সোনার হরিণ পাওয়ার জন্য লড়াই by সুদীপ অধিকারী
চাকরি।
যেন সোনার হরিণ। হন্যে হয়ে খুঁজছেন তরুণেরা। হাহাকার বেশি শিক্ষিত তরুণদের
মধ্যেই। উচ্চশিক্ষিত সন্তান। কিন্তু চাকরি না পাওয়ায় বাবা-মায়ের কাছেও
দিনকে দিন হয়ে ওঠে বোঝা। এ এক অবিশ্বাস্য যন্ত্রণা। মুখ লুকিয়ে চলা। আর
চাকরির ক্ষেত্রে বাড়তি যোগ্যতা হিসেবে প্রয়োজন হচ্ছে মামা-চাচার সুপারিশের।
চাকরির বাজারে ঘুষের রেটও চড়া। চাকরির আবেদনের জন্য বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়
বেসরকারি অনলাইন ওয়েবসাইট বিডি জবস এর তথ্যমতে জানা যায়, এই ওয়েবসাইটের
মাধ্যমে তৈরি করা ১ লাখ ৭০ হাজার জীবনবৃত্তান্তের মধ্যে, প্রতিদিন গড়ে এক
থেকে দেড় লাখ মানুষ চাকরির জন্য আবেদন করেন। এর বেশিরভাগ মানুষই জীবনে
প্রথম চাকরি খুঁজছেন। ওয়েবসাইটটি ঘেঁটে জানা যায়, সেখানে বেশিরভাগ চাকরিতে
ঢোকার ক্ষেত্রেই ১ থেকে ৮ বছর অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে। আর এই অভিজ্ঞতা না
থাকায় চাকরি বাজারের নতুন সদস্যদের পড়তে হচ্ছে বিড়ম্বনায়। কথা হয় চাঁদপুর
জেলার মো. তানভীর হাসানের সঙ্গে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
অনার্স-মাস্টার্স শেষ করা তানভীর বলেন, গত দেড়-দুই বছর ধরে চাকরির জন্য
আবেদন করেই চলেছি। সকাল-বিকাল অনলাইনে বেসরকারি চাকরির আবেদনের পাশাপাশি
চাকরির বিভিন্ন সাপ্তাহিক পত্রিকা কেনাও বাদ দিই না কখনো। কিন্তু যেই
চাকরিটাতেই আবেদন করতে যাই না কেন, সেখানেই লেখা থাকে ২-৫ বছরের অভিজ্ঞতা
লাগবে। কিন্তু যদি চাকরিতে ঢুকতেই না পারি, তাহলে অভিজ্ঞতা হবে কি করে?
তিনি বলেন, আব্বু-আম্মু অনেক কষ্ট করে পড়া-লেখা করিয়েছেন। শিক্ষা জীবন শেষ
করে এখন কোথায় বৃদ্ধ পিতা-মাতার দেখাশোনা করবো, তা না এখনো তাদের কাছ থেকে
টাকা নিয়ে চলতে হচ্ছে। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পাস করা অনিক বলেন, অনার্স পাস
করার পর থেকেই চাকরির জন্য বিভিন্ন ব্যাংক থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি
প্রতিষ্ঠানে আবেদন করে চলেছি। অনেক জায়গা থেকে ইন্টারভিউ এর ডাক এলেও কিছু
কিছু জায়গা থেকে এখনো কোনো খবর আসেনি। পরীক্ষাও দিয়েছি কয়েক জায়গায়। পরে
জানাবো বলে কিছুই জানায় না তারা। একটি বেসরকারি ব্যাংকে ইন্টারভিউ দেয়ার
কথা উল্লেখ করে অনিক বলেন, আমি সিটি ব্যাংকের কার্ড সেলস ইক্সজিকিউটিভ
পোস্টে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম মোট ৫ বার। প্রথম বার ইন্টারভিউ দিতে আসা প্রায়
৪৫০০ জনের মধ্যে, সর্বশেষ আমরা ৭ জনে এসে দাঁড়াই। ১১টি শূন্য পদ পূরণে
নতুন লোক নিয়োগের কথা থাকলেও আমাদের ৭ জনের একজনেরও স্থান হয়নি সেখানে।
তাহলে কাদের এরা চাকরিতে নিলো প্রশ্ন করে অনিক বলেন, আজকাল পড়া-লেখা করে
শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেটই পাওয়া যায়। কিন্তু তাতে কোনো চাকরি
পাওয়া যায় না। চাকরি পেতে হলে চাচা-মামা বা ফোনের জোর লাগে। ছোটবেলা থেকেই
পুলিশ অফিসার হওয়ার স্বপ্ন দেখতো যশোরের রাজিব। তাইতো স্নাতক ডিগ্রি লাভ
করেই নিয়মিত কসরত শুরু করেন তিনি। দুই বার মাঠেও দাঁড়ান। শারীরিক যোগ্যতা ও
লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরও, মৌখিক পরীক্ষায় বাদ পড়ে যান তিনি।
পুলিশের উপ-পরিদর্শক পদের পরীক্ষা দিতে যাওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানান
তিনি। তিনি বলেন, আমার সঙ্গে অনেকেই পরীক্ষা দিয়েছিল। দৌড়, লংজাম্প, রোপ
ক্লাম্বিং ঠিকমতো না করেও তারা আজ চাকরিতে বহাল রয়েছেন। কর্মকর্তাদের নাম
না বললেও তিনি জানান, ন্যূনতম ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা খরচ করা লেগেছে আমার
বন্ধুদের চাকরি পাওয়ার জন্য। আমাকেও বলা হয়েছিল টাকার কথা। কিন্তু
পারিবারিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় টাকার জোগাড় করতে পারেনি। আর এই জন্য
চাকরিটাও পাওয়া হয়নি। তিনি বলেন, এমন অবস্থা সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকসহ সব
ক্ষেত্রেই। সারা জীবন টাকা-পয়সা খরচ করে বাবা-মা পড়ালেখা করিয়েছেন। আর এখন
ছেলের চাকরির জন্যও তাদের টাকা দিতে হবে। কিন্তু আমাদের মতো মধ্যবিত্ত
পরিবারের মানুষ জমি-বাড়ি বিক্রি করে ঘুষের জন্য যে টাকাটা দেবে, সেটা কার
কাছে দেবে। আর টাকা দেয়ার পর যদি চাকরি না হয়, তাহলে কার কাছে বিচার
জানাবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করে বের হওয়া আতিক ইসলাম
বলেন, এখন ভাত ছিটালে কাকের দেখা না পাওয়া গেলেও, উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা
প্রার্থী চেয়ে চাকরির বিজ্ঞপ্তি দিলে, মাস্টার্স পাসের প্রার্থীদের ঠেলে
সরানো যায় না। তিনি বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিদর্শকের
৯টি শূন্য পদের বিপরীতে আবেদন করেছেন ৭৮ হাজার প্রার্থী। যারা সবাই ন্যূনতম
স্নাতক ডিগ্রিধারী। চাকরি পাওয়ার জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রেই এমনই মরিয়া হয়ে
উঠেছে আমাদের শিক্ষিত সমাজ। তিনি বলেন, যোগ্যতা অনুযায়ী আমার যে চাকরিতে
আবেদন করার কথা, সেগুলোর একটাতেও অভিজ্ঞতার অভাবে আবেদন করতে পারছি না।
জন্ম থেকেই কেউ অভিজ্ঞতাপূর্ণ হয় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগে তো আমাদের
কাজে ঢুকতে হবে। কাজ করতে হবে। তার পরতো আমরা অভিজ্ঞতা অর্জন করবো। তিনি
আরও বলে, অনেক ঘোরাঘুরি করে দুই বছর আগে আমার বড় ভাইয়ের একটি সরকারি
ব্যাংকে চাকরি হয়েছে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে। নিজের যোগ্যতা দিয়ে চাকরি না
পেলে, শেষ পর্যন্ত আমাকেও এমন টাকার বিনময়েই চাকরিতে ঢুকতে হবে। এছাড়া কিছু
করার নেই। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্য অনুযায়ী
জানা যায়, ২০১৭ সালে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
স্নাতক-স্নাতকোত্তরসহ উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেছেন কম-বেশি সাড়ে তিন লাখ
শিক্ষার্থী। এদের মতো প্রতিবছরই লাখ লাখ মানুষ চাকরির আশায় শ্রমবাজারে
প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর হিসাবনুযায়ী বর্তমান
এদেশে ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে অর্থনৈতিকভাবে কর্মক্ষম শ্রমশক্তি ৬ কোটি ৭ লাখ।
এদের মধ্যে ৫ কোটি ৮০ লাখ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত আছেন। বাকি ২৭ লাখই বেকার।
অবশ্য প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিবারের মধ্যে কাজ করে কোনো মজুরি পায় না
এমন মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ১১ লাখ। এছাড়া আরো ১ কোটি ৬ লাখ মানুষ দিনমজুর,
যাদের কাজের কোনোই নিশ্চয়তা নেই। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এর মতে
এরাও বেকার। এ হিসাব মতে, বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী দেশে বেকারের সংখ্যা ২
কোটি ৪৪ লাখ। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য মতে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৫ ভাগই
হচ্ছে বেকার।
এ বিষয়ে দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমেদ বলেন, সাধারণত বেসরকারি খাতে ৭০ শতাংশ কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনবল প্রয়োজন। কিছু অফিসিয়াল কাজের জন্য বাকি ৩০ শতাংশ মানুষের শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থাকলেই হয়। কিন্তু আমাদের দেশের ৯০ শতাংশ উচ্চশিক্ষিতের মধ্যেই কোনো কারিগরি বা বাস্তবভিত্তিক জ্ঞান নেই। ফলে তারা চাকরি পাচ্ছেন না। আর উচ্চ শিক্ষিতদের এই বেকারত্বের কারণে, সমাজ ও রাষ্ট্রে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রাণলয়ের সচিব মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, এখন প্রয়োজন দেশের জনপ্রশাসন নিয়ে নিবিড় পর্যালোচনা ও গবেষণা করে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। তাহলে এই দেশের এই বিশাল বেকার সমস্যা কিছুটা লাঘব হতে পারে।
এ বিষয়ে দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমেদ বলেন, সাধারণত বেসরকারি খাতে ৭০ শতাংশ কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনবল প্রয়োজন। কিছু অফিসিয়াল কাজের জন্য বাকি ৩০ শতাংশ মানুষের শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থাকলেই হয়। কিন্তু আমাদের দেশের ৯০ শতাংশ উচ্চশিক্ষিতের মধ্যেই কোনো কারিগরি বা বাস্তবভিত্তিক জ্ঞান নেই। ফলে তারা চাকরি পাচ্ছেন না। আর উচ্চ শিক্ষিতদের এই বেকারত্বের কারণে, সমাজ ও রাষ্ট্রে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রাণলয়ের সচিব মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, এখন প্রয়োজন দেশের জনপ্রশাসন নিয়ে নিবিড় পর্যালোচনা ও গবেষণা করে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। তাহলে এই দেশের এই বিশাল বেকার সমস্যা কিছুটা লাঘব হতে পারে।
No comments