গল্প- 'ঝড়ের রাতে' by প্রচেত গুপ্ত
অতিরিক্ত রকম নার্ভাস হয়ে পড়লে মানুষের শরীরে দু'রকম প্রতিক্রিয়া হতে পারে। হয় অল্প ঘাম হয়, নয়তো হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। অর্কর একই সঙ্গে দুটোই হচ্ছে।
কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে, আবার হাত পা ঠাণ্ডাও হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, শরীরের যাবতীয় গস্ন্যান্ড ফাংশন এলোমেলো হয়ে পড়েছে। তারা ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না। অর্ক এমনিতেই একজন নার্ভাস প্রকৃতির ছেলে। তারওপর ঘটনা যা ঘটেছে ততে সেই নার্ভাস ভাব বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। কপালের সঙ্গে, অর্কর নাকের দু'পাশেও ঘাম জমেছে এখন। শুধু হাত পা ঠাণ্ডা হয়নি, শিরদাঁড়ার ওপর দিয়ে চিন্চিনে ঠাণ্ডা ভাব একবার উঠছে, একবার নামছে।
সে শিমুলের দিকে তাকিয়ে বলল, 'এটা কী হল!'
সে শিমুলের দিকে তাকিয়ে বলল, 'এটা কী হল!'
শিমুল কাঁধের ব্যাগটা সোফার ওপর ছুঁড়ে ফেলে হাসি মুখে বলল, 'কোন্টা?'
শিমুল বেশিরকমের সুন্দরী। বড় বড় চোখ, টিকোলো নাক, টানা ভুরু আর এক মাথা কোঁকড়ানো চুলের মধ্যে একটা ঝলমলে ভাব রয়েছে। দেখলে মনে হয় না তার বয়স এখন চবি্বশ বছর তিনমাস, মনে হয় না মাত্র এক বছর হল সে মাল্টিন্যাশনাল এক ব্যাঙ্গে সিস্টেম প্রোগ্রামার হিসেবে চাকরিতে যোগ দিয়েছে এবং এক বছরের মধ্যেই প্রোমোশন পেয়েছে। মনে হয়, এই মেয়ের বয়স এখনও আঠেরো-উনিশ। কলেজে যাওয়ার জন্য এখনই মাথায় ঝুঁটি বেঁধে তৈরি হবে। ঝুঁটি বাঁধার সময় তাড়াহুড়ো করে মাথার ক্লিপ খুঁজবে। ক্লিপ খুঁজে না পেয়ে খোলা চুলেই ছুটবে। তারওপর আজ তার সাজগোজের মধ্যে একটা 'খুকি খুকি' ভাব রয়েছে। সাদা ক্যাপরির ওপর একটা নীল টপ পরেছে। টপের বাঁদিকে অল্প একটু নকশা। নকশা কলার থেকে কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় ফুলপাতা। কাছে এলে বোঝা যায় সেসব কিছু নয়। খানিকটা সুতোর হবিজাবি। সুন্দর মেয়ের গায়ে আছে বলে সেটাই চমৎকার লাগছে। শিমুলের পায়ে সি্নকার। সোফায় বসে পা দুটো লম্বা করে সামনে ছড়িয়ে দিল শিমুল। ছিপছিপে শরীরে একই সঙ্গে ক্লান্তি আর আলসেমির ভঙ্গি। ঘরের ঝলমলে আলোয় তার ক্যাপরি থেকে বেরিয়ে থাকা ফর্সা পা দুটো আকর্ষণীয় লাগছে।
অর্ক কোনওরকম আকর্ষণ বোধ করল না। উল্টে তার গা বিরক্তিতে চিড়বিড় করে উঠল। নিজের নার্ভাস ভাব গোপন করে রাগ রাগ গলায় বলল, 'মানে আবার কী, যা ঘটল তার কথা জিগ্যেস করছি।'
শিমুল ফের হাসল। হাসতে হাসতেই সোফার একপাশ থেকে অন্য পাশে গেল। সোফার গদি বড় আর নরম। সামান্য নড়াচাতেই যেন ঢেউ খেলে উঠে!
'আমাকে জিগ্যেস করছো কেন অর্ক? আমি তো কিছু ঘটায়নি।'
'তুমি হাসছো!' অর্ক অবাক হয়।
'হাসবো না তো কী করব? কাঁদবো?'
এবার 'হো হো' আওয়াজ করে হাসল শিমুল। যে চার-চাঁচটি কারণে অর্ক এই মেয়ের প্রেমে পড়েছে তার একটা হল এই হাসি। অর্ক হয়তো স্বীকার করবে না, কিন্তু সম্ভবত এটাই কারণ নম্বর ওয়ান। শিমুলের হাসি, শিমুলের আর অন্য সবকিছুর থেকে সুন্দর। যতবারই দেখে ততবারই অর্ক এত মুগ্ধ হয় যে, মনে হয় এই সৌন্দর্য সে জীবনে প্রথম দেখছে। কিন্তু এই মুহূর্তে মুগ্ধ হওয়ার বদলে তার রাগ হচ্ছে। কপালের ঘাম মোছার জন্য পকেট হাতড়ে রুমাল বের করতে গেল অর্ক। না, রুমাল নেই। উফ্!
শিমুল সামান্য সরে এসে আধো আধো গলায় বলল, 'অর্ক, তুমি কি রাগ করছো?'
অর্ক নাক দিয়ে ফোঁস করে আওয়াজ বের করে বলর, 'না, রাগ করব কেন? খুব খুশি হচ্ছি। তোমার এই দাদা বউদির কাণ্ড দেখে হাত তুলে ধেই ধেই করে নাচতে ইচ্ছে করছে। এতদূর ডাকার পরঃ কত বড় ইরেসপনসিবল্ হলে এরকম করে একবার ভেবে দেখেছো?'
