ভাষা ও নারী: পুরুষের ভাষিক অবরোধ -আমার ভাষা আমার একুশ by সৌরভ সিকদার
মানুষ ভাষার মাধ্যমে শুধু তার মনের ভাব প্রকাশই করে না, অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। আবার এই ভাষার দ্বারাই সে তার সৃজনশীল ক্ষমতার প্রকাশ ঘটায়। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষা প্রচলিত। দেশে দেশে ভাষার যেমন পার্থক্য দেখা যায়, তেমনি নারী-পুরুষেও ভাষাগত পার্থক্য বিদ্যমান। ভাষা মানুষের অর্থ-সমাজ-বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটায়। সমাজে আমরা যেভাবে নারীকে মূল্যায়ন করে থাকি, আমাদের ভাষাতেও তার প্রতিচ্ছবি পরিলক্ষিত হয়। নারীর জন্য অবলা, কোমল, নরম, লজ্জাবতী—এসব শব্দ তৈরি করা হয়, অন্যদিকে পুরুষকে পৌরুষত্বের বীরগাথায় বীর বা শক্তিমানের কাতারে রেখে নারীকে রাঁধুনি, গৃহিণী আখ্যা দিয়ে গৃহবন্দী করে রাখি আমরা—আমাদের বাংলা ভাষায়।
আমাদের ভাষার ভাব, শব্দ, ধ্বনি, অর্থ প্রভৃতি গড়ে উঠেছে সমাজ, রাষ্ট্র ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা দ্বারা। আমাদের সমাজের প্রধান নিয়ন্ত্রক হচ্ছে পুরুষ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে পুরুষ, আধিপত্য বিস্তার করে পুরুষ, উপভোগ করে পুরুষ, মালিকানা বা স্বত্ব পুরুষের—এ সমাজ পুরুষের ক্ষমতায়নকেই প্রাধান্য দেয়। নারী পায় শুধু অবহেলা-অমর্যাদা; তাই নারীর জন্য সমাজ যেন পৃথক ও দুর্বল ভাষাভঙ্গি তৈরি করে দিয়েছে। আবার আমাদের সমাজে নারীর পারিবারিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নেই বলেই তার ধ্বনিগত বা বাকস্বাধীনতাও নেই।
আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। শিক্ষার অভাব, ধর্মের প্রভাব, রক্ষণশীলতা, দৃষ্টিভঙ্গি প্রভৃতি কারণে নারী পিছিয়ে আছে। ভাষা যেমন ভাবপ্রকাশের মাধ্যম, তেমনি কখনো নির্যাতনের মাধ্যম হয়েও দাঁড়ায়। পুরুষ নারীকে নানাভাবে নির্যাতন করে থাকে, এমনকি শুধু ভাষা দিয়েও নির্যাতন করে থাকে। কবির ভাষায়—‘হাতে যদি না মারিত, শত মারিত ঠোঁটে’।
আজ নারীকে কেবল পেশিশক্তি দিয়েই নয়, ভাষাশক্তি দিয়েও অসম্মানিত এমনকি লাঞ্ছিতও করা হয়। পুরুষ তার পৌরুষত্বের প্রকাশ কেবল শারীরিক নির্যাতন দিয়েই নয়, ভাষাকে আশ্রয় করে মানসিক নির্যাতনও করে থাকে যা ‘ভারবাল এবিউজ’ বা মৌখিক নির্যাতন নামে পরিচিত। ‘ইভটিজিং’ নামে নারীকে ‘উত্ত্যক্ত’ করার এবং বিরক্ত করার পারিভাষিক শব্দ পর্যন্ত তৈরি হয়েছে। আমরা বাংলা ভাষায় পুরুষকে ‘উত্ত্যক্ত’ করতে দেখি, আর নারী ‘উত্ত্যক্ত’ হয়। বাংলা ভাষায় নারী কর্তৃক পুরুষকে বিরক্ত করার কোনো শব্দ নেই কিন্তু পুরুষ যে নারীকে বিরক্ত করে তার জন্য সমাজ তৈরি করেছে অসংখ্য শব্দ, খণ্ডবাক্য।
সম্ভবত বাংলাই পৃথিবীর একমাত্র ভাষা (ভারতীয় আর কয়েকটি ভাষা ছাড়া) যেখানে সীতার সতীত্ব পরীক্ষা থেকে নারীর জন্য জন্ম নিয়েছে সবচেয়ে অসম্মানকর শব্দ, শব্দসমূহ। অর্থাত্ আমাদের সমাজ সৃষ্টি করেছে ভাষায় এমন কিছু শব্দ যা নারীকে বেঁধে দিয়েছে লজ্জা আর অসম্মানের দড়িতে। পুরুষনিয়ন্ত্রিত সমাজে পুরুষ নারীর জন্য শুধু শব্দ তৈরিই করে না, তাকে মানবিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিতও করে।
পুরুষ শুধু নারীকেই নয়, তার ভাষাও নিয়ন্ত্রিত করছে। শুধু কথাই বলে না, দেহভাষা বা অঙ্গভঙ্গি করে (সাইন ল্যাংগুয়েজ প্রয়োগ করে) কিছু একটা প্রকাশ করতে চায়। আমাদের সমাজে যেসব পুরুষ স্ত্রীর কথামতো চলে, তাদের বলে ‘স্ত্রৈণ’। এ শব্দটি প্রয়োগ হয় পুরুষের জন্য নেতিবাচক বা অসম্মানজনক হিসেবে। যেন নারীর কথা পুরুষের শুনতে মানা। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহূত বেশ কিছু শব্দ আলোচনা করলে দেখতে পাব চেয়ারম্যান, সভাপতি, রাষ্ট্রপতি, মেম্বার, লিডার, ক্যাডার—এগুলো সব পুরুষবাচক শব্দ। এর কোনো স্ত্রীবাচক প্রতিশব্দ নেই। জেন্ডার বৈষম্য নিরোধকল্পে একালে আমরা ‘চেয়ারপারসন’, ‘সভাপ্রধান’ প্রয়োগ করে থাকি। এভাবেই একটি সমাজের সম্মিলিত চেষ্টায় তার ভাষার শব্দাবলিও বদলে দেওয়া সম্ভব। সম্ভব নারীকে সম্মানিত করা।
বাংলা ভাষার গবেষক সুকুমার সেন তাঁর ‘বাংলায় নারীর ভাষা’ প্রবন্ধে কিছু শব্দের উল্লেখ করেছেন যা থেকে পুরুষ ও নারীর সামাজিক অবস্থান স্পষ্ট হয়—যেমন: অনাছিষ্টি, লক্ষ্মীছাড়া, আটকুঁড়ো, আড়ি, আদিখ্যেতা, কটুনী, খোঁটা, গাদী, গুমর, গা, ছিরি, ঠমক, ঢঙ, দেমাক, ন্যাকা, পোয়াতি, বিয়েন, বেহায়া, কুট্টি, মিনসে, রাঁড়, রাঁড়ী, সেয়ানা, সোমত্ত, সোহাগ, সই ইত্যাদি। নারীর ক্ষেত্রে বাংলায় বিশেষ্য বাক্যাংশ এবং ক্রিয়া বাক্যাংশ প্রয়োগে কিছু স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। যেমন—
বিশেষ্য বাক্যাংশ—কাঁচা বয়েস, কচি খুকি, কোলের ছেলে, চোখের বালি, দাঁতে বিষ, ননীর পুতুল, নাড়ির টান, পেটের ছেলে, মাথার দিব্যি, রাঙা বৌ, হাঁড়ির খবর, পাতা কুড়নী, ঝগড়াটে, সাতে পাঁচে না থাকা, সাত পাঁচ ভাবা ইত্যাদি।
ক্রিয়া বাক্যাংশ—ঝেঁটিয়ে বিদেয় করা, বানের জলে ভেসে আসা, বিয়ের ফুল ফোটা, মুখে খই ফোটা, হাঁড়িতে স্থান দেয়া, কেঁদে হাট বসানো, সইপাতানো, পাকা চুলে সিঁদুর পরা, হাঁড়ি ঠেলা, পরের মুখে ঝাল খাওয়া, মাথা কোটা ইত্যাদি।
