আর কত দিন এভাবে হত্যা-আত্মহত্যা? by কাজী সুফিয়া আখ্‌তার

মা-বাবা কিভাবে সজ্ঞানে সন্তানদের হত্যা করে, বিক্রি করে দেয়! একবারও এ বিষয়ে চিন্তা করতে পারি না আমি। পত্রিকায় এসব খবর পড়ে অদেখা-অচেনা নিষ্পাপ বাচ্চাগুলোর জন্য হৃদয় ভেঙে দুমড়ে-মুচড়ে যায়। হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়। এ ধরনের খবর পড়ে সারা দিন একরকম অসুস্থতাবোধে আক্রান্ত হই। কাজকর্মে ভুল হয়।


নির্ধারিত কর্ম সম্পাদনে পিছিয়ে যাই। মানবিক বোধসম্পন্ন অনেক মানুষেরই এমন হয়। এমন হওয়া স্বাভাবিক। আমাদের মতো দেশে অনেক মানুষই গরিব এবং বেকার। তাদের বেশির ভাগেরই সংসার চালানোর সামর্থ্য নেই। ছেলেমেয়ের আবদার মেটানোর সক্ষমতা নেই। কিন্তু তারাও ছেলেমেয়েদের বিষ খাইয়ে, নদীতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে, পানিতে চুবিয়ে মেরে ফেলে না। সন্তানদের নিয়েই অভাবের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে।
কিছুদিন আগে একজন বাবা ঈদের নতুন জামার দাবি মেটাতে না পেরে ছেলেমেয়েকে নদীতে ছুড়ে ফেলে দেন। প্রথমে মেয়েকে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফেলে দেয়। তা দেখে ছেলেটা দৌড়ে পালাতে চেয়েছিল। আহা রে, ঘাতক জনকের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারল না সে। হৃদয়হীন লোকটা তাকেও দৌড়ে ধরে নদীর স্রোতে ফেলে দিয়েছিল। ঈদের জামার আবদার তাদের কাল হলো। এই পৃথিবীর সব আলো, সব রং, সব উৎসব পেছনে ফেলে, জীবনের সোপানে পা রাখার আগে তারা বাধ্য হলো নদীর জলের স্রোতের তোড়ে চিরতরে তলিয়ে যেতে।
আরেকটি খবর। 'অভাবের তাড়নায় বাগেরহাটে দুই মেয়েকে চুবিয়ে মারলেন বাবা' (কালের কণ্ঠ, ২৮ আগস্ট ২০১২)। সাত বছরের নিশামণি ও পাঁচ বছরের তিষামণিকে স্ত্রী ও শ্বশুরের সঙ্গে ঝগড়া করে বাবাবাড়ির ঘেরের পানিতে চুবিয়ে মারলেন। সন্তানের ভয়ার্ত মুখ দেখেও জনকের হৃদয়ে এতটুকু দয়ার সঞ্চার হলো না। এমন নিষ্ঠুর! অভাবের তাড়নায়, স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করে, স্ত্রীকে চিরজীবনের জন্য শাস্তি দেওয়ার অন্তর্গত গোপন ইচ্ছা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে আপন সন্তান হনন! একজন মা তো কখনো তাঁর সন্তানের কথা ভুলতে পারবেন না। সারা জীবন দুই কাঁধে বয়ে বেড়াবেন আদরের সন্তানের লাশ। বুকের গহিনে নিশিদিন চলবে দহন। মিথ্যে হয়ে যাবে তাঁর বেঁচে থাকা। এই পৃথিবীর কোনো স্থানের কোনো সন্তানের যেন এমন অমানুষ বাবা না হয়।
যে মায়েরা নিজ হাতে নিজের সঙ্গে নিজের সন্তানদের মেরে ফেলেন, তাঁরাই বা কেমন মা? কেমন করে এমন কঠিন কাজটি তাঁরা করেন? মানসিক বিপর্যয়ের কোন তলানিতে এসে দাঁড়ালে একজন মা এমন নিষ্ঠুর কাজটি করতে পারেন! একদিন যে সন্তান তাঁর দেহের অভ্যন্তরে বিন্দু থেকে তিল তিল করে বেড়ে উঠেছে, অনেক যন্ত্রণা সয়ে যে সন্তানকে তিনি জন্ম দিয়েছেন, লালন-পালন করেছেন তাকে মেরে ফেলতে; তার খাবারে বিষ মেশাতে তাঁর হাত একটুও কেঁপে ওঠে না! দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে ছেলেমেয়ে নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে সন্তানদের মেরে ফেলা অনেক কঠিন কর্ম নয় কি? স্বামীর ওপর এ কেমন অভিমান? স্বামীর ওপর এ কেমন ক্ষোভ? প্রতিশোধ নেওয়ার এ কি নিষ্ঠুর কৌশল? নিজের জীবন, অবুঝ সন্তানের জীবন নিয়ে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়ার মাশুল গুনতে হবে? বাংলাদেশের অভাবী পরিবারগুলো এতটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে যে মা আত্মহত্যা করলে তাঁর সন্তানদের দেখার কেউ থাকবে না? জানি, মা বেঁচে না থাকলে সন্তানদের বেঁচে থাকা খুব কষ্টের হয়। কিন্তু বেঁচে থাকার চেয়ে সুন্দর, কাঙ্ক্ষিত আর কিছু কি আছে এই ধরাধামে? একজন মা সন্তান নেবেন কি নেবেন না, এটা তাঁর সিদ্ধান্তের বিষয়। যদিও বাংলাদেশের বেশির ভাগ নারীর সন্তানধারণের ক্ষেত্রে তাঁর সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার পরিবার ও সমাজ-স্বীকৃত নয়। সম্প্র্রতি 'বারসিক' কর্তৃক পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, সন্তান নেবেন কি নেবেন না, এই সিদ্ধান্তের আগে গ্রামের বিবাহিত নারীর ৪৫ শতাংশ প্রথম সন্তান ধারণ করেছেন। সন্তান ধারণ ও জন্মদান নারীর অধিকার। কিন্তু সন্তান বিক্রি ও হত্যা করার অধিকার মা-বাবা কারো নেই। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ-বিবাদ হতে পারে। হয়। কিন্তু এর জন্য মরে যেতে হবে কেন? তা-ও আবার বাচ্চাদের নিয়ে? মানুষ এত অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে কেন? নিজেকে এমন অসহায় মনে করে কেন? আমাদের পারিবারিক বন্ধন কি এতটাই আলগা হয়ে গেছে? মানুষের কেন আশ্রয় করার মতো কেউ থাকবে না? মানুষ মানুষের জন্য। তবে কি আমরা সামাজিক দায়িত্ব পালনে অনেক বেশি অবহেলা করছি? আমাদের নৈতিক এবং আদর্শিক অবক্ষয় দ্রুত ঘটে গেছে। আমরা স্বার্থপরের মতো নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকি। আশপাশের মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গে নিজেদের জড়াই না। তাই এক সারিতে ঘর থাকলেও আমরা বুঝতে পারি না, কখন কে মর্মান্তিক এক দুরভিসন্ধি আঁটে। একসঙ্গে ছটফট করতে করতে নীরব হয়ে যায় তিনটি প্রাণ।
অনেক দিন আগে একজন মা তাঁর স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া ও অভিমান করে কয়েক মাসের বাচ্চা বুকের কাপড়ে বেঁধে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। যে পৃথিবীতে তিনি বঞ্চনার শিকার হলেন, সে পৃথিবীতে তিনি সন্তান রেখে যাওয়ার ভরসা পেলেন না। অথবা রেখে যেতে চাইলেন না। স্বামীর প্রতি অবিশ্বাসের কারণে পুরো পৃথিবীর প্রতি বিরূপ হয়ে উঠলেন। সন্তানকেও তাই অন্যায়ভাবে, অমানবিক নিষ্ঠুরতায় নিজের সঙ্গে জড়ালেন। ঠিক একই কাজ করেছেন কাফরুলের উত্তর ইব্রাহিমপুরের জাহানারা আক্তার। আত্মজা হাওয়া ও শারমিনকে বিষ খাইয়ে তিনি নিজে বিষ খেয়ে এই পৃথিবীর সঙ্গে সব লেনদেন চুকিয়ে দিলেন। আত্মহত্যা পাপ। যে জীবনের জন্য তিনি দায়ী না, সে জীবন নিজ হাতে শেষ করার অধিকার তিনি কোথায় পেলেন? তাঁর পাশে দাঁড়ানোর একটি মানুষও কি ছিল না? ফুটফুটে দুটি মেয়ের জীবন কেড়ে নেওয়ার কুবুদ্ধি তাঁকে কে দিল? চারপাশের মানুষ কেউ কিছু বুঝতে পারল না, এটা কিভাবে হয়? আমাদের শৈশবে আমরা তো আশপাশের দু-চার বাড়িতে দুপুরে কী রান্না হয়েছে জানতাম। সামাজিকতা, নৈতিকতা ভুলে আমরা, মানুষরা অনেক বদলে গেছি। ছোট করে ফেলেছি আমাদের পৃথিবী। স্বামী-স্ত্রী আর ছেলেমেয়ে- এই আমাদের পৃথিবী। মানুষের ভেতরে মনুষ্যত্ববোধ কমে গেছে। এর খেসারত মানুষকে এভাবে দিতে হচ্ছে, নাকি ৫০ বছরে পৃথিবী অনেক বদলে গেছে। নারী ও শিশুর বাসযোগ্য থাকছে না। তাই মায়েরাও নিষ্ঠুরতার চরম পথ বেছে নিচ্ছেন। পুরুষতান্ত্রিকতার স্বরূপটি তাঁর জানা আছে বলে মেয়েসন্তানদের আর পৃথিবীতে রেখে যেতে চান না।
অভাব আর জন্মের উৎসব অনেক পরিবারেই হাত ধরাধরি করে চলে। অভাবের কারণে সন্তান হত্যা কোনো যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য নয়। যারা এটা করে তাদের শাস্তি হওয়া দরকার। মানুষ সব সময় মানুষের পাশে। নতুন করে মানুষ কবে আবার মানুষের ভরসাস্থল হয়ে উঠবে? পরিবার সব মানুষের সুখ-দুঃখ-আনন্দ-আশ্রয়ের কেন্দ্রস্থল। সেই পরিবার যদি বসবাসের অযোগ্য হয়ে ওঠে, বিষময় হয়ে ওঠে, তবে মায়েরা সন্তানদের নিয়ে 'বাহির পানে' জীবনে বেঁচে থাকার পথ খুঁজবেন। অনেক সংগঠন আছে আপনাদের সাহায্য করার জন্য। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখবেন। স্বামী পরকীয়া করলে স্ত্রী আত্মহত্যার কথা চিন্তা করবেন না। মৃত্যুতে আশ্রয় খুঁজবেন না। এতে নিজের ক্ষতি ছাড়া কারো কোনো লাভ হয় না। স্বামী ব্যক্তিটির তো নয়ই। সুস্থভাবে বাঁচার চিন্তা সব সময় সব মানুষের করা উচিত। আর মায়েদের ওপর যুগে যুগেই এই দায়িত্ব বেশি বর্তেছে। আজ সময় এসেছে সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকার সুযোগ ও অধিকার চাওয়ার। মূর্খের মতো আত্মহত্যা নয়। আর কোনো মা এভাবে আত্মহত্যা করবেন না। আর কোনো মা-বাবা যেন এভাবে অভাবের কারণে বা স্বামীর পরকীয়ার কারণে তাদের সন্তানদের হত্যা না করেন। কোনো অজুহাতেই সন্তানদের হত্যা করা যেন না হয়। সবার বেঁচে থাকার অধিকার আছে। সেই অধিকার যেন কোনোভাবে ক্ষুণ্ন না হয়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের, সমাজের এবং ব্যক্তির করণীয় অনেক কিছু আছে। আমরা সবাই সেদিকে যেন দৃষ্টি দিই।
লেখক : লেখক ও গবেষক

No comments

Powered by Blogger.