রুদ্র তোমার দারুণ দীপ্তি এসেছে দুয়ার ভেদিয়া by শামসুল আরেফিন খান
পাশ্চাত্য জগতে অব্যাহত অর্থনৈতিক মন্দা, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, কাজ হারানো মানুষের আকাশছোঁয়া হতাশা, বিশ্বজুড়ে তীব্র খাদ্য সংকট, ধর্মীয় মৌলবাদী জঙ্গি গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী তৎপরতা এবং পারমাণবিক সন্ত্রাসের সুপ্ত আশঙ্কার পটভূমিতে মধ্যপ্রাচ্যের প্রচণ্ড মরুঝড়, বিশ্ব-পরাশক্তির দুধ-কলায় লালিত স্বৈরতন্ত্র ও রাজশক্তিকে ভিতসমেত কাঁপিয়ে তুলেছে।
এই বিবর্ণ সময়ে একজন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ সূচনা করেছেন প্রথম সাইবার বিশ্বযুদ্ধের। আঘাত হেনেছেন বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রশক্তির নিরাপত্তা ব্যবস্থার মর্মমূলে। ২৯ বছর আগে, ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা যখন স্বাধীনতার জন্য লড়ছেন একটি বর্বর সামরিক সরকার ও তার নৃশংস হানাদার বাহিনী এবং রাজাকারদের সঙ্গে তখন অস্ট্রেলিয়ার ছোট্ট এক দ্বীপে জন্ম নেন এ সময় দুনিয়া কাঁপানো দুঃসাহসী বিপ্লবী জুলিয়ান পল অ্যাসাঞ্জ। তিনি জর্জ অরওয়েলের উপন্যাস পড়ে টোটালিটেরিয়ান রাষ্ট্রের স্বরূপ চিনতে পারেন। কুটভোনেগাটও তার খুব প্রিয় লেখক। বোখারিনের গ্রেপ্তার ও মৃত্যুদণ্ডের কাহিনী অবলম্বনে লেখা আর্থার কোয়েসলারের 'ডার্কনেস অ্যাট নূন' তার উপলব্ধি ও চেতনাকে শাণিত করে। তিনি বিশ্বের জ্ঞানালোকিত সচেতন যুবসমাজের ওপর কতটা প্রভাব বিস্তার করেছেন তার প্রমাণ মেলে স্বৈর একনায়কের বিরুদ্ধে তিউনিসিয়া ও মিসরের ভাগ্যবিড়ম্বিত তরুণদের মহা উত্থান, গণশক্তির মহা জাগরণ এবং রুটি-রুজি ও গণতন্ত্রের দাবিতে জেগে ওঠা গণচেতনার উত্তাল ঊর্মিমালা থেকে। সেই দুর্বার গণজাগরণের ঢেউ আছড়ে পড়েছে লিবিয়া, আলজেরিয়া, সুদান, ইয়েমেন, জর্দান মায় সৌদি আরবের স্বৈরশাসনের ভিত্তিমূলেও। সেই নজিরবিহীন গণবিপ্লব আরব মরুদেশে উদ্গত ও স্ফূরিত হয়েছে ডিজিটাল জাদুর ছোঁয়ায়। ইন্টারনেট, ফেইসবুক, টুইটার, ইউটিউব, ইয়াহু, গুগলসের ওয়েভ তরঙ্গে ভর করে ঝড়ের বেগে ছুটে চলেছে বিপ্লবী চেতনার দাবানল আর যুব-মানসের রুদ্র রোষ। 'রুদ্র তোমার দারুণ দীপ্তি এসেছে দুয়ার ভেদিয়া; বক্ষে বেজেছে বিদ্যুৎবাণ স্বপ্নের জাল ছেদিয়া।' অগি্নবীণায় ঝড় তুলেছেন প্রথম তিউনিসিয়ার সিদি বাউজিদ শহরের কম্পিউটার গ্র্যাজুয়েট চাকরিপ্রত্যাশী বেকার যুবক মোহাম্মদ বৌয়াজিজি (২৬)। তিনি প্রতিকারহীন বেকারত্বের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রতিবাদের এক অনিবার্য মশাল রেখে গেছেন নিজের গায়ে আগুন জ্বালিয়ে শাহাদাতবরণ করে। তার অমর স্মৃতি বুকে ধারণ করে স্বর্ণপ্রসবিনী আরবের নিপীড়িত বঞ্চিত ভাগ্যাহত হাজার হাজার শিক্ষিত বেকার যুবক বুকের রক্তকে কলমের কালি বানিয়ে রচনা করেছেন সেক্যুলার আরব বিপ্লবের প্রথম মহাকাব্য। তার পাতায় পাতায় লেখা রয়েছে নমরুদ-ফেরাউনের উত্তরসূরিদের চূড়ান্ত বিনাশ পরোয়ানা। বিপ্লব ও গণতন্ত্র আরব দেশে নিষিদ্ধ তত্ত্ব ও নিষিদ্ধ কথা। মধ্যযুগীয় কায়দায় ও মাঝরাতে উট ও ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে তস্কর-লস্কর পাঠিয়েছিল হোসনি মুবারক নীল নদের তীরে কায়রোর স্বাধীনতা স্কোয়ারে লাখো জনতার জমায়েত গুঁড়িয়ে দেওয়ার হীন মতলবে। তারা অবিরাম গুলি চালিয়েছিল। জনতা জবাব দিয়েছিল পাথর আর মলোটভ ককটেলের ঝড় তুলে। সেনাবাহিনী সাঁজোয়া গাড়ি ও ট্যাংকে বসে নীরবে তামাশা দেখেছে। এই সেনাবাহিনী প্রতিপালিত হয় মার্কিন সরকারের দেওয়া বার্ষিক দেড় বিলিয়ন মতান্তরে দুই বিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়ে। তাদের প্রধান কাজ ফিলিস্তিনি বিপ্লবীদের হাত থেকে ইসরায়েলকে বাঁচানো। অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে সে দায়িত্ব পালন করেছেন হোসনি মুবারক বিগত ৩০ বছর। উত্তর আফ্রিকার মাত্র ১০.৫ মিলিয়ন মানুষ অধ্যুষিত ক্ষুদ্র রাষ্ট্র তিউনিসিয়া থেকে ২৩ বছরের স্বৈরশাসক উত্তাল গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে পরিবার-পরিজন নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন সৌদি আরবে। সেখানেই প্রথম ঝড় উঠেছিল আরব বিপ্লবের। কোনো জামাল-নাসের নেই, নেলসন ম্যান্ডেলা নেই, ভাকলাভ হাভেল নেই, ইয়াসির আরাফাত নেই, করম চাঁদ গান্ধী নেই, শেখ মুজিব নেই। কে ধরবে কাণ্ডারিহীন তরীর হাল! হয়তো গণসংগ্রামের পটভূমিতেই জন্ম নেবে বিশ্ব কাঁপানো কোনো নেতা, কে জানে সে কথা।
আশাই জীবন। আশাই প্রাণশক্তি। আশাই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। বঞ্চনা ব্যর্থতা ও হতাশার অন্ধকার গহ্বরে আবর্তিত ব্যক্তিজীবনে নিরাশা আত্মঘাতী প্রবণতা জাগায়। অন্যদিকে বাঙালির মতো আশায় উদ্বেলিত জাতি বাধার বিন্ধাচল ডিঙিয়ে সব চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তিমিরাচ্ছন্ন সুড়ঙ্গ অতিক্রম করে সম্ভাবনার আলোকিত প্রান্তরে পা রাখার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়। তিন হাজার বছর সামন্তবাদ ও রাজতন্ত্র মহাচীনের অযুত কোটি গণমানুষকে নেশার কারাগারে বন্দি রেখেছিল। সে জাতির ঘুম ভাঙ্গিয়েছিলেন সানইয়াৎসেন-মাওজেদং। সেই চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনৈতিক পরাশক্তি। সেদিনও দূরে নয়, যখন চীন ভারত ব্রাজিল দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বের সবচেয়ে বড় শক্তিধর পরাশক্তির শ্রেষ্ঠত্বের দর্প অহঙ্কার চূর্ণ করে দিতে সক্ষম হবে। এ কথা বলছেন যুক্তরাষ্ট্রেরই নোবেল বিজয়ী এক শীর্ষস্থানীয় খ্যাতিমান অর্থনীতিক। তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কেও উচ্চ আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন ভৌত অবকাঠামোর সঙ্গে বিদ্যুৎ ও গ্যাস জোগান দিতে পারলে বাংলাদেশ শিল্পসমৃদ্ধির পথে দ্রুত অগ্রসর হতে পারবে। নিম্ন আয় থেকে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া কঠিন হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের আশাবাদী অর্থনীতিবিদরা মনে করেন চীনের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ আকর্ষণে সক্ষম হলে অচিরে বাংলাদেশে ৪০ লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থান ঘটবে। আগামী দশকে বর্তমান মাথাপিছু আয় ৭৮০ ডলারের সঙ্গে আরো এক হাজার ২০০ ডলার যোগ করতে হবে। গত দুই বছরে এক হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হয়েছে। ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। আগামী বছরের মধ্যে আরো দুই হাজার ৩৬১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে। 'আমরা আগামী পাঁচ বছরে প্রায় ১২ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কর্মসূচি নিয়েছি। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি আমরা তরল জ্বালানি, কয়লা, ডুয়েল ফুয়েল এবং নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ শুরু করেছি। রাশিয়ার সহযোগিতায় রূপপুরে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে, যেখানে পর্যায়ক্রমে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। ভারত, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমার থেকে বিদ্যুৎ আমদানির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গ্যাসের উৎপাদন দৈনিক দুই হাজার ৩৫ মিলিয়ন ঘনফুটে উন্নীত হয়েছে।' আরো আশার কথা এই যে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশ এখন উদার গণতান্ত্রিক এবং অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা জাতিকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার। সে লক্ষ্যে প্রণীত কর্মপরিকল্পনা ও বিগত দুই বছরে সাধিত অগ্রগতির বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ তুলে ধরেছেন। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, তিনি তাঁর দল, মন্ত্রিসভা, দলীয় সাংসদ, ছাত্র ও যুবসমাজ মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তিকে এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে সচেষ্ট রয়েছেন। আমি আশা করি, প্রবাসের ৭০ লাখ বাঙালি এবং বাংলাদেশের শত্রুমিত্র সবাই স্বপ্নপূরণের পথে অর্জিত সব অগ্রগতির ডিজিটাল চিত্র ওয়েবসাইটে দেখতে পাবে।
সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ২২তম বৈঠক শেষে, গত ২৮ ডিসেম্বর ২০১০ এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, 'যাঁরা দিনবদলের কথা বলে মুখে ফেনা তুলছেন, তাঁদের মনমানসিকতা এখনো বদলায়নি। অফিসে কম্পিউটার সাজিয়ে রাখলেই দিনবদল হয় না। ডিজিটাল হওয়া যায় না। বেশির ভাগ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে মন্ত্রীর শপথ আর প্রথম দিকের দুই-একটি অনুষ্ঠানের ছবি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না।' এমনটি প্রত্যাশিত নয়। বলা চলে দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু আমার স্বস্তির কারণ হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলে আত্মসমালোচনা ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতি দ্রুত গড়ে তোলার দৃশ্যমান প্রচেষ্টা। এটাই হয়তো সব ঘাটতি দূর করে ভবিষ্যতের সম্ভাবনাগুলোকে উজ্জ্বল করে তুলবে। ১৯৯০ সালের সংসদে প্রধান দুই দলের পূর্ণ সম্মতি ও সহযোগিতায় সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে এসেছিল। তাই এর সাফল্য নিশ্চিত করতে বর্তমান বিরোধী দলকে তার ইতিহাস নির্ধারিত ভূমিকা পালন করে জাতি ও জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে হবে। বিগত দুই বছরে ১৭৪ কার্যদিবসের মধ্যে মাত্র ৪৪ দিন বিরোধী দল সংসদে উপস্থিত ছিল। বিরোধী দলের নেতা সংসদে উপস্থিত ছিলেন মাত্র পাঁচ দিন। এতে গণধিকৃত বয়কট সংস্কৃতির ভিত মজবুত হলেও বেতন-ভাতা ও গাড়ি-বাড়ির সুবিধা ভোগদখল হালাল হয়নি। গণতন্ত্র এবং করদাতা ও ভোটদাতার এবং জনস্বার্থের সমূহ ক্ষতি সাধিত হয়েছে। বিরোধী দল সংসদে উপস্থিত থেকে প্রতিবাদ ও ওয়াকআউটের মাধ্যমে সংসদীয় রীতিনীতির প্রতি সম্মান দেখালে এবং সুযোগ মতো গঠনমূলক সমালোচনার কৌশলে সরকারকে তুলো ধুনো করলেও জাতি উপকৃত হতো। দেশে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলো বলছে নতুন কথা। দলীয় সরকারের অধীনে সৃষ্ট অবাধ নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের নতুন আবহাওয়ার কথা। বলছে বলিষ্ঠ নিরপেক্ষ স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অব্যাহত উপস্থিতির কথা। প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণমুক্ত সম্পূর্ণ স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর শুনে জাতি সর্বক্ষেত্রে ন্যায়বিচার লাভের আশায় বুক বাঁধতে শুরু করেছে। এবার বলা যায়, টিকি বামনের সেই গল্পে কী হয়েছিল শেষটায় : মহাপ্রভুর শুভাগমন ঘটল শান্তিপুর গ্রামের লোকে লোকারণ্য তর্কসভায়। বিশাল প্রলম্বিত টিকির স্তূপসহ উচ্চমঞ্চে উত্তোলিত ও উপবিষ্ট হয়েই চড়া গলায় স্বাগতিক ব্রাহ্মণকে তর্কে আহ্বান করে তিনি ধাঁধার প্রথম বাক্যটি উচ্চারণ করলেন : 'লাউয়াং ফলং! সঙ্গে সঙ্গে সেই সাহসী বালক শিষ্য এক লাফে মঞ্চে আরোহণ করেই মহাগুরুর টিকি কর্তন করে বললেন, আগে বীজ রোপনং চারা গজানং_লতাইয়া লতাইয়া মঞ্চে উঠিয়া তবে তো লাউয়াং ফলং!' গল্পের কল্পকথা থাক। সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। ধাবমান মহাকাল দারিদ্র্য বেকারত্বের অবসান দাবি করে নজিরবিহীন মরুঝড় সৃষ্টি করেছে। রুদ্র তারুণ্য ও বিদ্রোহী যৌবন কাউকে আর সময় দিতে প্রস্তুত নয়। কাজেই সাবধান। সাধু সাবধান।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া প্রবাসী সাংবাদিক
আশাই জীবন। আশাই প্রাণশক্তি। আশাই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। বঞ্চনা ব্যর্থতা ও হতাশার অন্ধকার গহ্বরে আবর্তিত ব্যক্তিজীবনে নিরাশা আত্মঘাতী প্রবণতা জাগায়। অন্যদিকে বাঙালির মতো আশায় উদ্বেলিত জাতি বাধার বিন্ধাচল ডিঙিয়ে সব চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তিমিরাচ্ছন্ন সুড়ঙ্গ অতিক্রম করে সম্ভাবনার আলোকিত প্রান্তরে পা রাখার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়। তিন হাজার বছর সামন্তবাদ ও রাজতন্ত্র মহাচীনের অযুত কোটি গণমানুষকে নেশার কারাগারে বন্দি রেখেছিল। সে জাতির ঘুম ভাঙ্গিয়েছিলেন সানইয়াৎসেন-মাওজেদং। সেই চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনৈতিক পরাশক্তি। সেদিনও দূরে নয়, যখন চীন ভারত ব্রাজিল দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বের সবচেয়ে বড় শক্তিধর পরাশক্তির শ্রেষ্ঠত্বের দর্প অহঙ্কার চূর্ণ করে দিতে সক্ষম হবে। এ কথা বলছেন যুক্তরাষ্ট্রেরই নোবেল বিজয়ী এক শীর্ষস্থানীয় খ্যাতিমান অর্থনীতিক। তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কেও উচ্চ আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন ভৌত অবকাঠামোর সঙ্গে বিদ্যুৎ ও গ্যাস জোগান দিতে পারলে বাংলাদেশ শিল্পসমৃদ্ধির পথে দ্রুত অগ্রসর হতে পারবে। নিম্ন আয় থেকে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া কঠিন হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের আশাবাদী অর্থনীতিবিদরা মনে করেন চীনের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ আকর্ষণে সক্ষম হলে অচিরে বাংলাদেশে ৪০ লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থান ঘটবে। আগামী দশকে বর্তমান মাথাপিছু আয় ৭৮০ ডলারের সঙ্গে আরো এক হাজার ২০০ ডলার যোগ করতে হবে। গত দুই বছরে এক হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হয়েছে। ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। আগামী বছরের মধ্যে আরো দুই হাজার ৩৬১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে। 'আমরা আগামী পাঁচ বছরে প্রায় ১২ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কর্মসূচি নিয়েছি। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি আমরা তরল জ্বালানি, কয়লা, ডুয়েল ফুয়েল এবং নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ শুরু করেছি। রাশিয়ার সহযোগিতায় রূপপুরে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে, যেখানে পর্যায়ক্রমে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। ভারত, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমার থেকে বিদ্যুৎ আমদানির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গ্যাসের উৎপাদন দৈনিক দুই হাজার ৩৫ মিলিয়ন ঘনফুটে উন্নীত হয়েছে।' আরো আশার কথা এই যে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশ এখন উদার গণতান্ত্রিক এবং অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা জাতিকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার। সে লক্ষ্যে প্রণীত কর্মপরিকল্পনা ও বিগত দুই বছরে সাধিত অগ্রগতির বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ তুলে ধরেছেন। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, তিনি তাঁর দল, মন্ত্রিসভা, দলীয় সাংসদ, ছাত্র ও যুবসমাজ মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তিকে এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে সচেষ্ট রয়েছেন। আমি আশা করি, প্রবাসের ৭০ লাখ বাঙালি এবং বাংলাদেশের শত্রুমিত্র সবাই স্বপ্নপূরণের পথে অর্জিত সব অগ্রগতির ডিজিটাল চিত্র ওয়েবসাইটে দেখতে পাবে।
সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ২২তম বৈঠক শেষে, গত ২৮ ডিসেম্বর ২০১০ এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, 'যাঁরা দিনবদলের কথা বলে মুখে ফেনা তুলছেন, তাঁদের মনমানসিকতা এখনো বদলায়নি। অফিসে কম্পিউটার সাজিয়ে রাখলেই দিনবদল হয় না। ডিজিটাল হওয়া যায় না। বেশির ভাগ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে মন্ত্রীর শপথ আর প্রথম দিকের দুই-একটি অনুষ্ঠানের ছবি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না।' এমনটি প্রত্যাশিত নয়। বলা চলে দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু আমার স্বস্তির কারণ হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলে আত্মসমালোচনা ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতি দ্রুত গড়ে তোলার দৃশ্যমান প্রচেষ্টা। এটাই হয়তো সব ঘাটতি দূর করে ভবিষ্যতের সম্ভাবনাগুলোকে উজ্জ্বল করে তুলবে। ১৯৯০ সালের সংসদে প্রধান দুই দলের পূর্ণ সম্মতি ও সহযোগিতায় সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে এসেছিল। তাই এর সাফল্য নিশ্চিত করতে বর্তমান বিরোধী দলকে তার ইতিহাস নির্ধারিত ভূমিকা পালন করে জাতি ও জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে হবে। বিগত দুই বছরে ১৭৪ কার্যদিবসের মধ্যে মাত্র ৪৪ দিন বিরোধী দল সংসদে উপস্থিত ছিল। বিরোধী দলের নেতা সংসদে উপস্থিত ছিলেন মাত্র পাঁচ দিন। এতে গণধিকৃত বয়কট সংস্কৃতির ভিত মজবুত হলেও বেতন-ভাতা ও গাড়ি-বাড়ির সুবিধা ভোগদখল হালাল হয়নি। গণতন্ত্র এবং করদাতা ও ভোটদাতার এবং জনস্বার্থের সমূহ ক্ষতি সাধিত হয়েছে। বিরোধী দল সংসদে উপস্থিত থেকে প্রতিবাদ ও ওয়াকআউটের মাধ্যমে সংসদীয় রীতিনীতির প্রতি সম্মান দেখালে এবং সুযোগ মতো গঠনমূলক সমালোচনার কৌশলে সরকারকে তুলো ধুনো করলেও জাতি উপকৃত হতো। দেশে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলো বলছে নতুন কথা। দলীয় সরকারের অধীনে সৃষ্ট অবাধ নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের নতুন আবহাওয়ার কথা। বলছে বলিষ্ঠ নিরপেক্ষ স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অব্যাহত উপস্থিতির কথা। প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণমুক্ত সম্পূর্ণ স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর শুনে জাতি সর্বক্ষেত্রে ন্যায়বিচার লাভের আশায় বুক বাঁধতে শুরু করেছে। এবার বলা যায়, টিকি বামনের সেই গল্পে কী হয়েছিল শেষটায় : মহাপ্রভুর শুভাগমন ঘটল শান্তিপুর গ্রামের লোকে লোকারণ্য তর্কসভায়। বিশাল প্রলম্বিত টিকির স্তূপসহ উচ্চমঞ্চে উত্তোলিত ও উপবিষ্ট হয়েই চড়া গলায় স্বাগতিক ব্রাহ্মণকে তর্কে আহ্বান করে তিনি ধাঁধার প্রথম বাক্যটি উচ্চারণ করলেন : 'লাউয়াং ফলং! সঙ্গে সঙ্গে সেই সাহসী বালক শিষ্য এক লাফে মঞ্চে আরোহণ করেই মহাগুরুর টিকি কর্তন করে বললেন, আগে বীজ রোপনং চারা গজানং_লতাইয়া লতাইয়া মঞ্চে উঠিয়া তবে তো লাউয়াং ফলং!' গল্পের কল্পকথা থাক। সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। ধাবমান মহাকাল দারিদ্র্য বেকারত্বের অবসান দাবি করে নজিরবিহীন মরুঝড় সৃষ্টি করেছে। রুদ্র তারুণ্য ও বিদ্রোহী যৌবন কাউকে আর সময় দিতে প্রস্তুত নয়। কাজেই সাবধান। সাধু সাবধান।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া প্রবাসী সাংবাদিক
No comments