নির্বাচন- জনপ্রশাসন নিরপেক্ষ ভূমিকা নিতে পারবে কি? by আলী ইমাম মজুমদার
জাতীয় সংসদ নির্বাচন ক্রমশ এগিয়ে আসছে। সে সময়ে কী ধরনের সরকার দেশে থাকবে—এ নিয়ে বৃহৎ দুটো রাজনৈতিক দলের মধ্যে গুরুতর মতপার্থক্য রয়েছে। অবস্থার সূচনা সংবিধানের ১৩শ সংশোধনীর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে ১৫শ সংশোধনী কার্যকরী হওয়ার পর থেকে।
এ সংশোধনী অনুযায়ী ক্ষমতায় থাকা সরকারই নির্বাচনকালীন দায়িত্ব পালন করবে। বিদায়ী জাতীয় সংসদও বহাল থাকবে। প্রধান বিরোধী দল ঘোষণা দিয়ে রেখেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনরায় চালু করা না হলে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। আর সরকারের তরফ থেকে স্পষ্টতই বলে দেওয়া হচ্ছে, সে ধরনের সরকারব্যবস্থা পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা হবে না। তবে সম্প্রতি বলা হচ্ছে, নির্বাচনের সময়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থাকবে। এতে প্রধান বিরোধী দলটির অংশীদারিও থাকতে পারে। এর কাঠামো বা রূপরেখা অস্পষ্ট। সন্দেহ নেই, উদ্যোগটি তাৎপর্যপূর্ণ। এটা ইতিবাচক হতে পারে—যদি বাস্তবতার নিরিখে বিবদমান পক্ষগুলো একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছায়। সে সম্ভাবনা এখনো দেখা যাচ্ছে না। বরং লক্ষণীয় হচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা, জনগণের মধ্যে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা। কেননা, গত চারটি সফল সংসদ নির্বাচনের পর যদি প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণে আগামী সংসদ নির্বাচন না হয়, তাহলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। এ ধরনের নির্বাচনে গঠিত সরকার অতীতেও স্থিতিশীল হয়নি; হয়েছে স্বল্পমেয়াদি। আবার এ ধরনের নির্বাচনের প্রচেষ্টা ২০০৭-এর ১/১১ ডেকে এনেছে, এটাও নিকট অতীতের ঘটনা। কিন্তু আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে বিমুখ। দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝি না। ফলে মাশুল দিই অনেক বেশি। যা হোক, এখনো এক বছরের বেশি সময় হাতে রয়েছে। আমি বিশ্বাস করতে চাই যে আমাদের রাজনীতিবিদেরা দেশকে ভালোবাসেন। সুতরাং, তাঁরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছালে দেশবাসী আশ্বস্ত হয়।
আমার মূল প্রতিপাদ্য সংসদ নির্বাচনকালে জনপ্রশাসনের ভূমিকা কী হবে? কী হওয়া উচিত সে সম্পর্কে সবাই এক বাক্যে বলবেন, তারা স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অধীনে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবে। কিন্তু আমাদের জনপ্রশাসনে যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, সরকার পরম্পরা প্রতিষ্ঠানগুলোকে যেরূপ বিবেচনাহীনভাবে বিপন্ন করেছে; তার ফলে সে নির্বাচনের আগে এগুলোর ওপর সব রাজনৈতিক দলের আস্থা সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে। পরিবর্তিত যে সাংবিধানিক ব্যবস্থা তা পুরোপুরি বহাল থাকলে কীভাবে তা সম্ভব হবে, বোধগম্য হচ্ছে না। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে যে দলই ক্ষমতায় গেছে, তারা তাদের অনুসারী বলে দাবিদার কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবিতে নিয়ে আসছে। পদোন্নতিতেও তাঁদেরই প্রাধান্য। এ সময়ের শেষার্ধে প্রবণতাটা প্রকট হয়েছে। এসব কর্মকর্তার কারও কারও আচরণ রাজনীতিবিদদের চেয়েও অধিক রাজনীতিক। আবার অনেকেই বসন্তের কোকিলের মতো সময়ান্তরে হয়ে পড়েন অপর দলটির বড় ধরনের সমর্থক। নির্বাচন পরিচালনায় মাঠ প্রশাসনের সংশ্লিষ্টতা ও ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে গত প্রায় এক যুগ জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে নতজানু। কেউ একটু প্রতিবাদী হলেই শুধু বদলি বা ওএসডি করাই নয়, ক্ষেত্রবিশেষে শারীরিকভাবেও লাঞ্ছিত হয়। এসব ঘটনার প্রতিকারই হয় না। তাই তাঁদেরই কিছু সুবিধাবাদী শুধু টিকে থাকার জন্য অধিকতর রাজনৈতিক ভূমিকায় নেমে পড়েছে। যদিও নির্বাচনকালে তাঁরা নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকবেন, তবে প্রশাসনের প্রয়োজনীয় রদবদল ব্যতিরেকে জাতীয় নির্বাচনের বিশাল প্রেক্ষাপটে কমিশনের পক্ষে এঁদের নিরপেক্ষ রাখা কতটা সম্ভব হবে—এ নিয়ে সংশয় রয়েছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই এ দেশে জাতীয় নির্বাচনকালীন একটি নির্দলীয় সরকার প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯০ সালে। সেটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় একটি ব্যর্থ নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ১৩শ সংশোধনীর মাধ্যমে। ১৯৯০ সালে নির্দলীয় সরকার ক্ষমতা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ কতিপয় সচিব, আইজিপি থেকে জেলা ও উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে পরিবর্তন আনে। তেমনিভাবে ১৯৯৬ ও ২০০১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারও একই ধারা অনুসরণ করে। ২০০৭-এর দীর্ঘমেয়াদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়েও যথোচিত পরিবর্তন করা হয় ২০০৮-এর নির্বাচন সামনে রেখে। চারটি নির্বাচনই সফল হয়েছে। যদিও এ দেশের দুর্ভাগ্যজনক রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য চারটি নির্বাচনেই পরাজিত দল কারচুপির অভিযোগ আনে। তবে দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পায় এসব নির্বাচন এবং এর মাধ্যমে গঠিত নির্বাচিত সরকার। এ নির্বাচনগুলোর সাফল্যের কিছুটা অংশীদার এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সামরিক বাহিনীর উপস্থিতিও অত্যন্ত সহায়ক বলে বিবেচিত হয়।
নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনার সামগ্রিক দায়িত্বে থাকে। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা অত্যন্ত মুখ্য রূপে থেকে যাবে। কিছুসংখ্যক চিহ্নিত কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার ঢিলেমি আর কোথাও কোথাও বাড়াবাড়ি সে এলাকার ভোটের ফলাফলে নির্ণায়ক প্রভাব ফেলতে পারে। ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তাদের তালিকা শেষ মুহূর্তে রাতারাতি পরিবর্তন ও বিশেষ কারও প্রতি অনুগত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তি পাল্টে দিতে পারে পরিস্থিতি। দেশব্যাপী এক দিনে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে এ ধরনের অনিয়ম কমিশনের নজরে আনতে আনতেই ভোট গ্রহণ শেষ হয়ে যাবে। কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তারা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকলেও সে মহাযজ্ঞে তাঁরাও একাকার হয়ে যাবেন না, এ নিশ্চয়তাও কি দেওয়া যায়? বর্তমান সরকারের সময়কালে বেশ কয়েকটি উপনির্বাচন ও সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে তাদের প্রার্থী পরাজিত হয়েছে। নির্বাচনগুলোও হয়েছে নিরপেক্ষ ও সফল। তেমনটা কিন্তু এখনকার প্রধান বিরোধী দল ক্ষমতায় থাকার সময় ঢাকা ও চট্টগ্রামে প্রথম মেয়র নির্বাচনে তাদের প্রার্থী পরাজিত হয়েছিল। কিন্তু তারাই পরবর্তী সংসদ নির্বাচন করতে গিয়ে কার্যত ব্যর্থ হয় এবং দ্রুততার সঙ্গে সংবিধান সংশোধন করে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়। এখানে আমাদের স্মরণে রাখা দরকার, উপনির্বাচন বা কোনো সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে সমাবেশ ঘটানো হয় আর গণমাধ্যমের যে নজরদারি থাকে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তা রাখা সম্ভব হবে না।
আরেকটি দুর্ভাগ্য, রাজনৈতিক জগতে রাজনীতিবিদেরা ক্রমান্বয়ে পিছু হটছেন। তাঁদের স্থান দখল করছেন ব্যবসায়ী ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা। এতে আইনে বাধা নেই। তবে মূলত তাঁরাই রাজনৈতিক কার্যক্রমে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। যতটুকু জানা যায়, উভয় শিবিরেই বেশ কিছু অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বসে গেছেন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে। তাঁদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কর্মরতদের কারও কারও যোগাযোগের খবরও পাওয়া যায়। যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের কম্পিউটারে প্রশাসন ও পুলিশে কর্মরত সব কর্মকর্তার তথ্য রয়েছে বলেও জানা যায়। সেসব তথ্য হচ্ছে, কে তাঁদের সমর্থক আর কে বিরোধী। নিরপেক্ষ শব্দ তাঁদের অভিধানে নেই। তবে আছে সন্দেহভাজন বলে অন্য একটি শব্দ। কেউ নিরপেক্ষ থাকতে পারে, এটা তাঁরা বিশ্বাস করতে অনিচ্ছুক। এ যেন স্নায়ুযুদ্ধ যুগের মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন ফস্টার ডালেসের তত্ত্ব, ‘হয় তোমরা আমাদের পক্ষে অথবা বিপক্ষে।’ ৯/১১-এর পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশও একই তত্ত্ব আবার সামনে নিয়ে আসেন। আর দিন যত যাচ্ছে আমাদের জনপ্রশাসনে এ তত্ত্বটাই প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। তাই অনেকে আত্মরক্ষার্থে একটি শিবিরকে আঁকড়ে ধরছে এবং প্রধানত ক্ষমতায় যারা আছে তাদের। কিন্তু আমার দেখামতে বাস্তব হচ্ছে, বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব সম্পাদনে নিরপেক্ষ থাকতে চান। নির্বাচনকালে তো বটেই। অনুকূল পরিস্থিতি পেলে থাকেনও। নচেৎ এসব কর্মকর্তার দ্বারা চার-চারটি সফল জাতীয় নির্বাচন কীভাবে সম্ভব হলো। আবার প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনের অধীনে এ কর্মকর্তারাই ব্যর্থ নির্বাচনগুলোর দায়ভারও নিয়েছেন।
এখন প্রশ্ন থাকবে, আগামী নির্বাচনের জন্য প্রশাসনে প্রয়োজনীয় রদবদল কারা করবে? সংবিধান অনুসারে অবশ্যই বর্তমান সরকার। তাদের রদবদল কি একটি আস্থার পরিবেশ আনতে সক্ষম হবে? সন্দিহান প্রায় সবাই। এ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি কি নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া হবে? আগের কমিশন বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়েই এ দায়িত্ব নিজেরা নিতে আইনি বিধানের একটি প্রস্তাব রেখেছিল। বর্তমান কমিশন বলছে, তা অপ্রয়োজনীয়। তা হলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার? কিন্তু এর কাঠামোটা তো এখনো অজানা। আবার বহাল থাকছে জাতীয় সংসদ। তাহলে প্রতিকার কীভাবে পাওয়া যাবে?
সবদিক বিবেচনা নিয়ে বলা যায়, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি সফল সংলাপ—অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের সূত্রও বেরিয়ে আসতে পারে। এতে নির্বাচনকালীন সরকারকাঠামো ও নিরপেক্ষ প্রশাসনের রূপরেখাও থাকারই কথা। উভয় পক্ষকেই কিছু না কিছু ছাড় দিতে হবে। আমরা যেন ভুলে না যাই, সময়ের এক ফোঁড় আর অসময়ের দশ ফোঁড়। জেদাজেদি সরকার বা বিরোধী দল কারও জন্যই সুফল দেয় না। যেমনটা দেয়নি ২০০৬-এর শেষে এবং ২০০৭-এর সূচনায়।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
আমার মূল প্রতিপাদ্য সংসদ নির্বাচনকালে জনপ্রশাসনের ভূমিকা কী হবে? কী হওয়া উচিত সে সম্পর্কে সবাই এক বাক্যে বলবেন, তারা স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অধীনে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবে। কিন্তু আমাদের জনপ্রশাসনে যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, সরকার পরম্পরা প্রতিষ্ঠানগুলোকে যেরূপ বিবেচনাহীনভাবে বিপন্ন করেছে; তার ফলে সে নির্বাচনের আগে এগুলোর ওপর সব রাজনৈতিক দলের আস্থা সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে। পরিবর্তিত যে সাংবিধানিক ব্যবস্থা তা পুরোপুরি বহাল থাকলে কীভাবে তা সম্ভব হবে, বোধগম্য হচ্ছে না। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে যে দলই ক্ষমতায় গেছে, তারা তাদের অনুসারী বলে দাবিদার কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবিতে নিয়ে আসছে। পদোন্নতিতেও তাঁদেরই প্রাধান্য। এ সময়ের শেষার্ধে প্রবণতাটা প্রকট হয়েছে। এসব কর্মকর্তার কারও কারও আচরণ রাজনীতিবিদদের চেয়েও অধিক রাজনীতিক। আবার অনেকেই বসন্তের কোকিলের মতো সময়ান্তরে হয়ে পড়েন অপর দলটির বড় ধরনের সমর্থক। নির্বাচন পরিচালনায় মাঠ প্রশাসনের সংশ্লিষ্টতা ও ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে গত প্রায় এক যুগ জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে নতজানু। কেউ একটু প্রতিবাদী হলেই শুধু বদলি বা ওএসডি করাই নয়, ক্ষেত্রবিশেষে শারীরিকভাবেও লাঞ্ছিত হয়। এসব ঘটনার প্রতিকারই হয় না। তাই তাঁদেরই কিছু সুবিধাবাদী শুধু টিকে থাকার জন্য অধিকতর রাজনৈতিক ভূমিকায় নেমে পড়েছে। যদিও নির্বাচনকালে তাঁরা নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকবেন, তবে প্রশাসনের প্রয়োজনীয় রদবদল ব্যতিরেকে জাতীয় নির্বাচনের বিশাল প্রেক্ষাপটে কমিশনের পক্ষে এঁদের নিরপেক্ষ রাখা কতটা সম্ভব হবে—এ নিয়ে সংশয় রয়েছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই এ দেশে জাতীয় নির্বাচনকালীন একটি নির্দলীয় সরকার প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯০ সালে। সেটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় একটি ব্যর্থ নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ১৩শ সংশোধনীর মাধ্যমে। ১৯৯০ সালে নির্দলীয় সরকার ক্ষমতা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ কতিপয় সচিব, আইজিপি থেকে জেলা ও উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে পরিবর্তন আনে। তেমনিভাবে ১৯৯৬ ও ২০০১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারও একই ধারা অনুসরণ করে। ২০০৭-এর দীর্ঘমেয়াদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়েও যথোচিত পরিবর্তন করা হয় ২০০৮-এর নির্বাচন সামনে রেখে। চারটি নির্বাচনই সফল হয়েছে। যদিও এ দেশের দুর্ভাগ্যজনক রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য চারটি নির্বাচনেই পরাজিত দল কারচুপির অভিযোগ আনে। তবে দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পায় এসব নির্বাচন এবং এর মাধ্যমে গঠিত নির্বাচিত সরকার। এ নির্বাচনগুলোর সাফল্যের কিছুটা অংশীদার এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সামরিক বাহিনীর উপস্থিতিও অত্যন্ত সহায়ক বলে বিবেচিত হয়।
নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনার সামগ্রিক দায়িত্বে থাকে। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা অত্যন্ত মুখ্য রূপে থেকে যাবে। কিছুসংখ্যক চিহ্নিত কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার ঢিলেমি আর কোথাও কোথাও বাড়াবাড়ি সে এলাকার ভোটের ফলাফলে নির্ণায়ক প্রভাব ফেলতে পারে। ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তাদের তালিকা শেষ মুহূর্তে রাতারাতি পরিবর্তন ও বিশেষ কারও প্রতি অনুগত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তি পাল্টে দিতে পারে পরিস্থিতি। দেশব্যাপী এক দিনে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে এ ধরনের অনিয়ম কমিশনের নজরে আনতে আনতেই ভোট গ্রহণ শেষ হয়ে যাবে। কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তারা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকলেও সে মহাযজ্ঞে তাঁরাও একাকার হয়ে যাবেন না, এ নিশ্চয়তাও কি দেওয়া যায়? বর্তমান সরকারের সময়কালে বেশ কয়েকটি উপনির্বাচন ও সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে তাদের প্রার্থী পরাজিত হয়েছে। নির্বাচনগুলোও হয়েছে নিরপেক্ষ ও সফল। তেমনটা কিন্তু এখনকার প্রধান বিরোধী দল ক্ষমতায় থাকার সময় ঢাকা ও চট্টগ্রামে প্রথম মেয়র নির্বাচনে তাদের প্রার্থী পরাজিত হয়েছিল। কিন্তু তারাই পরবর্তী সংসদ নির্বাচন করতে গিয়ে কার্যত ব্যর্থ হয় এবং দ্রুততার সঙ্গে সংবিধান সংশোধন করে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়। এখানে আমাদের স্মরণে রাখা দরকার, উপনির্বাচন বা কোনো সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে সমাবেশ ঘটানো হয় আর গণমাধ্যমের যে নজরদারি থাকে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তা রাখা সম্ভব হবে না।
আরেকটি দুর্ভাগ্য, রাজনৈতিক জগতে রাজনীতিবিদেরা ক্রমান্বয়ে পিছু হটছেন। তাঁদের স্থান দখল করছেন ব্যবসায়ী ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা। এতে আইনে বাধা নেই। তবে মূলত তাঁরাই রাজনৈতিক কার্যক্রমে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। যতটুকু জানা যায়, উভয় শিবিরেই বেশ কিছু অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বসে গেছেন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে। তাঁদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কর্মরতদের কারও কারও যোগাযোগের খবরও পাওয়া যায়। যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের কম্পিউটারে প্রশাসন ও পুলিশে কর্মরত সব কর্মকর্তার তথ্য রয়েছে বলেও জানা যায়। সেসব তথ্য হচ্ছে, কে তাঁদের সমর্থক আর কে বিরোধী। নিরপেক্ষ শব্দ তাঁদের অভিধানে নেই। তবে আছে সন্দেহভাজন বলে অন্য একটি শব্দ। কেউ নিরপেক্ষ থাকতে পারে, এটা তাঁরা বিশ্বাস করতে অনিচ্ছুক। এ যেন স্নায়ুযুদ্ধ যুগের মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন ফস্টার ডালেসের তত্ত্ব, ‘হয় তোমরা আমাদের পক্ষে অথবা বিপক্ষে।’ ৯/১১-এর পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশও একই তত্ত্ব আবার সামনে নিয়ে আসেন। আর দিন যত যাচ্ছে আমাদের জনপ্রশাসনে এ তত্ত্বটাই প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। তাই অনেকে আত্মরক্ষার্থে একটি শিবিরকে আঁকড়ে ধরছে এবং প্রধানত ক্ষমতায় যারা আছে তাদের। কিন্তু আমার দেখামতে বাস্তব হচ্ছে, বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব সম্পাদনে নিরপেক্ষ থাকতে চান। নির্বাচনকালে তো বটেই। অনুকূল পরিস্থিতি পেলে থাকেনও। নচেৎ এসব কর্মকর্তার দ্বারা চার-চারটি সফল জাতীয় নির্বাচন কীভাবে সম্ভব হলো। আবার প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনের অধীনে এ কর্মকর্তারাই ব্যর্থ নির্বাচনগুলোর দায়ভারও নিয়েছেন।
এখন প্রশ্ন থাকবে, আগামী নির্বাচনের জন্য প্রশাসনে প্রয়োজনীয় রদবদল কারা করবে? সংবিধান অনুসারে অবশ্যই বর্তমান সরকার। তাদের রদবদল কি একটি আস্থার পরিবেশ আনতে সক্ষম হবে? সন্দিহান প্রায় সবাই। এ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি কি নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া হবে? আগের কমিশন বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়েই এ দায়িত্ব নিজেরা নিতে আইনি বিধানের একটি প্রস্তাব রেখেছিল। বর্তমান কমিশন বলছে, তা অপ্রয়োজনীয়। তা হলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার? কিন্তু এর কাঠামোটা তো এখনো অজানা। আবার বহাল থাকছে জাতীয় সংসদ। তাহলে প্রতিকার কীভাবে পাওয়া যাবে?
সবদিক বিবেচনা নিয়ে বলা যায়, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি সফল সংলাপ—অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের সূত্রও বেরিয়ে আসতে পারে। এতে নির্বাচনকালীন সরকারকাঠামো ও নিরপেক্ষ প্রশাসনের রূপরেখাও থাকারই কথা। উভয় পক্ষকেই কিছু না কিছু ছাড় দিতে হবে। আমরা যেন ভুলে না যাই, সময়ের এক ফোঁড় আর অসময়ের দশ ফোঁড়। জেদাজেদি সরকার বা বিরোধী দল কারও জন্যই সুফল দেয় না। যেমনটা দেয়নি ২০০৬-এর শেষে এবং ২০০৭-এর সূচনায়।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
No comments