গল্প- 'বাসস্ট্যান্ডে যে দাঁড়িয়েছিল' by ঝর্না রহমান

সে দাঁড়িয়েছিল আমার সামনা সামনি, তবে অনেকটা দূরে। তার পরনে একটা কালো টি-শার্ট আর জিনস। পায়ে মোটা জবরজং কেডস। মাথা ভরা ঘন চুল।

প্রাচীন গ্রীক যুবাদের মতো সেই চুলে পাক খেয়ে আছে অসংখ্য রিং। বড় বড় চোখের ওপর টানা ভ্রূ খাড়া নাক আর শ্মশ্রুবিহীন চকচকে মসৃণ শ্যামল চামড়া। সব মিলিয়ে তার চেহারায় প্রকৃতই বজ ও বিদু্যতের দেবতা এ্যাপোলের একটা আভাস পাওয়া যায়।
তার স্বাস্থ্য ভালো। কালো টি-শার্টটি তার বুকে আঁটোসাটো হয়ে লেগে আছে, তাতে তার বুকটা খুব দেখার মতো হয়েছে।
বুকের ওপর সাদা আর হলুদে মিল করে একটা ছুটন্ত জন্তুর অাঁদল আঁকা হয়েছে। দূর থেকে আমি যুবকটির স্বাস্থ্য উপচে পড়া ভরাট বুকের এপাশে ওপাশে ধাবমান জন্তুটিকে কখনো বাঘ কখনো জেব্রা বলে ভাবছি।
মীরপুর বা মোহাম্মদপুর কোন একটা বাসের টিকিট কেটে সে দাঁড়িয়ে আছে। শাহবাগের জাদুঘরের কোণার দিকের এই ফুটপাতের ওপরে অনেকগুলো বাসের টিকেট কাউন্টার। কাউন্টার মানে দেড়হাতি একটা আমকাঠের টেবিল আর পস্নাস্টিকের একটা টুল নিয়ে টিকিটের কয়েকটা রঙবেরঙের তোড়া নিয়ে বসে পড়া। বিভিন্ন পরিবহনের দু'জন তিনজন করে এজেন্ট টিকিট বিক্রি করা ছাড়াও যাত্রী পাকড়াও করা থেকে শুরু করে যাত্রীদের বাসের পেটের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়ার কাজে মহা তৎপর থাকে।
যুবকটি লাইনে দাঁড়ায়নি। ফুটপাতের ওপরে একটা ঘন জটলা। কে কার আগে বাসে উঠতে পারে তার জন্য ওঁৎ পেতে থাকা মানুষের জটলা। যুবকটি সেই জটলা এড়িয়ে একটু ফারাকে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তার কারণও আমি বেশ বুঝতে পারি। কারণ হলো সে সিগ্রেট খাচ্ছে। তার এক হাতে আলতো করে ধরে রাখা একটি গোলাপি টিকেট। অন্য হাতে সিগ্রেট। সিগ্রেট ধরা থেকে শুরু করে ধোঁয়া ছাড়া পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ই সে বিশিষ্ট ভঙ্গি নিয়ে সম্পন্ন করছে। তর্জনী আর মধ্যমায় একটা প্যাঁচ দিয়ে সিগ্রেটটি রেখে বুড়ো আঙুলের আলতো চাপে সেটিকে তুরতুর করে নাচাতে নাচাতে মাঝে মাঝে ঠোঁটে তুলে দিচ্ছে। দীর্ঘ টানে মুখের আগুন সাপের মনির মতো ধকধক করে ওঠে। তারপর তার ধোঁয়া ছাড়ার কারিশমা, যেটি আমি বাচ্চা মেয়ের মতো মুগ্ধতা নিয়ে দেখি। সে প্রতিবার ধোঁয়া ছাড়ে মুখটা আকাশের দিকে তুলে চোখ একটু কুঁচকে ভ্রূ জোড়ায় অদ্ভুত ধনুযের্াজনার ভঙ্গি নিয়ে। আমার মনে হচ্ছিলো ধোঁয়া দিয়ে বুঝি সে আকাশে ছবি আঁকছে। কখনো মনে হচ্ছিলো সিগ্রেট নয় স্বর্গীয় বাঁশিতে ফুঁ দিচ্ছেন অর্ফিউস। ধোঁয়ার অবয়বে বিশ্বচরাচরে ছড়িয়ে পড়ছে সুর। একটু বাদেই সেই সুরের ইন্দ জালে মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়বে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো।
কিন্তু আমি কেন যুবকটিকে এমন নিবিড় পর্যবেক্ষণ করছি? এটা করলে করতে পারতো রঞ্জন। কারণ রঞ্জন সাংবাদিক। ও ফ্রি-ল্যান্স সাংবাদিক। যখন যে পত্রিকার জন্য কোন এ্যাসাইনমেন্ট পায়, সেটাই করে খুব মনোযোগ দিয়ে, খুব নিষ্ঠার সাথে। রঞ্জন অবশ্য এ্যাসাইনমেন্টকে বলে 'খ্যাপ'। তবে মাত্র কিছুদিন হলো ও একটা নতুন পত্রিকায় জয়েন করেছে। পত্রিকাটা খুব মারমার কাটকাট করে শোরগোল তুলে যাত্রা করেছে। নতুনত্ব আনার জন্য সে পত্রিকা বহু সামান্য জিনিশে অসামান্য 'থিম' খুঁজে পাচ্ছে। কাজেই রঞ্জন এ মুহূর্তে এখানে থাকলে হয়তো বিশেষ কোন এ্যাঙ্গেল থেকে যুবকটির ধূম্র উদগীরণরত তাম্রকূটশলাকার ছবি তুলে ধূমপানবিরোধী জ্বালাময়ী ভাষার একটা স্টোরি ছেপে দিতে পারতো। রঞ্জন একটু বাদেই এখানে আসবে।
আমি তো রঞ্জনের জন্যই অপেক্ষা করছি।
রঞ্জন বলেছে ও রকেটের গতিতে আজকের রিপোর্টটা লিখে ওর হাসান ভাইয়ের কাছে বুঝিয়ে দিয়েই চলে আসবে। বিশ্বসাহিত্যের মোড় থেকে শাহবাগ মোড়ে আসতে ওর লাগবে উধের্্ব দশ মিনিট। কিন্তু আমি তো দাঁড়িয়েই আছি প্রায় দশ মিনিট। মোবাইল ফোনে একটু আগে মেসেজ লিখেছে রঞ্জন। জান, আর পাঁচ মিনিট, জাস্ট কামিং।
পাঁচ মিনিট আগে আমি দু'বার ওর মোবাইলে কল দিয়েছি। রঞ্জন বলেছে, ফাইসা গেছি জান। সুমুন্দির বাচ্চা এক খতরনাক ভাইরাস এ্যাটাক করছে অফিসের কম্পিউটার। আমার ফাইলটা হাইড কইরা ফালাইছে। গফফার ভাইরে ডাকতে হইছে। এখুনি ঠিক হয়ে যাবে। গফফার ভাইয়ের আঙুলের মাথায় মাথায় এন্টিভাইরাস মাখানো আছেঃ
রঞ্জন এলে আমরা দু'জনে মিলে ঘুরতে বেরিয়ে পড়বো। প্রথমে যাবো আজিজ সুপার মার্কেটে। সেখানে বাঁশের কেলস্নায় বসে পয়লা এক পেট খানাদানা, লুচি লাবড়া, গুড়ের পায়েস। তারপর বেরিয়ে পড়বো। রবীন্দ সরোবরে এলআরবির কনসার্ট আছে।
আমাদের আর এক বন্ধু বিজুর আজ জন্মদিন। বিজুর বাবার গার্মেন্টসের ব্যবসা আছে। অতএব ওর কাছ থেকে কীভাবে কত খসানো যায় তার পস্ন্যান-প্রোগ্রাম করা আছে। আমরা বিজুর গাড়িতে চলে যাবো বারিধারা। সেখানে আট্রিয়ামে বসে লবস্টার খেতে খেতে আমরা পাথরের খাঁজ কাটা দেয়ালে আমাদের আমোদ-আলস্নাদের সস্নোাগান বসিয়ে দেবো। ইচ্ছে হলে আমি আর রঞ্জন ওদের সঙ্গে কোথাও না গিয়ে দু'জনে আরও দূরে কোথাও চলে যাবো।
বাসায় অবশ্য বলে এসেছি বান্ধবীর জন্মদিনে যাচ্ছি। তবে রঞ্জন হলো বাসায় ওপেন সিক্রেট। আজকাল বাবা-মায়েরা অনেক লিবারাল হয়েছেন। মেয়েদের বয়ফ্রেন্ডের কথা শুনলে রামদা নিয়ে কতল করতে আসেন না। বরঞ্চ অনেকেই মনে মনে চান মেয়ে নিজেই টোপ ফেলে তার নাগালের 'ভালো ছেলেটিকে' সবার আগে গেঁথে ফেলুক। তবে আমরা কেউ কাউকে টোপ ফেলে গেঁথে তুলিনি। কীভাবে রঞ্জন আর আমি দু'জন দু'জনের 'জান' হয়ে গেলাম সে গল্প এখানে কোন ফ্যাক্টর নয়। এখন ফ্যাক্ট হলো এই, যে আমি ফুটপাতে দাঁড়ানো ঐ আপেল মার্কা চেহারার এ্যাপোলোকে দেখে রীতিমতো পটে গিয়েছি। একে তো পটা-ই বলে না কী! সেই তখন থেকে আমি তার চুলের ডগা থেকে শুরু করে জুতোর গোড়া পর্যন্ত জরিপ করা শুরু করে দিয়েছি।
লক্ষ্যভেদী দৃষ্টির একটা অদৃশ্য সুতোর টান আছে। তাতে করে যার দিকে তাকিয়ে থাকা হয় সে ব্যক্তি কোনদিকে না চেয়েও ঠিক টের পায় কেউ তাকে লক্ষ্য করছে। আমার চোখের টানে এ্যাপোলোও কয়েকবার ফালুক-ফুলুক করে আমাকে দু'চারটা পলক দিয়েছে।
নাহ আর যুবককে জরিপ করা ঠিক হবে না। ওর সিগ্রেট এতক্ষণে শেষ হয়েছে। বোঁটাটুকু ফুটপাতের ওপরে ছুঁড়ে মেরে কায়দা করে জুতোর গোড়ালি দিয়ে পিষে দেয় আগুনটা। এ সময় ওর জুতোর ডগায় এক ধরনের নাচের ছন্দ ওঠে। ও সব কিছুতেই খুব কারিশমা দেখাচ্ছে! কারিশমাটা আরোপিত তবে খুব লাগসই। যেন এ না হলে তাকে মানাবেই না।
আমার হঠাৎ সন্দেহ হয় আমি নই প্রথম থেকে ঐ যুবকই বরঞ্চ আমাকে টার্গেট করেছে। ভাব দেখাচ্ছে যেন সে আছে নিজেকে নিয়ে এক মগ্নতার ভেতরে। এই মগ্নতার অভিনয়ও নিজেকে একজন তরুণীর কাছে বিশিষ্ট করে তোলারই একটা কৌশল মাত্র। আসলে ওরই চোরা চোখের গোপন চাহনির টানে আমি ওর দিকে প্রথম তাকিয়েছি।
ধেৎ! যেই না আলু মাকর্া মাকুন্দা। তার জন্য আবার এত! নেহাৎ চেহারায় কী যেন একটা আলটপকা জিনিস ছিল তাইঃযাকগে ও দিয়ে আমার কোন দরকার নেই। আমার দরকার রঞ্জনকে।
রঞ্জনের চেহারা ব্যাকরণগতভাবে ভালো বলা যাবে না। রঞ্জনের গায়ের রঙ কালো। লম্বাটে মুখে শুধু বড় বড় দুটি চোখ। একটু লালচে তারা সাদা অংশের অনেকখানি জুড়ে আছে। মনে হয় দু' কাপ লেবু চা থেকে সৌরভ ছড়িয়ে পড়ছে। তবে এসব দিয়ে রঞ্জন আমাদের পরিবারে কোন 'ভালো ছেলে'র নাম কিনতে পারেনি। ভাইয়া রঞ্জনকে বলে শিং মাছ। মা বলে ভাঙাচুরা পোলাটা। আর আমার কাছে? আমার কাছে রঞ্জন হলো একটা শক্তির নাম। একটা স্বপ্ন একটা তোলপাড় করা জীবনের নাম। রঞ্জন একটা পৃথিবীরই নাম। আর সেটা হলো আমার পৃথিবী।
যুবককে চিন্তা থেকে নক আউট করে দিতে আমি মোবাইল ফোন বের করে রঞ্জনের নম্বর টিপি।
এই রঞ্জু, এত দেরি হচ্ছে কেন রে?
এই তো বেরিয়ে পড়েছি। বিশ্বসাহিত্য পার হচ্ছি।
হেঁটে আসছিস রঞ্জু?
না না, পুলিশকে পাঁচ টাকা ঘুষ দিয়ে রিকশা নিয়ে আসছি। আর পাঁচ মিনিট জান।
রাখ তোর পাঁচ মিনিট। সেই তখন থেকে পাঁচ মিনিট পাঁচ মিনিট করছিস। দু' মিনিটের মধ্যে আসবি তো আয় নইলে আমি ভাগলবা হলাম। রেগে উঠি সত্যিই আমি।
ও পাশে রঞ্জন হাসছে। রিকশার ধাক্কায় ওর হাসি এঁকেবেঁকে যায়। কথাগুলো বাঁকাচোরা হয়ে দুলতে দুলতে আমার কানে আসে। ও বলছে
ভাগলবা তো হবি আমার সঙ্গে! যুগল ভাগল!
আশ্চর্য! রঞ্জনের কথার যুৎসই উত্তর দিতে গিয়ে দেখি এ্যাপোলো আমার দিকে হাসিমুখে চেয়ে কী যেন ইঙ্গিত করছে। আমি ফট করে বলে ফেলি তোর সঙ্গে? শিঙ্গি মাছের সঙ্গে যুগল ভাগল?
তো পাঙাশ মাছ আর পাচ্ছিস কোথায়? রঞ্জন হাসতে থাকে।
আরে! আমি অবাক হয়ে দেখি যুবক যেন আমার বরাবরই হেঁটে আসছে! তার কোন যৌক্তিকতা নেই। নিশ্চয়ই আমার পেছন দিক থেকে আসছে তার ইপ্সিত বাস। আর তাই সে একটু এগিয়ে আসছে। এমনটি ভেবে নিয়েও রঞ্জনকে আমি বলে উঠি, আপাতত অলিম্পাস থেকে একজন যুবক এসেছেন। খুব সম্ভবত এ্যাপোলোর ছোট ভাই। তার সাথেই ভাগছি। তোর জন্য ফুটপাথে একটা কলা রেখে গেলাম। রিকশা থেকে নেমে ওতে আছাড় খেয়ে একটা পাঙাশ ধরে রাখিস।
হা হা হা হাঃওটা আছাড় হবে না, হবে পাছাড়ঃপাঙাশ ধরতে গেলে আছাড়ে চলবে নাঃঢেউ তোলা হাসির ভেতর রঞ্জনের কথা ভেঙে ভেঙে যেতে থাকে।
কিন্তু ওর কথা আর আমার কানে যায় না। আমার শ্রবণেন্দি য় তখন অদ্ভুত এক কণ্ঠস্বর শুনে কয়েক লহমা একটা বিভ্রান্তির মধ্যে ডুবে গিয়ে আবার সচকিত হয়ে উঠেছে।
কারণ সেই মুহূর্তে আমার প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মুখটা একটু এগিয়ে এনে পরিচিত হাসিতে মুখ ভাসিয়ে দিয়ে যুবক প্রশ্ন করেছে। আচ্ছা, আপনি কি আমাকে চেনেন? মানে আগে কি আপনাকে আমি দেখেছি কোথাও?
উত্তর না দিয়ে আমি যুবকের দিকে হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে থাকি।
প্রথমত আচমকা যুবক আমার এত কাছে এসে দাঁড়িয়েছে যে আমি তার ঘ্রাণ পেতে থাকি। সিগ্রেটের ধোঁয়া রোদে পোড়া ঘামভেজা জামা আর এমন মিষ্টি একটা সৌরভ যা কেবল মেয়েদেরই মানায়। এ সবের মিলিত একটা ঘ্রাণ।
সেই সঙ্গে তার কণ্ঠস্বর আমাকে একেবারে চমকে দেয়। এতক্ষণ আমি যুবকের কণ্ঠ থেকে মাদকতাময় এক পুরুষালি স্বর শোনার জন্যই হয়তো আমার শ্রবণকে গোপনে লালায়িত করে রেখেছিলাম। কিন্তু যুবকের গলা থেকে যেন ভিন্ন কেউ কথা বলে ওঠে। যেনবা কথা বলে দুজন। একটি প্রবল নারী কণ্ঠের পাশাপাশি একটি মৃদু পুরুষ কণ্ঠ। এই নারুষ কণ্ঠ একেবারেই অপ্রত্যাশিত। অপ্রাকৃত।
যুবক প্রশ্ন করে হাসিমুখে তখনও চেয়ে আছে আমার দিকে। টসটসে মসৃণ গালে তার হাসি বিকেলের চাপা রোদে সবুজ আপেলের মতো চকচক করতে থাকে। সেই সবুজ ছড়িয়ে পড়েছে তার সাজানো দাঁতের সারিতে, ফণা তোলা ভুরু আর বড় বড় দুই চোখের তারায়। আমি হাঁ করে চেয়ে থাকি তার মুখের দিকে।
তা দেখে সে আবার বলে, মানে আপনি অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছিলেন তো!
আবার সেই কণ্ঠ। একটি মোটা আর একটি সরু তার যেন একসাথে বেজে ওঠে। যুবকের এই মেয়েলি অথচ অদ্ভুত কর্কশ কণ্ঠস্বর আমাকে কেমন ভয়ার্ত করে তোলে।
এ কি নারী?
আমার নিরুত্তর হতবুদ্ধি মুখের দিকে চেয়ে ও দুই কাঁধে শ্রাগ করে মুখমণ্ডলের সবকটা ভাঁজ নাচিয়ে অদ্ভুত অবজ্ঞার ভঙ্গি করে। সে মুহূর্তে আমি যেন ওর বুকে দুটো পুরুষ্ট স্তনের আভাস পাই। হাত ঝুলিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ফিরে যাওয়া মাত্র আবার ওর বুক দুটো টুপ করে ডুব দিয়ে কোথায় তলিয়ে গেল।
আমি বিমূঢ়ের মতো ওর বুকের দিকে তাকিয়ে দেখি হালকা দুটি ঢেউয়ের ভেতর বিলবোর্ডের ছবি পাল্টানোর মতো বাঘ পাল্টে জেব্রা আবার জেব্রা পাল্টে বাঘ বেরিয়ে আসছে। এবার অপাঙ্গে তাকাই ওর উরু সন্ধিতে। টান টান উত্তেজনায় স্থির হয়ে আছে ঢেউ!
আমি আবার ভয় পেয়ে উঠি। আমার মনে হয়, ওখান থেকেও বেরিয়ে আসবে বাঘ অথবা জেব্রা!
ও কে? ও কি পুরুষের পোশাকে একজন নারী? হতেই পারে। পোশাকের ছাট বা ডিজাইন মেয়ে অথবা ছেলেদের জন্য আলাদা করে তো আর ঈশ্বর নির্ধারণ করে দেননি! যে কেউ তার ইচ্ছামতো পোশাক পরতেই পারে।
না কি পোশাকটা তার ক্যামোফ্লাজ করার জন্য! সে কি কোন আন্ডারগ্রাউন্ডের নারী সদস্য? কোন কোন মৌলবাদী জঙ্গী নারী? ওর নিম্নাঙ্গে কি কোন অস্ত্র লুকানো আছে?
হঠাৎ চঞ্চল হয়ে ওঠে ও। ওর বাস এসে গিয়েছে।
হালকা একটা দৌড়ের ছন্দ জেগে ওঠে ওর দেহে। বাসটা খুব ভাল করে থামছে না। চলন্ত অবস্থায়ই যাত্রীদের ওঠানামা করাচ্ছে। দৌড়ে লাইনে ঢুকে যাবার আগেই আমি যেন মরিয়া হয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করি, আপনার নাম কী? যেন আমি ওর নামটা দিয়েই ওর জেন্ডার নির্ণয় করতে চাই।
আমার প্রশ্ন শুনে নাটকীয় ভঙ্গিতে এক পা পিছিয়ে এসে ও বলে, নয়ন, নয়ন শিকদার। আর আপনার?
উত্তর শোনার জন্য নয়ন একপলক হাসিমুখে অপেক্ষা করে।
আমি উত্তর না দিয়ে উজবুকের মতো নয়নের দিকে তাকিয়ে থাকি।
বাস চলতে শুরু করেছে। নয়ন দৌড়ে গিয়ে অবলীলায় বাসের হাতল ধরে লাফ দিয়ে বাসের পাদানিতে এক পা দিয়ে ঝুলে পড়ে। তখনও ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে বুঝি বা উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকে। ওর সেই অদ্ভুত কণ্ঠস্বরের প্রশ্নটি তখনও আমার কানের পাশে কালো একটা ভোমরার মতো বোঁ বোঁ করতে থাকে। আমার বিমূঢ় ঠোঁটের ভেতর থেকে উত্তরটি আর বের হয়ে আসতে পারে না। কারণ আমার নামও নয়ন। আমার চেনাজানা আরও চারজন নয়ন আছে যাদের দু'জন ছেলে আর দু'জন মেয়ে।
নাম দিয়ে আর নয়নের জেন্ডার নির্ণয় করা গেল না। গাড়ি স্পিড নিচ্ছে। নয়ন হাতল ধরে পা দানিতে দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তখনও এদিকে তাকিয়ে আছে। আমি কী ভেবে নয়নকে হাত তুলে 'বাই' করি। নয়ন এবার হেসে ওঠে। ওর সুন্দর সাজানো দাঁতের হাসির ছটায় একবার ঝিলিক তুলে যায় এ্যাপোলোর বিদু্যৎ।
আমি এবার ধীরেসুস্থে রঞ্জনের আসার পথে চোখ পাতি।
==============================
গল্প- 'গন্না' by তিলোত্তমা মজুমদার  গল্প- 'ঘুড়িয়াল' by শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়  গল্প- 'প্রক্ষেপণ' by মোহিত কামাল  গল্প- 'গন্তব্য বদল' by রফিকুর রশীদ  গল্প- 'ঝড়ের রাতে' by প্রচেত গুপ্ত  গল্প- 'শুধু একটি রাত' by সাইপ্রিয়েন এক্ওয়েন্সি। অনুবাদ বিপ্রদাশ বড়ুয়া  গল্প- 'পিতা ও কুকুর ছানা' by হরিপদ দত্ত  স্মরণ- 'শওকত ভাই : কিছু স্মৃতি' by কবীর চৌধুরী  সাহিত্যালোচনা- 'রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পালাকারের নাটক  স্মরণ- 'আবদুল মান্নান সৈয়দ : কবি ও প্রাবন্ধিক' by রাজু আলাউদ্দিন  স্মরণ- 'সিদ্ধার্থ শংকর রায়: মহৎ মানুষের মহাপ্রস্থানে by ফারুক চৌধুরী  গল্প- 'ফাইভ স্টার' by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম  গল্প- 'নূরে হাফসা কোথায় যাচ্ছে?' by আন্দালিব রাশদী  গল্প- 'হার্মাদ ও চাঁদ' by কিন্নর রায়  গল্প- 'মাটির গন্ধ' by স্বপ্নময় চক্রবর্তী  সাহিত্যালোচনা- 'কবি ওলগা ফিওদোরোভনা বার্গলজ'  গল্পিতিহাস- 'বালিয়াটি জমিদারবাড়ির রূপগল্প' by আসাদুজ্জামান  ফিচার- ‘কাপ্তাই লেক:ক্রমেই পতিত হচ্ছে মৃত্যুমুখে' by আজিজুর রহমান



দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্য
লেখকঃ ঝর্না রহমান


এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.