সমকালীন প্রসঙ্গ-তেহরান ন্যাম সম্মেলন ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা by বদরুদ্দীন উমর
তেহরানে অনুষ্ঠিত ১৬তম শীর্ষ সম্মেলনের মাধ্যমে দেখা গেল যে, ন্যাম কর্তৃক ১৯৯১ সালের আগের ভূমিকা পালন করার কোনো ভিত্তি এখন না থাকলেও এর কার্যকারিতা নিঃশেষিত হয়নি এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই সংগঠনটি সীমিতভাবে হলেও অনেক ধরনের সাম্রাজ্যবাদী নীতি, কার্যকলাপ ও নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতার ক্ষেত্রে কিছুটা ইতিবাচক
ভূমিকা পালন করতে পারে। নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য বিষয়ে নানা লেনদেনের সুবিধাও এর মাধ্যমে অর্জিত হতে পারে। সর্বোপরি জাতিসংঘে মার্কিনসহ সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য হতে পারে
গত সপ্তাহে ইরানের রাজধানী তেহরানে ন্যামের ১৬তম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই সম্মেলনে ন্যামের ১২০ সদস্য দেশের প্রত্যেকটির প্রতিনিধিই যোগদান করেন। এই প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন ২৯ জন রাষ্ট্রপ্রধান, ৭ জন প্রধানমন্ত্রী ও ২৫ জন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। জাতিসংঘ, আফ্রিকান ইউনিয়ন, আরব লীগসহ ১০টি সদস্য সংগঠনকে নিয়ে ১৭টি পর্যবেক্ষক দেশের প্রতিনিধি এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন যাতে এই সম্মেলনে উপস্থিত না হন তার জন্য মার্কিন সরকার তার ওপর চাপ সৃষ্টি সত্ত্বেও তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। বস্তুতপক্ষে সেখানে তাকে যেতেই হতো, কারণ সম্মেলনে তার অনুপস্থিতি খোলাখুলি প্রমাণ করত যে, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর এজেন্ট মাত্র।
১৯৭৯ সালে ইরানে রাষ্ট্র পরিবর্তনের পর এই প্রথম সেখানে এ ধরনের কোনো আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এ কারণে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ন্যাম সদস্য দেশগুলোকে এই সম্মেলন বর্জন করার যে আহ্বান জানিয়েছিল তা ন্যাম সদস্য দেশগুলোর দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। অর্থাৎ ইরানকে কূটনৈতিকভাবে একঘরে করার যে চেষ্টা সাম্রাজ্যবাদেরা করেছে তা ব্যর্থ হয়েছে। এর অর্থ এই নয় যে, তেহরান ন্যাম সম্মেলনে যোগদানকারী দেশগুলোর প্রত্যেকটি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এবং সাম্রাজ্যবাদের কোনো প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ তাদের কারও ওপর নেই। এর অর্থ সাম্রাজ্যবাদীরা বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে এসব দেশের ওপর যে প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ কায়েম রেখে এসেছিল তা এখন আগের থেকে অনেক শিথিল হয়েছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ এভাবে শিথিল না হলে ন্যাম সম্মেলন উপলক্ষে ইরানকে কূটনৈতিকভাবে একঘরে বা দুর্বল করার সাম্রাজ্যবাদী প্রচেষ্টা এভাবে ব্যর্থ হতো না।
কিন্তু ইরানকে একঘরে করার এই চেষ্টা ব্যর্থ হলেও জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন ইরান কর্তৃক কঠোর ভাষায় ইসরায়েলের সমালোচনায় বিরোধিতা করেন। তিনি এবং মিসরের প্রেসিডেন্ট মুরসি উভয়েই সমালোচনা করেন ইরান কর্তৃক সিরিয়ার আসাদ সরকারকে পূর্ণ সমর্থনের। কিন্তু এই বিরোধিতা ও সমালোচনা সত্ত্বেও তেহরানে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ইরান যে লাভবান হয়েছে এতে সন্দেহ নেই। ইরানের শীর্ষতম নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি সম্মেলনে তার উদ্বোধনী বক্তৃতায় কঠোর ভাষায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সমালোচনা করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার প্রধান মিত্র দেশগুলো জাতিসংঘকে যেভাবে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে তারও কঠোর সমালোচনা করেন খামেনি।
আন্তর্জাতিক সংগঠন হিসেবে অর্থাৎ একটি জোটনিরপেক্ষ সংগঠন হিসেবে ন্যামের গ্রাহ্যতা ও কার্যকর ভূমিকা ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক একমাত্র পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পর আর বিশেষ না থাকায় এর গুরুত্ব বলে বিশেষ কিছু থাকেনি। কিন্তু তেহরানে অনুষ্ঠিত ১৬তম শীর্ষ সম্মেলনের মাধ্যমে দেখা গেল যে, ন্যাম কর্তৃক ১৯৯১ সালের আগের ভূমিকা পালন করার কোনো ভিত্তি এখন না থাকলেও এর কার্যকারিতা নিঃশেষিত হয়নি এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই সংগঠনটি সীমিতভাবে হলেও অনেক ধরনের সাম্রাজ্যবাদী নীতি, কার্যকলাপ ও নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতার ক্ষেত্রে কিছুটা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে। নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য বিষয়ে নানা লেনদেনের সুবিধাও এর মাধ্যমে অর্জিত হতে পারে। সর্বোপরি জাতিসংঘে মার্কিনসহ সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য হতে পারে।
লক্ষ্য করার বিষয় যে, তেহরানে অনুষ্ঠিত এই ন্যাম সম্মেলনে সৌদি আরব, কাতার ইত্যাদি মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন এজেন্ট দেশগুলোর বিশেষ কোনো উদ্যোগী ভূমিকা ছিল না। শুধু তাই নয়, ইরানের পরমাণু কর্মসূচির কোনো বিরোধিতা তারা করেননি। কাজেই এই ন্যাম সম্মেলনে তেহরানের পক্ষে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচির প্রতি সকলের সমর্থন লাভ সম্ভব হয়েছে। এই মর্মে একটি সর্বসম্মত প্রস্তাবও পাস হয়েছে। এই প্রস্তাবটিও যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পরদেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও খবরদারির বিরোধিতা এতে সন্দেহ নেই।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার যে, সম্মেলনে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অনেক সমালোচনা হলেও ইসরায়েলের নিজের পারমাণবিক বোমা নিয়ে ইরানসহ কোনো দেশই কিছু বলেনি। এটা যে শুধু এই সম্মেলনেরই বিশেষত্ব এমন নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের পারমাণবিক বোমা বিষয়ে কোনো উল্লেখ পর্যন্ত করতে দেখা যায় না। কালেভদ্রে কোনো ছোট দেশ এর উল্লেখ করলেও তার কোনো গুরুত্ব বা তাৎপর্য থাকে না। সাধারণভাবে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক নীরবতা এক বিস্ময়কর ব্যাপার। অথচ ইসরায়েল যখন পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য ইরান আক্রমণ করার ঘোষণা পর্যন্ত দেয় তখন তাদের নিজেদের পারমাণবিক বোমার পাহাড়ের উল্লেখ ও সেখানে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সংস্থার পরিদর্শনের দাবি যে সহজেই তাদের অবস্থানকে ভয়ানকভাবে দুর্বল করতে পারে এটা বোঝা কোনো কঠিন ব্যাপার নয়।
ন্যামের ১৬তম শীর্ষ সম্মেলনে ইরান ন্যামের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত হওয়ায় তার আন্তর্জাতিক অবস্থান শক্তিশালী হবে। তিন বছরের জন্য ন্যামের নেতৃত্বে থাকা অবস্থায় ইরানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অথবা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রধান মিত্র ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ইসরায়েলের পক্ষে সামরিক আক্রমণ পরিচালনা কোনো সহজ ব্যাপার হবে না। সেটা অসম্ভবই হবে। এ নিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের নিজেদের মধ্যেই যে বড় মতভেদ আছে সেটা জার্মান চ্যান্সেলর কর্তৃক ইসরায়েলের এই অভিসন্ধির সরাসরি ও কড়া বিরোধিতা থেকেই বোঝা যায়।
এক হিসাবে বলা চলে ন্যাম কর্তৃক বর্তমানে তার আদি ভূমিকা বর্তমান পরিস্থিতিতে পালন করার মতো অবস্থা না থাকলেও পূর্ব ভূমিকা পরিবর্তন করে নতুন ভূমিকা পালনের সম্ভাবনা তার ক্ষেত্রে এখন দেখা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সুবিধা এই যে, নতুন কোনো সংগঠন খাড়া না করে ন্যামকেই বর্তমান পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যবাদী চাপ ও নিয়ন্ত্রণ ঠেকানোর কাজে ছোট ও দুর্বল দেশগুলো ব্যবহার করতে পারে।
এ ক্ষেত্রে সর্বশেষে যা বলা দরকার তা হলো, ন্যামের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল মার্কিন ও সোভিয়েত উভয় পরাশক্তির আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ থেকে অন্য দেশগুলোকে যথাসম্ভব রক্ষা করা। এই হিসাবে এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দুই পরাশক্তির পরিবর্তে একমাত্র পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ এবং চাপ প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে ন্যামের পক্ষে এখন যে ভূমিকা পালনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তাতে এর আদি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে এর কোনো পার্থক্য নেই। কাজেই বলা যেতে পারে যে, নতুন পরিস্থিতিতে 'জোটনিরপেক্ষতা'র কোনো ব্যাপার এখন না থাকলেও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার ক্ষেত্রে এই আন্তর্জাতিক সংগঠনটি এখন নতুনভাবে ব্যবহারযোগ্য হচ্ছে। তেহরান সম্মেলনে যা দেখা গেল তাতে এদিক দিয়ে এই সংগঠনটির জন্য এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে।
৩.৯.২০১২
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয়
মুক্তি কাউন্সিল
গত সপ্তাহে ইরানের রাজধানী তেহরানে ন্যামের ১৬তম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই সম্মেলনে ন্যামের ১২০ সদস্য দেশের প্রত্যেকটির প্রতিনিধিই যোগদান করেন। এই প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন ২৯ জন রাষ্ট্রপ্রধান, ৭ জন প্রধানমন্ত্রী ও ২৫ জন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। জাতিসংঘ, আফ্রিকান ইউনিয়ন, আরব লীগসহ ১০টি সদস্য সংগঠনকে নিয়ে ১৭টি পর্যবেক্ষক দেশের প্রতিনিধি এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন যাতে এই সম্মেলনে উপস্থিত না হন তার জন্য মার্কিন সরকার তার ওপর চাপ সৃষ্টি সত্ত্বেও তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। বস্তুতপক্ষে সেখানে তাকে যেতেই হতো, কারণ সম্মেলনে তার অনুপস্থিতি খোলাখুলি প্রমাণ করত যে, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর এজেন্ট মাত্র।
১৯৭৯ সালে ইরানে রাষ্ট্র পরিবর্তনের পর এই প্রথম সেখানে এ ধরনের কোনো আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এ কারণে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ন্যাম সদস্য দেশগুলোকে এই সম্মেলন বর্জন করার যে আহ্বান জানিয়েছিল তা ন্যাম সদস্য দেশগুলোর দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। অর্থাৎ ইরানকে কূটনৈতিকভাবে একঘরে করার যে চেষ্টা সাম্রাজ্যবাদেরা করেছে তা ব্যর্থ হয়েছে। এর অর্থ এই নয় যে, তেহরান ন্যাম সম্মেলনে যোগদানকারী দেশগুলোর প্রত্যেকটি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এবং সাম্রাজ্যবাদের কোনো প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ তাদের কারও ওপর নেই। এর অর্থ সাম্রাজ্যবাদীরা বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে এসব দেশের ওপর যে প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ কায়েম রেখে এসেছিল তা এখন আগের থেকে অনেক শিথিল হয়েছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ এভাবে শিথিল না হলে ন্যাম সম্মেলন উপলক্ষে ইরানকে কূটনৈতিকভাবে একঘরে বা দুর্বল করার সাম্রাজ্যবাদী প্রচেষ্টা এভাবে ব্যর্থ হতো না।
কিন্তু ইরানকে একঘরে করার এই চেষ্টা ব্যর্থ হলেও জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন ইরান কর্তৃক কঠোর ভাষায় ইসরায়েলের সমালোচনায় বিরোধিতা করেন। তিনি এবং মিসরের প্রেসিডেন্ট মুরসি উভয়েই সমালোচনা করেন ইরান কর্তৃক সিরিয়ার আসাদ সরকারকে পূর্ণ সমর্থনের। কিন্তু এই বিরোধিতা ও সমালোচনা সত্ত্বেও তেহরানে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ইরান যে লাভবান হয়েছে এতে সন্দেহ নেই। ইরানের শীর্ষতম নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি সম্মেলনে তার উদ্বোধনী বক্তৃতায় কঠোর ভাষায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সমালোচনা করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার প্রধান মিত্র দেশগুলো জাতিসংঘকে যেভাবে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে তারও কঠোর সমালোচনা করেন খামেনি।
আন্তর্জাতিক সংগঠন হিসেবে অর্থাৎ একটি জোটনিরপেক্ষ সংগঠন হিসেবে ন্যামের গ্রাহ্যতা ও কার্যকর ভূমিকা ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক একমাত্র পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পর আর বিশেষ না থাকায় এর গুরুত্ব বলে বিশেষ কিছু থাকেনি। কিন্তু তেহরানে অনুষ্ঠিত ১৬তম শীর্ষ সম্মেলনের মাধ্যমে দেখা গেল যে, ন্যাম কর্তৃক ১৯৯১ সালের আগের ভূমিকা পালন করার কোনো ভিত্তি এখন না থাকলেও এর কার্যকারিতা নিঃশেষিত হয়নি এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই সংগঠনটি সীমিতভাবে হলেও অনেক ধরনের সাম্রাজ্যবাদী নীতি, কার্যকলাপ ও নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতার ক্ষেত্রে কিছুটা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে। নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য বিষয়ে নানা লেনদেনের সুবিধাও এর মাধ্যমে অর্জিত হতে পারে। সর্বোপরি জাতিসংঘে মার্কিনসহ সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য হতে পারে।
লক্ষ্য করার বিষয় যে, তেহরানে অনুষ্ঠিত এই ন্যাম সম্মেলনে সৌদি আরব, কাতার ইত্যাদি মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন এজেন্ট দেশগুলোর বিশেষ কোনো উদ্যোগী ভূমিকা ছিল না। শুধু তাই নয়, ইরানের পরমাণু কর্মসূচির কোনো বিরোধিতা তারা করেননি। কাজেই এই ন্যাম সম্মেলনে তেহরানের পক্ষে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচির প্রতি সকলের সমর্থন লাভ সম্ভব হয়েছে। এই মর্মে একটি সর্বসম্মত প্রস্তাবও পাস হয়েছে। এই প্রস্তাবটিও যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পরদেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও খবরদারির বিরোধিতা এতে সন্দেহ নেই।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার যে, সম্মেলনে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অনেক সমালোচনা হলেও ইসরায়েলের নিজের পারমাণবিক বোমা নিয়ে ইরানসহ কোনো দেশই কিছু বলেনি। এটা যে শুধু এই সম্মেলনেরই বিশেষত্ব এমন নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের পারমাণবিক বোমা বিষয়ে কোনো উল্লেখ পর্যন্ত করতে দেখা যায় না। কালেভদ্রে কোনো ছোট দেশ এর উল্লেখ করলেও তার কোনো গুরুত্ব বা তাৎপর্য থাকে না। সাধারণভাবে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক নীরবতা এক বিস্ময়কর ব্যাপার। অথচ ইসরায়েল যখন পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য ইরান আক্রমণ করার ঘোষণা পর্যন্ত দেয় তখন তাদের নিজেদের পারমাণবিক বোমার পাহাড়ের উল্লেখ ও সেখানে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সংস্থার পরিদর্শনের দাবি যে সহজেই তাদের অবস্থানকে ভয়ানকভাবে দুর্বল করতে পারে এটা বোঝা কোনো কঠিন ব্যাপার নয়।
ন্যামের ১৬তম শীর্ষ সম্মেলনে ইরান ন্যামের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত হওয়ায় তার আন্তর্জাতিক অবস্থান শক্তিশালী হবে। তিন বছরের জন্য ন্যামের নেতৃত্বে থাকা অবস্থায় ইরানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অথবা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রধান মিত্র ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ইসরায়েলের পক্ষে সামরিক আক্রমণ পরিচালনা কোনো সহজ ব্যাপার হবে না। সেটা অসম্ভবই হবে। এ নিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের নিজেদের মধ্যেই যে বড় মতভেদ আছে সেটা জার্মান চ্যান্সেলর কর্তৃক ইসরায়েলের এই অভিসন্ধির সরাসরি ও কড়া বিরোধিতা থেকেই বোঝা যায়।
এক হিসাবে বলা চলে ন্যাম কর্তৃক বর্তমানে তার আদি ভূমিকা বর্তমান পরিস্থিতিতে পালন করার মতো অবস্থা না থাকলেও পূর্ব ভূমিকা পরিবর্তন করে নতুন ভূমিকা পালনের সম্ভাবনা তার ক্ষেত্রে এখন দেখা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সুবিধা এই যে, নতুন কোনো সংগঠন খাড়া না করে ন্যামকেই বর্তমান পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যবাদী চাপ ও নিয়ন্ত্রণ ঠেকানোর কাজে ছোট ও দুর্বল দেশগুলো ব্যবহার করতে পারে।
এ ক্ষেত্রে সর্বশেষে যা বলা দরকার তা হলো, ন্যামের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল মার্কিন ও সোভিয়েত উভয় পরাশক্তির আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ থেকে অন্য দেশগুলোকে যথাসম্ভব রক্ষা করা। এই হিসাবে এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দুই পরাশক্তির পরিবর্তে একমাত্র পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ এবং চাপ প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে ন্যামের পক্ষে এখন যে ভূমিকা পালনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তাতে এর আদি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে এর কোনো পার্থক্য নেই। কাজেই বলা যেতে পারে যে, নতুন পরিস্থিতিতে 'জোটনিরপেক্ষতা'র কোনো ব্যাপার এখন না থাকলেও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার ক্ষেত্রে এই আন্তর্জাতিক সংগঠনটি এখন নতুনভাবে ব্যবহারযোগ্য হচ্ছে। তেহরান সম্মেলনে যা দেখা গেল তাতে এদিক দিয়ে এই সংগঠনটির জন্য এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে।
৩.৯.২০১২
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয়
মুক্তি কাউন্সিল
No comments