জবাবদিহি- আমাদের সবার বুয়েট-বসন্ত

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান অচলাবস্থা ইতিমধ্যে সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে সবাই অবগত। এ বিষয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মূল বক্তব্য নতুন করে উপস্থাপনের প্রয়োজন নেই। তবে একটা বিষয় সম্পর্কে সবার অবগত হওয়া প্রয়োজন যে বুয়েটে এ ধরনের পরিস্থিতি নিত্য ঘটনা।


বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি একযোগে সবার অনাস্থা প্রকাশের এই ঘটনা বুয়েটের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সচেতনভাবেই বুয়েটকে তিয়াত্তরের অধ্যাদেশে অন্তর্ভুক্ত করেননি। কারণ, যে প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকৌশল ও প্রযুক্তিগত শিক্ষায় পারদর্শী মানুষ বের হবেন, সেখানে শিক্ষক-রাজনীতি প্রবেশ করুক, সেটা তিনি চাননি। আর সে কারণেই বুয়েটে রাজনীতির নগ্ন রূপটি কদাচিৎই আমরা দেখতে পেয়েছি। ছাত্ররাজনীতি থাকলেও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো ছাত্ররাজনীতির নামে চরম নৈরাজ্য আমরা সচরাচর বুয়েটে দেখতে পাই না। প্রশ্ন উঠেছে, শিক্ষার্থীরা কেন শিক্ষকদের সঙ্গে আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে দিনরাত কাউন্সিল ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে প্রশাসনের বিরুদ্ধে তাঁদের অনাস্থা প্রকাশ করেছেন (এখানে বলে রাখা দরকার যে শুধু শিক্ষার্থীরা নন, বুয়েটের প্রত্যেকটি কর্মচারী, বাসের ড্রাইভার, ঝাড়ুদার, দারোয়ান, পিয়ন, ল্যাব ডেমোনেস্ট্রেটর—সবাই আনুষ্ঠানিকভাবে বর্তমান উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনাস্থা ব্যক্ত করেছেন এবং এই আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন)। ঈদের পর বুয়েটে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে আন্দোলন কর্মসূচি কঠোর আকার ধারণ করে। সমস্যা তো প্রশাসনিক, এখানে শিক্ষার্থীদের সরাসরি স্বার্থ কোথায়? প্রথমত, না, সমস্যা শুধু প্রশাসনিক নয়। দ্বিতীয়ত, প্রশাসনিক সমস্যাও দীর্ঘমেয়াদি, অবশ্যই শিক্ষার্থীদের ভুক্তভোগী করবে। নিচের বিষয়গুলোর প্রতি একটু দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যাক:
১. ফল জালিয়াতির ঘটনা বুয়েটের ইতিহাসে অকল্পনীয় ও অবিশ্বাস্য। ফল জালিয়াতির বিষয়টি ইতিমধ্যে সব গণমাধ্যমে বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে। তাই এটা নিয়ে এখানে আর বিস্তারিত কিছু লেখার প্রয়োজন বোধ করছি না।
২. গত ৩১ ডিসেম্বর ২০১১ তারিখে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ঈষাণ ভাইয়ের ওপর হামলার প্রতিবাদে সাধারণ শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন এবং প্রশাসনকে বাধ্য করেছিলেন কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে। এখানে আলোচ্য বিষয় দুটি—প্রথমত, ছাত্র নামের কিছু ক্যাডারকে বাঁচাতে প্রশাসনের কেন ছিল সেই লুকোচুরি খেলা? দ্বিতীয়ত, আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী কয়েকজন শিক্ষার্থীর ফলাফল তদন্তের নামে আটকে রাখা হয়েছে দীর্ঘদিন। কিছু বিপথগামী শিক্ষার্থী, যাঁরা বাংলাদেশে সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠনের নাম ব্যবহার করে স্বেচ্ছাচারী ভূমিকা পালন করে ক্যাম্পাসের সবার মধ্যে ভীতি সঞ্চার করছেন, তাঁদের প্রতি কর্তৃপক্ষের পক্ষপাতমূলক আচরণ ছিল দৃশ্যমান। উপরিউক্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে যাঁরা নেতৃত্ব দিলেন, তাঁদের একাডেমিকভাবে চাপগ্রস্ত করে এবং তদন্তের নামে ফলাফল আটকে রেখে কর্তৃপক্ষ যে ন্যক্কারজনক দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করেছিল, তা সাধারণ শিক্ষার্থীরা সংগত কারণেই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারেননি।
৩. গত তিন বছরে বিভিন্ন হলে এবং হলের ক্যানটিনে অনেক সহিংস ঘটনা ঘটেছে (প্রতিটির বিবরণ দেওয়া এই আলোচনায় সম্ভব নয়)। প্রতিটি ক্ষেত্রেই কর্তৃপক্ষ নীরব ভূমিকা পালন করেছে।
৪. শুরুতেই বলেছি, বুয়েটে ছাত্ররাজনীতির নগ্ন রূপটি কদাচিৎই দেখা যায়। কিন্তু অতিসম্প্রতি ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের জন্য রাজনীতির নগ্ন ব্যবহার যেন বেড়েই চলেছে এবং প্রশাসনের নীরব ভূমিকা স্বাভাবিকভাবেই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।
৫. সর্বশেষ গত ১০ জুলাই ২০১২ আকস্মিকভাবে গ্রীষ্মকালীন অবকাশ ও ঈদের ছুটি মিলিয়ে মোট ৪৪ দিনের জন্য বুয়েট বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বুয়েটে গ্রীষ্মকালীন অবকাশ নামে আলাদা করার কোনো অবকাশ নেই। স্পষ্টতই বোঝা যায়, ক্যাম্পাস ফাঁকা করতেই এই দুরভিসন্ধিমূলক ছুটির ঘোষণা। এমনিতেই আমরা এখন সেশনজটে আছি, এর মধ্যে ব্যক্তিস্বার্থে কেউ যদি বুয়েট ৪৪ দিন বন্ধ করে, সেটা সরাসরি শিক্ষার্থীর স্বার্থে আঘাত।
এই কারণগুলোসহ আরও কিছু কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কর্তৃপক্ষের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছেন। সংক্ষেপে এ-ই ছিল শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে আসার পেছনের গল্প। এখন যুক্ত হয়েছে আরও নতুন কিছু বিষয়। আমরা দেখলাম, গত ২ সেপ্টেম্বর আমাদের আন্দোলন নস্যাৎ করার জন্য একটি ছাত্রসংগঠনের ক্যাডার বাহিনী মাঠে নেমেছে এবং এই ক্যাডাররা ছাত্রছাত্রীদের ওপর চড়াও হয়েছে। উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের মদদ ছাড়া এটা সম্ভব বলে আমরা মনে করি না। একই দিন শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী কয়েকজন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগ তুলে ষড়যন্ত্রমূলক মামলা করা হয়।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আলাদা স্বার্থ যেমন আছে, তেমনি নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ও গৌরব রক্ষায় শিক্ষার্থী-শিক্ষক সহমত পোষণ করেন বলেই শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের এই যুগপৎ আন্দোলন। এর মধ্যে অন্য কিছুর গন্ধ খুঁজতে যাওয়াটা হবে সত্যকে আড়াল করার প্রচেষ্টামাত্র। এমতাবস্থায় অতিসত্বর বুয়েটের এই অচলাবস্থা দূর করে ক্লাস শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। ইতিমধ্যে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে, ডিসেম্বরে আইবিএর পরীক্ষা আমাদের পক্ষে ধরা সম্ভব হবে না। যাঁরা ২০১৩-এর বসন্তে উচ্চশিক্ষার জন্য বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন, তাঁদের পক্ষেও এই সেশন ধরা অত্যন্ত দুরূহ হয়ে পড়েছে।
আন্দোলন চলাকালীন শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে প্রেস ব্রিফিংয়ে যে শপথবাক্য পাঠ করা হয়েছিল, তার একাংশ তুলে ধরে লেখাটি শেষ করছি:
আমাদের এই আন্দোলন সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্ত। এই আন্দোলনকে সফল করার জন্য আমরা বুয়েটের সব শিক্ষার্থী একসঙ্গে আছি এবং থাকব। ভবিষ্যতে কোনো শিক্ষার্থীর ওপর একাডেমিক, প্রশাসনিক, শারীরিক এবং অন্য যেকোনো ধরনের আঘাত এলে তা বুয়েটের সব শিক্ষার্থীর ওপর আঘাত হিসেবে বিবেচিত হবে। আমরা শপথ করছি যে এমন কোনো ঘটনা ঘটলে এবং আমাদের দাবি পূরণ না হলে, আমরা বুয়েটের শিক্ষার্থীরা পুনরায় একতাবদ্ধ হয়ে এ ধরনের অন্যায় আচরণের মোকাবিলা করব।
লেখকেরা: বুয়েটের বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থী।

No comments

Powered by Blogger.