মৌসুমি কথকতা -গদ্যকার্টুন by আনিসুল হক
ফেব্রুয়ারি মাস। বইমেলার মাস। ভাষার মাস। ফাল্গুনের ফাগ ছড়িয়ে দেওয়ারও মাস। আবার আজকাল ভ্যালেন্টাইনের দিন বলে একটা দিন আসে এই ফেব্রুয়ারিতে। এই সব কটা মিলিয়ে একটা গদ্য কার্টুন রচনা করা যায় কী করে?
আচ্ছা! একটা চিরপ্রেমিক কবির জীবনের দুটো ঘটনা বলে শুরু করি। রবার্ট ব্রাউনিং। তিনি আরেকজন কবির কবিতা দেখে তাঁর প্রেমে পড়ে যান। এলিজাবেথ বারেট সেই কবির নাম। তাঁরা বিয়ে করেন আর ইংল্যান্ড থেকে পালিয়ে চলে যান ইতালিতে। প্রেমে পড়লে পুরুষেরা বোকা হয়, অনেকে আবার ভাগ্য বা নিয়তিবিশ্বাসীও হয়ে ওঠে। অনেককেই দেখেছি, রাশিচক্রের বই কিনে নিজের প্রেম-বিয়ে-সংক্রান্ত পাতাটা আগ্রহ নিয়ে পড়ে থাকে। তো একবার ব্রাউনিং করলেন কী, তাঁর প্রেমের পরিণতি কী দাঁড়াবে, তা বোঝার জন্য নিজের ভাগ্যটাকে পরখ করে নিতে চাইলেন। তিনি ঠিক করলেন, চোখ বন্ধ করে একটা বই তুলে নেবেন, যেকোনো একটা লাইন পড়বেন, যে লাইনটা পড়বেন, সেটাই হবে তাঁর প্রেমবিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণী।
তিনি একটা বই হাতে নিলেন। দুঃখের বিষয়, এটা একটা ইতালীয় ব্যাকরণ বই। অসুবিধা নেই! তিনি পাতা খুললেন। দৃষ্টি স্থির করলেন একটা বাক্যের ওপর। অনুবাদ করো। একটা অনুচ্ছেদ। অনুচ্ছেদটা শুরু হয়েছে, ‘আমরা যদি পরজগতেও এই জগতের মতোই ভালোবেসে যাই, আমি তোমাকে ভালোবেসে যাব অনন্তকাল।’
এটাকেই বোধ হয় বলা যায়, ভাগ্য!
রবার্ট ব্রাউনিংয়ের বই বেরোলো ১৮৪০ সালে। বইটিতে কিছু কিছু জায়গা ছিল খুবই দুর্বোধ্য। পাঠকেরা কবির কাছে জানতে চাইল, এর মানে কী! লন্ডন পোয়েট্রি সোসাইটি একটা সভার আয়োজন করল। কবিকে সেখানে ডাকা হলো। তারা কবির হাতে বইটা তুলে দিয়ে বলল, এই পাতাগুলোর অর্থ বলে দিন। কবি দাঁড়ালেন। অনুচ্ছেদগুলো একবার পড়লেন, দুবার পড়লেন। তারপর বললেন, ‘যখন আমি এসব লিখি, তখন আমি আর ঈশ্বর এসবের অর্থ জানতাম, কিন্তু এখন ঈশ্বর একাই কেবল এর অর্থ জানেন। আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না, দয়া করে।’
বেশি কঠিন কথা বলে ফেললাম? একটু সহজ কথা বলব। আচ্ছা, তাহলে চার্লি চাপলিন।
নাট্যকার চার্লস ম্যাক আর্থার একবার চার্লি চাপলিনকে বললেন, হাসির ছবির স্ক্রিপ্ট লেখার চেয়ে কঠিন কাজ আর নেই। ধরা যাক, একটা মোটা মহিলা একটা কলার খোসার ওপর পা ফেলে পিছলে পড়ে গেলেন। এটা কীভাবে সিনেমায় দেখানো হবে। আগে মোটা মহিলা, তারপর কলার খোসা। নাকি আগে কলার খোসা, তারপর মোটা মহিলা। তারপর কলার খোসায় পা এবং পপাতধরণিতল! কী দেখালে দর্শকেরা হাসবে।
চার্লি চাপলিন জবাব দিলেন, ‘আমরা প্রথমে দেখাব মহিলা আসছেন, তারপর দেখাব কলার খোসাটা। তারপর দেখাব মহিলা কলার খোসাটা থেকে বাঁচার জন্য একটু বড় পদক্ষেপ নিলেন। তারপর তিনি একটা ম্যানহোলের মধ্যে পড়ে হারিয়ে গেলেন।’ আমরা যারা টিভিতে হাসির নাটক লেখার চেষ্টা করি, তাদের জন্য এখানে একটা খুব বড় উপদেশ লুকিয়ে রয়েছে। আমি আর সেটা ভেঙে বলতে চাই না।
