গল্প- 'বেঁটে খাটো ভালোবাসা' by রেজানুর রহমান

ঝামেলা শুরু হয়েছে উচ্চতা নিয়ে। পাত্রী লম্বা। পাত্র খাটো। উনিশ বিশ হলেও চলত। কিন্তু পার্থক্যটা ষোল আর বিশের মতো। পাত্রীর চেয়ে পাত্র খাটো।

বিষয়টা কেমন দেখাবে? লোকজন নানা কথা বলবে। এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতা আছে সোমার। প্রাণের বান্ধবী হিমু হঠাৎ বিয়ে করে ফেলল তাও আবার তার চেয়ে দশ বছরের ছোট একটি ছেলেকে। হিমুর বয়স এখন চলছে ছত্রিশ।
তার মানে ছত্রিশ থেকে দশ বাদ দিলে পাত্রের বয়স কত দাঁড়াল? ছাবি্বশ। ছেলে মানুষ। তবে ছেলেটির উচ্চতা ঠিক থাকলে বয়স কোন ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াত না।
বেচারী হিমু, মারাত্মক ভুল করেছে। প্রেম করবি কর। তাই বলে যার তার সাথে। উঁচা নীচা দেখবি না। অবশ্য হিমু নিজে বলে সে দারুণ সুখে আছে। প্রসঙ্গ তুললেই বলে খুব ভালো আছি রে সোমা। জর্জকে পেয়ে (হিমুর স্বামী) আমি দারুণ সুখী। জানিস ও আমার কোন কিছুই অপূর্ণ রাখেনি। বয়স আর উচ্চতার কথা বলছিস তো? ওটা কোন ব্যাপার না। আসল কথা হল সমঝোতা। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বন্ধুত্বই হল আসল। এটা নাই ওটা নাই বলে সারাক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করলে সংসার সুখের হয় না। সুখ হল নিজের কাছে।
এইতো গত পরশু হিমুর সাথে সোমার মোবাইল ফোনে কথা হয়েছে। হিমু নিজেই ফোন করেছিল।
সোমা কেমন আছিস?
কে হিমু? ভালো আছি। তোর খবর কি?
ভালো।
তোর সাহেব কেমন আছে?
ভালো।
সব ভালো?
হঁ্যা।
সত্যি বলতেছিস?
হঁ্যা।
কিন্তু আমি যে শুনলাম তোদের নাকি ঝামেলা যাচ্ছে? ইচ্ছে করেই হিমুকে একটু বাজিয়ে দেখতে চাইল সোমা। হিমু ব্যাপারটাকে পাত্তাই দিল না। হাসতে হাসতে বলল- তোর কানেও তাহলে এসব কথা গেছে। আচ্ছা সোমা বিয়ে করেছিতো আমি? হাজবেন্ড ছোট না বড় সেটাতো আমার ব্যাপার। এটা নিয়ে লোকজনের এত মাথা ব্যথা কেন? আশ্চর্য এই দুনিয়া। আমি কি আমার মতো করে বাঁচতে পারব না। আচ্ছা ধর আমার চেয়ে উচা একজনকে বিয়ে করলাম। লোকজন বলল বাহ দারুণ। কিন্তু উঁচা লোকটার সাথে আমার এডজাস্ট হল না। মনের মিল হল না। রাতে আমরা আলাদা বিছানায় থাকি। কেউ কারও সাথে কথা বলি না। দিনে 'হাসিখুশি মিষ্টি মিশি'। যেন আমাদের চেয়ে হ্যাপি কপাল আর দ্বিতীয়টি নাই। লোকজন কি এটাই চায়? কিন্তু আমি তো সেটা পারব না। সংসার করব আমি। কাজেই ভালো-মন্দ আমাকেই দেখতে হবে। বলেই হিমু থামল।
হিমুর জন্য মায়া হচ্ছে। সোমা আদরের ডাক দিল- হিমু!
