ভাষাশহীদ বরকতের কথা -একুশে by দীপংকর চন্দ
জয়দেবপুর চৌরাস্তা থেকে সদর অভিমুখী পথে খানিকক্ষণ হেঁটেই নলজানি পৌঁছলাম। হাতের বাঁ দিকে একতলা মার্কেটের সামনে চারপাশ ঘেরা একটি কবর। একটি সাইনবোর্ড সেই কবরের কাছেই। পরিচিতি-জ্ঞাপক কালো সাইনবোর্ডটির ওপর সাদা হরফে লেখা হাজি হাসিনা বিবির নাম। হ্যাঁ, হাজি হাসিনা বিবি ভাষাশহীদ আবুল বরকতের গর্ভধারিণী। ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গকারী আবুল বরকতের মা হাসিনা বিবি মারা যান ১৯৮২ সালের ২১ এপ্রিল। ‘তবে তাঁদের উত্তরসূরিরা এখনো বসবাস করেন বরকত মঞ্জিল নামের ওই বাড়িটিতে।’ আঙুল তুলে নির্মাণাধীন একটি বহুতল বাড়ি দেখাতে দেখাতে জানালেন জয়দেবপুরের স্থানীয় বাসিন্দা মাজেদুল ইসলাম।
বরকত মঞ্জিলে বর্তমানে বসবাস করেন ভাষাশহীদ আবুল বরকতের ছোট ভাই মরহুম আবুল হাসনাতের সন্তান-সন্ততিরা। মনোরম এক ছায়াঘেরা বিকেলে কথা হলো মরহুম আবুল হাসনাতের বড় ছেলে সঙ্গে। না, অকৃতদার বড় চাচার প্রত্যক্ষ কোনো স্মৃতি নেই তাঁর কাছে। তাঁর জন্ম বড় চাচা শহীদ হওয়ার আট বছর পর, অর্থাৎ ১৯৬০ সালে। তবে জন্মের পর থেকেই দাদিসহ সংসারের বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে মুখে চাচা আবুল বরকতের স্মৃতিবিজড়িত নানা কথা শুনেছেন তিনি। দেখেছেন বাড়িতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বেশ কিছু স্মৃতিস্মারকও। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বড় চাচা আবুল বরকত সম্পর্কে এক ধরনের পরোক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন আলাউদ্দিন বরকত। আমরা তাঁর অভিজ্ঞতার অংশ হওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করি। আমাদের আন্তরিক অভিপ্রায় আলাউদ্দিন বরকতকে উদ্বুদ্ধ করে ভাষাশহীদ আবুল বরকতের জীবনচরিত বর্ণনায়।
‘ভাষাশহীদ আবুল বরকতের জন্ম ১৯২৭ সালের ১৬ জুন। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমার ভরতপুর থানার বাবলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর পিতার নাম মৌলভি শামসুজ্জোহা ওরফে ভুলু মিয়া। তিন বোন, দুই ভাইয়ের মধ্যে আবুল বরকতের স্থান চতুর্থ।’
‘আবুল বরকতের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনা হয় বাবলা বহড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হওয়ার পর তিনি ভর্তি হন তালিবপুর উচ্চবিদ্যালয়ে। বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার দূরের এই বিদ্যালয় থেকেই ১৯৪৫ সালে মাধ্যমিক শিক্ষার গণ্ডি অতিক্রম করেন তিনি। শিক্ষা গ্রহণের পরবর্তী ধাপে পা রাখতে বহরমপুর চলে যান আবুল বরকত। ভর্তি হন বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে। এই কলেজ থেকেই ১৯৪৭ সালে আইএ পাস করেন তিনি। সে বছরের আগস্ট মাসেই ভাগ হয় দেশ। আকস্মিক দেশভাগ কিছুটা হলেও দ্বিধায় ফেলে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে উন্মুখ আবুল বরকতকে। উচ্চশিক্ষার্থে কোথায় যাবেন তিনি? কলকাতায়, না ঢাকায়? সব দ্বিধার অবসান ঘটিয়ে ১৯৪৮ সালে ঢাকায় এলেন আবুল বরকত। ঢাকায় পুরানা পল্টন লেনের বিষ্ণুপ্রিয়া ভবনে তখন বসবাস করতেন তাঁর মামা আবদুল মালেক। তিনি চাকরি করতেন ওয়াপদায়, বেশ উঁচু পদে। ঢাকায় এসে মামা আবদুল মালেকের বাসায় উঠলেন আবুল বরকত। কয়েক দিনের মধ্যেই ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। লেখাপড়া শুরু হলো। অতিক্রান্ত হলো বেশ কিছু বছর। সম্মান চূড়ান্ত বর্ষের পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণীতে চতুর্থ স্থান অর্জন করলেন আমার বড় চাচা।’ দীর্ঘ বক্তব্যের এ পর্যায়ে খানিকটা বিরতি নিলেন আলাউদ্দিন বরকত। চোখ বুজে স্মৃতির পাতা ওল্টালেন মনে মনে। এরপর কথা শুরু করলেন আবার। ‘১৯৫২ সালে আমার চাচা আবুল বরকত ছিলেন এমএ শেষ বর্ষের ছাত্র। তখন তিনি লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে অল্পবিস্তর রাজনীতি করছেন। ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি কর্মকাণ্ডের সঙ্গেই তিনি নিশ্চিত করছেন তাঁর সংযুক্তি।’
‘একুশে ফেব্রুয়ারি। সেদিন ১৪৪ ধারা জারি ছিল ঢাকায়। বেলা ১১টার দিকে মধুর ক্যান্টিনের সামনে অনুষ্ঠিত সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সদলবলে পথে নেমে এল ছাত্ররা। ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে শুরু হলো স্লোগান। শুরু হলো ছাত্র-জনতার সম্মিলিত মিছিল। শাসকগোষ্ঠীর কঠোর নির্দেশে পুলিশ পিছু হটল না মোটেই। কিছু ছাত্রকে গ্রেপ্তার তো করলই তারা, এগিয়ে এসে লাঠিচার্জ করল, নিক্ষেপ করল কাঁদানে গ্যাস। ছাত্র-জনতা ছত্রভঙ্গ হলো। কিন্তু তা অল্প সময়ের জন্য। আবার তারা সংগঠিত হলো দ্রুত মেডিকেল কলেজ হোস্টেল ব্যারাকের সামনে। দুপুরের পরপরই তীব্র হলো আন্দোলন। তীব্র হলো পুলিশের সহিংস মনোভাবও। বেলা তিনটার দিকে ছাত্র-জনতার সমাবেশ লক্ষ্য করে গুলি চালাল পুলিশ। সেই গুলিতে ঘটনাস্থলেই শহীদ হলেন রফিক উদ্দিন আহমদ। গুলি লাগল গফরগাঁওয়ের আবদুল জব্বার, দাগনভূঞার আবদুস সালাম এবং আমার বড় চাচা আবুল বরকতের শরীরেও।’
তারপর? ঘটনা বর্ণনার এ পর্যায়ে কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারি না আমরা। জানতে চাই বহুবর্ণিত ঘটনাই রুদ্ধশ্বাসে আবার। আলাউদ্দিন বরকত একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে ধীরে ধীরে বলেন, ‘তারপর আর কী! জব্বার, সালাম আর বরকতকে ধরাধরি করে নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত আটটার দিকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন আমার বড় চাচা।’
বরকত মঞ্জিলে বর্তমানে বসবাস করেন ভাষাশহীদ আবুল বরকতের ছোট ভাই মরহুম আবুল হাসনাতের সন্তান-সন্ততিরা। মনোরম এক ছায়াঘেরা বিকেলে কথা হলো মরহুম আবুল হাসনাতের বড় ছেলে সঙ্গে। না, অকৃতদার বড় চাচার প্রত্যক্ষ কোনো স্মৃতি নেই তাঁর কাছে। তাঁর জন্ম বড় চাচা শহীদ হওয়ার আট বছর পর, অর্থাৎ ১৯৬০ সালে। তবে জন্মের পর থেকেই দাদিসহ সংসারের বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে মুখে চাচা আবুল বরকতের স্মৃতিবিজড়িত নানা কথা শুনেছেন তিনি। দেখেছেন বাড়িতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বেশ কিছু স্মৃতিস্মারকও। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বড় চাচা আবুল বরকত সম্পর্কে এক ধরনের পরোক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন আলাউদ্দিন বরকত। আমরা তাঁর অভিজ্ঞতার অংশ হওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করি। আমাদের আন্তরিক অভিপ্রায় আলাউদ্দিন বরকতকে উদ্বুদ্ধ করে ভাষাশহীদ আবুল বরকতের জীবনচরিত বর্ণনায়।
‘ভাষাশহীদ আবুল বরকতের জন্ম ১৯২৭ সালের ১৬ জুন। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমার ভরতপুর থানার বাবলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর পিতার নাম মৌলভি শামসুজ্জোহা ওরফে ভুলু মিয়া। তিন বোন, দুই ভাইয়ের মধ্যে আবুল বরকতের স্থান চতুর্থ।’