সি্নকার পরা ডান পাটা বাঁয়ের ওপর আমরা করে তুলে দিয়েছে শিমূল। সেই পা নাড়াতে শান্ত গলায় বলল, 'এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না অর্ক। তুমি কণ্ডিশন ব্রেক করছো। বলেছিলে বিয়ের পর এক বছর আমার ওপর কোনও কারণে রাগ করবে না। এক সপ্তাহ কাটতে না কাটতে তুমি সেই শর্ত ভাঙছো।'
অর্কর রাগ আরও বাড়ল। শিমুূলর কথাটা মিথ্যে নয়। সত্যি সে এরকম বলেছিল। কিন্তু তাতে কী হয়েছে? প্রেম করার সময় মানুষ অনেক কথাই বলে। সেগুলো কেউ ধরে বসে থাকে না। বসে থাকা যায়ও না। তাছাড়া যেভাবে গত শনিবার দুম্ করে তাদের রেজিস্ট্রি হয়েছে তকে কি ঠিক 'বিয়ে' বলা যায়? বিবাহিত হলেও তারা এখনও একসঙ্গে থাকে না। এমনকি হাতে গোনা দু-একজন ছাড়া কেউ তাদের বিয়ের খবর জানেও না। শিমুলের বাবা-মা অন্য জায়গায় বিয়ের জন্য মেয়ের ওপর ভীষণ চাপ দিচ্ছেন। সেই কারণেই একটা 'লিগ্যাল প্রোটেকশন' নেওয়া হয়েছে মাত্র। আইন দিয়ে ঢাল বানানো। অর্কর এই বিয়েতে মোটেই সায় ছিল না। তার মতে এটা বাড়াবাড়ি হয়েছে। তাদের অপেক্ষা করা উচিত ছিল। সে যতক্ষণ না একটা চাকরি পায় সেই পর্যন্ত অপেক্ষা। একটা বেকার ছেলে কথা নেই বলা নেই বিয়ে করে বসল! ছিঃ ছিঃ। লোকে শুনলে কী বলবে? শিমুলের তাড়াহুড়োর জন্যই অবিবেচকের মতো কাজটা তাকে করতে হয়েছে। শিমুলের উচিত ছিল নিজের বাবা-মাকে বোঝানো। তাদের কাছ থেকে সময় নেওয়া। যতই সাক্ষী-সাবুদ নিয়ে গিয়ে সই করে আসুক অর্ক এটাকে 'বিয়ে' বলে মানতেই পারছে না।
মেয়ের বাপ-মায়ের অবশ্য দোষ নেই। হঠাৎই হাতের কাছে লোভনীয় এক পাত্র এসে হজির হওয়ায় তারা শিমুলের বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। ছেলের বয়স একটা বেশির দিকে। সেটা কোনও ব্যাপার নয়, ব্যাপার হল, পাত্র প্রবাসী। আমেকিার ফেমিংহাম শহরে নিজের ব্যবসা ফেমিংহাম বস্টন থেকে মাত্র এক ঘন্টার ড্রাইভ। বিরাট গ্রেসারি শপ শুনতে মুদির দোকান মনের হলেও পাত্রবাবুর পয়সাকড়ি অগাধ। তেল, ডাল নুন থেকে শুরু করে আখের গুড় পর্যন্ত কী না পাওয়া যায় সেখানে। আসলে এই ছেলের রয়েছে ফেলে যাওয়া বাংলার প্রতি হাবুডুবু ধরনের প্রেম! পা বিদেশে, মন বাংলায়। নিজের জন্য পাত্রী খুঁজতে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিল- বাঙালী, ঘরোয়া, কমবয়সী, গৃহকর্মে নিপুণা, প্রকৃত সুন্দরী পাত্রী চাই। রবীন্দ্রসঙ্গীত জানা বাধ্যতামূলক শাক, ওল, মানকচু, থোড় ইত্যাদি রন্ধন প্রণালী সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। তৎসহ বড়ি তৈরিতে পারদর্শিতা থাকলে ভাল হয়। প্রাচুর্যের কোনো অভাব নেই। পাত্রের নিজের তিনটি গাড়ি এবং একটি ভ্যান রয়েছে। বাড়ির ছাদে সুইমিং পুল। তাতে হট ওয়াটারের ব্যবস্থা। বাগানে টেনিস কোর্ট।
বিজ্ঞাপন খুবই ইন্টারেস্টিং। আমেরিকাবাসী পাত্রের মানকচু স্পেশালিস্ট বউ চাওয়া সহজ কথা নয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই শিমুলের মা বিশেষ উৎসাহ বোধ করলেন। ছেলের শাকপাতা, বড়ি, রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি দরদ এবং ব্যাঙ্ক ব্যালান্স তাকে মুগ্ধ করল। তিনি গোপনে মেয়ের ছবিসহ সিভি মেলে পাঠিয়ে দিলেন। যদিও বড়ি তৈরি এবং শাক রান্না বিষয়ে শিমুল কিছুই জানে না। কার্যত মাইক্রোওভেনে দু-একটা শখের খাবার তৈরি ছাড়া সে রান্নাবান্নার কিছু জানেই না। জানতে চায়ও না। মেয়ের মায়ের অবশ্য তাতে অবশ্য কিছু এসে যায় না। কথাবার্তা এগোলে এসব শেখাতে কতক্ষণ? সাত থেকে দশদিনের একটা ক্র্যাশ কোর্সে হয়ে যাবে। সন্টলেকে ছোটো বোনের ননদের বড়িতে না হয় দিন কতক গিয়ে থাকবে। সেই মেয়ে নিরামিষ রান্নাবান্নায় এক্সপার্ট। ঝটপট শিখিয়ে দেবে। শিমুলের মাথাও পরিষ্কার। কম্পিউটার নাড়াঘাটায় যে এত ওস্তাদ, তার ওলকচু, মানকচু ম্যানেজ করতে কতক্ষণ? তিনি নিজেও যে একেবারে কিছু পারেন না এমন নয়। যদিও সংসারে এসব খাওয়ার রোকের খুবই অভাব। শিমুল তো ছোঁয়েই না, শিমুলের বাবারও খাওয়া দাওয়ায় আবদার নেই। ফরে বহু বছর তাকে আর এসব করতে হয় না। করতে হলেও একেবারে ন'মাসে ছ'মাসে। এছাড়া গানের ব্যাপারটাও আছে। ডিপেস্নামা, ডিগ্রি না থাকলেও শিমুলের গানের গলা ভালো। স্কুলজীবনে সিনথেসাইজার কিনেছিল শখ করে। কলেজ পর্যন্ত টেনেছিল। অক্টোপাস না হিপোপটেমাস কী যে ছাইভস্ম নামে একটা ব্যাণ্ডে গানও গেয়েছে ক'দিন। গান তো নয়, চিৎকার। সেসব বন্ধ হয়েছে অনেক বছর। তবে এখনও গুনগুন করে খাল গলায় মাঝে মাঝেই গান করে। তার মধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীত দু-একটা থাকে বৈকি। সব থেকে বড় কথা হল, বিজ্ঞাপন দেখেই ছেলের মন বোঝা যাচ্ছে। এটা খুব বড় জিনিস। মানুষ দেখেও আজকাল আর মানুষের মন বোঝা যায় না। তাকে ধরা যায় না। সেই জায়গায় মাত্র দু-এক লাইনেই ছেলে ধরা দিয়েছে। এই ছেলে 'হীরের টুকরো' না হয়ে যায়ই না। দেখাই যাক না একবার। এইসব ভেবেই মেয়ের ফটো পাঠিয়ে দেওয়া হল সুদূর আমেরিকায়। তিনদিনের মাথায় উত্তর। ফটো পাত্রের পছন্দ। কলকাতায় এসে ফাইনাল কথা বলতে চায়। তবে একটা খুব কড়া। বিয়ের পর মেয়ের কিছুতেই চাকরি-বাকরি করা চলবে না। ঘর সংসারে মন দিতে হবে যা এতদিন শিমুলের কাছে তার মা-বাবা গোপন করেছিল, তা এবার বলতেই হল।
তারপর থেকেই গোলমাল।
গোলমালের প্রথম পর্যায়ে ছিল শান্তিপূর্ণ। পরের দিকে অবস্থা জটিল হল।
শিমুলের মা বললেন, 'ঘর-সংসারেই মেয়ের আসল পরিচয়। এখানে তো আর তোকে ঝিয়ের মতো খাটতে হবে না, দু-একটা রান্নাবান্না আর ছেলেপুলে মানুষেই হ্যাপা শেষ। চোখ বুঁজে রাজি হয়ে যা শিমুল। এমন সুযোগ আর পাওয়া যাবে না।'
'না পাওয়া গেলেই মঙ্গল।'
'অমন করে বলছিস কেন? আমেরিকায় গিয়ে ঘর-সংসার পাতবি, এ কী চাট্টিখানি কথা হল? ছেলের নিজের বাড়ি। অতগুলো গাড়ি। ছাদে সুইমিংপুল। গিয়ে টেনিস খেলা শিখে নিবি।'
'কে বলেছে মা চাট্টিখানি কথা? খুবই কঠিন কথা। কিন্তু আমি অত কঠিন কাজ করতে পারছি না।'
'এক কাজ কর, নিজে একবার ছেলের সঙ্গে কথা বল।'
'কী কথা বলব? বড়ির কীভাবে নাক তোলে? নাকি নটে শাকের রেসিপি?'
'আহা, রেগে যাচ্ছিস কেন? বিদেশে গিয়ে কত ছেলে-মেয়ে বখে যায়, এই ছেলে তো সেরকম নয়। একটু বাঙালী রান্না খেতে চায়, বাংলা গান বাজনা পছন্দ করে। যদি বলিস আমি তোর মেল আইডি পাটিয়ে দিই।'
শিমুল বলেছে, 'এ বিষয়ে আর একটা কথাও নয় মা।
শিমুলের মা বললেন, 'কেন? কথা নয় কেন? আমার মেয়ের বিয়ে নিয়ে আমি কথা বলব না তো কে বলবে? তুই?'
'কেউ বলবে না।'
মহিলা রাগে চোখ-মুখ লাল করে বললেন, 'আমি খবর পেয়েছি, তুমি আজকাল আজেবাজে ছেলেপিলেদের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করেছো শিমুল। দু-পয়সার চাকরি করে আমার মাথা কিনে নিয়েছো নাকি?'
শিমুল হেসে বলেছে, 'তোমার মাথা কিনিনি, নিজের মাথা কিনেছি। আর সেই কারণেই চাকরি ছেড়ে আমেরিকা কেন, চাঁদে গিয়েও হেঁসেল ঠেলার মধ্যে নেই। ও ওখানে তো আমার হেঁসেল হয় না। উনুনের বদলে আভেন আর ঝাঁটার বদলে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার। শুনেছি আজকাল রোবট সিস্টেম চালু হয়েছে। কাজে বেরোনোর আগে প্রোগ্রামিং করে দিলেই হল। ফিরে এসে দেখা যাবে ঘরদোর সাফাইল হয়ে গেছে। সরি মা, এই সবের মধ্যে আমি নেই।'
এই গোলমালের পরেও বাড়ির পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হয়নি। বরং উত্তাপ বেড়েছে। শিমূলের বাবাও গোলমালে প্রবেশ করেছেন এবং পুরোপুরি স্ত্রীর পক্ষ নিয়েছেন। নেয়াটাই স্বাভাবিক। অন্য কেউ হলেও নিত। সন্তানের এমন উজ্জ্বল, নিশ্চিন্ত জীবনের সুবর্ণ সুযোগ তিনি হেলাফেলা করতে পারবেন কেন? তিনি তো আর উন্মাদ নন।
সব ঘটনা শুনে অর্ক গম্ভীর গলায় বলেছিল, 'ছেলে কেমন?'
শিমুল কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, 'কোন ছেলে?'
'কোন ছেলে আবার? যার সঙ্গে তোমার বিয়ের কথা হচ্ছে।'
'ছেলে চমৎকার।'
অর্ক ভুরু কুঁচকে বলল, 'কেন? চমৎকার কেন?'
'সরু একটা গোঁফ আছে। হালকা ভুড়ি। সন্ধের পর বাড়িতে ফিরে পায়জামা পাঞ্জাবি পরে। গান শোনে।'
অর্ক ভুরু আরও গভীর হল।
'কী করে জানলে? ফটো দেখেছো?'
'না। ওসব আমি দেখিনি।'
'তবে?'
'সিভি দেখে মনে হল। এ ছেলে সারাদিন গুড় বাতাসা বিক্রির পর পায়জামা পাঞ্জাবি পরে।'
অর্ক লম্বা নিঃশ্বাস টেনে বলল, 'তুমি কি রসিকতা করছো?'
শিমুল মিষ্টি করে হেসে বলল, 'হঁ্যা করছি। তবে মা করছে না। মা ইজ সিরিয়াস। মেয়েকে বিয়ে না দিয়ে ছাড়বে না। সমস্যা হল বাবা মায়ের সাইড নিয়েছে।'
'তুমি আমার কথা বলে দিচ্ছো না কেন?'
সেদিন এই আলোচনা হচ্ছিল পার্কস্ট্রিটের কফিশপে বসে। কফি মাগ হাতে শিমুল বলল, 'খেপেছো! একেই পরিস্থিতি ভলক্যানো হয়ে আছে। তার মধ্যে বেকার প্রেমিকের কথা বলে ঘি ঢালব নাকি? আগ্নেয়গিরিতে ঘি ঢাললে কী হয় জানও?'
'এখন বেকার পরে তো চাকরি পাবই।'
'সে যখন পাবে পাবে, তার আগে এই বিয়েটা তো আটকাতে হবে।'
অর্ক বলল, 'কীভাবে আটকাবে?'
শিমুল কফিতে চুমুক দিয়ে নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে বলল, 'একটাই পথ। ওনলি ওয়ান? বিয়ে করে।'
অর্ক বিষম খেল। বলল, 'কী বললে?'
শিমুল বলল, 'বিয়ে করে বিয়ে আটকাব। বিষে বিষে বিষক্ষয় শোননি? তোমাকে বিয়ে করে আমার বিয়ে আটকাবো। বাবা-মা বাড়াবাড়ি করলে ফট করে সার্টিফিকেট বের করে দেখাবো। আরও বাড়াবাড়ি করলে আমেরিকায় সার্টিফিকেটের কপি পাঠিয়ে দেব। স্ক্যান করে সোজা মেল।'
'অসম্ভব। ইমপসিবল্। তুমি ভেবেছোটা কী? কাজকর্ম কিছু করি না। দাদার সংসারে থাকি। এই অবস্থায় বিয়ে করে তোমাকে তুলব কোথায়?'
শিমুল ঠোঁট উল্টে বলল, 'বয়ে গেছে আমার। এখন ওঠাউটির কোয়েশ্চন আসছে কোথা থেকে? বিয়েটা করে রাখছি এই পর্যন্ত। বাবা-মা বেশি বাড়াবাড়ি করলে ফটাস্ করে বলে দেব। একটা লিগ্যাল প্রোটেকশন বলতে পারও। এরকম তো কতই হয়। হয় না? আমার কলেজেই এরকম তিনটে কেস ছিল। শরন্যা তো কেলেঙ্কারি করেছিল। অ্যাবরসন ট্যাবরসন করেঃ।' বিয়ে পর্যন্ততে যতটা ঘাবড়ে গিয়েছিল, অ্যাবরশন শুনে আরও ঘাবড়ে গেল অর্ক। ঢোঁক গিয়ে বলল, 'অন্য কোনও পথ নেই শিমুল? দেখ না ভেবে। এটা বড্ড রিস্ক হয়ে যাচ্ছে। জানাজানি হয়ে গেলে বিচ্ছিরি হবে। তোমার মা হেভি দুঃখ পাবেন।'
এবার ভুরু কোঁচকানোর পালা শিমুলের। অর্কর দিকে তাকিয়ে রইল সে।
আর ইউ স্কেয়ারড্? তুমি কি ভয় পাচ্ছো?'
অর্ক স্মার্ট হওয়ার ভঙ্গিতে বলল, 'আরে না না ভয় পাওয়ার কী আছেঃ সে কথা বলিনিঃ বলছি যদি অন্য কোনও ওয়েআউট থাকত। আর একটা পকৌড়া বলি?'
কফি মাগে লম্বা চুমুক দিয়ে শিমুল বলল, 'পথ অবশ্যই আছে। মাকে হঁ্যা বলে দিলেই সব ঝামেলা মিটে যায়। পাত্রকে শোনাবার জন্য দুটো গান বাছাও আছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত। একটা শোনাবো পাকা দেখার দিন। একটা ফুলশয্যার রাতে। পাকাদেখার গানটা তোমার উদ্দেশ্যে গাইব। আমি তারেই জানি তারেই জানি আমায় যে জন আপন জানেঃ। ফুলশয্যার গানটা ওই ছেলের জন্য। এখনও তারে চোখে দেখি নি, শুধু বাঁশি শুনেছি- মন প্রাণ যাহা ছিল দিয়ে ফেলেছি। কেমন হবে?'
অর্ক ফিসফিস করে বলে, 'স্টপ ইট! পিস্নজ স্টপ।'
এরপর আর 'না' বলার উপায় ছিল না অর্কর। ঝিনুকের দূর সম্পর্কের এক দাদা বউদিকে সঙ্গ নিয়ে গড়িয়াহাটের রেজিস্টির অফিসে গিয়ে গোপনে সই করে এসেছে এক গনগনে রোদের দুপুরে। ব্যাক ডেটে ফর্ম ফিলাপ করতে অসুবিধে হয়নি। বাড়তি দুশো টাকায় সব ম্যানেজ হয়েছে।
সেই দাদা বউদিই আজ নেমন্তন্ন করেছে। তাদের নিউটাউনে নতুন ফ্ল্যাট। টাওয়ারে দশ তলার ওপর। ডিনারের নেমন্তন্ন। শিমুলের মুখে শুনে অর্ক ক্ষীণ আপত্তি করেছিল।
'এসবের কী দরকার?'