বল।
তুই সুখে আছিস?
হঁ্যা।
সত্যি?
সত্যি। সত্যি। সত্যি!
তোরা যখন একসাথে কোথাও যাস তখনঃ সোমার কথা কেড়ে নেয় হিমু। আগে লোকজন আগ্রহ নিয়ে তাকাত। নানা মন্তব্য করত। কেউ কেউ ভাবত জর্জ কি আমার ছেলে? চিন্তা কর মানুষের চোখে কেমন বিষ? জর্জ আর আমি একসাথে দাঁড়ালে কি মা-ছেলে মনে হয়? সোমা আমি তোর বন্ধু বলে নয়, নিরপেক্ষভাবে বলত। আমাদেরকে দেখে কি সেটা মনে হয়? অথচ লোকজনঃ আমি লোকজনের খাই না পরি? আমার ফ্যামিলি বিয়েটা মেনে নেয়নি। বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন কেউ খোঁজ নেয় না। তাতে কি হয়েছে? আমি কি মরে গেছি। আমি ভালো আছি সোমা, খুউব ভালো আছি। বলেই ফোন কেটে দেয় হিমু।
একটা বায়োডাটা নিয়ে টিএন্ডটি টেলিফোনের কাছে বসে আছে সোমা। হিমুর কথা ভেবে ভরসা হচ্ছে। সংসারে সমঝোতাই হল আসল। সেখানে উঁচা-নীচার গুরুত্ব কি? এটা একটা স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতা। ছেলের চেয়ে মেয়ে খাটো হতে হবে। কেন রে বাবা! মেয়ে ছেলের চেয়ে লম্বা হলে ক্ষতি কি? মহাভারত কি অশুদ্ধ হয়ে যাবে। এসব প্রাগৈতিহাসিক চিন্তা।
জহুরা বুবুর বাসায় ফোন করল সোমা। জহুরাই ফোন ধরেছেন। সোমা সালাম দিল। বুবু আমি সোমা।
বুবু খুশি হয়ে বললেন- হঁ্যা বল কেমন আছিস?
ভালো। তোমাদের খবর কি?
কোন খবর চাস? খবর তো একটাই ঝুমুর বিয়ে। মেয়েটা যে কেন এত লম্বা হল বুঝতে পারিনি।
সোমা হেসে বলল- দুলাভাই লম্বা। কাজেই তার মেয়ে তো লম্বা হবেইঃ
সোমার কথা কেড়ে নিলেন জহুরা-তাই বলে তালগাছের মতো লম্বা। এখন আমি এত লম্বা পাত্র কোথায় পাই!
বুবু!
বল।
রাজউকে চাকরি করে একটা ছেলের বায়োডাটা আছে না তোমার কাছে?
হঁ্যা।
কি যেন নাম?
কবির।
ওর বায়োডাটাটা একবার দেখো তো!
কেন দেখতে বলতেছিস?
ছেলেটার উচ্চতা কত?
পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি!
আমাদের ঝুমুর উচ্চতা?
ছয় ফুটেরও বেশী।
বুবু এই ছেলেটাকে কিন্তু আমার অনেক পছন্দ হয়েছে!
কিন্তু এত খাটো ছেলে?
বুবু আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।
কি বুদ্ধি? বল।
ছেলেটা যদি উচা জুতা পরে তাহলে ঝুমুর সাথে তাল খাবে না?
দূর অ, বিয়ে সাদী কি এভাবে হয়? নতুন একটা বায়োডাটা পাইছি। উচ্চতা ঝুমুর চেয়েও দুই ইঞ্চি বেশী। কলেজের শিক্ষক! ভাবতেছি সে দিকেই আগাব।
জহুরার কথা শুনে না-না করে উঠল সোমা। জহুরা মারাত্মক ভুল করতে যাচ্ছেন এটাই বোঝাতে চাইল সে। বুবু তুমি এইটা কি বলতেছ? কলেজের শিক্ষক? সরকারী না বেসরকারী কলেজ?
বোধ হয় বেসরকারী। লেখালেখি করে। দশ-বারোটা বই বার হইছে। আমাদের কাছে পাঠাইছে।
বুবু তোমার কি মাথা খারাপ হইছে?
কেন?
ঝুমুকে কি তোমরা সমুদ্রে ছুঁইড়া ফেলতে চাও?
এই কথা কেন বলতেছিস?
আজকালকার এই যুগে শিক্ষক, সাহিত্যিকদের কি দাম আছে!
কিন্তু এর চেয়ে ভালো তো পাইতেছি না।
সোমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। তার কাছে বেশ কয়েকজন পাত্রের বায়োডাটা আছে। সেখান থেকে খুঁজে নিয়ে জহুরাকে বলল- কলাবাগান থাইক্যা মিনহাজ নামে যে পাত্রের বায়োডাটা পাইছেন তার ব্যাপার কি হইল! পাত্র পিডবিস্নউডির ইঞ্জিনিয়ার। ঘুষের জগতে বাস করে। এই পাত্রের খবর কি? জহুরা বিরক্ত হয়ে বললেন- সব কিছুই তো ঠিক হয়ে গেছিলো। বাধা হয়ে দাঁড়াল উচ্চতা। ঝুমুর উচ্চতার চেয়ে পাঁচ ইঞ্চি ছোট। ঝুমু রাজী না।
টেলিফোন কোম্পানী থেকে একজন পাত্রের বায়োডাটা পাইছিলেন না? কি নাম যেন? ও হ্যা সৌরভ? ওটার খবর কি?
পাত্রের গায়ের রঙ ভালো না।
রেগে উঠলো সোমা। রঙ ধুইয়া কি পানি খাইবা? আচ্ছা, ডাক্তার ছেলেটার খবর কি? ঢাকা মেডিক্যালে চাকরি করে। এর চেয়ে ভালো পাত্র কি পাইবা?
জহুরা মন খারাপ করে বললেন- ছেলেটার ডিমান্ড অনেক। একটা বাড়ি লেইখ্যা চায়।
তার মানে ডাক্তার বিয়ে করতে রাজি?
হ্যা। বাড়ি যৌতুক হিসাবে দিতে হবে।
সোমা খুশী হয়ে বলল, তাহলে রাজি হইতেছ না কেন? ঢাকায় তোমাদের ৩টা বাড়ি। আগে আর পরে মেয়েকেতো একটা দিবাই। এখন দিতে সমস্যা কোথায়?
জহুরা বিরক্ত হয়ে বললেন- যৌতুক টৌতুক তোর দুলাভাইয়ের পছন্দ নয়। সে বোধ হয় প্রফেসরের ব্যাপারেই আগ্রহী।
জহুরার কথা টেনে নিল সোমা। গম্ভীর হয়ে বলল- তার মানে তোমরা ঝুমুর ভবিষ্যৎও নষ্ট করতে চাইতেছ। বুবু আমি এইটা হইতে দিব না। কক্ষনো না। বলেই টেলিফোন কেটে দিল সোমা। রাগে কাঁপছে সে। কোন কিছু ছুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা করছেঃ
ডাইনিং টেবিলে চুপচাপ বসে আছে আজাদ। রাগে ফুঁসছে সে। সব কিছুর একটা হেস্তন্যস্ত হওয়া দরকার। সোমা ভেবেছি কী? যখন যা খুশী তাই বলবে? আজাদকে বিয়ে করে সুখী হয়নি একথা সরাসরি বললেই হয়। এত রাখঢাক কেন? গত এক মাস ধরে প্রায় প্রতিদিন আজাদের ঘুম ভাঙ্গে সোমার টেলিফোন বৈঠকের হাঁক ডাক শুনে। বিছানার পাশেই টেলিফোন। হয়তো শুয়ে ঘুমাচ্ছে আজাদ। সোমা ঘন্টার পর ঘন্টা টেলিফোনে কথা বলেই যাচ্ছে। এটা নিত্যদিনের দৃশ্য। একটা মেয়ের বিয়ে নিয়ে এরা কিনা করছে। আজাদকে পাত্র খুঁজতে বলেছিল সোমা। আজাদ এর মধ্যে কমপক্ষে বিশজনের বায়োডাটা এনে দিয়েছে। কোনটাই পছন্দ হয়নি সোমার। কারও চেহারা পছন্দ হলে বংশ পছন্দ হয় না। কারও বংশ পছন্দ হলে চেহারা পছন্দ হয় না। একটা ছেলেকে মোটামুটি পছন্দ হল। ব্যাংকে চাকরি করে। দেখতে বেশ। সমস্যা দাঁড়াল তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা নিয়ে। ছেলেটি পরিবারের মধ্যে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। বাবা রিটায়ার করেছেন। দুই ভাই এক বোনকে তাকেই চালাতে হয়। সোমার এককথা এই সংসারে ঝুমু সুখ পাবে না। ঝুমুর ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাবে। আরেকটি ছেলের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত প্রায় পাকা হয়েই যাচ্ছিলো। টিভিতে অভিনয় করে। সোমাই ভেটো দিল। তার ধারণা এই ছেলেও ঝুমুকে সুখী করতে পারবে না। নামকরা অভিনেতা হওয়ার পর আরেকটা বিয়ে করবে। ঝুমু তখন অথৈ সমুদ্রে হাবুডুবু খাবে!
বুয়া টেবিলে নাস্তা দিয়েছে। অন্যদিন হলে এতক্ষণে সোমা আজাদের পাশে এসে বসত। সংসারের নানা কথা বলত। আজ তার দেখা নাই। আজাদ বুয়াকে ডাকে দিল। বুয়াঃ
জ্বে। বুয়া রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
বেগম সাহেবাকে ডাক দাও তো!
তিনি তো বাথরুমে।
এতক্ষণ বাথরুমে কি করে? ডাক দাও। বলো আমি ডাকতেছি।
বুয়া মাথা নীচু করে বলল- আমি পারতাম না।
কেন?
বুয়া ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল- মেম সাহেব বাথরুমের দরজা বন্ধ কইরা কাঁদতেছেন।
কাঁদছেন? কেন? অবাক হয়ে প্রশ্ন করল আজাদ।
এরপর বুয়ার উত্তরের অপেক্ষা না করে দ্রুত ঘরের দিকে পা বাড়াল। বাথরুম থেকে বেরিয়েছে সোমা। কান্নাকাটি করেছে এটা বোঝা যায়। আজাদের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। রেগে প্রশ্ন করল সে- সোমা তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
বল। নির্লিপ্ততা প্রকাশ করল সোমা।
তুমি এসব কি শুরু করেছ?
কি শুরু করেছি?
বুঝতে পারতেছ না?
না। বুঝিয়ে বল।
তুমি বাথরুমে কাঁদছিল কেন?
সোমা সরাসরি আজাদের চোখের দিকে তাকাল। সুখে, মহাসুখে কাঁদছিলাম। তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলেই চলে যাচ্ছিলো সোমা। আজাদ রেগে উঠল- সোমা দাঁড়াও।
ঘুরে দাঁড়াল সোমা।
আজ একটা বিষয় ক্লিয়ার করা দরকার। তুমি কি আমার ওপর খুব বেশী ক্ষুব্ধ?
বুঝলাম না।
বুঝেও না বোঝার ভান করো না। পষ্ট করে বলো!
আমাকে নিয়ে তোমার অনেক হতাশা। আমার জন্য তুমি হিল সেন্ডেল পরতে পার না। তোমার ভাষায় আমি স্মার্ট না। আমার শিক্ষকতা পেশাও তোমার পছন্দ নয়। এতো নেতিবাচক বিষয় তো সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পারে না। তুমি আসলে কি চাও?
কি চাই মানে? কি বলতে চাও তুমি?
তুমি কি আমাকে নিয়ে হ্যাপি?
সোমা রেগে উঠল- ধর আমি হ্যাপি না। তাহলে কি হবে? বলে কোন লাভ হবে?
কি লাভ চাও তুমি? আজাদও রেগে উঠল। রান্না ঘরের দরজা দিয়ে উঁকি মেরে ঘটনা দেখছিলো কাজের বুয়া। আজাদকে রাগতে দেখে ভয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। আজাদকে রাগতে দেখে সোমা আরো বেশী রেগে উঠল- চিৎকার করো না আস্তে কথা বল।
কেন আস্তে কথা বলব। আমি কাউকে ভয় পাই না। তুমি কি চাও বলো?
সোমা এবার হঠাৎ সিরিয়াস হয়ে উঠল- আমাদের বিয়ে হয়েছে ক'বছর বলো?
ধরো পাঁচ বছর।
এই পাঁচ বছরে তুমি আমাকে কি দিয়েছ বল!
কি দিয়েছি মানে?
কি দিয়েছ মানে বোঝ না। বিয়ের একটা আংটি এক গাছি স্বর্ণের মালা। একবারের জন্যও কোথাও বেড়াতে নিয়ে গেছ?
তার মানে তুমি আলাদা হতে চাও!
আজাদের কথা শুনে চিৎকার দিল সোমা- হঁ্যা আমি আলাদা হতে চাই। এবার খুশী হয়েছ? বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সোমা। আজাদের মনে হল তার পা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে।
হিমু একটা দীর্ঘ চিঠি লিখেছে। চিঠিখানা কয়েকবার পড়ল সোমা। "প্রিয় সোমা। আশা করি ভালই আছিস। মোবাইলের এই আধুনিক দুনিয়ায় চিঠি লেখা ভুলেই গিয়েছিলাম। তোর সাথে মোবাইলেই কথাগুলো বলতে পারতাম; কিন্তু কেন যেন মনে হলো চিঠিতেই জানাই। পারলাম নারে। সংসারটা টিকিয়ে রাখতে পারলাম না। ভালোবেসে বিয়ে করেছি। আমার চেয়েও বয়সে ছোট। হাইটও কম। কতজনে কত কথা বলেছে। কান দেইনি। কেন দেইনি জানিস? জর্জকে আমি খুব ভালবেসে ফেলেছিলাম। ওকে সাথে নিয়ে আমি একটা অচলায়তন ভাঙ্গতে চেয়েছিলাম। এরজন্য বাবা-মা ভাই-বোনকে ত্যাগ করেছি। সংসার জীবনের শুরুতে আমরা কিন্তু হ্যাপিই ছিলাম। তুই আমাকে মাঝে মাঝে প্রশ্ন করতিস্, জানতে চাইতিস আমি হ্যাপি কিনা। হঁ্যা আমি প্রচণ্ড হ্যাপি ছিলাম। সকালে আমি আমার কর্মক্ষেত্রে, জর্জ তার কর্মক্ষেত্রে বেরিয়ে যেত। আমরা দু'জন দু'জনকে জড়িয়ে ধরে বলতাম- ভালো থেকো সোনা। তারপর অফিসে গিয়ে ফোনের পর ফোন। কি করছো সোনা? ও বলতো কাজ করছি। মাঝে মাঝে ধমক দিত। এই মেয়ে এত ফোন করো কেন? তোমার বাবা-মাকে বলেদিব কিন্তু। চিন্তা