অযোগ্য ‘আওয়ামীদের’ নিয়োগ নয় by মিজানুর রহমান খা
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বাহাত্তরের সংবিধান সম্পর্কে কতিপয় ক্ষেত্রে ভিন্নমত দিয়েছিলেন। এই ভিন্নমত-সংবলিত চূড়ান্ত খসড়া ১২ অক্টোবর ১৯৭২ গেজেটে ছাপা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টে নতুন বিচারক নিয়োগের চলতি তোড়জোড় সামনে রেখে আমি আজ তাঁর সেই ভিন্নমত থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত লিখেছিলেন, ‘মি. চেয়ারম্যান স্যার, সংবিধানের ৯৫(২) অনুচ্ছেদের ক দফায় বর্ণিত বিচারক নিয়োগের যোগ্যতা সম্পর্কে যে বিধান রাখা হয়েছে, সে সম্পর্কে আমি দৃঢ়তার সঙ্গে আপত্তি জানাচ্ছি।’ ওই অনুচ্ছেদ বলেছে, বিচারক হতে হলে দুটো শর্তের একটি পূরণ করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টে অ্যাডভোকেট হিসেবে, না হয় কোনো বিচার বিভাগীয় পদে অন্যূন ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। শ্রী সেনগুপ্তের যুক্তি ছিল, ‘কেউ ১০ বছর বা তার বেশি সময় ওকালতি করলেই তিনি বিচারক হতে পারেন না। কারণ সে ধরনের নিয়োগে রাজনৈতিক নিয়োগের সম্ভাবনা থাকবে। আর এর ফলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং মৌলিকত্ব নিশ্চিতভাবেই লুপ্ত হবে।’ আমরা আজ বেদনার সঙ্গে লক্ষ করি যে শ্রী সেনগুপ্তর আশঙ্কা কী নিষ্ঠুরভাবে সত্যে পরিণত হয়েছে। বড় অবাক হয়ে ভাবি, তিনি কী করে এ রকম একটি বিষয়ে নির্দিষ্টভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, যা অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হলো?
শ্রী সেনগুপ্ত কষ্ট চেপে স্বস্তি অনুভব করতে পারেন এটা লক্ষ করে যে, সেই সংবিধান প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান কামাল হোসেন ইতিমধ্যেই আক্ষেপ করেছেন যে সুপ্রিম কোর্টে একটি সুনামি আসা উচিত। আরেক বরেণ্য আইনবিদ মাহমুদুল ইসলাম ২০০৬ সালে লিখলেন, ‘কেবল অল্পসংখ্যক বিচারকই দক্ষ। এবং তাঁদের মধ্যে অতি কমসংখ্যক বিচারকই তাঁদের দক্ষতার জন্য গর্ব করতে পারেন। বিচারকদের নৈতিকতা ও সততা প্রশ্নবিদ্ধ।’ এই প্রেক্ষাপটে হাইকোর্টের বিচারক নিয়োগে আমরা জরুরি অবস্থায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশন পেলাম। এরপর আমরা সেই কমিশনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিলাম। অতঃপর হাইকোর্টের রায় এল। বিএনপি আমলে আওয়ামী হিসেবে বাদ পড়া ১০ বিচারকের পুনর্বহাল আমরা দেখলাম। হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চকে বিচারক নিয়োগে গ্রহণযোগ্য নীতিমালা দিতে দেখলাম। আপিল বিভাগ তা অনেকটাই বিসর্জন দিলেন। তাঁরা যেন কার্যত প্রধান বিচারপতির সঙ্গে নিছক পরামর্শের বিধানটা টেকালেন। আপিল বিভাগের পরিমার্জিত নীতিমালার ৯ নম্বর দফাটি নির্দিষ্টভাবে বলেছে, ‘প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ কিংবা সংবিধানে বর্ণিত যোগ্যতার শর্ত পূরণের ঘাটতির প্রশ্ন ছাড়া অন্য কোনো কারণেই বিচারক নিয়োগের বৈধতা বিচার্য নয়।’ এমনকি ‘পক্ষপাত ও অসদুদ্দেশ্যে’ নিয়োগের যুক্তিতেও চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। হাইকোর্টের রায়ের সবচেয়ে সংবেদনশীল অংশটাও বাদ পড়ল। সেটি ছিল, নতুন বিচারক নিয়োগে প্রথম বাছাই তালিকাটা জন্ম নেবে মাতৃজঠরেই অর্থাৎ সুপ্রিমকোর্টেই।
ডেইলি স্টার-এ খবর এসেছে, ১৫ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে এ সপ্তাহেই। অথচ কীভাবে আগেই তালিকা তৈরি হলো, তার স্পন্দন টের পেলাম না। বিএনপির মাথাব্যথা না থাকাই স্বাভাবিক। কারণ তারা চাইবেই আওয়ামী লীগ যেন তাদের টেক্কা দিতে পারে!