‘আবুল বরকতের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনা হয় বাবলা বহড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হওয়ার পর তিনি ভর্তি হন তালিবপুর উচ্চবিদ্যালয়ে। বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার দূরের এই বিদ্যালয় থেকেই ১৯৪৫ সালে মাধ্যমিক শিক্ষার গণ্ডি অতিক্রম করেন তিনি। শিক্ষা গ্রহণের পরবর্তী ধাপে পা রাখতে বহরমপুর চলে যান আবুল বরকত। ভর্তি হন বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে। এই কলেজ থেকেই ১৯৪৭ সালে আইএ পাস করেন তিনি। সে বছরের আগস্ট মাসেই ভাগ হয় দেশ। আকস্মিক দেশভাগ কিছুটা হলেও দ্বিধায় ফেলে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে উন্মুখ আবুল বরকতকে। উচ্চশিক্ষার্থে কোথায় যাবেন তিনি? কলকাতায়, না ঢাকায়? সব দ্বিধার অবসান ঘটিয়ে ১৯৪৮ সালে ঢাকায় এলেন আবুল বরকত। ঢাকায় পুরানা পল্টন লেনের বিষ্ণুপ্রিয়া ভবনে তখন বসবাস করতেন তাঁর মামা আবদুল মালেক। তিনি চাকরি করতেন ওয়াপদায়, বেশ উঁচু পদে। ঢাকায় এসে মামা আবদুল মালেকের বাসায় উঠলেন আবুল বরকত। কয়েক দিনের মধ্যেই ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। লেখাপড়া শুরু হলো। অতিক্রান্ত হলো বেশ কিছু বছর। সম্মান চূড়ান্ত বর্ষের পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণীতে চতুর্থ স্থান অর্জন করলেন আমার বড় চাচা।’ দীর্ঘ বক্তব্যের এ পর্যায়ে খানিকটা বিরতি নিলেন আলাউদ্দিন বরকত। চোখ বুজে স্মৃতির পাতা ওল্টালেন মনে মনে। এরপর কথা শুরু করলেন আবার। ‘১৯৫২ সালে আমার চাচা আবুল বরকত ছিলেন এমএ শেষ বর্ষের ছাত্র। তখন তিনি লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে অল্পবিস্তর রাজনীতি করছেন। ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি কর্মকাণ্ডের সঙ্গেই তিনি নিশ্চিত করছেন তাঁর সংযুক্তি।’
‘একুশে ফেব্রুয়ারি। সেদিন ১৪৪ ধারা জারি ছিল ঢাকায়। বেলা ১১টার দিকে মধুর ক্যান্টিনের সামনে অনুষ্ঠিত সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সদলবলে পথে নেমে এল ছাত্ররা। ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে শুরু হলো স্লোগান। শুরু হলো ছাত্র-জনতার সম্মিলিত মিছিল। শাসকগোষ্ঠীর কঠোর নির্দেশে পুলিশ পিছু হটল না মোটেই। কিছু ছাত্রকে গ্রেপ্তার তো করলই তারা, এগিয়ে এসে লাঠিচার্জ করল, নিক্ষেপ করল কাঁদানে গ্যাস। ছাত্র-জনতা ছত্রভঙ্গ হলো। কিন্তু তা অল্প সময়ের জন্য। আবার তারা সংগঠিত হলো দ্রুত মেডিকেল কলেজ হোস্টেল ব্যারাকের সামনে। দুপুরের পরপরই তীব্র হলো আন্দোলন। তীব্র হলো পুলিশের সহিংস মনোভাবও। বেলা তিনটার দিকে ছাত্র-জনতার সমাবেশ লক্ষ্য করে গুলি চালাল পুলিশ। সেই গুলিতে ঘটনাস্থলেই শহীদ হলেন রফিক উদ্দিন আহমদ। গুলি লাগল গফরগাঁওয়ের আবদুল জব্বার, দাগনভূঞার আবদুস সালাম এবং আমার বড় চাচা আবুল বরকতের শরীরেও।’
তারপর? ঘটনা বর্ণনার এ পর্যায়ে কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারি না আমরা। জানতে চাই বহুবর্ণিত ঘটনাই রুদ্ধশ্বাসে আবার। আলাউদ্দিন বরকত একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে ধীরে ধীরে বলেন, ‘তারপর আর কী! জব্বার, সালাম আর বরকতকে ধরাধরি করে নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত আটটার দিকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন আমার বড় চাচা।’
No comments