কর কত সুখ ছিল সংসার জীবনের প্রথমদিকে। মাঝখানে হল কি, জর্জ হঠাৎ যেন বদলে যেতে থাকল। একদিন রাতে আমরা তুমুল ঝগড়া করলাম। ওর কোন বন্ধু বলেছে আমাকে নাকি ওর মায়ের মতো লাগে! চিন্তা কর, আমিও তো এই ধরনের কটূ কথা শুনেছি। তাই বলে সম্পর্ক শেষ করবো? কক্ষণো না; কিন্তু পারলাম না। কেন পারলাম না জানিস? জর্জ একটি মেয়েকে ভালোবাসে। ওরা বিয়ে করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত পরশু জর্জ আমাকে এই খবর জানায়। আমি এতটুকু রাগ করিনি। কাঁদিনি এতটুকুও। জর্জকে বলেছি- উইস ইউগুড লাক! জীবনটা কি এমনইরে সোমা? তোকে একটা কথা বলি। তোর অস্থিরতার খবরও আমি জানি। সংসার হল আসলে বিশ্বাসের জায়গা। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক টেনে টুনে হয় না। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য সেক্রিফাইস করতে হয়। ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে দিতে হয়। যদি সে ফিরে আসে তবেই বুঝবি সে তোকে ভালোবাসে। আমার ধারণা জর্জ একদিন আমার কাছে আবার ফিরে আসবে। ভালো থাকিস বন্ধু। আমার জন্য দোয়া করিস! ইতি তোর হিমু!
শরীর কাঁপছে সোমার। হিমুটা একা হয়ে গেল। ওর সাথে দেখা করতে হবে। তার আগে জহুরা আপার সাথে কথা বলা জরুরি। ঝুমুর বিয়ে নাকি ঠিক হয়ে গেছে।
পাত্র পিডবিস্নউডি'র সেই ইঞ্জিনিয়ার। চট্টগ্রামের বাসিন্দা। পারিবারিক অবস্থা বেশ ভালো। ঝুমুকে তাদের বেশ পছন্দ হয়েছে। জহুরা আপাকে টেলিফোন করলো সোমা।
জহুরাই ফোন রিসিভ করেছেন। উৎকণ্ঠা নিয়ে জানতে চাইলেন হ্যারে খবর শুনলাম সত্যি নাকি?
কি খবর?
আজাদের সাথে তোর কি ঝামেলা হয়েছে?
সোমা রেগে উঠলো- আজাদ কি তোমাদের কাছে নালিশ করেছে?
না। তুই রেগে যাচ্ছিস কেন?
রাগব না তো কি করব? ও আমার জীবনে একটা অভিশাপ। বুবু আমি ওর সাথে থাকতে পারব না।
তুই ভুল করতেছিস সোমা।
ঠিক আছে ভুল করলে আমি করব। তোমাদের কোন দায়-দায়িত্ব নাই।
তার মানে তুই সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিস?
হঁ্যা।
পস্তাবি কিন্তু একদিন।
ভয় দেখাবে না। আমি আমারটা ভাবব। তোমাদের কাউকেই ভাবতে হবে না।
তুই কি জানিস আজাদ একটা বড় কাজে হাত দিয়েছে?
বড় কাজ? ওর আবার কোন কাজ আছে নাকি? ও তো অফিসের কেরানী। কি সব ছাইপাঁশ লেখে। তুমি কি মনে কর ও হুমায়ূন আহমেদ হবে?
হতেও পারে। সোমা মাথা খারাপ করিস না।
মাথা আমার ঠিকই আছে। তুমি অন্য কথা বল। ঝুমুর বিয়ের কি হল? পিডবিস্নউডির ইঞ্জিনিয়ার ঠিক আছে?
