বলব না তো- পুনর্মূষিকোভব! by অজয় দাশগুপ্ত
নাসিরউদ্দিন
হোজা প্রখর রসবোধের জন্য সুপরিচিত ছিলেন। যে কোনো পরিস্থিতি তিনি
হাস্যকৌতুকে সামলে নিতে শুধু নয়, নিজের অনুকূলে নিয়ে আসতে পারতেন। একদিন এক
লোক তাকে বলেন, হোজা সাহেব, এখানে আসার পথে দেখলাম কয়েকজন লোক অনেক
সুস্বাদু খাবার নিয়ে যাচ্ছে। নাসিরউদ্দিন সাহেব উত্তর দিলেন, 'তাতে আমার
কী?' ওই লোক তখন বিষয়টি খোলসা করে বললেন, 'তাদের আপনার বাড়ির দিকে আসতে
দেখলাম।' নাসিরউদ্দিন সাহেব চটজলদি উত্তর দিলেন, 'তাতে আপনার কী লাভ?' ঠিকই
তো, অন্য কারও বাড়িতে উপাদেয় সব খাবার গেলে নাসিরউদ্দিন হোজার কী লাভ এবং
তার বাড়িতে এসব খাবার গেলে অন্যের কী লাভ? তবে দুনিয়ার সবকিছুর ফয়সালা তো
এভাবে করা যায় না। নাসিরউদ্দিন সাহেব যদি এসব খাবার বিলিয়ে দেন, তাহলে
অন্যদের লাভ হতেই পারে। আবার অন্যরা যদি ভালো খাবারগুলোর একটু অংশ তাকে
দেয়, সেভাবে তিনিও লাভবান হতে পারেন। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর
তালিকায় আর থাকছে না, স্থান হয়েছে উন্নয়নশীল দেশের সারিতে- এটা সুখবর। যে
দেশটিকে জন্মলগ্নে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হতো 'বাস্কেট কেস' হিসেবে, সেটিই
কি-না এখন উন্নয়নশীল দেশ! কেউ কেউ নিজেকে নিয়ে রসিকতা করতে পারেন। আবার কেউ
কেউ নিজেকে নিজের শক্তির তুলনায় খাটো দেখিয়ে, কিংবা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেও
মজা পান। বিশ্বব্যাংক ও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অর্থনীতির পণ্ডিত বলে দাবিদার
ব্যক্তি আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের সময় বলেছিলেন, এ দেশটি বাস্কেট কেস,
উন্নত দেশগুলোর দান-খয়রাতেই কেবল টিকে থাকতে পারে। জাস্ট ফালান্ড এবং কে আর
পারকিনসন নামের দুই পণ্ডিত 'বাংলাদেশ :দি টেস্ট কেস অব ডেভেলপমেন্ট' নামের
বইয়ে মন্তব্য করেছিলেন, যদি বাংলাদেশে উন্নয়ন হতে পারে, তাহলে বিশ্বের যে
কোনো দেশে এটা হতে পারে। তারা বলেন, বিদেশি সাহায্য না পেলে অর্থনীতি
বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যৌথ উদ্যোগেই কেবল বাংলাদেশ
টিকে থাকতে ও উন্নত হতে পারে।আমরা স্কুলে শিক্ষকদের ঠাট্টা শুনেছি 'খারাপ'
ছাত্রদের ব্যাপারে- 'ও পাস করলে চেয়ার-টেবিলও পাস করবে!' ফালান্ড-পারকিনসন
সাহেবরা ঠিক এমনটিই বলতে চেয়েছেন। বাংলায় প্রবাদ আছে, শকুনের দোয়ায় গরু মরে
না। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি বা সিডিপি স্বল্পোন্নত দেশের
তালিকা থেকে বের হওয়ার শর্ত ঠিক করেছে তিনটি- মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক ও
অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক, এ তিনটির দুটি অর্জন হলেই চলবে। বাংলাদেশ তিনটি
শর্তই পূরণ করেছে। কেবল ফালান্ড-পারকিনসনরাই যে বাংলাদেশের বদনাম করেছিলেন
তা কিন্তু নয়। 'বাস্কেট কেস'-এর বাংলা এ দেশেরই কিছু লোক করেছিলেন
'তলাবিহীন ঝুড়ি'। আর সেটার অনুবাদ করা হয় 'বটমলেস বাস্কেট'। এভাবে বাস্কেট
কেস পরিণত হয় বটমলেস বাস্কেটে। নিজেদের এভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়েছিল
কিন্তু রাজনৈতিক কারণে। যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি, তারা বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অর্জিত বাংলাদেশকে ভিখারির দেশ,
দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে তুলে ধরতে সচেষ্ট ছিল স্বাধীন দেশ হিসেবে
যাত্রার শুরু থেকেই। তাতে অবশ্য কাঙ্ক্ষিত ফল মেলেনি। বাংলাদেশ কিন্তু এখন
নিজের পায়ে ভালোই দাঁড়িয়ে গেছে। নিজের প্রয়োজনীয় খাদ্য নিজেই উৎপাদন করছে।
ঘাটতি হলে নিজের অর্থে তা আমদানির মুরোদ রাখে। যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতু
নির্মাণে মোট ব্যয় ৮০ কোটি ডলারের প্রায় সবটা এসেছে বৈদেশিক ঋণ থেকে।
কিন্তু পদ্মা সেতুর ৪০০ কোটি ডলারের সবটাই জোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে আমাদের
নিজস্ব ভাণ্ডার থেকে। প্রকৃত অর্থেই আমরা বলতে পারি পদ্মা সেতু একটি চেতনার
নাম, পরনির্ভরতা থেকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পথে বলিষ্ঠ পদক্ষেপের
নাম।আমাদের অন্তর্নিহিত শক্তিই ১৯৭১ সালে প্রবল পরাক্রমশালী পাকিস্তানি
সামরিক বাহিনীকে পরাজিত করতে পেরেছে। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই একটি নিরস্ত্র
জাতি নিজেদের সশস্ত্র করে তুলতে পারবে, সেটা পাকিস্তান কিংবা সে সময়ে
তাদের অস্ত্র-অর্থ জোগানদাতা যুক্তরাষ্ট্র ধারণা করতে পারেনি। তারা বলেছে,
দেশটিতে খাদ্য ঘাটতি প্রবল, নারীরা অবগুণ্ঠনবতী এবং চার দেয়ালে প্রায় বন্দি
থাকে। শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা দেশটিতে কুসংস্কার-কূপমণ্ডূকতার দাপট। এমন একটি
দেশের প্রায় ৪০ লাখ নারী গ্রাম থেকে শহরে এসে কোনো ট্রেনিং ছাড়াই পোশাক
শিল্পের হাল ধরবে, সেটা তারা ভাবতে পারেনি। আমাদের ছায়াঢাকা সবুজ-শ্যামল
গ্রামের কৃষক পরিবারের লাখ লাখ তরুণ মধ্যপ্রাচ্যের মরু এলাকায় কাজ নিয়ে
যাবে এবং দেশে প্রতি বছর বিপুল অর্থ পাঠাবে, সেটাও উন্নত বিশ্বের পণ্ডিতদের
চিন্তায় আসেনি। তারা কি এটাও ভাবতে পেরেছিলেন যে স্বাধীনতার চার দশক পার
হতে না হতেই প্রায় পাঁচ কোটি ছাত্রছাত্রী স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত
ছড়িয়ে পড়বে? প্রকৃতই আমরা বড় বড় অর্জন করেছি। কিন্তু একইসঙ্গে অনেক প্রশ্ন
দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসবে- 'তাতে আমার কী?' বাংলাদেশ অসীম
সম্ভাবনাময়- এটা এখন অনেক পণ্ডিত মানছেন। এ দেশ উপচে পড়ছে কাজ করার মতো
শক্তি-সামর্থ্য-বুদ্ধি রাখে, এমন অনেক অনেক মানুষে। তাদের অনেকের বাড়তি
যোগ্যতা- ইংরেজি ভাষা জানে। ভুল বা অশুদ্ধ ইংরেজি অনেকে বলে, অনেকের
উচ্চারণ ঠিক নয়- কিন্তু কাজ চালিয়ে নিতে তাতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বিশ্বের
বহু দেশে দেখা যায়, আমাদের চেয়েও দুর্বল ইংরেজি জ্ঞান নিয়ে চলতে সমস্যা হয়
না। কিন্তু কাজ বা চাকরি তো পেতে হবে তাদের? মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে
কিংবা উন্নত বিশ্বে দক্ষ লোকের যথেষ্ট চাহিদা আছে। উন্নত বিশ্বে এখন
'তারুণ্যের বড় অভাব'। বয়স্ক লোক বেশি। অথচ বাংলাদেশের চিত্র ভিন্ন- ১৫ থেকে
৬০ বছরের নিচের নারী-পুরুষ বেশি।
এটা দেশের বড় সম্পদ। উপযুক্ত করে গড়ে
তুলতে পারলে বিশ্বের নানা দেশেও তারা যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে পারবে। কিন্তু
দেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর চাকরির যে বড় অভাব! গত বছর অক্টোবরে সংবাদপত্রে
একটি প্রতিবেদন ছিল এভাবে- 'ব্যাংকে সাত হাজার পদে আবেদন ১০ লাখ ৮৪ হাজার'।
গত ২ মার্চ একটি দৈনিকের খবর - 'মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ৯ শূন্য পদে ৭৮
হাজার আবেদন'। ৩৮তম বিসিএসের জন্য ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৪৬৮ জন প্রার্থী আবেদন
করেছেন। তাদের জন্য পদ রয়েছে মাত্র ২ হাজার ২৪টি। এসব আবেদনকারীর
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সনদ রয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। আমাদের রাজনৈতিক
নেতৃত্ব, উদ্যোক্তা এবং অন্য যারা দেশ ও দশের স্বার্থ নিয়ে ভাবেন, তাদের
বেকারত্ব দূর করার পথ নিয়ে ভাবতে হবে। উন্নয়নশীল দেশের সারিতে বসার কারণে
আমাদের মর্যাদা বিশ্বে বাড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। ভিখারির দেশে বিনিয়োগ করতে
অনেকে দ্বিধাগ্রস্ত থাকে। এটা ভালো দিক। কিন্তু গরিব বা স্বল্পোন্নত দেশ
হিসেবে আমরা কিছু দান-খয়রাত পেতাম সেটা বন্ধ হবে বা সীমিত হবে। এখন অনেক
উন্নত দেশ আমাদের পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক্ক আরোপ করে না। এ সুবিধা ক্রমে
বন্ধ হয়ে যাবে। এর অর্থ হচ্ছে বিশ্বে আমাদের জন্য পরিস্থিতি প্রতিকূূল হতে
পারে। তখন কেউ কি আকুল হয়ে বলবে- 'পুনর্মূষিকোভব!' অর্থাৎ ফের যেন বাংলাদেশ
গরিব দেশ হয়ে যায়। এটা বলার প্রশ্ন আসে না। ১৯৭১ সালে আমরা বীরের মতো লড়ে
স্বাধীনতা অর্জন করেছি। পরের বছরগুলোতে আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি।
সামনে বিশ্ববাজারে যে প্রতিযোগিতা তার সঙ্গে পাল্লা দিতে আমাদের দক্ষতা
বাড়াতে হবে। এ জন্য একটি শর্ত হচ্ছে মানসম্পন্ন শিক্ষা। প্রশ্ন ফাঁসের
সুযোগ নিয়ে কিংবা নকল করে পাস করে লাভ নেই। আমাদের শিক্ষার প্রসার ঘটেছে।
এটা বড় অর্জন। এখন মান বাড়াতেই হবে। আমাদের গড় আয়ু বাড়ছে। এটাও বড় অর্জন।
তবে কেবল আয়ু বাড়া নয়, প্রতিটি শিশু-কিশোর-কিশোরী যেন সুস্থ-সবল হয়ে বেড়ে
ওঠে, সেটা নিশ্চিত করা চাই। আমরা আর কম সুদে এবং অনেক লম্বা সময় ধরে
পরিশোধের শর্তে বিশ্বব্যাংক বা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ঋণ পাব না। এখন ঋণ
নিলে সুদ বেশি গুনতে হবে। তাড়াতাড়ি শোধ দিতে হবে। বাংলাদেশের সামনে এখন
দুটি পথ খোলা- ঋণ গ্রহণ কমিয়ে দেওয়া কিংবা যে ঋণ নেব, সেটা ভালোভাবে কাজে
লাগানো। শেষের কাজটি করার জন্য দুর্নীতি কমানো অপরিহার্য। ঋণ নিয়ে ঘি
খাওয়ার দিন যে শেষ। সঠিক পথে চলতে হলে এখন অবশ্যই সুশাসনের প্রতি নজর দিতে
হবে। দেশের ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মেরে দেওয়া কিংবা অন্য দেশ বা সংস্থা থেকে
ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ- এসব যতটা কমানো যায় ততই মঙ্গল। এতে ব্যর্থ হলে কিন্তু
অনেকেই বলতে শুরু করবে- উন্নয়নশীল দেশের তকমা লেগেছে তো আমার কী!
ajoydg@gmail.com
ajoydg@gmail.com
No comments