গাজীপুর উপনির্বাচন এবং রাজনীতিতে জনকল্যাণের সুবাতাস by ড. হারুন রশীদ
রাজনীতিসচেতন মানুষের দৃষ্টি এখন গাজীপুরের দিকে। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর গাজীপুর-৪ আসনের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নানা নাটকীয়তা এবং ঘটনাপ্রবাহের পর সোহেল তাজের পদত্যাগপত্র গৃহীত হওয়ায় আসনটি শূন্য হয়। এর পর পরই সম্ভাব্য প্রার্থীরা মাঠে নেমে পড়েন।
বিশেষ করে বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার গ্রীন সিগন্যাল পেয়ে ব্রিগেডিয়ার (অব) আ স ম হান্নান শাহ এই আসনে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দেন। সাংবাদিকদের কাছে এ ব্যাপারে তিনি সুস্পষ্ট করে বলেন, নেত্রী তাঁকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। এর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সংসদীয় বোর্ডের সভায় বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের কন্যা সিমিন হোসেন রিমিকে গাজীপুর-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেন। সভায় তিনি রিমির হাতে আওয়ামী লীগের মনোনয়নও তুলে দেন আনুষ্ঠানিকভাবে। বস্তুত এর পর থেকেই দ্রুত দৃশ্যপট পাল্টে যেতে থাকে। সম্ভাব্য অনেক প্রার্থীই তাঁদের আগাম নির্বাচনী প্রচারণা থেকে সরে দাঁড়ান। মহাজোটের শরিক দল জাতীয় পার্টি এই নির্বাচনে তাদের প্রার্থী দেয়ার কথা বললেও এ সংক্রান্ত সভা শেষে পার্টির পক্ষ থেকে জানানো হয় উপযুক্ত প্রার্থী না পাওয়া যাওয়ায় জাতীয় পার্টি এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে না। বিএনপি সুস্পষ্ট কোন কারণ না দেখিয়েই এই নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। অবশ্য বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার পেছনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গটি নিয়ে আসা হয়েছে। তাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এ সরকারের অধীনে তারা কোন নির্বাচনে যাবে না। যেহেতু তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন করছে। একদিকে বিএনপি বলছে সরকার তাদের রেখেই জাতীয় নির্বাচনে যাওয়ার পাঁয়তারা করছে আবার নিজেরাই নির্বাচন বর্জনের রাজনীতি অব্যাহত রেখেছে। এর আগে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী এ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকারকে মধ্যরাতে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেন বেগম খালেদা জিয়া। এর পর কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও তারা অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। যদিও দলীয় নির্দেশ অমান্য করে স্থানীয় বিএনপি নেতা মনিরুল হক সাক্কু নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং তিনি মেয়র নির্বাচিত হন। বিএনপি তাকে দল থেকে বহিষ্কার করলেও নির্বাচিত হওয়ার পর তাকে আবার দলে ফিরিয়ে নেয়। বিএনপি একদিকে বলছে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না। এ জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা কোন নির্বাচনে যাবে না। আবার নিজ দলের প্রার্থী জিতলে সে ক্ষেত্রে তারা চুপ থাকছে। গাজীপুর উপনির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি প্রমাণ করতে পারত যে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হয় কিনা। বিএনপি বার বারই এই সরকারকে আগাম নির্বাচন দিয়ে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের কথা বলছে। সেক্ষেত্রে গাজীপুরের উপনির্বাচনে অংশ নিয়ে নিজেদের জনপ্রিয়তাটাও তো যাচাই করে নিতে পারত তারা। বিশেষ করে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন নতুন নির্বাচন কমিশনের অধীনে এটাই প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই কমিশন ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে আগামী সংসদ নির্বাচনে ইভিএম পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে না; যেটা বিএনপির অন্যতম একটি দাবি ছিল। দেখা যাচ্ছে, কমিশন ইতোমধ্যেই বিএনপির একটি বড় দাবি মেনে নিয়েছে। তো সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বর্তমান কমিশন কতটা ভূমিকা রাখতে পারে সেটি দেখতে হলেও তো এই নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ করা উচিত ছিল। নাকি রিমির মতো একজন শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী দেখে নির্বাচনে না জেতার আশঙ্কা থেকে তারা সরে দাঁড়িয়েছে? আসলে এই বর্জনের তো কোন মানে নেই। শুরু থেকেই তো বিএনপি সংসদ বয়কট করে চলেছে। তাতে কাজের কাজ কিছু কি হয়েছে। না রাজপথে, না সংসদে কোন জায়গাতেই তো বিরোধী দল হিসেবে জনমানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি বিএনপি।
আজ ৪ সেপ্টেম্বর সংসদের অধিবেশন বসছে। এই অধিবেশনেও যে বিএনপি অনুপস্থিত থাকবে সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বিরোধী দলকে সংসদে যোগ দেয়ার জন্য বার বারই অনুরোধ করা হচ্ছে। কিন্তু বিরোধী দল বরাবরের মতোই পূর্বশর্ত জুড়ে দিয়েছে কেবল তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নে আলোচনার নিশ্চয়তা দিলেই তারা সংসদে যোগদান করবে। এটা কোন নীতি হতে পারে না। জনপ্রতিনিধি হিসেবে সংসদে যোগ দেয়াই হচ্ছে বিরোধী দলের কাজ। এক্ষেত্রে কোন শর্তারোপ করা গণতান্ত্রিক রীতিসিদ্ধ নয়। বিরোধী দল বছরের পর বছর সংসদ বর্জন করে যাবে, এটা কোন কাজের কাজ নয়। সংসদকে কার্যকর করতে হলে সকলের অংশগ্রহণেই তা করতে হবে। সংসদ যদি কার্যকর না হয় তাহলে তার দায় বিরোধী দলও এড়াতে পারবে না। আর সংসদ কার্যকর না হলে গণতন্ত্রের ভিত্তিও মজবুত হবে না। এবং গণতান্ত্রিক আবহ ছাড়া রাজনীতিরও কোন চরিত্রগত পরিবর্তন হবে না। আর সেটি না হলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা কমবে না। ফলে বাধাগ্রস্ত হবে সকল ধরনের ইতিবাচক কর্মকা-, উন্নয়ন-অগ্রগতি। এ জন্য সকল পক্ষকে অবশ্যই দায়িত্বশীলতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে একটি গুণগত পরিবর্তনের জন্য।
সংসদে যোগ দেয়ার ব্যাপারে বিরোধী দল নানা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকে। ভাবখানা এমনÑ ৯০ দিনের ‘ফাঁড়া’ কাটানোর জন্য মাঝেমধ্যে গেলেই হলো। অথচ তারা বেতন-ভাতা নেবে। সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে। গাড়ি নেবে। বাড়ি নেবে। বিদেশ ভ্রমণ করবে সরকারী খরচে। এসবে তাদের কোন লজ্জা-সঙ্কোচ নেই। তারা গাছেরটাও খাবে আবার তলারটাও। সংসদে না গিয়েও সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে আবার আন্দোলনের নামে রাজপথ গরম করবে। মানুষের দুর্ভোগ বাড়াবে। হরতাল ডাকবেÑএটা কোন্ নীতি?