বাংলা ভাষা ও নারী বিষয়ে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন জানান, ‘বাংলা ভাষার শব্দ প্রয়োগে ও সম্বোধনে নারীকে সম্মানিত তো নয়ই বরং হেয় করা হয়েছে। বাংলা ভাষায় অজস্র শব্দ আছে, যা আবহমান কাল থেকে খুব অন্যায়ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। অভিধান খুললেই দেখা যাবে সেখানে পুরুষবাচক আর স্ত্রীবাচক শব্দের অর্থ উপস্থাপনার মধ্যে কত পার্থক্য। নারীর প্রতি মানবিক সম্মানবোধের ধারণাটি পর্যন্ত আমরা সমাজে স্থাপন করতে পারিনি। তাই জেন্ডার সমতার ভিত্তিতে বাংলা ভাষাকে ব্যবহার করার মানসিকতাও আমাদের তৈরি হয়নি। তবে ক্ষীণ ধারায় হলেও চেষ্টা চলছে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের একটা বড় ভূমিকা আছে। তারা যদি বিষয়টিকে সচেতনভাবে আমাদের দেশের মানুষের সামনে নিয়ে আসে তবে পরিবর্তন দ্রুত হওয়া সম্ভব।’
সুকুমার সেন বলেছিলেন—‘নারীর শব্দভান্ডার পুরুষের শব্দভান্ডার থেকে খুবই আলাদা। নারী পুরুষের তুলনায় অনেক কম শব্দ ব্যবহার করে।’ শ্রেণীবিভক্ত সমাজে নারীকে ঘরে পুরুষের সেবায় আবদ্ধ করে রাখলে সেটাই স্বাভাবিক। তার কর্মজগত্ যেমন বৃদ্ধিতে পুরুষের উদ্যোগ-উত্সাহ কম, তেমনি নারীর শব্দের সীমানাও হয়ে পড়ে অনেক ছোট। নারীর যত ক্ষমতায়ন ঘটবে, উত্পাদন ও অর্থ উপার্জনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে, পুরুষের মতো বাইরের জগেক নিজের ভাবতে পারবে—আমাদের ভাষায় তত দ্রুত নারী-পুরুষের বৈষম্য কমে যাবে।
বাংলা ভাষা এবং একুশের গৌরবময় বাংলাদেশ নামক মানচিত্রে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে, পুরুষ এবং নারী উভয়ই নারীকে তার প্রাপ্য মর্যাদাটুকু দিলে সমাজের জন্য, দেশের জন্য যেমন মঙ্গল; তেমনি বাংলা ভাষারও শ্রীবৃদ্ধি।
সৌরভ সিকদার: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আমাদের ভাষার ভাব, শব্দ, ধ্বনি, অর্থ প্রভৃতি গড়ে উঠেছে সমাজ, রাষ্ট্র ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা দ্বারা। আমাদের সমাজের প্রধান নিয়ন্ত্রক হচ্ছে পুরুষ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে পুরুষ, আধিপত্য বিস্তার করে পুরুষ, উপভোগ করে পুরুষ, মালিকানা বা স্বত্ব পুরুষের—এ সমাজ পুরুষের ক্ষমতায়নকেই প্রাধান্য দেয়। নারী পায় শুধু অবহেলা-অমর্যাদা; তাই নারীর জন্য সমাজ যেন পৃথক ও দুর্বল ভাষাভঙ্গি তৈরি করে দিয়েছে। আবার আমাদের সমাজে নারীর পারিবারিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নেই বলেই তার ধ্বনিগত বা বাকস্বাধীনতাও নেই।
আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। শিক্ষার অভাব, ধর্মের প্রভাব, রক্ষণশীলতা, দৃষ্টিভঙ্গি প্রভৃতি কারণে নারী পিছিয়ে আছে। ভাষা যেমন ভাবপ্রকাশের মাধ্যম, তেমনি কখনো নির্যাতনের মাধ্যম হয়েও দাঁড়ায়। পুরুষ নারীকে নানাভাবে নির্যাতন করে থাকে, এমনকি শুধু ভাষা দিয়েও নির্যাতন করে থাকে। কবির ভাষায়—‘হাতে যদি না মারিত, শত মারিত ঠোঁটে’।
আজ নারীকে কেবল পেশিশক্তি দিয়েই নয়, ভাষাশক্তি দিয়েও অসম্মানিত এমনকি লাঞ্ছিতও করা হয়। পুরুষ তার পৌরুষত্বের প্রকাশ কেবল শারীরিক নির্যাতন দিয়েই নয়, ভাষাকে আশ্রয় করে মানসিক নির্যাতনও করে থাকে যা ‘ভারবাল এবিউজ’ বা মৌখিক নির্যাতন নামে পরিচিত। ‘ইভটিজিং’ নামে নারীকে ‘উত্ত্যক্ত’ করার এবং বিরক্ত করার পারিভাষিক শব্দ পর্যন্ত তৈরি হয়েছে। আমরা বাংলা ভাষায় পুরুষকে ‘উত্ত্যক্ত’ করতে দেখি, আর নারী ‘উত্ত্যক্ত’ হয়। বাংলা ভাষায় নারী কর্তৃক পুরুষকে বিরক্ত করার কোনো শব্দ নেই কিন্তু পুরুষ যে নারীকে বিরক্ত করে তার জন্য সমাজ তৈরি করেছে অসংখ্য শব্দ, খণ্ডবাক্য।
সম্ভবত বাংলাই পৃথিবীর একমাত্র ভাষা (ভারতীয় আর কয়েকটি ভাষা ছাড়া) যেখানে সীতার সতীত্ব পরীক্ষা থেকে নারীর জন্য জন্ম নিয়েছে সবচেয়ে অসম্মানকর শব্দ, শব্দসমূহ। অর্থাত্ আমাদের সমাজ সৃষ্টি করেছে ভাষায় এমন কিছু শব্দ যা নারীকে বেঁধে দিয়েছে লজ্জা আর অসম্মানের দড়িতে। পুরুষনিয়ন্ত্রিত সমাজে পুরুষ নারীর জন্য শুধু শব্দ তৈরিই করে না, তাকে মানবিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিতও করে।
পুরুষ শুধু নারীকেই নয়, তার ভাষাও নিয়ন্ত্রিত করছে। শুধু কথাই বলে না, দেহভাষা বা অঙ্গভঙ্গি করে (সাইন ল্যাংগুয়েজ প্রয়োগ করে) কিছু একটা প্রকাশ করতে চায়। আমাদের সমাজে যেসব পুরুষ স্ত্রীর কথামতো চলে, তাদের বলে ‘স্ত্রৈণ’। এ শব্দটি প্রয়োগ হয় পুরুষের জন্য নেতিবাচক বা অসম্মানজনক হিসেবে। যেন নারীর কথা পুরুষের শুনতে মানা। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহূত বেশ কিছু শব্দ আলোচনা করলে দেখতে পাব চেয়ারম্যান, সভাপতি, রাষ্ট্রপতি, মেম্বার, লিডার, ক্যাডার—এগুলো সব পুরুষবাচক শব্দ। এর কোনো স্ত্রীবাচক প্রতিশব্দ নেই। জেন্ডার বৈষম্য নিরোধকল্পে একালে আমরা ‘চেয়ারপারসন’, ‘সভাপ্রধান’ প্রয়োগ করে থাকি। এভাবেই একটি সমাজের সম্মিলিত চেষ্টায় তার ভাষার শব্দাবলিও বদলে দেওয়া সম্ভব। সম্ভব নারীকে সম্মানিত করা।
বাংলা ভাষার গবেষক সুকুমার সেন তাঁর ‘বাংলায় নারীর ভাষা’ প্রবন্ধে কিছু শব্দের উল্লেখ করেছেন যা থেকে পুরুষ ও নারীর সামাজিক অবস্থান স্পষ্ট হয়—যেমন: অনাছিষ্টি, লক্ষ্মীছাড়া, আটকুঁড়ো, আড়ি, আদিখ্যেতা, কটুনী, খোঁটা, গাদী, গুমর, গা, ছিরি, ঠমক, ঢঙ, দেমাক, ন্যাকা, পোয়াতি, বিয়েন, বেহায়া, কুট্টি, মিনসে, রাঁড়, রাঁড়ী, সেয়ানা, সোমত্ত, সোহাগ, সই ইত্যাদি। নারীর ক্ষেত্রে বাংলায় বিশেষ্য বাক্যাংশ এবং ক্রিয়া বাক্যাংশ প্রয়োগে কিছু স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। যেমন—
বিশেষ্য বাক্যাংশ—কাঁচা বয়েস, কচি খুকি, কোলের ছেলে, চোখের বালি, দাঁতে বিষ, ননীর পুতুল, নাড়ির টান, পেটের ছেলে, মাথার দিব্যি, রাঙা বৌ, হাঁড়ির খবর, পাতা কুড়নী, ঝগড়াটে, সাতে পাঁচে না থাকা, সাত পাঁচ ভাবা ইত্যাদি।
ক্রিয়া বাক্যাংশ—ঝেঁটিয়ে বিদেয় করা, বানের জলে ভেসে আসা, বিয়ের ফুল ফোটা, মুখে খই ফোটা, হাঁড়িতে স্থান দেয়া, কেঁদে হাট বসানো, সইপাতানো, পাকা চুলে সিঁদুর পরা, হাঁড়ি ঠেলা, পরের মুখে ঝাল খাওয়া, মাথা কোটা ইত্যাদি।
বাংলা ভাষা ও নারী বিষয়ে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন জানান, ‘বাংলা ভাষার শব্দ প্রয়োগে ও সম্বোধনে নারীকে সম্মানিত তো নয়ই বরং হেয় করা হয়েছে। বাংলা ভাষায় অজস্র শব্দ আছে, যা আবহমান কাল থেকে খুব অন্যায়ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। অভিধান খুললেই দেখা যাবে সেখানে পুরুষবাচক আর স্ত্রীবাচক শব্দের অর্থ উপস্থাপনার মধ্যে কত পার্থক্য। নারীর প্রতি মানবিক সম্মানবোধের ধারণাটি পর্যন্ত আমরা সমাজে স্থাপন করতে পারিনি। তাই জেন্ডার সমতার ভিত্তিতে বাংলা ভাষাকে ব্যবহার করার মানসিকতাও আমাদের তৈরি হয়নি। তবে ক্ষীণ ধারায় হলেও চেষ্টা চলছে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের একটা বড় ভূমিকা আছে। তারা যদি বিষয়টিকে সচেতনভাবে আমাদের দেশের মানুষের সামনে নিয়ে আসে তবে পরিবর্তন দ্রুত হওয়া সম্ভব।’
সুকুমার সেন বলেছিলেন—‘নারীর শব্দভান্ডার পুরুষের শব্দভান্ডার থেকে খুবই আলাদা। নারী পুরুষের তুলনায় অনেক কম শব্দ ব্যবহার করে।’ শ্রেণীবিভক্ত সমাজে নারীকে ঘরে পুরুষের সেবায় আবদ্ধ করে রাখলে সেটাই স্বাভাবিক। তার কর্মজগত্ যেমন বৃদ্ধিতে পুরুষের উদ্যোগ-উত্সাহ কম, তেমনি নারীর শব্দের সীমানাও হয়ে পড়ে অনেক ছোট। নারীর যত ক্ষমতায়ন ঘটবে, উত্পাদন ও অর্থ উপার্জনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে, পুরুষের মতো বাইরের জগেক নিজের ভাবতে পারবে—আমাদের ভাষায় তত দ্রুত নারী-পুরুষের বৈষম্য কমে যাবে।
বাংলা ভাষা এবং একুশের গৌরবময় বাংলাদেশ নামক মানচিত্রে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে, পুরুষ এবং নারী উভয়ই নারীকে তার প্রাপ্য মর্যাদাটুকু দিলে সমাজের জন্য, দেশের জন্য যেমন মঙ্গল; তেমনি বাংলা ভাষারও শ্রীবৃদ্ধি।
সৌরভ সিকদার: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments