ডায়াবেটিস ও গর্ভধারণ
সন্তান গর্ভধারণ যে কোন মানুষের জন্য খুব বড় একটি ঘটনা এবং এটি স্ট্রেসেরও কারণ। এ সময় মাযের স্বাভাবিক দৈহিক মিথক্রিয়া, হরমোনের পরিমাণ ও এর সাপেক্ষে উদ্দীপনার পরিমাণ এবং এর গভীরতার তারতম্য হয়। গর্ভস্থ শিশুটি নিজেই একটি অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির (হরমোন নিঃসরণকারী গ্রন্থির) মতো আচরণ করে।
প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল থেকে নিঃসৃত হয় হরমোন-এইচসিজি, এইচপিএল, ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন ও মায়ের দেহ নিঃসৃত স্টেরেয়েড ও প্রোটিন হরমোন ইত্যাদি মিলে মায়ের ওপর ডায়াবেটিস হবার অনুকূলে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। গর্ভাবস্থার ২য় অংশে (৩-৬ মাস) সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে শর্করা বিপাকের ওপর। এ সময় অগ্ন্যাশেয় থেকে ইনসুলিশ নিঃসরণের হার কয়েকগুণ বেড়ে যায়। কিন্তু অনেকেরই ইনসুলিনের কার্যকারিতা বহিস্থ কোষসমূহে বাধাগ্রস্ত হবার কারণে কাক্সিক্ষত কনপাওয়ার যায় না। অতএব, সন্তান গর্ভধারণ ইনসুলিনের মজুদের ওপর এক প্রকার চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেয়। ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত হবার ফলে বাচ্চার বৃদ্ধিতে সহায়তা হয় এবং বাচ্চার জন্য গ্লুকোজের সরবরাহও বাড়ে। গর্ভাবস্থার শেষ দিকে এটি দূরীভূত হয়ে যায়। কারও কারও শুধুমাত্র গর্ভধারণকালেই রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেশি থাকে। এর আগে সে হয়ত স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে আগে থেকেই টাইপ১ বা টাইপ২ ডায়াবেটিস ভোগার ইতিহাস থাকতে পারে।
গর্ভধারণকারীর রক্তে গ্লুকোজ পরিমাপের জন্য যে বিশেষ ধরনের পরীক্ষা করা হয় তার নাম জিটিটি (গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট)। এতে প্রথমে খালি পেটে গর্ভধারণকারীর রক্ত ও মূত্র নিয়ে গ্লুকোজের পরিমাণ দেখা হয়। এরপর ৫০ গ্রাম গ্লুাকোজ ২০০ মিলিলিটার জলে মিশিয়ে পান করার (৫ মিনিট ধরে) ২ ঘণ্টা পর আবার রক্ত ও মূত্র নিয়ে তাতে গ্লুকোজের পরিমাণ দেখা হয়। খালি পেটে (কমপক্ষে ৮ ঘণ্টা না খেয়ে থাকার পর) রক্তে গ্লুকোজের স্বাভাবিক পরিমাণ ৩.৫ থেকে ৫.৫ মিলিমোল/লিটার; ৫০ গ্রাম গ্লুকোজ ২০০ মিলিলিটার পানিতে মিশিয়ে পাঁচ মিনিট ধরে খাবার ২ ঘণ্টা পর রক্তে গ্লুকোজের স্বাভাবিক পরিমাণ হবে ৭.৮ মিলিমোল/লিটারের কম। যদি খালি পেটে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ ৫.৫ থেকে ৬.৯ মিলিমোল/লিটার বা ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাবার ২ ঘণ্টা পর ৭.৮ থেকে ১১.১ মিলিমোল/লিটার হয়, তাকে বলা হবে গ্লুকোজ অসহিষ্ণুুতা (ওসঢ়ধৎবফ এষঁপড়ংব ঞড়ষবৎবহপব);
গর্ভধারণের চিন্তা-ভাবনা শুরু করার প্রথম থেকে নিয়মিত রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষা করা উচিত। আর গর্ভধাণের পর অবশ্যই ডাক্তার দেখাতে হবে। গর্ভাবস্থার ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহ সময়ের মধ্যে বিশেষভাবে ডায়াবেটিসের পরীক্ষা করতে হয়।
গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হলে মাও শিশু উভয়ের জন্যই অনেকগুলো ক্ষতিকর ঘটনা ঘটতে পারে।
মায়ের ঝুঁকি :
(১) মাতৃ মৃত্যুর হার বেড়ে যায়
(২) হার্ট ফেইলুর ও আরও অনেক হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়
গর্ভস্থ শিশুর ঝুঁকি :
(১) উন্নত বিশ্বে এটি কমিয়ে আনা সম্ভব হলেও আমাদের দেশে এখনও ডায়াবেটিস রোগীর বাচ্চাদের মৃত্যুর হার অনেক বেশি।
(২) মরা বাচ্চা প্রসব ও অস্বাভাবিক অঙ্গ প্রত্যঙ্গসহ বাচ্চা জন্মানোর হার বেশি ; কোন কোন শিশুর হৃৎপি- ঠিকমতো গঠিত হয় না, কারও কারও মাথা ছোট হয়, মেরুদণ্ড নিচের দিকে জোড়া লাগানো থাকে না, ঠোঁট কাটা, উপরের তালু কাটা, মলদ্বার তৈরি না হওয়াসহ বিবিধ সমস্যা দেখা যায় এসব শিশুদের।
(৩) যে কোন সময় বাচ্চা প্রসব হয়ে যেতে পারে।
(৪) সহসা মায়ের পেটে বাচ্চার মৃত্যু ঘটতে পারে।
(৫) বাচ্চার ওজন অস্বাভাবিক রকম বেশি হয়।
(৬) এসব শিশু পরবর্তীতে দৈহিক স্থূলতা, ডায়াবেটিস ও বিভিন্ন রকম স্নায়ুরোগে ভোগে।
চিকিৎসা : প্রথমেই গর্ভবতী মায়ের খাদ্য গ্রহণ সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। ডায়াবেটিস হবার সম্ভাবনা আছে এমন মায়েদের জন্য বিশেষ ধরনের ব্যবস্থাপত্র দিতে হবে যার মধ্যে তার গর্ভধারণকালের মধ্যে মোট ১০ কেজি ওজন বৃদ্ধি অনুমোদন করা যাবে অর্থাৎ প্রতিমাসে .৪৫ কেজি ওজন বৃদ্ধি। তার জন্য প্রত্যেহ তাকে মোট খাদ্যের ৪০-৪৫% শর্করা (১৫০-২০০ গ্রাম), ১৮-২০% আমিষ (৭৪ গ্রাম) এবং চর্বি জাতীয় খাদ্য ৩০% এর কম খেতে হবে। আদর্শ খাদ্য গ্রহণ যতটা সম্ভব বাড়িয়ে দিতে হবে আর সমগ্র খাবারকে ৬ ভাগ করে প্রতিদিন খেতে হবে। আর প্রচুর ফল খেতে হবে।
গর্ভধারণকারী মহিলার ডায়াবেটিস চিকিৎসা করতে গিয়ে কখনও তাকে মুখে খাবার ওষুধ দেয়া যাবে না। তার জন্য একটাই ওষুধ- ইনসুলিন । যাদের গর্ভধারণের আগে থেকেই ডায়াবেটিস ছিল এবং তারা মুখে খাবার ওষুধ খেয়ে ভাল ছিলেন, তাদেরও ইনসুলিন শুরু করতে হবে গর্ভধারণ করার পর থেকেই। সম্ভব হলে বাচ্চা পেটে আসার আগে থেকেই তা করতে হবে। ইনসুলিন নিলে কারও কারও হাইপেগ্লোইসিমিয়া হতে পারে। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে । আর এদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে এবং বাচ্চা প্রসব ও প্রসব পরবর্তী ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়ে বিশদ সতর্ক ও দক্ষতাপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাটা জরুরী।
গর্ভকালীন সময়ে যাদের প্রথম ডায়াবেটিস ধরা পড়ল, তাদের ৫০ শতাংশের বেশি পরবর্তী এক বছরের মধ্যে ডায়াবেটিস রোগীতে পরিণত হবেন। ৫০%-৬০% ক্ষেত্রে যদি রক্ত পরীক্ষা না করা হয় তবে হয়ত কোনভাবেই সন্দেহ করার মতো কোন লক্ষণাদি দেখা যাবে না। কিন্তু রক্ত পরীক্ষা করলেই তাদের ডায়াবেটিস আছে বলে প্রতীয়মান হবে। গর্ভবতীর ডায়াবেটিস শিশুর জন্য একটি বিরাট গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ও জনস্বাস্থ্যের জন্য এটি একটি বিশাল হুমকি। তাই এটি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য মা-বাবাসহ সবাইকে জানানো জরুরী।
ডা. শাহজাদা সেলিম
এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ
বারডেম হাসপাতাল, শাহবাগ, ঢাকা।
০১৯১৯০০০০২২
গর্ভধারণকারীর রক্তে গ্লুকোজ পরিমাপের জন্য যে বিশেষ ধরনের পরীক্ষা করা হয় তার নাম জিটিটি (গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট)। এতে প্রথমে খালি পেটে গর্ভধারণকারীর রক্ত ও মূত্র নিয়ে গ্লুকোজের পরিমাণ দেখা হয়। এরপর ৫০ গ্রাম গ্লুাকোজ ২০০ মিলিলিটার জলে মিশিয়ে পান করার (৫ মিনিট ধরে) ২ ঘণ্টা পর আবার রক্ত ও মূত্র নিয়ে তাতে গ্লুকোজের পরিমাণ দেখা হয়। খালি পেটে (কমপক্ষে ৮ ঘণ্টা না খেয়ে থাকার পর) রক্তে গ্লুকোজের স্বাভাবিক পরিমাণ ৩.৫ থেকে ৫.৫ মিলিমোল/লিটার; ৫০ গ্রাম গ্লুকোজ ২০০ মিলিলিটার পানিতে মিশিয়ে পাঁচ মিনিট ধরে খাবার ২ ঘণ্টা পর রক্তে গ্লুকোজের স্বাভাবিক পরিমাণ হবে ৭.৮ মিলিমোল/লিটারের কম। যদি খালি পেটে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ ৫.৫ থেকে ৬.৯ মিলিমোল/লিটার বা ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাবার ২ ঘণ্টা পর ৭.৮ থেকে ১১.১ মিলিমোল/লিটার হয়, তাকে বলা হবে গ্লুকোজ অসহিষ্ণুুতা (ওসঢ়ধৎবফ এষঁপড়ংব ঞড়ষবৎবহপব);
গর্ভধারণের চিন্তা-ভাবনা শুরু করার প্রথম থেকে নিয়মিত রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষা করা উচিত। আর গর্ভধাণের পর অবশ্যই ডাক্তার দেখাতে হবে। গর্ভাবস্থার ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহ সময়ের মধ্যে বিশেষভাবে ডায়াবেটিসের পরীক্ষা করতে হয়।
গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হলে মাও শিশু উভয়ের জন্যই অনেকগুলো ক্ষতিকর ঘটনা ঘটতে পারে।
মায়ের ঝুঁকি :
(১) মাতৃ মৃত্যুর হার বেড়ে যায়
(২) হার্ট ফেইলুর ও আরও অনেক হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়
গর্ভস্থ শিশুর ঝুঁকি :
(১) উন্নত বিশ্বে এটি কমিয়ে আনা সম্ভব হলেও আমাদের দেশে এখনও ডায়াবেটিস রোগীর বাচ্চাদের মৃত্যুর হার অনেক বেশি।
(২) মরা বাচ্চা প্রসব ও অস্বাভাবিক অঙ্গ প্রত্যঙ্গসহ বাচ্চা জন্মানোর হার বেশি ; কোন কোন শিশুর হৃৎপি- ঠিকমতো গঠিত হয় না, কারও কারও মাথা ছোট হয়, মেরুদণ্ড নিচের দিকে জোড়া লাগানো থাকে না, ঠোঁট কাটা, উপরের তালু কাটা, মলদ্বার তৈরি না হওয়াসহ বিবিধ সমস্যা দেখা যায় এসব শিশুদের।
(৩) যে কোন সময় বাচ্চা প্রসব হয়ে যেতে পারে।
(৪) সহসা মায়ের পেটে বাচ্চার মৃত্যু ঘটতে পারে।
(৫) বাচ্চার ওজন অস্বাভাবিক রকম বেশি হয়।
(৬) এসব শিশু পরবর্তীতে দৈহিক স্থূলতা, ডায়াবেটিস ও বিভিন্ন রকম স্নায়ুরোগে ভোগে।
চিকিৎসা : প্রথমেই গর্ভবতী মায়ের খাদ্য গ্রহণ সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। ডায়াবেটিস হবার সম্ভাবনা আছে এমন মায়েদের জন্য বিশেষ ধরনের ব্যবস্থাপত্র দিতে হবে যার মধ্যে তার গর্ভধারণকালের মধ্যে মোট ১০ কেজি ওজন বৃদ্ধি অনুমোদন করা যাবে অর্থাৎ প্রতিমাসে .৪৫ কেজি ওজন বৃদ্ধি। তার জন্য প্রত্যেহ তাকে মোট খাদ্যের ৪০-৪৫% শর্করা (১৫০-২০০ গ্রাম), ১৮-২০% আমিষ (৭৪ গ্রাম) এবং চর্বি জাতীয় খাদ্য ৩০% এর কম খেতে হবে। আদর্শ খাদ্য গ্রহণ যতটা সম্ভব বাড়িয়ে দিতে হবে আর সমগ্র খাবারকে ৬ ভাগ করে প্রতিদিন খেতে হবে। আর প্রচুর ফল খেতে হবে।
গর্ভধারণকারী মহিলার ডায়াবেটিস চিকিৎসা করতে গিয়ে কখনও তাকে মুখে খাবার ওষুধ দেয়া যাবে না। তার জন্য একটাই ওষুধ- ইনসুলিন । যাদের গর্ভধারণের আগে থেকেই ডায়াবেটিস ছিল এবং তারা মুখে খাবার ওষুধ খেয়ে ভাল ছিলেন, তাদেরও ইনসুলিন শুরু করতে হবে গর্ভধারণ করার পর থেকেই। সম্ভব হলে বাচ্চা পেটে আসার আগে থেকেই তা করতে হবে। ইনসুলিন নিলে কারও কারও হাইপেগ্লোইসিমিয়া হতে পারে। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে । আর এদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে এবং বাচ্চা প্রসব ও প্রসব পরবর্তী ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়ে বিশদ সতর্ক ও দক্ষতাপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাটা জরুরী।
গর্ভকালীন সময়ে যাদের প্রথম ডায়াবেটিস ধরা পড়ল, তাদের ৫০ শতাংশের বেশি পরবর্তী এক বছরের মধ্যে ডায়াবেটিস রোগীতে পরিণত হবেন। ৫০%-৬০% ক্ষেত্রে যদি রক্ত পরীক্ষা না করা হয় তবে হয়ত কোনভাবেই সন্দেহ করার মতো কোন লক্ষণাদি দেখা যাবে না। কিন্তু রক্ত পরীক্ষা করলেই তাদের ডায়াবেটিস আছে বলে প্রতীয়মান হবে। গর্ভবতীর ডায়াবেটিস শিশুর জন্য একটি বিরাট গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ও জনস্বাস্থ্যের জন্য এটি একটি বিশাল হুমকি। তাই এটি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য মা-বাবাসহ সবাইকে জানানো জরুরী।
ডা. শাহজাদা সেলিম
এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ
বারডেম হাসপাতাল, শাহবাগ, ঢাকা।
০১৯১৯০০০০২২
No comments