থলের বিড়াল by ফসিহ বণিক
অবশেষে থলের বিড়ালটি বেরিয়ে পড়ল। এর ফলে চমৎকার বুননে গাঁথা গল্পটি আরব্য রজনীর কল্পকাহিনীর মর্যাদা পাওয়ার মোক্ষম সুযোগ বঞ্চিত হলো। এ কারণে, যিনি ধর্মকে অধর্মের হাত রক্ষা করার নামে ব্লাসফেমি তরবারি হাতে খোদার অবাধ্যকে (!) উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার সাক্ষী হতে চেয়েছিলেন, তিনি বীরের সম্মান খুইয়ে ভিলেনের স্তরে নেমে গেছেন।
পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনে এক কিশোরীকে ফাঁসাতে গিয়ে মসজিদের ইমাম খালিদ জাদুন চিশতি এখন নিজেই চৌদ্দ শিকের মধ্যে হাঁসফাঁস করছেন। একই মসজিদের মুয়াজ্জিন হাফিজ যোবায়েরের মধ্যে যে একজন মুমিন মুসলমানের বাস, এটি ইমাম সাহেব স্বপ্নেও ভাবেননি। ইমাম সাহেব তার এলাকার এক খ্রিস্টান কিশোরীর বিরুদ্ধে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরআন পুড়িয়ে ছাইয়ের সঙ্গে বাজারের ব্যাগে করে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ আনেন। আর যায় কোথা! একে তো কোরআন অবমাননা, তাও আবার বিধর্মীর হাতে! হোক না কম বয়সী মেয়ে। কোরআন পুড়িয়েছে শোনার পর পাকিস্তানের মুসলমানদের মধ্যে প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া হওয়াটাই স্বাভাবিক। এতে উত্তেজিত জনতা যে ওই মেয়েকে পাথর মেরে বা পায়ে দলে মেরে ফেলেনি! এ ধরনের ঘটনায় সেখানে বদ্ধপাগল পর্যন্ত উত্তেজিত জনতার রুদ্ররোষ থেকে রক্ষা পায়নি। হয়তো কাহিনীর শুরু থেকেই মুয়াজ্জিন একজন প্রতিবাদী চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার কারণে ইমাম সাহেব স্থানীয় জনতাকে উত্তেজিত করে বিচারটা মাঠেই সেরে ফেলার বন্দোবস্ত করে উঠতে পারেননি। মুয়াজ্জিন দেখেছেন, কীভাবে ইমাম নিজেই কোরআনের ছেঁড়া পাতা জড়ো করে ছাইয়ের সঙ্গে কিশোরীটির বাজারের থলের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনের কীভাবে অপব্যবহার হচ্ছে, এ ঘটনাটি তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। আইনটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত শত্রুতা এবং সাম্প্রদায়িক ভেদজ্ঞানকে আরও তীক্ষষ্ট করার কাজে ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে। যখনই এই আইন সংস্কার বা বাতিলের প্রশ্ন উঠেছে তখনই এর বিরুদ্ধে দক্ষিণপন্থি ইসলামী দল ও জঙ্গি সংগঠনগুলো রে রে করে তেড়ে এসেছে। আমাদের এখানেও যারা ব্লাসফেমি আইন করার দাবি করেন তারা সজ্ঞানে হোক আর অজ্ঞানেই হোক কার্যত পাকিস্তানের মতো একটা চরম রক্ষণশীলতাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে চান। এতে দেশের যে চৌদ্দটা বাজতে আর বেশি দেরি হবে না সেটা তারা হিসাবে রাখেন না। পাকিস্তানের এক্সপ্রেস ট্রিবিউনের রিপোর্টেই দেখা যায়, সেখানে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে ক্ষুব্ধ জনতার হাতে ৩৪ জন মানুষ মারা গেছে। ব্লাসফেমি আইন জিয়াউল হকের আমলে ১৯৮৬ সালে শেষবার সংশোধনের পর থেকে এ পর্যন্ত এই আইনে ৪ হাজারটির মতো মামলা হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে ব্লাসফেমি আইনে মামলা হয়েছে তাদের বাদবাকি জীবনও চরম সামাজিক প্রতিকূলতার মধ্যেই থাকতে হয়। তাদের পরিবারকেও মারাত্মক পরিস্থিতির মধ্যে দিন গুজরান করতে হয়। সেখানে ধর্মীয় মৌলবাদের শিকড়টা কতটা গভীরে প্রোথিত তার প্রমাণ পাঞ্জাবের গভর্নর উদারতাবাদী সালমান তাসির ও সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী শাহবাজ ভাট্টির উগ্রবাদীদের হাতে নিহত হওয়ার ঘটনা। তাদের দু'জনকেই ব্লাসফেমি আইন সংস্কারের পক্ষে কথা বলার জন্য হত্যা করা হয়। মানবাধিকার কর্মী আসমা জাহাঙ্গীরের ভাষায়, সেখানে ব্লাসফেমি আইনে মিথ্যা মামলা দায়ের বা ওই মামলায় কারও শাস্তি হলে তার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করার কেউ সাহস করেন না।
মুয়াজ্জিনের সৎ সাহসের কারণে এবার হয়তো ইমাম নিজের ফাঁদা জালে নিজেই আটকা পড়বেন, আর বেরিয়ে আসবেন নিরপরাধ কিশোরী রিমশা মসিহ। কিন্তু এই আইন যতদিন একই অবস্থায় বলবৎ থাকবে, ততদিন পাকিস্তানে এর আড়ালে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা চলতেই থাকবে।
No comments