চরাচর-গোমতীর তীরে 'মধুর বাঁশরী বাজে' by জাহাঙ্গীর হোসেন অরুণ

'গোমতীর তীরে পাতার কুটিরে/আজও সে পথ চাহে সাঁঝে/আজও মধুর বাঁশরী বাজে।' এটি বিখ্যাত একটি নজরুলগীতি। নজরুলের লেখায়ই যে শুধু নদী গোমতী উঠে এসেছে তা নয়। কবির জীবনের প্রেম, বিবাহ, বিচ্ছেদ, পুনর্বিবাহ- সব কিছুই এসেছে এই গোমতীকে ঘিরে।


গোমতী নদীর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক আরেকজন প্রবাদ পুরুষের আছে। তাঁর নাম কর্তা, শচীন কর্তা। গোমতীর পাশে ত্রিপুরার রাজপরিবার আবাস গড়েছিল। শচীন কর্তার জন্ম এখানেই। গোমতী খরস্রোতা নদী। তাই এর সঙ্গে সম্পর্কে বাঁধা যাঁরাই পড়েছেন, সবাই কেমন যেন খরস্রোতেরই মতো। ভেবে দেখুন, কাজী নজরুল ইসলামের কথা। তিনি তো বিদ্রোহী কবি। শচীন কর্তা, তিনি তো সংগীতের জগতে খরস্রোতের মতোই আবির্ভূত হলেন। এত এত জনপ্রিয় গান, এত এত ভিন্নধর্মী সুর আর কোনো সংগীতস্রষ্টা দিয়ে যেতে পারেননি। গোমতী তীরের ছেলে শচীন ভারতীয় সংগীতের জগতের সবচেয়ে জ্বলজ্বল করা নক্ষত্র। ত্রিপুরার বিখ্যাত মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্যকে কে না চেনে? কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ যখন একেবারেই তরুণ, তখন তাঁর লেখা পড়ে সদ্য স্ত্রীবিয়োগ হওয়া বীরচন্দ্র মানিক্য কেঁদেছিলেন এবং তরুণ কবিকে পাঠিয়েছিলেন উপঢৌকন। সম্ভবত তরুণ রবীন্দ্রনাথের এই-ই ছিল কবিতা লেখার প্রথম বিশাল প্রাপ্তি। ত্রিপুরা তথা বর্তমান কুমিল্লার সেই মহারাজা সম্পর্কে যদি আরো জানতে চান, তাহলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম আলো পড়তে পারেন। গোমতীর খরস্রোতের প্রভাব এই গোমতীপারের মহারাজার মধ্যেও বিদ্যমান। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তান গণপরিষদে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চেয়েছিলেন এই গোমতীপারের ছেলে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। আইনপেশার এই রাজনীতিবিদ সারা জীবন বিপ্লব ও বিদ্রোহে কাটিয়ে দিয়েছেন বাংলার মানুষের হয়ে।
গোমতী নদীর উৎসস্থল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ডাম্বুর নামক পাহাড়ি অঞ্চল। প্রায় ১৫ কিলোমিটার ভারতে বিচরণ শেষে বাংলাদেশে এই নদী প্রবেশ করে কুমিল্লা শহরের কটক বাজারে। এরপর কুমিল্লা শহর পাশ কাটিয়ে, ময়নামতির পাশ দিয়ে দেবীদ্বার হয়ে এই নদী পেঁৗছে কোম্পানীগঞ্জ। গোমতী নদী বাংলাদেশে মোট ১৩৫ কিলোমিটার রাস্তা পার হয়ে পরে দাউদকান্দির সাপ্তায় এসে মেঘনা নদীর সঙ্গে মিশেছে। গোমতী নদীর পানি বহতার পরিমাণ ১০০ থেকে ২০ হাজার বর্গফুট/সেকেন্ড। বর্ষায় এই নদী যখন দুই কূলে কানায় কানায় ভরে বইতে থাকে, তখন এই নদীর গড় প্রস্থ হয় প্রায় ১০০ মিটার। খরস্রোতের কারণে কয়েক বছর পর পরই বর্ষাকালে এই নদীর তীর ভাঙে। তখন ভাসিয়ে নিয়ে যায় গ্রামের পর গ্রাম। ক্ষতি হয় বিস্তর; কিন্তু তা পুষিয়ে দেয় পানির সঙ্গে বয়ে আনা বিপুল পরিমাণ পলিমাটি দিয়ে। ভাঙনের পর তাই গোমতী পারের ভেসে যাওয়া অঞ্চল হয় সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা। শচীন কর্তা যে গেয়েছিলেন, ঘাটে লাগাইয়া ডিঙ্গা পান খাইয়া যাও মাঝি, আল্লাহর দোহাই- এই ঘাট যে শচীনের স্মৃতিতে গোমতীরই কোনো একটি ঘাট, সেটা দিব্যি করে বলা যায়। গোমতী নদী বয়ে যায় প্রাণের কথা বলে, আর তার পারে জন্ম নেওয়া মানুষেরা তাঁরে মনে রাখে পরম মমতায়।
জাহাঙ্গীর হোসেন অরুণ

No comments

Powered by Blogger.