এখন পর্যন্ত আছে।
এখন পর্যন্ত আছে মানে? তার মানে এখনও ঝামেলা আছে? সোমার প্রশ্ন শুনে হঠাৎ কেঁদে ফেললেন জহুরা। সোমা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল- আপা কি হয়েছে? আপাঃ
জহুরা কাঁদতেই থাকলেন।
রমনা রেস্তোরাঁয় বসে আছে সোমা। ঝুমুর তাকে এখানে আসতে বলেছে। হিমুর মতো ঝুমুরও একটা ভুল করেছে। বাবা-মার অমতে বিয়ে করেছে। তাও আবার উচ্চতায় তার চেয়ে ছোট। বয়স বোধকরি সমান সমান। হিমুকে সমর্থন করেছিল সোমা। কিন্তু ঝুমুকে সমর্থন করতে পারছে না। তবুও ঝুমুর আহবানে রমনা রেস্তোরাঁয় এসেছে সে। ঝুমুর বরকে সরাসরি দেখতে চায়।
জহুরা ফোন করেছেন। সোমা মোবাইল রিসিভ করে বলল-আপা বল।
ওরা কি এসেছে?
না। এখনও আসেনি।
তুই কি করতেছিস?
কিছু না। একা বসে আছি।
ওরা এলে আমাকে জানাস!
আচ্ছা।
সোমা শোন।
বল।
আজাদের সাথে তোর কি কোন যোগাযোগ নাই?
না। আপা আমি এ ব্যাপারে তোমার সাথে পরে কথা বলব। বলেই ফোন কেটে দিল সোমা।
ঝুমুকে দেখা যাচ্ছে। সাথে একটি ছেলে। সোমার থেকে হাইটে ছোট। তবে ছেলেটি দেখতে বেশ সুন্দর।
ঝুমু এগিয়ে এসে ছেলেটিকে নিয়ে সোমার সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বলল-খালামণি এর নাম রকিব। বুঝতেই পারছঃ
রকিব ছেলেটি বেশ বুদ্ধিমান। আইটি ইঞ্জিনিয়ার। একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজ করে। এই বয়সে এতদূর এগিয়েছে, সে কি শেষ পর্যন্ত ঝুমুর সাথে থাকবে? হিমুদের মতো হবে নাতো?
টেবিলে খাবার এলো। খেতে খেতে অনেক কথা হলো রকিবের সাথে। বেশ স্মার্ট। শুধু খাটো ছাড়া এই ছেলের অযোগ্যতা বলে তো কিছু নাই। তাহলে বুবু দুলাভাই আপত্তি করছে কেন? বিয়েটা মেনে নিচ্ছে না কেন? এ ব্যাপারে কথা বলতে হবে। ভাবতে না ভাবতেই জহুরা বুবুর ফোন এলো সোমার মোবাইলে। সোমা তড়িঘড়ি রিসিভ করে বলল- বুবু আমি খুব খুশী। ওরা সুখী হবে।
তাই! ঝুমুকে দেতো।
ঝুমুর আগেই মোবাইল নিল রকিব। জহুরাকে সালাম দিয়ে সরাসরি বলল- মা আমার নাম রকিব। আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করেছি। আমার অযোগ্যতা একটাই, আমি একটু খাটো। আমি যদি আপনার ছেলে হতাম আপনি কি করতেন? মা ফেলে দিতেন আমাকে?
রকিবের কথা শুনে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন জহুরা। কাঁদতে কাঁদতে বললেন- তোমরা আস। এক্ষুণি আমার কাছে আসো। আমি অপেক্ষা করতেছি। বলেই মোবাইল কেটে দিলেন জহুরা।
খাবারের টেবিলে সিদ্ধান্ত হল ঝুমু এবং রকিবকে নিয়ে জহুরা আপার কাছে যাবে সোমা। উঠে আসবে ভাবতেই ঝুমু একটা বই তুলে দিল সোমার হাতে। একটা উপন্যাস। কভারে লেখকের নাম দেখে চমকে উঠল সোমা। আজাদের ছবি কেন? বইয়ের পাতা খুলতেই উৎসর্গ পাতা নজরে পড়ল- 'প্রিয়তমেষু সোমাকে। যার কাছে আমার অনেক ঋণ'।
তার মানে আজাদ উপন্যাস লিখেছে? অথচ একথা একটি বারের জন্য জানায়নি। খুশিতে চোখের কোণে পানি এসে গেছে সোমার।
ঝুমু প্রশ্ন করলো- খালামনি
খালু উপন্যাস লেখেন তুমি জান না?
না, মানে আমি তেমন গুরুত্ব দেইনি।
বইটা দেখে কেমন লাগছে?
খুউব ভালো লাগছে!
গাড়িতে ওরা তিনজন উঠে বসেছে। শান্তিনগরে জহুরার কাছে যাবে। কিন্তু সেদিকে যেতে ইচ্ছে করছে না সোমার। জাহিদের কাছে যেতে ইচ্ছে করছে। হিমুর চিঠির কথা মনে পড়ল। ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে দিতে হয়। তারপর যদি সে ফিরে আসে তবে বুঝতে হবে ভালোবাসা আছে। মুখ ঢেকে হঠাৎ কেঁদে ফেলল সোমা! ঝুমু এবং রকিব কেউই বাধা দিল না। ভালোবাসার জন্য এই কান্নাটুকুর দরকার আছে। ভালোবাসা কাঁদলেই ভালোবাসা পোক্ত হয়।
==========================
কবর by জসীম উদ্দীন (পল্লীকবি)  গল্প- 'নদীর নাম চিলমারী' by নীলু দাস  গল্প- 'লাউয়ের ডগা' by নূর কামরুন নাহার  গল্প- 'অপূর্ব সৃষ্টি' by পারভীন সুলতানা গল্প- 'ঊনচলিস্নশ বছর আগে' by জামাল উদ্দীন  গল্প- 'সুচ' by জাফর তালুকদার   গল্প- 'বাসস্ট্যান্ডে যে দাঁড়িয়েছিল' by ঝর্না রহমান  গল্প- 'গন্না' by তিলোত্তমা মজুমদার  গল্প- 'ঘুড়িয়াল' by শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়  গল্প- 'প্রক্ষেপণ' by মোহিত কামাল  গল্প- 'গন্তব্য বদল' by রফিকুর রশীদ  গল্প- 'ঝড়ের রাতে' by প্রচেত গুপ্ত  গল্প- 'শুধু একটি রাত' by সাইপ্রিয়েন এক্ওয়েন্সি। অনুবাদ বিপ্রদাশ বড়ুয়া  গল্প- 'পিতা ও কুকুর ছানা' by হরিপদ দত্ত  স্মরণ- 'শওকত ভাই : কিছু স্মৃতি' by কবীর চৌধুরী  সাহিত্যালোচনা- 'রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পালাকারের নাটক  স্মরণ- 'আবদুল মান্নান সৈয়দ : কবি ও প্রাবন্ধিক' by রাজু আলাউদ্দিন  স্মরণ- 'সিদ্ধার্থ শংকর রায়: মহৎ মানুষের মহাপ্রস্থানে by ফারুক চৌধুরী  গল্প- 'ফাইভ স্টার' by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম  গল্প- 'নূরে হাফসা কোথায় যাচ্ছে?' by আন্দালিব রাশদী  গল্প- 'হার্মাদ ও চাঁদ' by কিন্নর রায়  গল্প- 'মাটির গন্ধ' by স্বপ্নময় চক্রবর্তী  সাহিত্যালোচনা- 'কবি ওলগা ফিওদোরোভনা বার্গলজ'  গল্পিতিহাস- 'বালিয়াটি জমিদারবাড়ির রূপগল্প' by আসাদুজ্জামান  ফিচার- ‘কাপ্তাই লেক:ক্রমেই পতিত হচ্ছে মৃত্যুমুখে' by আজিজুর রহমান



দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্য
লেখকঃ রেজানুর রহমান


এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.