জাতীয় নির্বাচন কি ধরনের সরকারের অধীনে হবে তা নিয়ে সরকার ও বিরোধী দল মুখোমুখি। দিন যতই যাচ্ছে এ নিয়ে পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য রাজনীতিবিদদের আরও দায়িত্বশীল হওয়ার কথা বলা হচ্ছে বিশেষজ্ঞ মহল থেকে। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে এর কোন বিকল্প নেই। আমাদের দেশে গণতন্ত্র বার বার হোঁচট খেয়েছে। গণতন্ত্রের জন্য এদেশের মানুষকে রক্ত দিতে হয়েছে। অথচ লাখ লাখ মানুষের রক্তস্্েরাতের বিনিময়েই এদেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীন দেশে গণতন্ত্র মজবুত ভিত্তি পাবে এমনটাই ছিল প্রত্যাশিত। কিন্তু স্বাধীনতার পর গণতন্ত্র বার বার বিপন্ন হয়েছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ভূলুণ্ঠিত করে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ক্ষমতা দখল করেছে। চেপে বসা স্বৈরশাসন গণতন্ত্রকে গলাটিপে হত্যা করেছে। কিন্তু স্বৈরাচারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এদেশের মানুষ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছে। অথচ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সময়ও গণতন্ত্র বিকশিত হওয়ার পথ খুব একটা সুগম হয়নি। উল্টো নেতানেত্রীদের মধ্যে পরস্পরের বিরুদ্ধে দোষারোপ এবং অসহনশীল মনোভাবই দেশের রাজনীতির প্রধান চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। দায়িত্বশীল পদে থেকেও এমনসব আচরণ, কথাবার্তা বলা হয় যা সঙ্কটকে আরও ঘনীভূত করে তোলে। এতে গণতান্ত্রিক চর্চা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু মানুষজন দেখতে চায় জাতীয় স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলো অভিন্ন সুরে কথা বলছে এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। বিশেষ করে সভাসমাবেশের নামে রাজপথ গরম না করে, জনভোগান্তি না বাড়িয়ে, মাঠে-ময়দানে দায়দায়িত্বহীন বক্তব্য না দিয়ে সংসদে গিয়ে সকল বিষয়ে আলোচনা করা হোক, সংসদই হোক সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু গণতন্ত্রকামী মানুষের চাওয়া এমনই।
কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক রীতিনীতির পথ থেকে বেরিয়ে এসে বিএনপি বয়কট-বর্জনের পথেই চলছে। গাজীপুর উপনির্বাচনে অংশ না নেয়াটা যার সর্বশেষ উদাহরণ। উপনির্বাচনে অংশ নিলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিটি অসার হয়ে যাবে; এ ভয়ে তারা ভীত। অথচ এটা সম্পূর্ণ অমূলক একটি বিষয়। কারণ বর্তমান সরকারের অধীনেই স্থানীয় সরকারের পাঁচ হাজারেরও বেশি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেসব নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছে। তাদের অনেক প্রার্থী তাতে জয়লাভ করেছে। সংসদের উপনির্বাচনেও তারা অংশ নিয়েছে। সেই নির্বাচনে তাদের প্রার্থী বিজয়ী হয়েছে। কাজেই এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার কথা বলে গাজীপুর উপনির্বাচনে অংশ না নেয়ার কোন মানে হয় না। গণতন্ত্রে নির্বাচনই মূলকথা। গণতন্ত্রে বিশ্বাস করলে সেই দলকে অবশ্যই নির্বাচনমুখী হতে হবে।
মানুষ এখন আর রাজনীতির নামে হিংসা, হানাহানি দেখতে চায় না। তারা চায় আসন্ন জাতীয় নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হোক এবং সকল দল তাতে অংশ নিক। জয়-পরাজয় মেনে নিতেও তারা কোন কার্পণ্য করবে না; এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।
গাজীপুর উপনির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন লাভের পর সিমিন হোসেন রিমি গণমাধ্যমকে বলেছেন, তিনি একটি বার্তা দিতে চান সেটি হচ্ছে ‘রাজনীতি মানে জনকল্যাণ, মানুষের সেবা।’ জাতীয় রাজনীতির ঘূর্ণায়মান পরিস্থিতিতে এই বার্তার আজ বড় বেশি প্রয়োজন।
harun_press@yahoo.com
No comments