প্রধান বিচারপতি সম্পদের বিবরণী প্রকাশে অভিপ্রেত মত দিয়েছেন। প্রথম আলোতে এ ব্যাপারে সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে। প্রধান বিচারপতিকে সাধুবাদ জানানো হয়েছে। সম্পাদকীয়তে আশা প্রকাশ করে বলা হয়েছে ‘আমরা প্রধান বিচারপতির দিকে তাকিয়ে’। আইনবিদ শাহদীন মালিক এর প্রতিক্রিয়ায় প্রথম আলোতে লিখলেন, যতক্ষণ খুশি তাকিয়ে থাকুন। খোঁচাটা হজম করতে না হলে আমরা সবাই খুব খুশি হব।
কিছুদিন আগে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এক সভায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি ইফতেখার চৌধুরীর ভূমিকার প্রশংসা করেন। বিচারপতি চৌধুরীকে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ অপসারণ করেছিলেন। তাতে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক আন্দোলন বেগবান হয়ে ওঠে। পারভেজীয় সামরিক জমানার অবসানে বিচারপতি চৌধুরীর অবদান বিরাট। তিনি প্রধান বিচারপতি পদে পুনর্বহাল হন। বিশ্বের ইতিহাসে এ এক নজিরবিহীন ঘটনা। ডন পত্রিকার এক প্রতিবেদনে গত রোববার পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি-রাষ্ট্রপতির মধ্যকার টানোপোড়েনের খবর প্রকাশিত হয়েছে। নির্বাসিত জীবনে বেনজির ও নওয়াজ শরিফ গণতন্ত্রের সনদ তৈরি করেছিলেন। তাতে তাঁরা বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে গণশুনানি করে বিচারক নিয়োগের বিধানের কথা বলেছিলেন। এখন তা পিপিপি ও মুসলিম লীগ ভুলে গেছে। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ না করেই দুটি নিয়োগ দেন আসিফ জারদারি। লাহোর হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি খাজা মোহাম্মদ শরিফকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক এবং বিচারপতি সাকিব নেসারকে লাহোর হাইকোর্টের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি করা হয়। গত শনিবার তাঁদের নিয়োগ হয়। তাঁরা শপথ নিতে যাচ্ছিলেন। প্রধান বিচারপতি ইফতেখার চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিতভাবে সরকারের বিরুদ্ধে রুল জারি করেন। তাঁরা ‘অসাংবিধানিক’ বলে দুটি নিয়োগ স্থগিত রেখেছেন। জারদারি যে কাণ্ড করলেন, তা রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস ১৯৯৪ সালে করেছিলেন। প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ ‘মি. নোবডি’ বলাতে ঝড় উঠেছিল। নিয়োগ বাতিল করে নতুন করে প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়ার উদারতায় অল্পের ওপর দিয়ে ধকল যায়। এবার পাকিস্তানের ঘটনা দেখার মতো। বিচারপতি ইফতেখার চৌধুরী শুধু ‘নো বডি’ বলার লোক নন। তিনি বিচারপতিদের নিয়োগ স্থগিত করে দুনিয়ার সব সাহসী প্রধান বিচারপতির জন্য অনুকরণীয় নজির তৈরি করলেন। পাকিস্তানের অন্তত ৬৬টি বার অ্যাসোসিয়েশন সর্বসম্মতিক্রমে রাষ্ট্রপতির ওই নিয়োগকে অবৈধ বলে সিদ্ধান্ত প্রস্তাব পাস করেছে।
আমরা আমাদের আপিল বিভাগের কাছ থেকে বিচারক নিয়োগে একটি প্রশ্নবিদ্ধ বিচারক নিয়োগ নীতিমালা পেয়েছি। এই নীতিমালায় সরকারের সঙ্গে ভীষণ রকম আপস করা হয়েছে। সুতরাং নতুন করে এখন ১৫ জন হাইকোর্টের বিচারক নিয়োগের কথা জেনে আমরা উত্কণ্ঠিত। এরপর আরও নেওয়া হবে। শোনা যাচ্ছে, সরকার ও সুপ্রিম কোর্ট বার একাট্টা হয়েছে, তারা আর ভুলেও বিএনপি আমলের বিতর্কিত বিচারকদের নিয়োগের বিরোধিতা করে নেওয়া রেজুলেশনের কথা মুখে আনবে না। তার চেয়ে বরং চাপে রেখে সংখ্যা দিয়ে তথাকথিত বিএনপিপন্থী বিচারপতিদের সংখ্যালঘু করবে।
আওয়ামী লীগের সমর্থক আইনজীবীরা আমাদের ইতিমধ্যে শিখিয়েছেন যে বিচারক নিয়োগ নিয়ে কী করে সংকীর্ণ রাজনীতি করতে হয়। জোট সরকারের আমলে উনিশজন বিচারক (যোগ্যতাসম্পন্নরাও এখানে আছেন) নিয়োগ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বার নিদারুণ লম্ফঝম্ফ করেছিল। আইনের শাসনের জন্য মায়াকান্না করেছিল। তাঁরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার স্লোগান তুলেছিল। এখনো তারা জোট সরকারের নানা কাণ্ডকীর্তির সমালোচনায় মুখর, কিন্তু ওই একটি বিষয় বাদে। অতি যত্নের সঙ্গে তারা সেই রেজুলেশন প্রসঙ্গ এড়িয়ে চলে।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে উনিশজন বিচারকের নিয়োগ নিয়ে তবু প্রতিবাদের একটা আওয়াজ উঠেছিল। এবার সে ধরনের কোনো বিপর্যয় ঘটলে প্রতিবাদ করারও কেউ থাকবে না। কারণ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির বর্তমান নেতারা একান্তভাবে আওয়ামী লীগের অনুগত। তাঁদের কাছ থেকে অতীতের মতো রেজুলেশন পাস করা তো দূরের কথা, বরং তাঁরা অন্ধের মতো সাধুবাদ জানানোর জন্য প্রস্তুত থাকবেন। সুতরাং একটি সম্ভাব্য বিপর্যয় থেকে রেহাই পেতে চাইলে নাগরিক সমাজকে কালবিলম্ব না করে প্রস্তুতি নিতে হবে।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বক্তব্য আমরা স্মরণ করি। পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনাটা সহায়ক হবে। বাহাত্তরে তিনি ভিন্নমতে লেখেন, ‘অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি, ক্ষমতাসীন সরকারের সঙ্গে যাঁদের রাজনৈতিক যোগাযোগ রয়েছে, যাঁরা সব সময় ব্যক্তিস্বার্থচিন্তাতাড়িত এবং যাঁরা তোষামোদি কলা রপ্ত করেছেন, তাঁরাই বিচারক পদে নিয়োগ পেয়েছেন। সে কারণে আমি মনে করি, অতীতের অভিজ্ঞতা হওয়া উচিত আমাদের সংবিধান প্রণয়নের পাথেয়। বিচার বিভাগের মর্যাদাকে খাটো করে, তাঁর স্বাধীনতাকে বিপন্ন করে এমনভাবে বিচারক নিয়োগের সুযোগ থাকা উচিত নয়।’
হলফ করে বলতে পারি, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শতভাগ অভ্রান্ত। কিন্তু আমরা কেবল আফসোস করব না। এখন সময় এসেছে বিচারক নিয়োগে সংসদে একটি উপযুক্ত আইন তৈরি করা। এই রাষ্ট্রের জন্মলগ্নে আইনজীবীদের মধ্য থেকে বিচারক নিয়োগের ওই দফাটি বিলোপ করতে সেনগুপ্ত সুপারিশ করেছিলেন। বলেছিলেন অধস্তন আদালতে কর্মরত বিচারকদের মধ্য থেকে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে বিচারক নিয়োগ দিতে। কী আশ্চর্য, এম হাফিজ উদ্দীন খান ঠিক এমন একটি সুপারিশ করেছেন সমপ্রতি। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে তাঁর ভিন্নমতের জন্য অভিবাদন জানাই। তবে জেলা জজ থেকে শতভাগ বিচারক হয়তো বাস্তব নয়, কিন্তু জেলা জজদের অচ্ছুত্ ভেবে বর্তমানে যেভাবে নিয়োগ চলছে, তা অবশ্যই বদলানো উচিত। দশজন নিলে দুজন জেলা জজ নিয়োগের চলতি রীতি অসাংবিধানিক।
আমরা গোপন বিচারের মতো গোপন বিচারক নিয়োগ চাই না। তবে আপাতত প্রার্থনা এই—আওয়ামী মনোভাবাপন্ন অনেক ভালো আইনজীবী রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতে দিন। অযোগ্য ‘আওয়ামীদের’ নিয়োগ দেবেন না। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সেই মোসাহেবরা আজও সমান সক্রিয়।
পুনশ্চ: গত ২৫ জানুয়ারি ‘প্রধান বিচারপতি নিয়োগে সমীকরণ’ শীর্ষক লেখায় অনবধানতাবশত উল্লেখ করেছিলাম, বিচারপতি মো. ফজলুল করিম প্রধান বিচারপতি হলে বিচারপতি মো. আবদুল মতিনের প্রধান বিচারপতি হওয়ার সম্ভাবনা তিরোহিত হবে। এটি সঠিক নয়। প্রধান বিচারপতি অবসরে যাবেন আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর। এরপর বিচারপতি আবদুল মতিনই হবেন জ্যেষ্ঠতম। তিনি প্রধান বিচারপতি হলে সে পদে থাকবেন ২৫ ডিসেম্বর ২০১০ পর্যন্ত। অনিচ্ছাকৃত এই ভুলের জন্য আমি দুঃখিত।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত লিখেছিলেন, ‘মি. চেয়ারম্যান স্যার, সংবিধানের ৯৫(২) অনুচ্ছেদের ক দফায় বর্ণিত বিচারক নিয়োগের যোগ্যতা সম্পর্কে যে বিধান রাখা হয়েছে, সে সম্পর্কে আমি দৃঢ়তার সঙ্গে আপত্তি জানাচ্ছি।’ ওই অনুচ্ছেদ বলেছে, বিচারক হতে হলে দুটো শর্তের একটি পূরণ করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টে অ্যাডভোকেট হিসেবে, না হয় কোনো বিচার বিভাগীয় পদে অন্যূন ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। শ্রী সেনগুপ্তের যুক্তি ছিল, ‘কেউ ১০ বছর বা তার বেশি সময় ওকালতি করলেই তিনি বিচারক হতে পারেন না। কারণ সে ধরনের নিয়োগে রাজনৈতিক নিয়োগের সম্ভাবনা থাকবে। আর এর ফলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং মৌলিকত্ব নিশ্চিতভাবেই লুপ্ত হবে।’ আমরা আজ বেদনার সঙ্গে লক্ষ করি যে শ্রী সেনগুপ্তর আশঙ্কা কী নিষ্ঠুরভাবে সত্যে পরিণত হয়েছে। বড় অবাক হয়ে ভাবি, তিনি কী করে এ রকম একটি বিষয়ে নির্দিষ্টভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, যা অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হলো?
শ্রী সেনগুপ্ত কষ্ট চেপে স্বস্তি অনুভব করতে পারেন এটা লক্ষ করে যে, সেই সংবিধান প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান কামাল হোসেন ইতিমধ্যেই আক্ষেপ করেছেন যে সুপ্রিম কোর্টে একটি সুনামি আসা উচিত। আরেক বরেণ্য আইনবিদ মাহমুদুল ইসলাম ২০০৬ সালে লিখলেন, ‘কেবল অল্পসংখ্যক বিচারকই দক্ষ। এবং তাঁদের মধ্যে অতি কমসংখ্যক বিচারকই তাঁদের দক্ষতার জন্য গর্ব করতে পারেন। বিচারকদের নৈতিকতা ও সততা প্রশ্নবিদ্ধ।’ এই প্রেক্ষাপটে হাইকোর্টের বিচারক নিয়োগে আমরা জরুরি অবস্থায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশন পেলাম। এরপর আমরা সেই কমিশনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিলাম। অতঃপর হাইকোর্টের রায় এল। বিএনপি আমলে আওয়ামী হিসেবে বাদ পড়া ১০ বিচারকের পুনর্বহাল আমরা দেখলাম। হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চকে বিচারক নিয়োগে গ্রহণযোগ্য নীতিমালা দিতে দেখলাম। আপিল বিভাগ তা অনেকটাই বিসর্জন দিলেন। তাঁরা যেন কার্যত প্রধান বিচারপতির সঙ্গে নিছক পরামর্শের বিধানটা টেকালেন। আপিল বিভাগের পরিমার্জিত নীতিমালার ৯ নম্বর দফাটি নির্দিষ্টভাবে বলেছে, ‘প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ কিংবা সংবিধানে বর্ণিত যোগ্যতার শর্ত পূরণের ঘাটতির প্রশ্ন ছাড়া অন্য কোনো কারণেই বিচারক নিয়োগের বৈধতা বিচার্য নয়।’ এমনকি ‘পক্ষপাত ও অসদুদ্দেশ্যে’ নিয়োগের যুক্তিতেও চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। হাইকোর্টের রায়ের সবচেয়ে সংবেদনশীল অংশটাও বাদ পড়ল। সেটি ছিল, নতুন বিচারক নিয়োগে প্রথম বাছাই তালিকাটা জন্ম নেবে মাতৃজঠরেই অর্থাৎ সুপ্রিমকোর্টেই।
ডেইলি স্টার-এ খবর এসেছে, ১৫ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে এ সপ্তাহেই। অথচ কীভাবে আগেই তালিকা তৈরি হলো, তার স্পন্দন টের পেলাম না। বিএনপির মাথাব্যথা না থাকাই স্বাভাবিক। কারণ তারা চাইবেই আওয়ামী লীগ যেন তাদের টেক্কা দিতে পারে!
প্রধান বিচারপতি সম্পদের বিবরণী প্রকাশে অভিপ্রেত মত দিয়েছেন। প্রথম আলোতে এ ব্যাপারে সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে। প্রধান বিচারপতিকে সাধুবাদ জানানো হয়েছে। সম্পাদকীয়তে আশা প্রকাশ করে বলা হয়েছে ‘আমরা প্রধান বিচারপতির দিকে তাকিয়ে’। আইনবিদ শাহদীন মালিক এর প্রতিক্রিয়ায় প্রথম আলোতে লিখলেন, যতক্ষণ খুশি তাকিয়ে থাকুন। খোঁচাটা হজম করতে না হলে আমরা সবাই খুব খুশি হব।
কিছুদিন আগে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এক সভায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি ইফতেখার চৌধুরীর ভূমিকার প্রশংসা করেন। বিচারপতি চৌধুরীকে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ অপসারণ করেছিলেন। তাতে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক আন্দোলন বেগবান হয়ে ওঠে। পারভেজীয় সামরিক জমানার অবসানে বিচারপতি চৌধুরীর অবদান বিরাট। তিনি প্রধান বিচারপতি পদে পুনর্বহাল হন। বিশ্বের ইতিহাসে এ এক নজিরবিহীন ঘটনা। ডন পত্রিকার এক প্রতিবেদনে গত রোববার পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি-রাষ্ট্রপতির মধ্যকার টানোপোড়েনের খবর প্রকাশিত হয়েছে। নির্বাসিত জীবনে বেনজির ও নওয়াজ শরিফ গণতন্ত্রের সনদ তৈরি করেছিলেন। তাতে তাঁরা বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে গণশুনানি করে বিচারক নিয়োগের বিধানের কথা বলেছিলেন। এখন তা পিপিপি ও মুসলিম লীগ ভুলে গেছে। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ না করেই দুটি নিয়োগ দেন আসিফ জারদারি। লাহোর হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি খাজা মোহাম্মদ শরিফকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক এবং বিচারপতি সাকিব নেসারকে লাহোর হাইকোর্টের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি করা হয়। গত শনিবার তাঁদের নিয়োগ হয়। তাঁরা শপথ নিতে যাচ্ছিলেন। প্রধান বিচারপতি ইফতেখার চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিতভাবে সরকারের বিরুদ্ধে রুল জারি করেন। তাঁরা ‘অসাংবিধানিক’ বলে দুটি নিয়োগ স্থগিত রেখেছেন। জারদারি যে কাণ্ড করলেন, তা রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস ১৯৯৪ সালে করেছিলেন। প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ ‘মি. নোবডি’ বলাতে ঝড় উঠেছিল। নিয়োগ বাতিল করে নতুন করে প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়ার উদারতায় অল্পের ওপর দিয়ে ধকল যায়। এবার পাকিস্তানের ঘটনা দেখার মতো। বিচারপতি ইফতেখার চৌধুরী শুধু ‘নো বডি’ বলার লোক নন। তিনি বিচারপতিদের নিয়োগ স্থগিত করে দুনিয়ার সব সাহসী প্রধান বিচারপতির জন্য অনুকরণীয় নজির তৈরি করলেন। পাকিস্তানের অন্তত ৬৬টি বার অ্যাসোসিয়েশন সর্বসম্মতিক্রমে রাষ্ট্রপতির ওই নিয়োগকে অবৈধ বলে সিদ্ধান্ত প্রস্তাব পাস করেছে।
আমরা আমাদের আপিল বিভাগের কাছ থেকে বিচারক নিয়োগে একটি প্রশ্নবিদ্ধ বিচারক নিয়োগ নীতিমালা পেয়েছি। এই নীতিমালায় সরকারের সঙ্গে ভীষণ রকম আপস করা হয়েছে। সুতরাং নতুন করে এখন ১৫ জন হাইকোর্টের বিচারক নিয়োগের কথা জেনে আমরা উত্কণ্ঠিত। এরপর আরও নেওয়া হবে। শোনা যাচ্ছে, সরকার ও সুপ্রিম কোর্ট বার একাট্টা হয়েছে, তারা আর ভুলেও বিএনপি আমলের বিতর্কিত বিচারকদের নিয়োগের বিরোধিতা করে নেওয়া রেজুলেশনের কথা মুখে আনবে না। তার চেয়ে বরং চাপে রেখে সংখ্যা দিয়ে তথাকথিত বিএনপিপন্থী বিচারপতিদের সংখ্যালঘু করবে।
আওয়ামী লীগের সমর্থক আইনজীবীরা আমাদের ইতিমধ্যে শিখিয়েছেন যে বিচারক নিয়োগ নিয়ে কী করে সংকীর্ণ রাজনীতি করতে হয়। জোট সরকারের আমলে উনিশজন বিচারক (যোগ্যতাসম্পন্নরাও এখানে আছেন) নিয়োগ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বার নিদারুণ লম্ফঝম্ফ করেছিল। আইনের শাসনের জন্য মায়াকান্না করেছিল। তাঁরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার স্লোগান তুলেছিল। এখনো তারা জোট সরকারের নানা কাণ্ডকীর্তির সমালোচনায় মুখর, কিন্তু ওই একটি বিষয় বাদে। অতি যত্নের সঙ্গে তারা সেই রেজুলেশন প্রসঙ্গ এড়িয়ে চলে।