শিমুল বলল, 'এর আবার দরকার অদরকার কী? নতুন বর বউকে তো সবাই নেমন্তন্ন করে খাওয়ায়। খাওয়ায় না? তেমনই ওরা বলেছে। কী আর এমন ব্যাপার? আমি অফিস থেকে চলে যাব। তোমার তো সে ঝামেলাও নেই। বেকার যুবক। তুমি আটটা নাগাদ চলে এসো। দশটার মধ্যে খেয়ে দেয়ে বেরিয়ে এলেই হবে। আমাকে বাড়ির সামনে নামিয়ে তুমি চলে যাবে। ফিনিশ।'
'ঠাট্টা কোর না শিমুল। আমরা নেমন্তন্ন খাওয়ার জন্য বিয়ে করিনি।'
টেলিফোনের ওপাশে হেসে ফেলল শিমুল।
'তাহলে কী জন্য করেছি? বাড়িতেই বলতে পারব না, একসঙ্গে থাকতে পারব না, আবার ভালবেসে কেউ ডাকলে যেতেও পারব না? তুমি বাড়াবাড়ি করছো। কাম অন। যদি মন না চায় তাহলে ক্যানসেল করে দিচ্ছি। ওরা তো জোর করেনি। রেজিস্ট্রির সময় সাক্ষী ছিল। সেই কারণেই যাওয়া উচিত। তাছাড়া এই ফ্ল্যাটটা দাদারা নতুন কিনেছে। নিউটাউন একটা নতুন শহর। এয়ারপোর্টের কাছে। শুনলাম, দাদারা ফ্ল্যাটটা খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে। সেটা একবার দেখাতে চাইছে। আমার তো মনে হয় ফ্ল্যাট ট্যাটের ব্যাপারগুলো আমাদের এখন থেকেই বুঝে নেওয়া উচিত।'
'কেন।'
'বাঃ, কেন মানে! আজ না হোক, দুদিন বাদে আমাদের লাগবে না?'
'আবার ঠাট্টা করছো?'
শিমুল হাসতে হাসতে বলল, 'হঁ্যা করছি। একদম টেনশন না করে আটটার মধ্যে চলে আসবে। শোন নুতন জায়গা চিনতে সমস্যা হতে পারে তাই একসঙ্গে যাওয়া উচিত।'
'তুমি চেনও?'
'গৃহপ্রবেশের সময় মায়ের সঙ্গে গিয়েছিলাম। আবছা আবচা মনে আছে। ওসব জায়গায় তো এখনও লোকজনও প্রায় থাকে না, রাস্তাঘাটে জিগ্যেস করে নেব এমন কাউকে চট করে পাওয়া যাবে না।'
আজ আটটার পর সেই ফ্ল্যাটেই আসা হয়েছে। শিমুল, অর্ক দুজনে একই সঙ্গে এসেছে। বিরাট হাউজিং কমপেস্নক্সের ভেতর ফ্ল্যাট। লোকজন সত্যি কম। ভেতরটা গাছপালা, আলো, ফোয়ারা, পার্ক দিয়ে সাজানো, কিন্তু ভীষণ নির্জন। আলো অল্প অল্প। তাই সুন্দর আর রহস্যময়।
শিমুল বলল, 'বিউটিফুল।'
অর্ক বলল, 'ভূতুড়ে মনে হচ্ছে।'
শিমুল বলল, 'বাজে কথা বলো না ইস্ আমাদের যদি এখানে একটা ফ্ল্যাট থাকত। মনেই হয় না কলকাতায় এত কাছে এরকম জায়গা আছে আমি তপনদাকে বলব, একটা যদি দেখে দেয়।'
'কী যে বল শিমুল। আমরা কী করে এখন ফ্ল্যাট কিনব?'
'আমি কিনব। ইতিমধ্যেই আমি অফিসে হাউজিং লোনের ব্যাপারে কথাবার্তা শুরু করেছি।'
'তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছো।'
'দেখ বিয়ে যখন করে ফেলেছি, তখন সবটাই ভাবতে হবে।'
'আগে তো আমাকে একটা কাজকর্ম পেতে দেবে।'
'ওমা কাজকর্ম পেতে তোমায় কে আটকাচ্ছে? না পেলেও ক্ষতি নেই। সবাই জানবে গৃহকর্মে নিপুণ একটা কমৎকার ছেলেকে আমি বিয়ে করেছি। মেয়েদের যদি গৃহকর্মে নিপুণা হতে লজ্জা না থাকে তোমার আপত্তি কীসের? তারপরও যদি শাক, কচু, থোড়ের প্রিপারেশন শিখে নাও তাহলে তো কথাই নেই।'
'তুমি কিন্তু আমাকে টিজ্ করছো শিমুল।'
শিমুল আর্কর হাতটা খপ্ করে ধরে বলল, 'যাঃ বাবা, নিজের সদ্য বিয়ে করা বরকে খেপাবো নাতো কাকে খেপাবো?' এরপর শিমুল মাথা উঁচু করে অন্ধকার আকাশছোঁয়া বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, 'মনে হচ্ছে ঝড় বৃষ্টি হবে।'
অর্ক চমকে মাথা তুলল। বলল, 'কেলেঙ্কারি। ঝড় বৃষ্টি হলে এখান থেকে আর ফিরতে হবে না।'
শিমুল বলল, 'কেন? তপনদা গাড়িতে বড় রাস্তা পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে আসবে।'
উঁচু লোহার গেট খুলে দিতে দিতে দারোয়ান ফ্ল্যাটের নম্বর জানতে চেয়েছিল। তারপর হাত তুলে বাড়িটা চিনিয়ে দিল। সেই বাড়ির নরম নীলচে আলো জ্বলা ইস্পাত রঙের একটু করো লিফট একটানে দশ তলায় তুলে দিল শিমুল আর অর্ককে। দরজা খুলতে লম্বা করিডোর। সারি সারি কম পাওয়ারের আলো জ্বলছে। করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অর্ক বলল, 'মনে হচ্ছে এই ফ্লোরে এখনও কেউ আসেনি। শুধু তোমার দাদা-বউদি এসেছে।'
শিমুল মুচকি হেসে বলল, 'দাদা-বউদিও আসেনি।'
'আসেনি মানে!' চমকে উঠল অর্ক।
'আরে বাবা, আসেনি মানে পাকাপাকিভাবে আসেনি। উইকএণ্ডে এসে থাকে। শনি-রবি করে। নতুন জায়গা, নতুন শহর, এখনও তো জমেনি। বছর খানেকের মধ্যে জমে যাবে। তাছাড়া ছেলে-মেয়েদের স্কুলের ঝামেলা রয়েছে। অনেকটা দূর হয়ে যাবে।'
করিডোর শেষেই ফ্ল্যাট। নেমপেস্নটে শিমূলের দাদা-বউদির নাম। শিমূল হাত বাড়িয়ে কলিংবেল টিপতে গিয়ে থমকে গেল। দরজার হাতলে কাগজ গোঁজা! কাগজ! কীসের কাগজ? শিমুল টেনে নিয়ে ভাঁজ খুলতেই দেখল কাগজটা একটা চিঠি। তার বউদির লেখা-
'স্নেহের শিমুল এবং অর্ক। তোমাদের দাদার অফিসের এক কলিগ হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আমাদের দুজনকেই নার্সি হোমে ছুটতে হচ্ছে। তাই নেমন্তন্ন করেও নিজেরা থাকতে পারলাম না। মোবাইলে ধরবার চেষ্টা করেছিলাম। লাইন পেলাম না। মনে হয় টাওয়ারে গোলমাল হচ্ছিল। এখানে অনেক সময় এরকম হয়। নার্সিং হোমে পেঁৗছে তোমাদের ফোনে ধরবার চেষ্টা করব। যাই হোক, দরজা বাঁ দিকে যে লেটার বক্সটা দেখতে পাচ্ছো সেখানে ফ্ল্যাটের চাবি রেখে গেলাম। দরজার খুলে ভেতরে ঢুকে পড়বে খাবার টাবার সব করা আছে। খুবই সামান্য আয়োজন । রুটি, চিকেন রেজালা, রেশমি কাবাব আর খানিকটা ফ্রায়েড রাইস। ডাইনিং টেবিলের হটকেসে সব রেখে গেলাম। ফ্রিজে পুডিং আর দুটো রাজভোগ রাখা আছে। বের করে নিও। শিমুল তুমি খানিকটা স্যালাড কেটে নেবে। কিচেনে শশা পেঁয়াজ টোমাটো রাখা আছে। যদি সেরকম কিছু না হয় তাহলে আমরা অবশ্যই চলে আসব। পিস্নজ নিজের মনে করে বাকিটুকু করে নিও। ভালবাসা জেনো।'
শিমুল কাঁধ ঝাঁকিয়ে চিঠিটা অর্কর দিকে এগিয়ে দিল। তারপর লেটার বক্স হাতড়ে চাবি বেড় করে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ফেলল স্বচ্ছন্দে।
সত্যি দারুণ সাজানো গোছানো ঘর! একেবারে আধুনিক কায়দায় ড্রইং কাম ডাইনিং রুমের একপাশে ওপেন কিচেন। দেয়ালে বড় বড় পেন্টিং। লাল রঙের সোফার সামনে নিচু কাঁচের টেবিল। একটু দূরে ডাইনিং টেবিলে হটকেস, পেস্নট, গস্নাস সাজানো।
শিমুল দু'পাশে হাত ছড়িয়ে বলল, 'মার্ভেলাস। অ্যাই দরজাটা লক করে দাও।'
দরজা যতক্ষণ খোলা ছিল না, ততক্ষণ পর্যন্ত একরকম ছিল, দরজা বন্ধ করেই নার্ভাস হয়ে পড়ল অর্ক। বন্ধ ঘরে সে আর শিমুল! অতিরিক্ত রকম নার্ভাস লাগছে। সেটাই স্বাভাবিক। এরকম কোনও পরিস্থিতির মধ্যে যে পড়তে হবে সে কল্পনাও করতে পারেনি। এই প্রথম এরকম একটা কাণ্ড ঘটল।
শিমুল বলল, 'আমার ওপর কিন্তু একদম রাগ দেখানো চলবে না।'
'রাগ তোমার ওপর দেখাচ্ছি না, তোমার ওই দাদা বউদির ওপর দেখাচ্ছি। এটা কী হল? ধ্যাড়ে ধ্যাড়ে গোবিন্দপুরে ডেকে এনে তারা চলে গেলেন।'
শিমুল হাত তুলে আড়ামোড়া ভাঙল। বলল, 'প্রথমত এটা মোটেই ধ্যাড় ধ্যাড়ে গোবিন্দপুর নয়। দ্বিতীয়ত ওরা ইচ্ছে করে চলে যায়নি, যেতে বাধ্য হয়েছে। আমার অফিসের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে আমিও যেতাম।'
'সেটা আমাদের জানিয়ে নেমন্তন্নাটা ক্যানসেল করলেই তো হত।'
'পর্ণা বউদি চিঠিটায় তো লিখেছে ফোন পায়নি। আর নেমন্তন্ন ক্যানসেল করার কী হয়েছে? ফ্ল্যাটও রয়েছে, খাবার দাবারও রেডি। খেয়ে নিলেই তো হয়। তোমার খিদে পায়নি?'
অর্ক তার রাগ এবং নাভার্স মিশ্রিত মুখ ঘুরিয়ে বলল, 'না, পায়নি।'
শিমুল উঠে দাঁড়িয়ে বলল, 'আমার পেয়েছে। আমি এখন কফি বানাব এবং স্টাটার হিসেবে রেশমি কাবাব সহযোগে খাব।'
'যা খুশি কর।'
শিমুল উঠে গেলে, সম্বিত আরও অস্বস্তির মধ্যে পড়ল। সে টেবিলের ওপর রাখা পুরোনো ম্যাগাজিন নিয়ে ওল্টাতে লাগল। বিরক্তিকর। কিছুক্ষণের মধ্যে ম্যাগাজিন সরিয়ে রেখে উঠে পড়ল। মিনিট দুই ঘরের মধ্যে পায়চারি করে বসে পড়ল ফের। দু' মগ কফি এনে শিমুল বলল, 'বউদি কিন্তু খুব সুন্দর করে সব সাজিয়ে রেখেছে। কফি টফ পেতে একটুও অসুবিধে হল না। আমিও এরকম করব। ধর তুমি বাড়ি ফিরে দেখলে আমি নেই, তখন নিজেই চা কফি বানিয়ে খেতে পারবে।'
অর্ক ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, 'আদিখ্যেতা কর না ঝিনুক। আদিখ্যেতা ভাল লাগছে না।'
'তুমি অমন ছটফট করছো কেন? মনে হচ্ছে, কেউ তোমাকে জোর করে কনফাইনড্ করে রেখেছে।'
'বন্দী ছাড়া কী? এরকম একটা নির্জন জায়গায়ঃ।'
শিমুল চোখ কপালে তুলে বলল, 'ওমা নির্জনই তো ভাল। স্বামী স্ত্রী দুজনে নির্জনে থাকাটা খারাপ হবে কেন! তারওপর আমরা হলাম নবদম্পতি। আমাদের একা থাকতে হবে। দুটিতে লুটিতেঃ।'
কথা বলতে বলতে হেসে ফেলে শিমুল।
অর্ক কঠিন চোখে শিমুলের দিকে তাকালো। খোলা জানলা দিয়ে শির্শিরে হাওয়া আসছে। এটাও বাড়াবাড়ি করেছে মেয়েটা। ঘরের জানলাগুলো সব খুলে দিয়েছে।
শিমুল বলল, 'অমন কড়া চোখে তাকাচ্ছো কেন? নাও কফি খাও।'
অর্ক হাত বাড়িয়ে কফি নিল। বলল, 'কেউ যদি এখন এখানে এসে জিগ্যেস করে আপনারা কারা? এই ফ্ল্যাটে কী করছেন? কী বলবে?'
শিমুল ফিক্ করে হেসে ফেলল।
'বলল, আমরা মানুষ। দুটি মানুষ। নর এবং নারী। নাও কাবাব খাও। ফ্যানটাস্টিক! দাঁড়াও গান বাজনা কিছু চালাই। এদের মিউজিক সিস্টেমটা কোথায়? উফ্ আমার যা ভালো লাগছে না! মনে হচ্ছে এটা আমাদের বাড়ি। আমার আর তোমার।'
অর্ক এবার কেমন যেন মনে হচ্ছে। শিমুলের এত আনন্দ কীসের?
'কী পাগলামি শুরু করেছো!'
'পাগলের মতো ভাল লাগছে তাই পাগলামি করছি। বেডরুমে গিয়ে দেখব ওখানে মিউজিক সিস্টেমটা আছে কিনা?'
অর্ক চাপা গলায় ধমক দিয়ে বলল, 'তুমি চুপ করে বস তো। এক কাজ কর, তোমার বউদিকে একটা টেলিফোন কর। জিগ্যেস কর তারা সত্যি সত্যি কখন আসবে।'
শিমুল এর মধ্যে কখন যেন পায়ের সি্নকার খুলে ফেলেছে। এবার টপের ওপরের দুটো বোতাম খুলে জামাটাকে ঢিলেঢালা করে নিল।
'খেপেছা? আর ইউ ম্যাড? ফোন করতে যাব কেন? একটা এমারজেন্সি কাজে গেছে। ইস্ ঘামে গা চ্যাট চ্যাট করছে, একটা শাওয়ার নিলে হত। বাথরুমটা নিশ্চয় দুর্দান্ত। দাঁড়াও দেখে আসি। সেরকম হলে স্নান করে নেব। ওইটা বাথরুম না?
না ওটায় যাব না, বউদির বেড়রুমেরটায় যাই।'
কাঁচুমাচু মুখে অর্ক সরে গেল শিমুলর কাছ থেকে। বলল, 'কী আরম্ভ করেছো! অন্যের বাড়িতে এসে স্নান।'
হাতের কফি মগ নামিয়ে শিমুল সত্যি সত্যি বন্ধ বেডরুমটার দিকে এগিয়ে গেল। হাতের চেটো দিয়ে কপালের ঘাম মুছে অর্ক উত্তেজিত গলায় বলল, 'তুমি থামবে?'
শিমুল ঘুরে দাঁড়িয়ে অর্কর মুখোমুখি হল। ভুরু কুঁচকে বলল, 'কী ব্যাপার বলও তো? হোয়াই ইউ আর সো নার্ভাস? এমন একটা করছো যেন আমরা চুরি করে এই ফ্ল্যাটে ঢুকেছি। আর যদি ঢুকেই থাকি তাহলেই বা সমস্যাটা কোথায়? উই আর হাজবেণ্ড ওয়াইফ। আমি এখন সাবান মেখে ্ ভাল করে স্নান করব, তারপর একটা কাণ্ড করব।'
শিমুল 'হো হো' আওয়াজে হেসে উঠল। বুক কেঁপে উঠল অর্কর।
'ছিঃ শিমুল এসব তুমি কী বলছো?
শিমুল এ কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল, 'কী বল তো?'
অর্ক ঢোঁক গিলে বলল, 'আমার তো এখন কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে। তোমার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, গোটাটাই একটা পস্ন্যান। তুমি ইচ্ছে করে তোমার দাদা বউদিকে সরিয়ে দিয়েছো। নিশ্চয় তোমার ওই বউদি তোমার সঙ্গে পস্ন্যান করেছে।' কথাটা শুনেও না শোনার ভান করল শিমুল। ঠোঁট উল্টে ভেংচি কেটে বলল, 'স্নানের পর কী করব বললে না তো সোনা?'
'তুমি সবটা জানতে বলেই তোমার এত ফুর্তি। তাই না? সত্যি কথা বলো তো।' ঢোঁক গিলে বলল অর্ক।
'আর তোমার বুক ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেল? সত্যি বাপু বিয়ের আগে কত বীরত্বই না দেখাতে। সুযোগ পেলেই হাত ধরা, পায়ে পা ছোঁয়ানো। সিনেমা হলে কতবার জড়িয়ে বসেছো বলতো। আর আজ বর হয়ে একেবারে ঘাবড়ে গেলে? হা হা। দাঁড়াও আজ তোমার মজা দেখাচ্ছি। আজই আমাদের ফুলশয্যা হবে। এখানেই হবে।'
'ছি ছি, কী বলছো শিমুল! তোমার মাথা সত্যি সত্যি খারাপ হয়ে গেল নাকি?'
'তুমি আলো নিভিয়ে অপেক্ষা কর। আর যদি আলো নেভাতে না চাও তাহলেও কোন অসুবিধে নেই, জানালার পর্দাগুলো টেনে দিলেই হবে। এত ওপরে আর কে দেখছে? আর তাও যদি ভয় ভয় করে তাহলে বেডরুমে চলে এসও গুডবয়ের মতো। ওঘরে নিশ্চয় জানলা খোলা নেই।'
কথাটা বলে হাসতে হাসতে শিমুল বন্ধ ঘরের দিকে রওনা হল। যাওয়ার সময় গলা ছেড়ে গান ধরল- 'ঝড়ে যায় উড়ে যায় গো আমার মুখের আঁচলখানি/ ঢাকা থাক না হায় গো, তারে রাখতে নারিঃ।'
শিমুল এমন সুন্দর গাইতে পারে! অর্ক আশ্চর্য হল। কই সে তো জানতো না! তার থেকেও আশ্চর্যের কথা সত্যি সত্যি বাইরে ঝড় উঠছে! খুব জোর নয়, তবে দশতলা ভেসে যেতে লাগল উথাল পাতাল বাতাসে।
অতিরিক্ত রকম নার্ভাস হয়ে পড়লে মানুষের শরীরে দু'রকম প্রতিক্রিয়া হতে পারে। হয় অল্প অল্প ঘাম হয়, নয়তো হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। অর্কর একই সঙ্গে দুটোই হচ্ছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে, আবার হাত-পা ঠাণ্ডাও হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থাতে সে ঘরের আলো নিভিয়ে সোফার ওপর বসে আছে জড়োসড়ো হয়ে। দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করছে। তার ভালো লাগছে। খুব ভালো লাগছে।
এমন সময় দরজায় খটখট আওয়াজ হল। অর্ক চমকে উঠল। কীসের আওয়াজ? কেউ এলো? নাকি ঝড়ের আওয়াজ?
================================
গল্প- 'শুধু একটি রাত' by সাইপ্রিয়েন এক্ওয়েন্সি। অনুবাদ বিপ্রদাশ বড়ুয়া গল্প- 'পিতা ও কুকুর ছানা' by হরিপদ দত্ত স্মরণ- 'শওকত ভাই : কিছু স্মৃতি' by কবীর চৌধুরী সাহিত্যালোচনা- 'রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পালাকারের নাটক স্মরণ- 'আবদুল মান্নান সৈয়দ : কবি ও প্রাবন্ধিক' by রাজু আলাউদ্দিন স্মরণ- 'সিদ্ধার্থ শংকর রায়: মহৎ মানুষের মহাপ্রস্থানে by ফারুক চৌধুরী গল্প- 'ফাইভ স্টার' by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম গল্প- 'নূরে হাফসা কোথায় যাচ্ছে?' by আন্দালিব রাশদী গল্প- 'হার্মাদ ও চাঁদ' by কিন্নর রায় গল্প- 'মাটির গন্ধ' by স্বপ্নময় চক্রবর্তী সাহিত্যালোচনা- 'কবি ওলগা ফিওদোরোভনা বার্গলজ' গল্পিতিহাস- 'বালিয়াটি জমিদারবাড়ির রূপগল্প' by আসাদুজ্জামান ফিচার- ‘কাপ্তাই লেক:ক্রমেই পতিত হচ্ছে মৃত্যুমুখে' by আজিজুর রহমান রাজনৈতিক আলোচনা- 'ছাত্ররাজনীতি:লেজুড়বৃত্তির অবসান আজ জরুরি by বদিউল আলম মজুমদার কৃষি আলোচনা- 'কৃষিজমি রক্ষার দায় সবার' by আফতাব চৌধুরী শিল্পি- 'আমি যে গান গেয়েছিলেম...কলিম শরাফী' by জাহীদ রেজা নূর আলোচনা- 'হাওয়ার হয়রানি নামে ঢেকে যায় যৌন
দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্য
লেখকঃ প্রচেত গুপ্ত
এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
গল্প- 'শুধু একটি রাত' by সাইপ্রিয়েন এক্ওয়েন্সি। অনুবাদ বিপ্রদাশ বড়ুয়া গল্প- 'পিতা ও কুকুর ছানা' by হরিপদ দত্ত স্মরণ- 'শওকত ভাই : কিছু স্মৃতি' by কবীর চৌধুরী সাহিত্যালোচনা- 'রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পালাকারের নাটক স্মরণ- 'আবদুল মান্নান সৈয়দ : কবি ও প্রাবন্ধিক' by রাজু আলাউদ্দিন স্মরণ- 'সিদ্ধার্থ শংকর রায়: মহৎ মানুষের মহাপ্রস্থানে by ফারুক চৌধুরী গল্প- 'ফাইভ স্টার' by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম গল্প- 'নূরে হাফসা কোথায় যাচ্ছে?' by আন্দালিব রাশদী গল্প- 'হার্মাদ ও চাঁদ' by কিন্নর রায় গল্প- 'মাটির গন্ধ' by স্বপ্নময় চক্রবর্তী সাহিত্যালোচনা- 'কবি ওলগা ফিওদোরোভনা বার্গলজ' গল্পিতিহাস- 'বালিয়াটি জমিদারবাড়ির রূপগল্প' by আসাদুজ্জামান ফিচার- ‘কাপ্তাই লেক:ক্রমেই পতিত হচ্ছে মৃত্যুমুখে' by আজিজুর রহমান রাজনৈতিক আলোচনা- 'ছাত্ররাজনীতি:লেজুড়বৃত্তির অবসান আজ জরুরি by বদিউল আলম মজুমদার কৃষি আলোচনা- 'কৃষিজমি রক্ষার দায় সবার' by আফতাব চৌধুরী শিল্পি- 'আমি যে গান গেয়েছিলেম...কলিম শরাফী' by জাহীদ রেজা নূর আলোচনা- 'হাওয়ার হয়রানি নামে ঢেকে যায় যৌন
দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্য
লেখকঃ প্রচেত গুপ্ত
এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
No comments