আপনাদের সবারই জানা যে একবার একটা প্রতিযোগিতা হয়েছিল। চার্লি চাপলিন লুক-এলাইক প্রতিযোগিতা। অর্থাৎ চার্লি চাপলিন সাজতে হবে। তাঁর মতো করে চলতে-বলতে হবে। চার্লি চাপলিন এই প্রতিযোগিতায় নিজেই অংশ নিয়েছিলেন। তিনি প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন।
এখান থেকে আইজাক আসিমভের লেখা একটা সায়েন্স ফিকশনে যেতে পারি। এই ছোট্ট গল্পটা আমি একবার গদ্য কার্টুন কলামেই অনুবাদ করে দিয়েছিলাম। টাইম মেশিনে চড়ে একবার উইলিয়াম শেক্সপিয়ার আজকের দুনিয়ায় ফিরে আসেন। তিনি আমেরিকার একটা বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে বিখ্যাত নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ক্লাসে ঢুকে পড়েন। দেখেন যে ক্লাসে শেক্সপিয়ার পড়ানো হচ্ছে। শেক্সপিয়ারও সেই ক্লাসে বসে লেকচার শুনলেন। এরপর পরীক্ষা। শেক্সপিয়ার এই নাটকে কী বোঝাতে চেয়েছেন, লেখো। শেক্সপিয়ার লিখলেন। এবং তিনি পরীক্ষায় ফেল করলেন।
আইজাক আসিমভ তাঁর নিজের জীবনের একটা কাহিনি লিখেছেন এক জায়গায়। এই বিখ্যাত সায়েন্স ফিকশন লেখকের বইয়ের সংখ্যা ৫০০-রও বেশি। তিনি বলছেন, একবার তিনি একটা লেখা নিয়ে গিয়েছিলেন এক সম্পাদকের কাছে। সম্পাদক তাঁর লেখাটা পড়ে তাঁকে একটা কঠিন অপ্রচলিত শব্দ বলেন। শব্দটার মানে হলো পতিতা। আসিমভ লিখছেন, সম্পাদক বলতে চাইছেন, আসিমভের খ্যাতি হয়েছে, তিনি যা লিখবেন, তা-ই বিক্রি হবে, এটা হলো পতিতার লক্ষণ, লেখাটা এতই খারাপ হয়েছে। আসিমভ লিখেছেন, ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। তাঁর এই লেখাটা অন্য সম্পাদক পরে ছেপেছেন, এটা বই হিসেবে বেরিয়েছে এবং প্রশংসিত হয়েছে। সম্পাদকের মুখে শব্দটা শুনে আসিমভ না বোঝার ভান করে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কী শব্দ ব্যবহার করলেন?
‘পতিতা’—দুর্বোধ্য শব্দটা আবার উচ্চারণ করলেন সম্পাদক।
আসিমভও না বোঝার ভান করে বললেন, আপনাকেও শুভ নববর্ষ। বলে তিনি ফিরে এলেন ওই সম্পাদকের কাছ থেকে।
সম্পাদক আর লেখকের প্রসঙ্গে আমরা আসতে পারি টি এস এলিয়টের কথায় (১৮৮৮—১৯৬৫)। একবার একজন প্রকাশক এলিয়টকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি মনে করেন, লেখক হিসেবে যাঁরা ব্যর্থ হন, তাঁরাই সম্পাদক হন। এলিয়ট উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি মনে করি, সম্পাদকদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন, যাঁরা ব্যর্থ লেখক। আর লেখকদের মধ্যে প্রায় সবাই ব্যর্থ লেখক।’
আমেরিকান রাজনীতিক ও বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিনকে (১৭০৬—৯০) জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সবচেয়ে বড় করুণার পাত্র কে?
তিনি বলেছিলেন, একটা লোক, বৃষ্টির কারণে একাকী একটা ঘরে বসে আছে, অথচ লোকটা বই পড়তে জানে না।
এবার আমরা গদ্য কার্টুন শেষ করতে পারি। আমরা উপসংসহারে আসব, সেই মানুষই সবচেয়ে করুণার পাত্র, যে বই কেনে না, বই পড়ে না এবং সর্বশেষ কবে একটা বই পড়েছে, মনেও করতে পারে না।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
আচ্ছা! একটা চিরপ্রেমিক কবির জীবনের দুটো ঘটনা বলে শুরু করি। রবার্ট ব্রাউনিং। তিনি আরেকজন কবির কবিতা দেখে তাঁর প্রেমে পড়ে যান। এলিজাবেথ বারেট সেই কবির নাম। তাঁরা বিয়ে করেন আর ইংল্যান্ড থেকে পালিয়ে চলে যান ইতালিতে। প্রেমে পড়লে পুরুষেরা বোকা হয়, অনেকে আবার ভাগ্য বা নিয়তিবিশ্বাসীও হয়ে ওঠে। অনেককেই দেখেছি, রাশিচক্রের বই কিনে নিজের প্রেম-বিয়ে-সংক্রান্ত পাতাটা আগ্রহ নিয়ে পড়ে থাকে। তো একবার ব্রাউনিং করলেন কী, তাঁর প্রেমের পরিণতি কী দাঁড়াবে, তা বোঝার জন্য নিজের ভাগ্যটাকে পরখ করে নিতে চাইলেন। তিনি ঠিক করলেন, চোখ বন্ধ করে একটা বই তুলে নেবেন, যেকোনো একটা লাইন পড়বেন, যে লাইনটা পড়বেন, সেটাই হবে তাঁর প্রেমবিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণী।
তিনি একটা বই হাতে নিলেন। দুঃখের বিষয়, এটা একটা ইতালীয় ব্যাকরণ বই। অসুবিধা নেই! তিনি পাতা খুললেন। দৃষ্টি স্থির করলেন একটা বাক্যের ওপর। অনুবাদ করো। একটা অনুচ্ছেদ। অনুচ্ছেদটা শুরু হয়েছে, ‘আমরা যদি পরজগতেও এই জগতের মতোই ভালোবেসে যাই, আমি তোমাকে ভালোবেসে যাব অনন্তকাল।’
এটাকেই বোধ হয় বলা যায়, ভাগ্য!
রবার্ট ব্রাউনিংয়ের বই বেরোলো ১৮৪০ সালে। বইটিতে কিছু কিছু জায়গা ছিল খুবই দুর্বোধ্য। পাঠকেরা কবির কাছে জানতে চাইল, এর মানে কী! লন্ডন পোয়েট্রি সোসাইটি একটা সভার আয়োজন করল। কবিকে সেখানে ডাকা হলো। তারা কবির হাতে বইটা তুলে দিয়ে বলল, এই পাতাগুলোর অর্থ বলে দিন। কবি দাঁড়ালেন। অনুচ্ছেদগুলো একবার পড়লেন, দুবার পড়লেন। তারপর বললেন, ‘যখন আমি এসব লিখি, তখন আমি আর ঈশ্বর এসবের অর্থ জানতাম, কিন্তু এখন ঈশ্বর একাই কেবল এর অর্থ জানেন। আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না, দয়া করে।’
বেশি কঠিন কথা বলে ফেললাম? একটু সহজ কথা বলব। আচ্ছা, তাহলে চার্লি চাপলিন।
নাট্যকার চার্লস ম্যাক আর্থার একবার চার্লি চাপলিনকে বললেন, হাসির ছবির স্ক্রিপ্ট লেখার চেয়ে কঠিন কাজ আর নেই। ধরা যাক, একটা মোটা মহিলা একটা কলার খোসার ওপর পা ফেলে পিছলে পড়ে গেলেন। এটা কীভাবে সিনেমায় দেখানো হবে। আগে মোটা মহিলা, তারপর কলার খোসা। নাকি আগে কলার খোসা, তারপর মোটা মহিলা। তারপর কলার খোসায় পা এবং পপাতধরণিতল! কী দেখালে দর্শকেরা হাসবে।
চার্লি চাপলিন জবাব দিলেন, ‘আমরা প্রথমে দেখাব মহিলা আসছেন, তারপর দেখাব কলার খোসাটা। তারপর দেখাব মহিলা কলার খোসাটা থেকে বাঁচার জন্য একটু বড় পদক্ষেপ নিলেন। তারপর তিনি একটা ম্যানহোলের মধ্যে পড়ে হারিয়ে গেলেন।’ আমরা যারা টিভিতে হাসির নাটক লেখার চেষ্টা করি, তাদের জন্য এখানে একটা খুব বড় উপদেশ লুকিয়ে রয়েছে। আমি আর সেটা ভেঙে বলতে চাই না।
আপনাদের সবারই জানা যে একবার একটা প্রতিযোগিতা হয়েছিল। চার্লি চাপলিন লুক-এলাইক প্রতিযোগিতা। অর্থাৎ চার্লি চাপলিন সাজতে হবে। তাঁর মতো করে চলতে-বলতে হবে। চার্লি চাপলিন এই প্রতিযোগিতায় নিজেই অংশ নিয়েছিলেন। তিনি প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন।
এখান থেকে আইজাক আসিমভের লেখা একটা সায়েন্স ফিকশনে যেতে পারি। এই ছোট্ট গল্পটা আমি একবার গদ্য কার্টুন কলামেই অনুবাদ করে দিয়েছিলাম। টাইম মেশিনে চড়ে একবার উইলিয়াম শেক্সপিয়ার আজকের দুনিয়ায় ফিরে আসেন। তিনি আমেরিকার একটা বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে বিখ্যাত নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ক্লাসে ঢুকে পড়েন। দেখেন যে ক্লাসে শেক্সপিয়ার পড়ানো হচ্ছে। শেক্সপিয়ারও সেই ক্লাসে বসে লেকচার শুনলেন। এরপর পরীক্ষা। শেক্সপিয়ার এই নাটকে কী বোঝাতে চেয়েছেন, লেখো। শেক্সপিয়ার লিখলেন। এবং তিনি পরীক্ষায় ফেল করলেন।
আইজাক আসিমভ তাঁর নিজের জীবনের একটা কাহিনি লিখেছেন এক জায়গায়। এই বিখ্যাত সায়েন্স ফিকশন লেখকের বইয়ের সংখ্যা ৫০০-রও বেশি। তিনি বলছেন, একবার তিনি একটা লেখা নিয়ে গিয়েছিলেন এক সম্পাদকের কাছে। সম্পাদক তাঁর লেখাটা পড়ে তাঁকে একটা কঠিন অপ্রচলিত শব্দ বলেন। শব্দটার মানে হলো পতিতা। আসিমভ লিখছেন, সম্পাদক বলতে চাইছেন, আসিমভের খ্যাতি হয়েছে, তিনি যা লিখবেন, তা-ই বিক্রি হবে, এটা হলো পতিতার লক্ষণ, লেখাটা এতই খারাপ হয়েছে। আসিমভ লিখেছেন, ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। তাঁর এই লেখাটা অন্য সম্পাদক পরে ছেপেছেন, এটা বই হিসেবে বেরিয়েছে এবং প্রশংসিত হয়েছে। সম্পাদকের মুখে শব্দটা শুনে আসিমভ না বোঝার ভান করে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কী শব্দ ব্যবহার করলেন?
‘পতিতা’—দুর্বোধ্য শব্দটা আবার উচ্চারণ করলেন সম্পাদক।
আসিমভও না বোঝার ভান করে বললেন, আপনাকেও শুভ নববর্ষ। বলে তিনি ফিরে এলেন ওই সম্পাদকের কাছ থেকে।
সম্পাদক আর লেখকের প্রসঙ্গে আমরা আসতে পারি টি এস এলিয়টের কথায় (১৮৮৮—১৯৬৫)। একবার একজন প্রকাশক এলিয়টকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি মনে করেন, লেখক হিসেবে যাঁরা ব্যর্থ হন, তাঁরাই সম্পাদক হন। এলিয়ট উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি মনে করি, সম্পাদকদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন, যাঁরা ব্যর্থ লেখক। আর লেখকদের মধ্যে প্রায় সবাই ব্যর্থ লেখক।’
আমেরিকান রাজনীতিক ও বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিনকে (১৭০৬—৯০) জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সবচেয়ে বড় করুণার পাত্র কে?
তিনি বলেছিলেন, একটা লোক, বৃষ্টির কারণে একাকী একটা ঘরে বসে আছে, অথচ লোকটা বই পড়তে জানে না।
এবার আমরা গদ্য কার্টুন শেষ করতে পারি। আমরা উপসংসহারে আসব, সেই মানুষই সবচেয়ে করুণার পাত্র, যে বই কেনে না, বই পড়ে না এবং সর্বশেষ কবে একটা বই পড়েছে, মনেও করতে পারে না।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments