আফগানিস্তানে মার্কিন উপস্থিতি শেষ হওয়ার পথে by বদরুদ্দীন উমর
মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র এখন সে দেশের ইতিহাসের নিকৃষ্টতম প্রেসিডেন্টের অধীনে শাসিত
হচ্ছে এবং তার সাম্রাজ্যবাদী হামলায় এখন খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
আফ্রিকান আমেরিকান, লাতিনের থেকে নিয়ে গরিব শ্রমজীবীরাসহ সারা দুনিয়ার
মানুষের জীবন, বিশেষত উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তান ইত্যাদি
দেশে মানুষের জীবন ছিন্নভিন্ন হচ্ছে। দীর্ঘদিন আগে থেকেই 'গণতান্ত্রিক দেশ'
নামে সাম্রাজ্যবাদী প্রচারণার মাধ্যমে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি
ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত হলেও সে বিষয়ে বিশ্ব গণমাধ্যমে বিশেষ কিছু শোনা
যায় না। মার্কসের এক বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে, যে রাষ্ট্র অন্য দেশের জনগণের
ওপর নির্যাতন করে, সে রাষ্ট্র নিজেদের দেশের জনগণেরও শোষণ-নির্যাতনকারী। এ
কথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো 'গণতান্ত্রিক' রাষ্ট্রের পক্ষে যে
সর্বতোভাবে প্রযোজ্য, এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক
নীতির সঙ্গে যারা পরিচিত, তাদের ভালোভাবেই জানা। তাদের সাম্রাজ্যবাদী
প্রচারণায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই চরিত্র খুব সাফল্যের সঙ্গে ধামাচাপা
দেওয়া হলেও সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে তাদের মিথ্যা ও কুৎসার
শেষ নেই। ১৯৪৫ সালে তাদের প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান জাপানে আণবিক বোমা
নিক্ষেপ করে মুহূর্তের মধ্যে লাখ লাখ নিরীহ জাপানি নারী, শিশু, বৃদ্ধ
নির্বিশেষে হত্যা এবং আরও লাখ লাখ মানুষকে চিরতরে পঙ্গু করে দেওয়া সত্ত্বেও
ট্রুম্যানকে তাদের কেউ ভয়ঙ্কর ফ্যাসিস্ট হিসেবে আখ্যায়িত করে না। এ জন্য
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তারা ফ্যাসিস্ট আখ্যা দেয় না। ইতিহাসে এই অন্যতম
বৃহৎ হত্যাকাণ্ড সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হলো এক 'আদর্শ' গণতান্ত্রিক
রাষ্ট্র! অথচ সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও তার
নির্মাতা স্ট্যালিন হলেন তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রচারণায় হিটলারের জার্মানি
এবং হিটলারের সঙ্গে তুলনীয়। এ কথা কে না জানে যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণের
কোনো কাজের সংকট ছিল না। খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা, বাসস্থানের কোনো
মৌলিক সমস্যা ছিল না। তাদের কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নের এই সমাজতান্ত্রিক অর্জন
ছিল হিটলারের ফ্যাসিবাদের সঙ্গে তুলনীয়! যে স্ট্যালিনের নেতৃত্বাধীন
কমিউনিস্ট পার্টির শাসনে সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে জনগণের সব মৌলিক চাহিদা
পূরণ করা হয়েছিল, সেই স্ট্যালিন নাকি হলেন লাখ লাখ মানুষ হত্যাকারী। যারা
নিজেদের দেশের জনগণের সব মৌলিক সমস্যার সমাধান বড় আকারে করে দেখিয়েছিল,
সমাজতন্ত্র মানুষকে কী দিতে পারে, তারা একই সঙ্গে লাখ লাখ মানুষ হত্যা করতে
পারে কীভাবে? যদি সেটা তারা করত তাহলে কি সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র
প্রতিষ্ঠা সম্ভব হতো? হাজার প্রতিকূলতার মুখে স্ট্যালিন যেভাবে রাশিয়ার মতো
একটি চরম পশ্চাৎপদ দেশকে একটি সুপারপাওয়ারে পরিণত করেছিলেন, সেটা তার
পক্ষে কি সম্ভব হতো দেশের লাখ লাখ মানুষ হত্যা করে? লাখ লাখ মানুষ হত্যা
করলে কি সে দেশের মানুষ কমিউনিস্ট পার্টি ও তার সর্বোচ্চ নেতা স্ট্যালিনকে
অনেক আগেই উৎখাত করত না? এ ধরনের হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও জনগণ কি
কোনো সরকার ও রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখতে পারে, তাকে সুপারপাওয়ারে পরিণত করা
তো দূরের কথা। দেশের জনগণকে এভাবে হত্যা করলে কি সোভিয়েত ইউনিয়ন হিটলারকে
পরাজিত করতে পারত? স্ট্যালিনের ও কমিউনিস্ট পার্টির পেছনে জনগণ ঐক্যবদ্ধ
হয়ে দাঁড়াত? কিন্তু এটাই হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী প্রচারের চরিত্র। এটাই তাদের
এক বিশাল প্রচারণা সাফল্য। এই প্রচারণার শিকারই হয়েছে দশকের পর দশক ধরে আজ
পর্যন্ত দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষ। এসব কথা এখানে বলা প্রয়োজন হলো, বর্তমানে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের সাম্রাজ্যবাদী মিত্রেরা সারা দুনিয়ার
মানুষের ওপর তাদের যে অর্থনৈতিক শোষণ ও ব্যাপক নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে তারই
পরিপ্রেক্ষিতে। তারা ২০০১ সালে নিউইয়র্কের আন্তর্জাতিক ট্রেড সেন্টার
বিধ্বস্ত হওয়া থেকে, এমনকি বুড়ো বুশ ও ক্লিনটনের আমল থেকে নতুন পর্যায়ে
বিশ্ব জনগণের ওপর তাদের হামলা চালিয়ে আসছে। এখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে এটা
এক নতুন মাত্রা অর্জন করেছে। তারা আগে আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়ার শাসন
ব্যবস্থা ধ্বংস করে সে দেশগুলোর জনগণের জীবন ছিন্নভিন্ন করেছে। সিরিয়ায়
তারা অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালিয়ে এবং তার ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেশটির এমন
ব্যবস্থা করেছে, যা আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়ার থেকেও ভয়ঙ্কর।
আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়ায় তারা সেখানকার নেতৃত্ব উৎখাত করলেও রাশিয়ার
সমর্থনের কারণে প্রেসিডেন্ট আসাদকে এ পর্যন্ত ক্ষমতাচ্যুত করতে পারেনি।
কিন্তু তারা সিরিয়ায় সব থেকে ভয়ঙ্করভাবে সে দেশের সবকিছু ধ্বংস করেছে।
জনগণের জীবন প্রত্যেকটি অঞ্চলে বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত ও সম্পূর্ণভাবে
ছিন্নভিন্ন করেছে। এর ফলে লাখ লাখ সিরিয়াবাসী দেশ ছেড়ে তুর্কি, জর্ডান,
পাকিস্তান এবং ইউরোপীয় দেশগুলোতে উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে। লাখ লাখ
লোকের জীবন গেছে, হাজার হাজার সিরিয়াবাসী ইউরোপ যাওয়ার উদ্দেশ্যে ভূমধ্য
সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে নৌকাডুবি হয়ে নিহত হয়েছেন। সিরিয়ায় আসাদ প্রেসিডেন্ট
হিসেবে টিকে থাকলেও সিরিয়া ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন আফগানিস্তানে তাদের সৃষ্ট
সংকট আফগানিস্তানে তালেবান শাসন প্রত্যাবর্তনের পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে এনে
দাঁড় করিয়েছে, যাতে ২০১৮ সালের মধ্যেই কারজাই সরকারের পতন এবং তালেবানদের
সরকার প্রতিষ্ঠা রোধ করার আর কোনো উপায় নেই। আফগান প্রেসিডেন্ট কারজাই
নিজেই বলেছেন যে, আফগানিস্তানে তাদের সরকার খুব জোর আর ৬ মাস টিকে থাকতে
পারে। এই অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক
১৯৪৭ সালের পর সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদের
বিরুদ্ধে তাদের তৎপরতা যথেষ্ট চালাচ্ছে না, এই অভিযোগে তারা সে দেশে তাদের
দুইশ' কোটি ডলারের সামরিক সাহায্য বন্ধ করেছে এবং আরও নানাভাবে পাকিস্তানকে
শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুসলিমবিরোধী নীতি যে এ
ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করছে, এতে সন্দেহ নেই। মুসলমানদের চরম শত্রু
ইসরায়েল ও ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকারের সঙ্গে মিলে তারা মুসলমানদের ওপর যে
আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হলো, তারই একটা
দিক।
অন্যথায় পাকিস্তানের মতো একটি ফ্যাসিস্ট এবং দীর্ঘদিন ধরে তাদের অনুগত
রাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতি এ পর্যায়ে তারা নামিয়ে আনত না।
পাকিস্তান ডোনাল্ড ট্রাম্প সরকারের বিরুদ্ধে জোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা
সত্ত্বেও একটি কাজ করা থেকে তারা এখনও বিরত আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
আফগান সরকার টিকিয়ে রাখার জন্য সেখানে যে সামরিক সরঞ্জাম পাঠায়, সেটা
পাকিস্তানের মধ্য দিয়েই যায়। এই সরবরাহ রুট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফগান
যুদ্ধের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই রুট বন্ধ করলে কারজাই সরকারের পতন
আরও ত্বরান্বিত হবে। পর্যবেক্ষকদের মত হলো- পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত এ
ক্ষেত্রে কী করবে, তার এখনও ঠিক নেই। তবে তারা যদি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এই সুবিধা দেওয়া বন্ধ করে, তাহলে আফগানিস্তানে
কারজাই সরকার তিন মাসের বেশি টিকবে না। তালেবানরা এর মধ্যেই ক্ষমতায়
অধিষ্ঠিত হবে। পাকিস্তান ছাড়া অন্য যে পথে আফগানিস্তানে সামরিক সরঞ্জাম
পাঠানো যায়, সেটা হলো উত্তরে তাজিকিস্তানের মধ্য দিয়ে; কিন্তু ভৌগোলিক
কারণে তার অসুবিধা অনেক। কাজেই সে পথে এত বিশাল সামরিক সরঞ্জাম
আফগানিস্তানে পাঠানো ভয়ানক অসুবিধার ব্যাপার। তাছাড়া তাজিকিস্তানের ওপর
রাশিয়ার প্রভাব যথেষ্ট। রাশিয়ার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে সম্পর্ক
তাতে সে পথ রাশিয়া ইচ্ছা করলে বন্ধ করতে পারে। সে অবস্থায় আফগানিস্তানে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সামরিক ভূমিকা আর থাকার কথা নয় এবং সে ভূমিকা
না থাকলে সেখানে কারজাই সরকারের পতন এবং তালেবানদের প্রত্যাবর্তন
অপ্রতিরোধ্য। ভারত সরকারকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সামরিক
হস্তক্ষেপের জন্য প্ররোচিত করলেও বাস্তব কারণে ভারতের পক্ষে এটা অসুবিধাজনক
ও বিপজ্জনক। কাজেই আফগানিস্তানে ভারতের বড় ধরনের উপস্থিতি থাকলেও সেটা
কারিগরি, প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক সাহায্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কাজেই কারজাই
সরকারকে রক্ষা করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এখন আর সম্ভব নয়।
সাম্রাজ্যবাদী প্রতিদ্বন্দ্বী সোভিয়েত ইউনিয়নকে আফগানিস্তান থেকে উৎখাতের
উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তালেবানদের সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে
সামরিকভাবে শক্তিশালী করেছিল এবং শেষ পর্যন্ত সেখানে সোভিয়েত প্রভাবাধীন
সরকার উৎখাত হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তালেবানদের ক্ষমতায় বসিয়েছিল।
কিন্তু পরে তালেবান নেতা মোল্লা ওমর তেলের পাইপলাইন আফগানিস্তানের মধ্য
দিয়ে পাকিস্তান হয়ে আরব সাগর পর্যন্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের হুকুম মেনে
নিতে অস্বীকার করায় তারা পরস্পরের শত্রুতে পরিণত হয় এবং ইউরোপীয়
সাম্রাজ্যবাদী মিত্রদের সহায়তায় আফগানিস্তানে তালেবান সরকার উৎখাত করে।
ক্ষমতায় বসানো হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তাঁবেদার সরকার। কিন্তু বিশাল
মার্কিন সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য সত্ত্বেও তালেবানরা একের পর এক সামরিক
বিজয়ের মাধ্যমে এখন ক্ষমতার দোরগোড়ায়। শুধু কারজাই সরকার নয়, মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রও এখন আফগানিস্তান থেকে উৎখাতের পথে। সেখানে তাদের অবস্থান
রক্ষার কোনো সম্ভাবনাই আর নেই। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে, আফগানিস্তান থেকে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উৎখাত হওয়ার পরিস্থিতির একটা ইতিবাচক দিক হলেও
আফগানিস্তানে আবার তালেবান শাসন ফিরে আসা সে দেশের জনগণের জীবনে কোনো সুখ,
শান্তি নিয়ে আসা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এর জন্য
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সাম্রাজ্যবাদী মিত্রদের ছাড়া অন্য কাউকেই দায়ী
করার প্রশ্ন ওঠে না।
সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
No comments