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে উনিশজন বিচারকের নিয়োগ নিয়ে তবু প্রতিবাদের একটা আওয়াজ উঠেছিল। এবার সে ধরনের কোনো বিপর্যয় ঘটলে প্রতিবাদ করারও কেউ থাকবে না। কারণ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির বর্তমান নেতারা একান্তভাবে আওয়ামী লীগের অনুগত। তাঁদের কাছ থেকে অতীতের মতো রেজুলেশন পাস করা তো দূরের কথা, বরং তাঁরা অন্ধের মতো সাধুবাদ জানানোর জন্য প্রস্তুত থাকবেন। সুতরাং একটি সম্ভাব্য বিপর্যয় থেকে রেহাই পেতে চাইলে নাগরিক সমাজকে কালবিলম্ব না করে প্রস্তুতি নিতে হবে।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বক্তব্য আমরা স্মরণ করি। পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনাটা সহায়ক হবে। বাহাত্তরে তিনি ভিন্নমতে লেখেন, ‘অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি, ক্ষমতাসীন সরকারের সঙ্গে যাঁদের রাজনৈতিক যোগাযোগ রয়েছে, যাঁরা সব সময় ব্যক্তিস্বার্থচিন্তাতাড়িত এবং যাঁরা তোষামোদি কলা রপ্ত করেছেন, তাঁরাই বিচারক পদে নিয়োগ পেয়েছেন। সে কারণে আমি মনে করি, অতীতের অভিজ্ঞতা হওয়া উচিত আমাদের সংবিধান প্রণয়নের পাথেয়। বিচার বিভাগের মর্যাদাকে খাটো করে, তাঁর স্বাধীনতাকে বিপন্ন করে এমনভাবে বিচারক নিয়োগের সুযোগ থাকা উচিত নয়।’
হলফ করে বলতে পারি, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শতভাগ অভ্রান্ত। কিন্তু আমরা কেবল আফসোস করব না। এখন সময় এসেছে বিচারক নিয়োগে সংসদে একটি উপযুক্ত আইন তৈরি করা। এই রাষ্ট্রের জন্মলগ্নে আইনজীবীদের মধ্য থেকে বিচারক নিয়োগের ওই দফাটি বিলোপ করতে সেনগুপ্ত সুপারিশ করেছিলেন। বলেছিলেন অধস্তন আদালতে কর্মরত বিচারকদের মধ্য থেকে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে বিচারক নিয়োগ দিতে। কী আশ্চর্য, এম হাফিজ উদ্দীন খান ঠিক এমন একটি সুপারিশ করেছেন সমপ্রতি। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে তাঁর ভিন্নমতের জন্য অভিবাদন জানাই। তবে জেলা জজ থেকে শতভাগ বিচারক হয়তো বাস্তব নয়, কিন্তু জেলা জজদের অচ্ছুত্ ভেবে বর্তমানে যেভাবে নিয়োগ চলছে, তা অবশ্যই বদলানো উচিত। দশজন নিলে দুজন জেলা জজ নিয়োগের চলতি রীতি অসাংবিধানিক।
আমরা গোপন বিচারের মতো গোপন বিচারক নিয়োগ চাই না। তবে আপাতত প্রার্থনা এই—আওয়ামী মনোভাবাপন্ন অনেক ভালো আইনজীবী রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতে দিন। অযোগ্য ‘আওয়ামীদের’ নিয়োগ দেবেন না। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সেই মোসাহেবরা আজও সমান সক্রিয়।
পুনশ্চ: গত ২৫ জানুয়ারি ‘প্রধান বিচারপতি নিয়োগে সমীকরণ’ শীর্ষক লেখায় অনবধানতাবশত উল্লেখ করেছিলাম, বিচারপতি মো. ফজলুল করিম প্রধান বিচারপতি হলে বিচারপতি মো. আবদুল মতিনের প্রধান বিচারপতি হওয়ার সম্ভাবনা তিরোহিত হবে। এটি সঠিক নয়। প্রধান বিচারপতি অবসরে যাবেন আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর। এরপর বিচারপতি আবদুল মতিনই হবেন জ্যেষ্ঠতম। তিনি প্রধান বিচারপতি হলে সে পদে থাকবেন ২৫ ডিসেম্বর ২০১০ পর্যন্ত। অনিচ্ছাকৃত এই ভুলের জন্য আমি দুঃখিত।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
No comments