যোগাযোগ-পদ্মা সেতুর কথা আবার নতুন করে ভাবি by ফ. র. আল-সিদ্দিক
পদ্মা সেতু নির্মাণের ওপর বিগত বছরাধিককাল ধরে এ দেশের পত্র-পত্রিকায় আলোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এত আলোচনা-সমালোচনার ধুন্ধুমারের মধ্যেও যে দুটি মূল্যবান কথা সম্পূর্ণভাবে বাদ পড়ে গেছে, তার প্রথমটি হলো : এক. আমরা, মানে এই বিশ্ববাসী এখন একটা যুগসন্ধিক্ষণে বাস করছি।
এর কারণ হলো, খুব শিগগির খনিজ তেল এবং খনিজ গ্যাসের মজুদ ফুরিয়ে আসবে। তাই সেগুলোর দাম এতই বেড়ে যাবে যে, গাড়ি, মানে প্রাইভেট কার চালানোর জন্য পেট্রোল কিংবা সিএনজি কেনার ক্ষমতা এ দেশের উচ্চ মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে না। তখন গাড়ি চালাতে হলে আমাদের বায়ো ফুয়েলের ওপর নির্ভর করতে হবে।
পেট্রোলের দাম এ পর্যন্ত যতটা বেড়েছে, তাতে এখনই ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক উন্নত দেশ বায়ো ফুয়েল উৎপাদন সীমিত পরিমাণে হলেও শুরু করছে এবং সেই সঙ্গে সস্তায় বায়ো ফুয়েল উৎপাদনের জন্য তারা জোরেশোরে গবেষণা শুরু করে দিয়েছে।
পেট্রোলের দাম যখন আরও বাড়বে তখন গাড়ি চালাতে হলে হয় আমাদের বায়ো ফুয়েল, না হয় বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। তখন সারাবিশ্বের বেশিরভাগ মোটর যান বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল হতে হলে ব্যাটারির দাম খুবই বেড়ে যাবে এবং মোটর গাড়ি নিয়ে চলাফেরা করতে হলে স্বল্প দূরত্বের মধ্যেই চলাফেরা করতে হবে।
দীর্ঘপথে চলাফেরা করতে হলে হয় বায়ো ফুয়েল, আর তা না হলে বৈদ্যুতিক ট্রাম, বৈদ্যুতিক ট্রেন অথবা বৈদ্যুতিক মনো রেলের মাধ্যমে চলাফেরা করতে হবে। তেল, গ্যাস, কয়লা ফুরিয়ে গেলেও আমাদের বিদ্যুৎ পেতে কোনো অসুবিধা হবে না। কারণ ভবিষ্যতের বেশিরভাগ বিদ্যুৎই উৎপাদিত হবে নিউক্লিয়ার এবং সৌরশক্তি থেকে। সৌরশক্তি যেমন কোনোদিন নিঃশেষ হবে না, নিউক্লিয়ার শক্তির কাঁচামালও বহু বহু সহস্র বছরেও নিঃশেষ হবে না।
বায়ো ফুয়েল তৈরি করতে হলে যেহেতু চাল, গম অথবা অন্য কোনো না কোনো একটা কৃষিপণ্যকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করতে হবে, সে জন্য যেসব দেশে জনসংখ্যার তুলনায় প্রচুর পরিমাণ কৃষিজমি আছে, তারাই শুধু তাদের মোটর গাড়ি চালানোর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ বায়ো ফুয়েল উৎপাদন করতে পারবে। তাই তাদের জন্য কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে যেখানে জনসংখ্যার তুলনায় যথেষ্ট পরিমাণ কৃষিজমি নেই এবং জনসংখ্যা কমানো তো যাচ্ছেই না, এমনকি জনসংখ্যা বৃদ্ধিও থামানো যাচ্ছে না, সেসব দেশের সরকারকে ভাবতে হবে, আমাদের দেশে যতটুকু জমি আছে, তা দিয়ে আমরা এ দেশের না খেতে পাওয়া দরিদ্র জনগণের জন্য ভাত-কাপড় জোগাব, নাকি উচ্চ মধ্যবিত্তের বিলাসী চলাচলের জন্য বায়ো ফুয়েল তৈরি করব।
এ দেশের কোনো সরকার যদি মনে করে_ দেশের দরিদ্র জনগণ চুলোয় যাক, আমাদের দেশের উচ্চবিত্ত এবং উচ্চ-মধ্যবিত্তরাই হলো এ দেশের আসল ইনসান। তাই তারা যেন বিলাস-ব্যসনে জীবনযাপন করতে পারে, সেটা দেখাই আমাদের পবিত্র কর্তর্র্ব্য। কাজেই ডাল-ভাতের উৎপাদন কমিয়ে হলেও আমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণে বায়ো ফুয়েল উৎপাদন করতে হবে। তাহলে সেই সরকারকে এ দেশের জনগণ এরপর আর কখনও ভোট তো দেবেই না, আর সেই সরকার যদি অস্ত্রের জোরে টিকে থাকার চেষ্টা করে, তাহলে এ দেশের জনগণ আরেকটা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তাদের উৎখাত করতে বুকের রক্ত ঢালতে একটুও কার্পণ্য করবে না।
এতক্ষণের আলোচনা থেকে এটা নিশ্চয়ই স্পষ্ট হয়েছে যে, খুব শিগগির আমাদের দেশের বেশিরভাগ যানবাহন চলবে বৈদ্যুতিক শক্তি ব্যবহার করে। অল্প দূরত্বের যানবাহন ব্যাটারিজাত বিদ্যুতে চললেও দূরপাল্লার যানবাহন এবং ভারী মালামাল বহনকারী যানবাহন এমনকি গণপরিবহনগুলোও চলবে সরাসরি বৈদ্যুতিক লাইন থেকে বিদ্যুৎ নিয়ে, ট্রান্সলাইন, রেললাইন অথবা মনো রেলের ওপর দিয়ে।
তার মানে পদ্মা সেতুটি আমাদের এমন একটি জায়গায় স্থাপন করতে হবে, যাতে তার ওপর দিয়ে রেললাইন নিয়ে যাওয়া যায়। অথচ বাংলাদেশ সরকার প্রথম যে পদ্মা সেতুটি স্থাপন করতে মনস্থ করেছে, সেই মাওয়া সাইটের দক্ষিণাঞ্চল এবং দক্ষিণ দিকের অবতরণ ভূমি খুবই ভাঙনপ্রবণ।
জাইকা যে তিনটি সাইটের ওপর স্টাডি রিপোর্ট পেশ করেছে, তার মধ্যে এটির দক্ষিণাঞ্চল ও অবতরণ ভূমিই বেশি ভাঙনপ্রবণ। জাইকা এই অবতরণ ভূমিগুলোর ভাঙন রোধ করার জন্য যে খরচের কথা বলেছে, তা হলো দ্রব্যমূল্যের
বর্তমান অবস্থান থেকে হিসাব করে পাওয়া খরচের পরিমাণ। তেল, গ্যাস ও কয়লার দাম খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাবে বলে লোহা, সিমেন্ট ও ইট-পাথরসহ সব নির্মাণ-সামগ্রীর দাম দ্রুত এত গুণ বেড়ে যাবে যে, সে কথা এখন কল্পনা করতেও ভয় করে।
আর এসব সেতুর অবতরণ ভূমির ভাঙন প্রবণতা রোধ করার কাজটি এমন নয় যে, সেতু তৈরি করার সময় একবার যা খরচ করলাম, তাই দিয়ে যুগের পর যুগ পার করে দেওয়া যাবে!
আসলে সেতুটি যতদিন টিকে থাকবে, ততদিন ধরেই কিছুদিন পরপর চঞ্চলমতি সর্বনাশা পদ্মার মন জুগিয়ে তার গতিধারাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নানা রকম খরচাপাতি করতে হবে।
তারপর খুব শিগগির যখন গ্যাস ও পেট্রোলচালিত যানবাহনের সংখ্যা ভীষণভাবে কমে যাবে আর এই সেতুতে রেললাইন দেওয়া সম্ভব নয় বলে এই সেতুর ব্যবহার কমে যাবে, তখন এই সেতুর টোল থেকে যা আয় হবে তার তুলনায় হয়তো এই সেতুটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য রক্ষণাবেক্ষণ ও নদীশাসনের জন্যই বেশি টাকা ব্যয় হয়ে যাবে।
এখন অবশ্য আমাকে কেউ একজন প্রশ্ন করতে পারেন, এই সেতুর ওপর দিয়ে যে রেললাইন নেওয়া যাবে না, সে কথা আপনাকে কে বলল? এ কথার উত্তরে আমি বলব_ মানিকদা, বালিয়াহাটি, চন্দ্রা ও আজিমনগরের পূর্বাঞ্চল মানে মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলার পুরোটা অঞ্চল এতই ভাঙনপ্রবণ যে, ভাঙ্গা নামক রেলস্টেশনটির পূর্ব পাশে আজ পর্যন্ত কোনো রেললাইন পাতার কথাই কেউ ভাবতে পারেনি।
অতএব বোঝা যাচ্ছে, এখানে সেতু নির্মাণ করলে খুব অল্পদিনের মধ্যেই এটা জাদু-সামগ্রী হিসেবে প্রদর্শনযোগ্য একটা অব্যবহার্য প্রত্ন সম্পদে পরিণত হবে। ফলে বাঙালি জাতি বিপুল অর্থ ব্যয়ে এখানে একটা সেতু নির্মাণ করে কী বোকামিটাই না করেছে, তা দেখানোর জন্য এখানে একটি পর্যটন কেন্দ্র তৈরি করা যাবে।
ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পর্যটকরা আমাদের এ যুগের প্রজন্মের মানুষের বোকামির কথা ভেবে আমাদের উদ্দেশে থুথু নিক্ষেপ করবে।
এখন তাহলে প্রশ্ন উঠবে, এখানে সেতু স্থাপন করা যদি আমাদের ভুল সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে তাহলে আমাদের করণীয় কী?
এ প্রশ্নের জবাবে আমি বলব, জাইকা যে তিনটি স্থানে সেতু স্থাপন করার সম্ভাবনা নিয়ে স্টাডি করেছে, সেই স্থান তিনটির মধ্যে পূর্ব দিক এবং পশ্চিম দিকের সাইট দুটি বাদ দিয়ে, তাদের মাঝখানের সাইটটিতে সেতু নির্মাণ করাই সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত হবে। তা করতে পারলে যে লাভ হবে তা হলো :এতে ফরিদপুর থেকে চরভদ্রাসন, দোহার, নবাবগঞ্জ রোহিতপুর বা কলাতিয়া ও আটি হয়ে ঢাকা শহরের উত্তরে গাজীপুর জেলার টঙ্গীতে গিয়ে রেললাইন সংযোগ দেওয়া যাবে। দুটি সেতুর বদলে একটি সেতু করলেই চলবে বলে নির্মাণ খরচ অর্ধেকে (আসলে তিন ভাগের এক ভাগে) নেমে আসবে। কারণ দুটি সেতু নির্মাণ করতে গেলে প্রথম সেতুটি নির্মাণ শেষ করে দ্বিতীয় সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু করতে করতে দ্রব্যমূল্য এতই বেড়ে যাবে যে, সেটি তৈরি করতে হয়তো প্রথম সেতুটি তৈরি করার খরচের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি অর্থের প্রয়োজন হবে। দু'পাশের নির্মাণস্থল দুটির তুলনায় মাঝখানের নির্মাণস্থলের দক্ষিণ প্রান্তটি কম ভাঙনপ্রবণ বলে এখানে নদীশাসনের জন্য ব্যয় অনেক কম হবে।
মাঝখানের নির্মাণস্থলে সেতুটি নির্মাণ করলে আমরা এর জীবনকালের শেষ দিন পর্যন্ত একটা সেতুই পাব। অথচ এটি নির্মাণ না করে আমরা এর দু'পাশে দুটি সেতু নির্মাণ করলে কিছুদিন পরেই এ দুটির মধ্যে একটির কার্যকারিতা হারিয়ে যাওয়ার ফলে আমাদের হাতে থাকবে একটি মাত্র সেতু।
ফ. র. আল-সিদ্দিক : ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির সাবেক পরিচালক
পেট্রোলের দাম এ পর্যন্ত যতটা বেড়েছে, তাতে এখনই ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক উন্নত দেশ বায়ো ফুয়েল উৎপাদন সীমিত পরিমাণে হলেও শুরু করছে এবং সেই সঙ্গে সস্তায় বায়ো ফুয়েল উৎপাদনের জন্য তারা জোরেশোরে গবেষণা শুরু করে দিয়েছে।
পেট্রোলের দাম যখন আরও বাড়বে তখন গাড়ি চালাতে হলে হয় আমাদের বায়ো ফুয়েল, না হয় বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। তখন সারাবিশ্বের বেশিরভাগ মোটর যান বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল হতে হলে ব্যাটারির দাম খুবই বেড়ে যাবে এবং মোটর গাড়ি নিয়ে চলাফেরা করতে হলে স্বল্প দূরত্বের মধ্যেই চলাফেরা করতে হবে।
দীর্ঘপথে চলাফেরা করতে হলে হয় বায়ো ফুয়েল, আর তা না হলে বৈদ্যুতিক ট্রাম, বৈদ্যুতিক ট্রেন অথবা বৈদ্যুতিক মনো রেলের মাধ্যমে চলাফেরা করতে হবে। তেল, গ্যাস, কয়লা ফুরিয়ে গেলেও আমাদের বিদ্যুৎ পেতে কোনো অসুবিধা হবে না। কারণ ভবিষ্যতের বেশিরভাগ বিদ্যুৎই উৎপাদিত হবে নিউক্লিয়ার এবং সৌরশক্তি থেকে। সৌরশক্তি যেমন কোনোদিন নিঃশেষ হবে না, নিউক্লিয়ার শক্তির কাঁচামালও বহু বহু সহস্র বছরেও নিঃশেষ হবে না।
বায়ো ফুয়েল তৈরি করতে হলে যেহেতু চাল, গম অথবা অন্য কোনো না কোনো একটা কৃষিপণ্যকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করতে হবে, সে জন্য যেসব দেশে জনসংখ্যার তুলনায় প্রচুর পরিমাণ কৃষিজমি আছে, তারাই শুধু তাদের মোটর গাড়ি চালানোর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ বায়ো ফুয়েল উৎপাদন করতে পারবে। তাই তাদের জন্য কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে যেখানে জনসংখ্যার তুলনায় যথেষ্ট পরিমাণ কৃষিজমি নেই এবং জনসংখ্যা কমানো তো যাচ্ছেই না, এমনকি জনসংখ্যা বৃদ্ধিও থামানো যাচ্ছে না, সেসব দেশের সরকারকে ভাবতে হবে, আমাদের দেশে যতটুকু জমি আছে, তা দিয়ে আমরা এ দেশের না খেতে পাওয়া দরিদ্র জনগণের জন্য ভাত-কাপড় জোগাব, নাকি উচ্চ মধ্যবিত্তের বিলাসী চলাচলের জন্য বায়ো ফুয়েল তৈরি করব।
এ দেশের কোনো সরকার যদি মনে করে_ দেশের দরিদ্র জনগণ চুলোয় যাক, আমাদের দেশের উচ্চবিত্ত এবং উচ্চ-মধ্যবিত্তরাই হলো এ দেশের আসল ইনসান। তাই তারা যেন বিলাস-ব্যসনে জীবনযাপন করতে পারে, সেটা দেখাই আমাদের পবিত্র কর্তর্র্ব্য। কাজেই ডাল-ভাতের উৎপাদন কমিয়ে হলেও আমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণে বায়ো ফুয়েল উৎপাদন করতে হবে। তাহলে সেই সরকারকে এ দেশের জনগণ এরপর আর কখনও ভোট তো দেবেই না, আর সেই সরকার যদি অস্ত্রের জোরে টিকে থাকার চেষ্টা করে, তাহলে এ দেশের জনগণ আরেকটা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তাদের উৎখাত করতে বুকের রক্ত ঢালতে একটুও কার্পণ্য করবে না।
এতক্ষণের আলোচনা থেকে এটা নিশ্চয়ই স্পষ্ট হয়েছে যে, খুব শিগগির আমাদের দেশের বেশিরভাগ যানবাহন চলবে বৈদ্যুতিক শক্তি ব্যবহার করে। অল্প দূরত্বের যানবাহন ব্যাটারিজাত বিদ্যুতে চললেও দূরপাল্লার যানবাহন এবং ভারী মালামাল বহনকারী যানবাহন এমনকি গণপরিবহনগুলোও চলবে সরাসরি বৈদ্যুতিক লাইন থেকে বিদ্যুৎ নিয়ে, ট্রান্সলাইন, রেললাইন অথবা মনো রেলের ওপর দিয়ে।
তার মানে পদ্মা সেতুটি আমাদের এমন একটি জায়গায় স্থাপন করতে হবে, যাতে তার ওপর দিয়ে রেললাইন নিয়ে যাওয়া যায়। অথচ বাংলাদেশ সরকার প্রথম যে পদ্মা সেতুটি স্থাপন করতে মনস্থ করেছে, সেই মাওয়া সাইটের দক্ষিণাঞ্চল এবং দক্ষিণ দিকের অবতরণ ভূমি খুবই ভাঙনপ্রবণ।
জাইকা যে তিনটি সাইটের ওপর স্টাডি রিপোর্ট পেশ করেছে, তার মধ্যে এটির দক্ষিণাঞ্চল ও অবতরণ ভূমিই বেশি ভাঙনপ্রবণ। জাইকা এই অবতরণ ভূমিগুলোর ভাঙন রোধ করার জন্য যে খরচের কথা বলেছে, তা হলো দ্রব্যমূল্যের
বর্তমান অবস্থান থেকে হিসাব করে পাওয়া খরচের পরিমাণ। তেল, গ্যাস ও কয়লার দাম খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাবে বলে লোহা, সিমেন্ট ও ইট-পাথরসহ সব নির্মাণ-সামগ্রীর দাম দ্রুত এত গুণ বেড়ে যাবে যে, সে কথা এখন কল্পনা করতেও ভয় করে।
আর এসব সেতুর অবতরণ ভূমির ভাঙন প্রবণতা রোধ করার কাজটি এমন নয় যে, সেতু তৈরি করার সময় একবার যা খরচ করলাম, তাই দিয়ে যুগের পর যুগ পার করে দেওয়া যাবে!
আসলে সেতুটি যতদিন টিকে থাকবে, ততদিন ধরেই কিছুদিন পরপর চঞ্চলমতি সর্বনাশা পদ্মার মন জুগিয়ে তার গতিধারাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নানা রকম খরচাপাতি করতে হবে।
তারপর খুব শিগগির যখন গ্যাস ও পেট্রোলচালিত যানবাহনের সংখ্যা ভীষণভাবে কমে যাবে আর এই সেতুতে রেললাইন দেওয়া সম্ভব নয় বলে এই সেতুর ব্যবহার কমে যাবে, তখন এই সেতুর টোল থেকে যা আয় হবে তার তুলনায় হয়তো এই সেতুটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য রক্ষণাবেক্ষণ ও নদীশাসনের জন্যই বেশি টাকা ব্যয় হয়ে যাবে।
এখন অবশ্য আমাকে কেউ একজন প্রশ্ন করতে পারেন, এই সেতুর ওপর দিয়ে যে রেললাইন নেওয়া যাবে না, সে কথা আপনাকে কে বলল? এ কথার উত্তরে আমি বলব_ মানিকদা, বালিয়াহাটি, চন্দ্রা ও আজিমনগরের পূর্বাঞ্চল মানে মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলার পুরোটা অঞ্চল এতই ভাঙনপ্রবণ যে, ভাঙ্গা নামক রেলস্টেশনটির পূর্ব পাশে আজ পর্যন্ত কোনো রেললাইন পাতার কথাই কেউ ভাবতে পারেনি।
অতএব বোঝা যাচ্ছে, এখানে সেতু নির্মাণ করলে খুব অল্পদিনের মধ্যেই এটা জাদু-সামগ্রী হিসেবে প্রদর্শনযোগ্য একটা অব্যবহার্য প্রত্ন সম্পদে পরিণত হবে। ফলে বাঙালি জাতি বিপুল অর্থ ব্যয়ে এখানে একটা সেতু নির্মাণ করে কী বোকামিটাই না করেছে, তা দেখানোর জন্য এখানে একটি পর্যটন কেন্দ্র তৈরি করা যাবে।
ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পর্যটকরা আমাদের এ যুগের প্রজন্মের মানুষের বোকামির কথা ভেবে আমাদের উদ্দেশে থুথু নিক্ষেপ করবে।
এখন তাহলে প্রশ্ন উঠবে, এখানে সেতু স্থাপন করা যদি আমাদের ভুল সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে তাহলে আমাদের করণীয় কী?
এ প্রশ্নের জবাবে আমি বলব, জাইকা যে তিনটি স্থানে সেতু স্থাপন করার সম্ভাবনা নিয়ে স্টাডি করেছে, সেই স্থান তিনটির মধ্যে পূর্ব দিক এবং পশ্চিম দিকের সাইট দুটি বাদ দিয়ে, তাদের মাঝখানের সাইটটিতে সেতু নির্মাণ করাই সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত হবে। তা করতে পারলে যে লাভ হবে তা হলো :এতে ফরিদপুর থেকে চরভদ্রাসন, দোহার, নবাবগঞ্জ রোহিতপুর বা কলাতিয়া ও আটি হয়ে ঢাকা শহরের উত্তরে গাজীপুর জেলার টঙ্গীতে গিয়ে রেললাইন সংযোগ দেওয়া যাবে। দুটি সেতুর বদলে একটি সেতু করলেই চলবে বলে নির্মাণ খরচ অর্ধেকে (আসলে তিন ভাগের এক ভাগে) নেমে আসবে। কারণ দুটি সেতু নির্মাণ করতে গেলে প্রথম সেতুটি নির্মাণ শেষ করে দ্বিতীয় সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু করতে করতে দ্রব্যমূল্য এতই বেড়ে যাবে যে, সেটি তৈরি করতে হয়তো প্রথম সেতুটি তৈরি করার খরচের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি অর্থের প্রয়োজন হবে। দু'পাশের নির্মাণস্থল দুটির তুলনায় মাঝখানের নির্মাণস্থলের দক্ষিণ প্রান্তটি কম ভাঙনপ্রবণ বলে এখানে নদীশাসনের জন্য ব্যয় অনেক কম হবে।
মাঝখানের নির্মাণস্থলে সেতুটি নির্মাণ করলে আমরা এর জীবনকালের শেষ দিন পর্যন্ত একটা সেতুই পাব। অথচ এটি নির্মাণ না করে আমরা এর দু'পাশে দুটি সেতু নির্মাণ করলে কিছুদিন পরেই এ দুটির মধ্যে একটির কার্যকারিতা হারিয়ে যাওয়ার ফলে আমাদের হাতে থাকবে একটি মাত্র সেতু।
ফ. র. আল-সিদ্দিক : ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির সাবেক পরিচালক
No comments