শিক্ষাঙ্গন-বুয়েট নিয়ে উদ্বেগ by মোহীত উল আলম
বুয়েটের উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্য নিয়ে প্রথমে দাবি ছিল পদত্যাগের, কিন্তু এরপর সেটা অপসারণে পরিণত হয়। দুটি শব্দের মধ্যে মর্যাদাগত ও সম্ভবত আর্থিক পার্থক্য আছে। যেমন মাস কয়েক আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদত্যাগ করেছিলেন, তাকে হয়তো পরিস্থিতির কারণে সরকার অপসারণ করতে বাধ্য হতো, কিন্তু তিনি
পদত্যাগ করেছিলেন। সম্ভবত পদত্যাগের মধ্যে যেটুকু মর্যাদা অবশিষ্ট থাকে, অপসারণের মধ্যে সেটি থাকে না
বুয়েট বাংলাদেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রাচীনতম এবং মানে সেরা। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করার পর দেশের সেরা ছাত্রছাত্রীদের একটি অংশ এখানে ভর্তির জন্য কঠিন প্রতিযোগিতায় নামে। অনুরূপভাবে বুয়েটের শিক্ষকদেরও নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রবল অধিকার। উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্যকে অপসারণের দাবিতে বুয়েটের আন্দোলন প্রায় তিন মাস হতে চলল। বুয়েট শিক্ষক সমিতি আন্দোলনে নেমেছিল। পরে উচ্চ আদালতের আদেশক্রমে তারা আন্দোলন স্থগিত রাখেন, কিন্তু ব্যক্তিগত পর্যায়ে ক্লাস না নেওয়াসহ আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচি বুয়েটের বেশিরভাগ শিক্ষক পালন করেন যাচ্ছেন। শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীরাও আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। বলা হচ্ছে, আজ সোমবার (৩ সেপ্টেম্বর) তারা দু'জন পদত্যাগ না করলে, তারা কঠোরতর আন্দোলনে যাবে। আন্দোলন শুরুর প্রথম দিকে বিভিন্ন অনুষদের ডিনসহ মোট চবি্বশজন অধ্যাপক পদত্যাগপত্র দাখিল করেছিলেন। এমন যখন অবস্থা, তখন ৩ সেপ্টেম্বর ডেইলি স্টারের একটি ছবি দেখাচ্ছে, সরকার সমর্থিত ছাত্রলীগের একজন কর্মী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষের একজন শিক্ষককে শাসাচ্ছে। বুয়েটের সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ প্রথম থেকে দাবি করে আসছিল যে, এ আন্দোলনে উসকানি দিচ্ছে জামায়াত-শিবির মহলের একটি অংশ। তারা এ বলে প্রচারপত্রও বিলি করেছে যে, যেসব শিক্ষার্থী এ আন্দোলনে অংশ নেবে তাদের বিরুদ্ধে চরমতম ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আন্দোলনরত শিক্ষকদের অভিযোগ, বর্তমান উপাচার্য এবং তার পেছনে কলকাঠি নাড়ার মূল ব্যক্তি উপ-উপাচার্য মিলে ব্যাপক দলীয়করণের ভিত্তিতে প্রশাসন চালাচ্ছেন। এমনও অভিযোগ তারা করেছেন যে, উপাচার্য যখন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন তখন সেখানেও অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল এবং তাকে সেই প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে আসতে হয়। কিন্তু তিনি সরকারি দলের একজন আস্থাভাজন অনুগামী হওয়ায় এবং একটি বিশেষ জেলায় তার বাড়ি হওয়ায় তিনি নানা অযোগ্যতা সত্ত্বেও উপাচার্য হিসেবে অধিষ্ঠিত আছেন। বিরোধী দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেছেন, উপাচার্য একজন বিশেষ লোকের আত্মীয় হওয়ায় অপসারিত হচ্ছেন না।
উপাচার্য গত ১১ জুলাই হঠাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটি দুই সপ্তাহ এগিয়ে নিয়ে এলে আন্দোলনরত শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা সেটা মেনে নিতে পারেননি। সে যাই হোক, ঈদের ছুটির পর আন্দোলন আবার দানা বাঁধছে। পরিস্থিতি ঘোলাটে তো বটেই, যে কোনো সময় মারাত্মক কিছু ঘটে যেতে পারে। অথচ বুয়েটের এমন পরিস্থিতি কারও কাম্য নয়।
বুয়েটের অস্থিরতা শুরুর প্রাক্কালে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল, যার সিদ্ধান্তগুলো উপাচার্যের পক্ষে আসে। শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ওই তদন্ত কমিটির সদস্যরা ছিলেন উপাচার্যের মনোনীত ব্যক্তি, ফলে আরাধ্য ফল আসেনি।
বুয়েটের উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্য নিয়ে প্রথমে দাবি ছিল পদত্যাগের, কিন্তু এরপর সেটা অপসারণে পরিণত হয়। দুটি শব্দের মধ্যে মর্যাদাগত ও সম্ভবত আর্থিক পার্থক্য আছে। যেমন মাস কয়েক আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদত্যাগ করেছিলেন, কিন্তু তাকে হয়তো পরিস্থিতির কারণে সরকার অপসারণ করতে বাধ্য হতো, কিন্তু তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। সম্ভবত পদত্যাগের মধ্যে যেটুকু মর্যাদা অবশিষ্ট থাকে, অপসারণের মধ্যে সেটি থাকে না। কিন্তু পত্রিকান্তরে জানা যায়, বুয়েটের উপাচার্য বলেছেন, একজন লোকের যদি কোনো দোষ না থাকে তাহলে তাকে অপসারণ করা উচিত হবে কি-না।
উপাচার্যের (ও উপ-উপাচার্যের) পদত্যাগ দাবি বা অপসারণ দাবি কখনও চূড়ান্তভাবে যৌক্তিকও নয়, অযৌক্তিকও নয়। কিন্তু এর ফলে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, হানাহানিসহ রক্তপাত হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় অবরুদ্ধ বা ছুটি হয়ে গেলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনসহ শিক্ষকদের জ্ঞানচর্চার যে অসুবিধা হয়, সেই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি না হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। কারণ বুয়েটের অবস্থা দূর থেকে দেখেও আমার মনে হচ্ছে, এ সিনারিও বা দৃশ্যপটের সঙ্গে যেন আমি পরিচিত। সেই পরিস্থিতি হয়েছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, ১৯৮৫ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রবীণ জ্ঞানতাপস ইতিহাসবিদ অধ্যাপক আবদুল করিম তার দ্বিতীয় দফার মেয়াদে দুর্নীতির দায়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলে, তৎকালীন এরশাদ সরকার প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবদুল আজিজ খানকে উপাচার্য নিযুক্ত করে। এ জ্ঞানতাপস অধ্যাপক নিরেট সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন, কিন্তু প্রশাসন শক্ত হাতে পরিচালনা করতে পারতেন। ফলে নানা ক্ষেত্রে চবির ভূয়সী উন্নতি হতে থাকে। তার মেয়াদ ফুরোলে ১৯৮৫ সালে চবিতে সর্বপ্রথম '৭৩-এর অ্যাক্ট অনুযায়ী উপাচার্য প্যানেল নির্বাচিত হয় এবং নির্বাচিত তিনজন অধ্যাপকের তালিকা থেকে সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া ইংরেজি বিভাগের খ্যাতিমান শিক্ষক অধ্যাপক মোহাম্মদ আলীকে উপাচার্য নিযুক্ত করা হয়। তার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সভার একটি জমজমাট বৈঠকে বর্তমানে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত কিন্তু যিনি ছিলেন তৎকালীন সংসদ সদস্য ও সরকার কর্তৃক মনোনীত একজন সিনেট প্রতিনিধি, তিনি যোগ দিলে সভাকক্ষের আবহাওয়া অত্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী উপস্থিত নির্বাচিত সিনেট শিক্ষক প্রতিনিধিদের মধ্যে এ নিয়ে তুমুল প্রতিক্রিয়া হয়। তারা উপাচার্যের পদত্যাগে আন্দোলনে নামেন। এর মধ্যে আরও একটি ঘটনা অধ্যাপক আলীর অবস্থাকে নাজুক করে তোলে। এরশাদপন্থি ছাত্র সংগঠন নতুন বাংলা ছাত্রসমাজের চবির সন্ত্রাসীমনস্ক নেতা হামিদকে ১৯৮৬ সালের ২৬ অক্টোবর প্রকাশ্য দিবালোকে সোহরাওয়ার্দী হলের সামনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মীরা আক্রমণ করে তার দু'হাতের কব্জি শুধু কেটে নেয়নি, তখন থেকে পুরো ক্যাম্পাসে শিবিরের পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপন করে ফেলে। সে কর্তৃত্ব নানাভাবে চবিতে এখনও বজায় আছে। চবিতে উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্য এসেছেন আর গেছেন, কিন্তু শিবিরের নেতাকর্মীদের আধিপত্য এতটুকুও ক্ষুণ্ন হয়নি। প্রশ্নযোগ্য কিন্তু নিরঙ্কুশ আধিপত্য। যা হোক, হামিদের পতনের পর চবি অস্থির হয়ে ওঠে। প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত শিক্ষক সমাজের আন্দোলনও তীব্রতা ধারণ করে। অধ্যাপক আলীর মতো সংবেদনশীল, রুচিবান ও আভিজাত্যমনস্ক শিক্ষকের পক্ষে সম্ভব ছিল না এ ধরনের সাংঘর্ষিক রাজনীতি সামাল দেওয়া। ফলে তার সময়ে যেমন প্রতিক্রিয়াশীল স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ক্রমশ আধিপত্যে ও সমর্থনে বলীয়ান হয়ে উঠতে থাকে চবি ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে, তেমনি চট্টগ্রাম শহরকেন্দ্রিক মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুসারী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা প্রবল প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে থাকে। ফলে শিক্ষার্থীদের ক্লাসের পর ক্লাস মিস যেতে থাকে। এ পর্যায়ে অধ্যাপক আলীর চান্দগাঁওয়ের সিডিএ আবাসিক এলাকায় তার বাসগৃহে একদিন রাতে সন্ত্রাসী আক্রমণ হলে তিনি পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন তার মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই।
এদিকে এরশাদ সরকারেরও পতন ঘনিয়ে আসে, কিন্তু তার আগেই চবির দ্বিতীয়বার উপাচার্য প্যানেলের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং সিনেটে সর্বকালের সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে উপাচার্য হিসেবে নিযুক্তি পান সুপরিচিত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. আলমগীর মুহাম্মদ সিরাজুদ্দিন। কিন্তু তাকে সমর্থন দেওয়ার বেলায় চবির প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। অধ্যাপক সিরাজুদ্দিন প্রার্থিতা পেয়েছিলেন সাদা দল বা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী শিক্ষকদের পক্ষ থেকে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী শিক্ষকদের একটি ব্যাপক অংশের সঙ্গে অধ্যাপক সিরাজুদ্দিনের এ বোঝাপড়া হয় যে তিনি উপাচার্য নিযুক্ত হলে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ যেটি চবি থেকে হারিয়ে যেতে বসেছিল সেটি তিনি পুনরুদ্ধার করবেন। তিনি সেই মোতাবেক বিশ্ববিদ্যালয়ের মোড় ঘোরানোর চেষ্টাও করছিলেন, কিন্তু নব্বইয়ের ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি এরশাদের পতন হলে ও ২২ ডিসেম্বর চবির কলাভবনের সামনে ছাত্রমৈত্রীর ছাত্রনেতা ফারুখ শিবিরের কর্মীদের হাতে নির্মমভাবে প্রহৃত হয়ে মারা গেলে পরিস্থিতি আরও বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে ওঠে। এদিকে ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় গেলে অধ্যাপক সিরাজুদ্দিনের পক্ষে তার পূর্বপ্রতিশ্রুত পথ অনুসরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। চবির জাতীয়তাবাদী শিক্ষক সমাজ ও ইসলামী ছাত্রশিবির এবং স্বাধীনতাবিরাধী একটি মহলের চক্রান্তে চবি ক্যাম্পাস সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত শিক্ষকদের যে মহল অধ্যাপক সিরাজুদ্দিনকে প্রথম থেকেই সমর্থন করেনি তাদের ভূমিকাও প্রকারান্তরে ক্যাম্পাস অবরুদ্ধ করে রাখার শক্তির পক্ষে চলে যায়। চবি ক্যাম্পাসে ঢুকতে না পারার কারণে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শিক্ষক সমাজ কয়েক সপ্তাহ শহরের ওমর গনি কলেজের সঙ্গে একটি ব্যবস্থার মাধ্যমে সেখানেই ক্লাস নিতে থাকেন। শিক্ষার্থীরাও আসতে থাকে। এদিকে শিবির তাদের চূড়ান্ত কর্মসূচি ঘোষণা করে এবং উপাচার্যের পদত্যাগ বা অপসারণ ছাড়া আন্দোলন থেকে সরে না আসার ঘোষণা দেয়। তারা উপাচার্য সিরাজুদ্দিনকে তার পাহাড়চূড়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি বাংলোয় আক্ষরিক অর্থে অবরুদ্ধ করে রাখে। গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের লাইন কেটে দেওয়া হয়। এ পর্যায়ে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী বদরুদ্দোজা চৌধুরী ক্যাম্পাসে এসে অবরুদ্ধ উপাচার্যকে পদত্যাগ করতে অনুরোধ করলে তিনি অবিচল থেকে বলেন, অন্যায় দাবির মুখে তিন পদত্যাগ করবেন না। তিনি মাথাও নোয়াননি, পদত্যাগও করেননি, কিন্তু সরকার ১৮৯৭ সালের ব্রিটিশ সরকারের গৃহীত কোনো একটি ধারায় তাকে অপসারণ করে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরোক্ত ইতিহাস থেকে বোঝা যায়, উপাচার্যের (বা উপ-উপাচার্যের) পদত্যাগ বা অপসারণের দাবি যতটা না তাদের দুর্নীতিপ্রবণতা বা অযোগ্যতাপ্রসূত, তার চেয়েও বেশি রাজনৈতিক। যেমন_ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিপ্রেক্ষিতে বলছি, অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী এবং অধ্যাপক আলমগীর মুহাম্মদ সিরাজুদ্দিন দু'জনেই ছিলেন নিজ নিজ বিষয়ে পণ্ডিত এবং দু'জনেই ছিলেন চারিত্রিকভাবে সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত এবং সর্বোপরি দু'জনেই ছিলেন নির্বাচিত; কিন্তু তারা তাদের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি রাজনৈতিক জেরবারের কারণে। বুয়েটের বর্তমান পরিস্থিতির পেছনে সেরকম একটি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট যে নেই, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই।
অধ্যাপক ড. মোহীত উল আলম :ডিন ও বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি, ইউল্যাব, ঢাকা
বুয়েট বাংলাদেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রাচীনতম এবং মানে সেরা। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করার পর দেশের সেরা ছাত্রছাত্রীদের একটি অংশ এখানে ভর্তির জন্য কঠিন প্রতিযোগিতায় নামে। অনুরূপভাবে বুয়েটের শিক্ষকদেরও নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রবল অধিকার। উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্যকে অপসারণের দাবিতে বুয়েটের আন্দোলন প্রায় তিন মাস হতে চলল। বুয়েট শিক্ষক সমিতি আন্দোলনে নেমেছিল। পরে উচ্চ আদালতের আদেশক্রমে তারা আন্দোলন স্থগিত রাখেন, কিন্তু ব্যক্তিগত পর্যায়ে ক্লাস না নেওয়াসহ আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচি বুয়েটের বেশিরভাগ শিক্ষক পালন করেন যাচ্ছেন। শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীরাও আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। বলা হচ্ছে, আজ সোমবার (৩ সেপ্টেম্বর) তারা দু'জন পদত্যাগ না করলে, তারা কঠোরতর আন্দোলনে যাবে। আন্দোলন শুরুর প্রথম দিকে বিভিন্ন অনুষদের ডিনসহ মোট চবি্বশজন অধ্যাপক পদত্যাগপত্র দাখিল করেছিলেন। এমন যখন অবস্থা, তখন ৩ সেপ্টেম্বর ডেইলি স্টারের একটি ছবি দেখাচ্ছে, সরকার সমর্থিত ছাত্রলীগের একজন কর্মী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষের একজন শিক্ষককে শাসাচ্ছে। বুয়েটের সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ প্রথম থেকে দাবি করে আসছিল যে, এ আন্দোলনে উসকানি দিচ্ছে জামায়াত-শিবির মহলের একটি অংশ। তারা এ বলে প্রচারপত্রও বিলি করেছে যে, যেসব শিক্ষার্থী এ আন্দোলনে অংশ নেবে তাদের বিরুদ্ধে চরমতম ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আন্দোলনরত শিক্ষকদের অভিযোগ, বর্তমান উপাচার্য এবং তার পেছনে কলকাঠি নাড়ার মূল ব্যক্তি উপ-উপাচার্য মিলে ব্যাপক দলীয়করণের ভিত্তিতে প্রশাসন চালাচ্ছেন। এমনও অভিযোগ তারা করেছেন যে, উপাচার্য যখন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন তখন সেখানেও অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল এবং তাকে সেই প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে আসতে হয়। কিন্তু তিনি সরকারি দলের একজন আস্থাভাজন অনুগামী হওয়ায় এবং একটি বিশেষ জেলায় তার বাড়ি হওয়ায় তিনি নানা অযোগ্যতা সত্ত্বেও উপাচার্য হিসেবে অধিষ্ঠিত আছেন। বিরোধী দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেছেন, উপাচার্য একজন বিশেষ লোকের আত্মীয় হওয়ায় অপসারিত হচ্ছেন না।
উপাচার্য গত ১১ জুলাই হঠাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটি দুই সপ্তাহ এগিয়ে নিয়ে এলে আন্দোলনরত শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা সেটা মেনে নিতে পারেননি। সে যাই হোক, ঈদের ছুটির পর আন্দোলন আবার দানা বাঁধছে। পরিস্থিতি ঘোলাটে তো বটেই, যে কোনো সময় মারাত্মক কিছু ঘটে যেতে পারে। অথচ বুয়েটের এমন পরিস্থিতি কারও কাম্য নয়।
বুয়েটের অস্থিরতা শুরুর প্রাক্কালে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল, যার সিদ্ধান্তগুলো উপাচার্যের পক্ষে আসে। শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ওই তদন্ত কমিটির সদস্যরা ছিলেন উপাচার্যের মনোনীত ব্যক্তি, ফলে আরাধ্য ফল আসেনি।
বুয়েটের উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্য নিয়ে প্রথমে দাবি ছিল পদত্যাগের, কিন্তু এরপর সেটা অপসারণে পরিণত হয়। দুটি শব্দের মধ্যে মর্যাদাগত ও সম্ভবত আর্থিক পার্থক্য আছে। যেমন মাস কয়েক আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদত্যাগ করেছিলেন, কিন্তু তাকে হয়তো পরিস্থিতির কারণে সরকার অপসারণ করতে বাধ্য হতো, কিন্তু তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। সম্ভবত পদত্যাগের মধ্যে যেটুকু মর্যাদা অবশিষ্ট থাকে, অপসারণের মধ্যে সেটি থাকে না। কিন্তু পত্রিকান্তরে জানা যায়, বুয়েটের উপাচার্য বলেছেন, একজন লোকের যদি কোনো দোষ না থাকে তাহলে তাকে অপসারণ করা উচিত হবে কি-না।
উপাচার্যের (ও উপ-উপাচার্যের) পদত্যাগ দাবি বা অপসারণ দাবি কখনও চূড়ান্তভাবে যৌক্তিকও নয়, অযৌক্তিকও নয়। কিন্তু এর ফলে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, হানাহানিসহ রক্তপাত হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় অবরুদ্ধ বা ছুটি হয়ে গেলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনসহ শিক্ষকদের জ্ঞানচর্চার যে অসুবিধা হয়, সেই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি না হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। কারণ বুয়েটের অবস্থা দূর থেকে দেখেও আমার মনে হচ্ছে, এ সিনারিও বা দৃশ্যপটের সঙ্গে যেন আমি পরিচিত। সেই পরিস্থিতি হয়েছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, ১৯৮৫ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রবীণ জ্ঞানতাপস ইতিহাসবিদ অধ্যাপক আবদুল করিম তার দ্বিতীয় দফার মেয়াদে দুর্নীতির দায়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলে, তৎকালীন এরশাদ সরকার প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবদুল আজিজ খানকে উপাচার্য নিযুক্ত করে। এ জ্ঞানতাপস অধ্যাপক নিরেট সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন, কিন্তু প্রশাসন শক্ত হাতে পরিচালনা করতে পারতেন। ফলে নানা ক্ষেত্রে চবির ভূয়সী উন্নতি হতে থাকে। তার মেয়াদ ফুরোলে ১৯৮৫ সালে চবিতে সর্বপ্রথম '৭৩-এর অ্যাক্ট অনুযায়ী উপাচার্য প্যানেল নির্বাচিত হয় এবং নির্বাচিত তিনজন অধ্যাপকের তালিকা থেকে সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া ইংরেজি বিভাগের খ্যাতিমান শিক্ষক অধ্যাপক মোহাম্মদ আলীকে উপাচার্য নিযুক্ত করা হয়। তার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সভার একটি জমজমাট বৈঠকে বর্তমানে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত কিন্তু যিনি ছিলেন তৎকালীন সংসদ সদস্য ও সরকার কর্তৃক মনোনীত একজন সিনেট প্রতিনিধি, তিনি যোগ দিলে সভাকক্ষের আবহাওয়া অত্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী উপস্থিত নির্বাচিত সিনেট শিক্ষক প্রতিনিধিদের মধ্যে এ নিয়ে তুমুল প্রতিক্রিয়া হয়। তারা উপাচার্যের পদত্যাগে আন্দোলনে নামেন। এর মধ্যে আরও একটি ঘটনা অধ্যাপক আলীর অবস্থাকে নাজুক করে তোলে। এরশাদপন্থি ছাত্র সংগঠন নতুন বাংলা ছাত্রসমাজের চবির সন্ত্রাসীমনস্ক নেতা হামিদকে ১৯৮৬ সালের ২৬ অক্টোবর প্রকাশ্য দিবালোকে সোহরাওয়ার্দী হলের সামনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মীরা আক্রমণ করে তার দু'হাতের কব্জি শুধু কেটে নেয়নি, তখন থেকে পুরো ক্যাম্পাসে শিবিরের পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপন করে ফেলে। সে কর্তৃত্ব নানাভাবে চবিতে এখনও বজায় আছে। চবিতে উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্য এসেছেন আর গেছেন, কিন্তু শিবিরের নেতাকর্মীদের আধিপত্য এতটুকুও ক্ষুণ্ন হয়নি। প্রশ্নযোগ্য কিন্তু নিরঙ্কুশ আধিপত্য। যা হোক, হামিদের পতনের পর চবি অস্থির হয়ে ওঠে। প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত শিক্ষক সমাজের আন্দোলনও তীব্রতা ধারণ করে। অধ্যাপক আলীর মতো সংবেদনশীল, রুচিবান ও আভিজাত্যমনস্ক শিক্ষকের পক্ষে সম্ভব ছিল না এ ধরনের সাংঘর্ষিক রাজনীতি সামাল দেওয়া। ফলে তার সময়ে যেমন প্রতিক্রিয়াশীল স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ক্রমশ আধিপত্যে ও সমর্থনে বলীয়ান হয়ে উঠতে থাকে চবি ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে, তেমনি চট্টগ্রাম শহরকেন্দ্রিক মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুসারী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা প্রবল প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে থাকে। ফলে শিক্ষার্থীদের ক্লাসের পর ক্লাস মিস যেতে থাকে। এ পর্যায়ে অধ্যাপক আলীর চান্দগাঁওয়ের সিডিএ আবাসিক এলাকায় তার বাসগৃহে একদিন রাতে সন্ত্রাসী আক্রমণ হলে তিনি পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন তার মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই।
এদিকে এরশাদ সরকারেরও পতন ঘনিয়ে আসে, কিন্তু তার আগেই চবির দ্বিতীয়বার উপাচার্য প্যানেলের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং সিনেটে সর্বকালের সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে উপাচার্য হিসেবে নিযুক্তি পান সুপরিচিত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. আলমগীর মুহাম্মদ সিরাজুদ্দিন। কিন্তু তাকে সমর্থন দেওয়ার বেলায় চবির প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। অধ্যাপক সিরাজুদ্দিন প্রার্থিতা পেয়েছিলেন সাদা দল বা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী শিক্ষকদের পক্ষ থেকে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী শিক্ষকদের একটি ব্যাপক অংশের সঙ্গে অধ্যাপক সিরাজুদ্দিনের এ বোঝাপড়া হয় যে তিনি উপাচার্য নিযুক্ত হলে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ যেটি চবি থেকে হারিয়ে যেতে বসেছিল সেটি তিনি পুনরুদ্ধার করবেন। তিনি সেই মোতাবেক বিশ্ববিদ্যালয়ের মোড় ঘোরানোর চেষ্টাও করছিলেন, কিন্তু নব্বইয়ের ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি এরশাদের পতন হলে ও ২২ ডিসেম্বর চবির কলাভবনের সামনে ছাত্রমৈত্রীর ছাত্রনেতা ফারুখ শিবিরের কর্মীদের হাতে নির্মমভাবে প্রহৃত হয়ে মারা গেলে পরিস্থিতি আরও বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে ওঠে। এদিকে ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় গেলে অধ্যাপক সিরাজুদ্দিনের পক্ষে তার পূর্বপ্রতিশ্রুত পথ অনুসরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। চবির জাতীয়তাবাদী শিক্ষক সমাজ ও ইসলামী ছাত্রশিবির এবং স্বাধীনতাবিরাধী একটি মহলের চক্রান্তে চবি ক্যাম্পাস সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত শিক্ষকদের যে মহল অধ্যাপক সিরাজুদ্দিনকে প্রথম থেকেই সমর্থন করেনি তাদের ভূমিকাও প্রকারান্তরে ক্যাম্পাস অবরুদ্ধ করে রাখার শক্তির পক্ষে চলে যায়। চবি ক্যাম্পাসে ঢুকতে না পারার কারণে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শিক্ষক সমাজ কয়েক সপ্তাহ শহরের ওমর গনি কলেজের সঙ্গে একটি ব্যবস্থার মাধ্যমে সেখানেই ক্লাস নিতে থাকেন। শিক্ষার্থীরাও আসতে থাকে। এদিকে শিবির তাদের চূড়ান্ত কর্মসূচি ঘোষণা করে এবং উপাচার্যের পদত্যাগ বা অপসারণ ছাড়া আন্দোলন থেকে সরে না আসার ঘোষণা দেয়। তারা উপাচার্য সিরাজুদ্দিনকে তার পাহাড়চূড়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি বাংলোয় আক্ষরিক অর্থে অবরুদ্ধ করে রাখে। গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের লাইন কেটে দেওয়া হয়। এ পর্যায়ে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী বদরুদ্দোজা চৌধুরী ক্যাম্পাসে এসে অবরুদ্ধ উপাচার্যকে পদত্যাগ করতে অনুরোধ করলে তিনি অবিচল থেকে বলেন, অন্যায় দাবির মুখে তিন পদত্যাগ করবেন না। তিনি মাথাও নোয়াননি, পদত্যাগও করেননি, কিন্তু সরকার ১৮৯৭ সালের ব্রিটিশ সরকারের গৃহীত কোনো একটি ধারায় তাকে অপসারণ করে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরোক্ত ইতিহাস থেকে বোঝা যায়, উপাচার্যের (বা উপ-উপাচার্যের) পদত্যাগ বা অপসারণের দাবি যতটা না তাদের দুর্নীতিপ্রবণতা বা অযোগ্যতাপ্রসূত, তার চেয়েও বেশি রাজনৈতিক। যেমন_ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিপ্রেক্ষিতে বলছি, অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী এবং অধ্যাপক আলমগীর মুহাম্মদ সিরাজুদ্দিন দু'জনেই ছিলেন নিজ নিজ বিষয়ে পণ্ডিত এবং দু'জনেই ছিলেন চারিত্রিকভাবে সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত এবং সর্বোপরি দু'জনেই ছিলেন নির্বাচিত; কিন্তু তারা তাদের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি রাজনৈতিক জেরবারের কারণে। বুয়েটের বর্তমান পরিস্থিতির পেছনে সেরকম একটি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট যে নেই, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই।
অধ্যাপক ড. মোহীত উল আলম :ডিন ও বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি, ইউল্যাব, ঢাকা
No comments