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিড় বেশি। সেখানেও আয় বাড়াতে গেলে বেতন পরিবর্তন না করে উপায় নেই। তবে বাড়ালেও এমন পর্যায়ে নিতে হবে, যাতে গরিব মানুষের অসুবিধা না হয়। শিক্ষার মান বাড়াতে হবে। তা না হলে আমাদের দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমাদের দেশে শত শত পাকিস্তানি, ভারতীয় কিংবা শ্রীলঙ্কার তরুণ কাজ করছে। অথচ আমাদের যুবকদের মেধা কম নয়। বিকশিত হওয়ার পথ করে দিতে পারলে আমাদের যুবকরা অনেক কিছু করে দেখাতে পারে। শিক্ষার জন্য বর্তমান সরকার আন্তরিক। প্রধানমন্ত্রী ট্রাস্ট ফান্ড করেছেন। তিনি এই খাতের জন্য এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন। এটা আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষা খাতকে সহায়তা প্রদান করবে। গত চার বছরে সাতটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। এতেও সাধারণ মানুষের উপকার হচ্ছে।
কালের কণ্ঠ : আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি থাকাকালেও ডাকসু নির্বাচন হয়নি, এখনো হচ্ছে না। দেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ উন্নয়নে এ ধারাকে কিভাবে দেখেন?
এ কে আজাদ চৌধুরী : সব উপাচার্য ক্ষমতায় আসার পর মনে করেন, ডাকসু নির্বাচন হওয়া জরুরি। সমস্যা হলো_একদল বলে পরিবেশ আছে, অন্য দল বলে পরিবেশ নেই। শিক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য যে কারণে ভিসিরা ডাকসু নির্বাচন এড়িয়ে যান। অথচ দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি সুষ্ঠু ধারায় পরিচালিত করতে হলে ছাত্র সংসদের নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন।
কালের কণ্ঠ : সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে এখন দেশে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার মান বাড়েনি সেই হারে। কী মনে করেন আপনি।
এ কে আজাদ চৌধুরী : সংখ্যা বৃদ্ধি যদি মানের সঙ্গে সম্পৃক্ত না হয়, তাহলে এই সংখ্যা বৃদ্ধিতে লাভ হবে না। মান বৃদ্ধি না হলে এই সংখ্যা বৃদ্ধিকে হাইব্রিডের সঙ্গে তুলনা করা যায়। ইউজিসি এ ব্যাপারে অত্যন্ত সজাগ। হায়ার এডুকেশন কোয়ালিটি এনহেন্সমেন্ট প্রকল্প নেওয়া হয়েছে এই চিন্তা করে। বিশ্বব্যাংক এই খাতে সহযোগিতা করছে। ৩৮৬ কোটি টাকার প্রকল্প এগিয়ে চলছে। উদ্ভাবনী প্রকল্পকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়েছে। ১৯৪৭ সালের পর থেকে দুই বছর আগ পর্যন্ত মাত্র দুই বছরে এত টাকা কখনো বরাদ্দ পায়নি এই খাতে। শিক্ষা কার্যক্রমে অনেক পরিবর্তন এসেছে।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ
এ কে আজাদ চৌধুরী : আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments