মুক্তিদাতাকে নিয়ে কিছু স্মৃতিকথা by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
আজ
১৭ মার্চ। 'ফাউন্ডিং ফাদার অব বাংলাদেশ' (বাংলাদেশের স্থপতি) বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৯তম জন্মদিন। ২০২০ সালে তার জন্মশতবার্ষিকী পালিত
হবে। আমার প্রয়াত সাহিত্যিক বন্ধু সৈয়দ শামসুল হক দুরারোগ্য ক্যান্সার রোগে
আক্রান্ত হওয়ার পর শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, 'আমি বঙ্গবন্ধুর
জন্মবার্ষিকীর উৎসব দেখে তার পরে মরতে চাই।' তার ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি। আমিও
নানা রোগে জর্জরিত অবস্থায় টেনেটুনে জীবনটাকে ২০২০ সাল পর্যন্ত নিয়ে যেতে
চাই। আমারও ইচ্ছা পূর্ণ হবে কিনা জানি না। যদিও না হয় বাংলার মানুষ যে
বিরাট সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দিয়ে দিনটি স্মরণ করবে, তাতে সন্দেহ নেই।
আমার জীবনের পরম গর্ব আমি বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য ও স্নেহ পেয়েছিলাম। আমার
জীবনের পরম গৌরব, বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে আমিই প্রথম তার ছোট
জীবনী পুস্তিকা লিখি। যেটি (ইংরেজি অনুবাদ) ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে
জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে বিশ্ব নেতাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। আবার
তার মৃত্যুর পর (যখন তার নাম উচ্চারণও বাংলাদেশে নিষিদ্ধ) তাকে নিয়ে লেখা
সর্বপ্রথম একটি বই (ইংরেজি) লন্ডন থেকে প্রকাশ করেছিলাম। এখন তো বঙ্গবন্ধুর
ওপর বইয়ের ছড়াছড়ি। কিন্তু বিনীতভাবে এই গর্বটাও প্রকাশ করতে পারি যে, সেই
দুর্দিনে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ওপর আমিই প্রথম বই প্রকাশ
('ইতিহাসের রক্ত পলাশ') এবং প্রথম ছায়াছবি 'পলাশী থেকে ধানমণ্ডি' তৈরি
করেছি। এ জন্য বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী গোষ্ঠী এবং বিএনপি ও জামায়াতের কাছ
থেকে যে হুমকির সম্মুখীন হয়েছি, তার সীমা-সংখ্যা নেই। নিজের গৌরবগাথা
প্রচারের জন্য এই লেখাটা লিখছি না। লিখছি এ জন্য যে, বঙ্গবন্ধু আমার কাছ
থেকে যা আশা করছিলেন, তার সবটা পূরণ করতে না পারলেও কিছু যে করতে পেরেছি,
তা বলার জন্য। আজ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোনো সিরিয়াস আলোচনায় যাচ্ছি না। এটা
আমার ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ, তার জন্মদিনে শ্রদ্ধা নিবেদন; তাই ব্যক্তিগত
স্মৃতির কিছু কথা আজ লিখছি। সম্ভবত ১৯৭৩ সালের কথা। সন্ধ্যার দিকে
বঙ্গবন্ধু পুরনো গণভবনের দোতলায় বিরাট কনফারেন্স রুমটাতে বসে আছেন। আমি
সেখানে গিয়ে দেখি, তিনি ঘরোয়া বৈঠকে ব্যস্ত। সেখানে শেখ ফজলুল হক মনি,
বদরুন্নেসা আহমদ, কাদের সিদ্দিকীসহ আরও অনেকে আছেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, দেশে
দুর্নীতিবাজরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে। আমার চারদিকেও চাটার দল এসে
জুটেছে। এদের আমি শক্ত হাতে দমন করতে চাই। দুর্ভাগ্যের কথা কি জান, এই
দুর্নীতি বেশি করছে শিক্ষিত এবং ভদ্রলোকেরাই। আমি এদের সম্পর্কে একটা কবিতা
লিখেছি। তোমরা শুনবে? বলেই তিনি তার পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে পড়তে
শুরু করলেন। কয়েক লাইন শুনেই বুঝলাম, রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত 'বিচারের বাণী
নীরবে নিভৃতে কাঁদে' কবিতাটির প্যারোডি এই কবিতা। তবে ভাষা ও ছন্দের গরমিল
আছে। এখানে ভাষা ও ছন্দটাই বড় কথা নয়, বড় কথা, বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য। কবিতার
প্রথম দুটি লাইন হলো- 'আমার বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে/বাংলার ভদ্রলোকেরা
শুধু চুরি করে, পোটলা বাঁধে।' বেশ দীর্ঘ কবিতা, বঙ্গবন্ধু পাঠ শেষ করলে
অনেকেই জিজ্ঞেস করলেন, 'কবিতাটি আপনি কী করবেন?' বঙ্গবন্ধু বললেন, 'তোমাদের
কাছেই রেখে যাব। আমার মৃত্যুর পর মানুষ জানবে, এ দেশের একশ্রেণির শিক্ষিত
ভদ্রলোকের চুরি, দুর্নীতির ঠেলায় আমি পর্যন্ত বেসামাল হয়ে পড়েছিলাম।'
অনেকেই 'কবিতাটা আমাকে দিন' বলে বঙ্গবন্ধুর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
তাদের মধ্যে বদরুন্নেসা আহমদ, শেখ মনি, এমনকি কাদের সিদ্দিকীও ছিলেন।
বঙ্গবন্ধু তাদের দিকে চেয়ে বললেন, 'না, এটা তোমাদের দেব না। গাফ্ফারকে
দেব। সে এটাকে কাজে লাগাতে পারবে। আমার মৃত্যুর পর নিন্দুকেরা অসত্য প্রচার
চালালে গাফ্ফার উপযুক্ত জবাব দেবে।' এরপরই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র
সমর্পণ সম্পর্কে কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন। কাদের সিদ্দিকীর
সঙ্গে ছিল একগাদা ফটোগ্রাফ। কাদেরিয়া বাহিনীর অস্ত্র সমর্পণের ছবি, কাদের
সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুর সামনে নতজানু হয়ে অস্ত্র রাখছেন, তার ছবিও ছিল।
বঙ্গবন্ধু খুশি হয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। বঙ্গবন্ধুকে বলা হয় লৌহকঠিন
হৃদয়ের অধিকারী মানুষ। কিন্তু তিনি যে কতটা স্নেহ-কোমল হৃদয়ের অধিকারী
মানুষ ছিলেন, তার প্রমাণ বহুবার পেয়েছি। ১৯৫৩-৫৪ সাল। তখনকার পূর্ব
পাকিস্তানে প্রাদেশিক নির্বাচনের জোর প্রস্তুতি চলছে। প্রাদেশিক মুসলিম লীগ
সরকারের মুখ্যমন্ত্রী তখন নূরুল আমীন। তার সরকারের অত্যাচারে সাধারণ মানুষ
জর্জরিত। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য হক-ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর
নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়েছে। নূরুল আমীনকেও পরাজিত করা তখন
যুক্তফ্রন্টের লক্ষ্য। ঠিক হলো, নূরুল আমীনের নির্বাচনী কেন্দ্র নান্দাইলে
হক, ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দী এই তিন নেতাই পরপর নির্বাচনী প্রচারে যাবেন এবং
যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী ছাত্রনেতা খালেক নওয়াজ খানকে সমর্থন দেবেন। নেতাদের
সঙ্গে ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরাও যাবেন। একটি ছাত্র-প্রতিনিধি দলে
আমিও সদস্য হয়ে নান্দাইলে গিয়েছিলাম। তখন আমি ঢাকা কলেজের ছাত্র।
নান্দাইলে প্রথম গেলেন শেরেবাংলা ফজলুল হক। একটি জিপের আরোহী ছিলেন তিনি।
সঙ্গে অন্যান্য গাড়িতে তার দলবলের লোকেরা। নান্দাইলে পৌঁছার আগেই একটি
পাহাড়িয়া এলাকা। হক সাহেবের গাড়িবহর সেই এলাকায় পৌঁছতেই মুসলিম লীগের
গুণ্ডারা পাহাড়ের ওপর থেকে বিরাট মাটির চাক নিচে গড়িয়ে দেয়।
ওই মাটির চাক
হক সাহেবের বা অন্য কোনো গাড়িতে পড়লে যাত্রীদের মৃত্যু ছিল অবধারিত।
ভাগ্যক্রমে শক্ত মাটির চাকটি কোনো গাড়ির মাথায় না পড়ে দু-একটা গাড়ির পাশ
ছুঁইয়ে রাস্তায় পড়ে। তাতে সাত-আটজন সামান্য আহত হয়। পরের সপ্তাহে শহীদ
সোহরাওয়ার্দীর নান্দাইলে যাওয়ার কথা। সকলেই তাকে সতর্ক করলেন। তিনি যেন
ট্রেনে বা অন্য পথে নান্দাইলে যান। তাহলে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। শহীদ
সাহেব তাদের কথা শুনলেন না। বললেন, তিনি ওই পথেই জিপ গাড়িতে চড়ে হক সাহেবের
মতো নান্দাইলে যাবেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাবশিষ্য তখনকার যুবনেতা শেখ
মুজিব বললেন, তিনি কিছু ছাত্র ভলান্টিয়ার নিয়ে সোহরাওয়ার্দীর গাড়ির অনুগামী
হবেন। এই ভলান্টিয়ারদের মধ্যে আমাকেও তিনি যুক্ত করলেন। আমি তখন ছাত্র;
কিন্তু ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত নই। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নান্দাইল যাত্রায়
কোনো বিঘ্ন ঘটেনি। তাকে থাকতে দেওয়া হলো যুক্তফ্রন্টের এক স্থানীয় নেতার
বাসায়। ছাত্র ভলান্টিয়ারদের সঙ্গে আমাদের আশ্রয় একটি ডাকবাংলোর মতো বাড়িতে।
সম্ভবত ডাকবাংলোটা এখন সঠিকভাবে মনে নেই। শেখ মুজিবের থাকার ব্যবস্থা
হয়েছিল শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে; কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, আমাদের
সঙ্গে থাকবেন। লম্বা টানা হলের মতো কক্ষ। তাতে চার-পাঁচজনের থাকার মতো
চার-পাঁচটি চৌকি পাতা। তার ওপর বিছানা। মুজিব ভাই আমাদের সঙ্গে একই রুমে।
খাওয়া-দাওয়ার শেষে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ার পর বুঝলাম, নান্দাইলের মশা কত
হিংস্র। কিন্তু কোনো বিছানাতেই মশারি নেই। কেবল মুজিব ভাইকে (তখন আমরা কেউ
তাকে লিডার, কেউ কেউ মুজিব ভাই সম্বোধন করতাম) একটা কাঁথা দেওয়া হয়েছে;
যেটা গায়ে চাপালে মশা আক্রমণ করতে পারবে না। রাতে ঘুমানোর কোনো সুযোগ ছিল
না। তবু মশা তাড়াচ্ছি, মশা মারছি- এই অবস্থায় চোখে তন্দ্রা এসে গিয়েছিল।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে জেগে উঠতেই দেখি, আমার গায়ে একটি কাঁথা। মুজিব ভাই অদূরেই
শুয়ে আছেন। তার গায়ে কাঁথা নেই। অর্থাৎ তার গায়ের কাঁথাটি তিনি আমার শরীরে
চাপিয়ে দিয়ে গেছেন। আমি তন্দ্রার ঘোরে টের পাইনি। আমি কাঁথাটি তাকে ফিরিয়ে
দিতে গেলে তিনি বাধা দিলেন। বললেন, 'ওটা গায়ে দিয়ে ঘুমাও। ভোর হতে বেশি
দেরি নেই। আমার জন্য ভেবো না। বাংলার মশা আমাকে কামড়াবে না।' আজ সুদীর্ঘকাল
পর বিদেশে বসে সেই রাতের কথা স্মরণ করছি আর ভাবছি, যে মানুষটি বলেছিলেন,
বাংলার মশা আমাকে কামড়াবে না, সেই মানুষটিকে বাংলার একদল মানুষরূপী পশুই
সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। আরেকদিনের স্মৃতি। ১৯৭৪ সাল। বাংলাদেশে
অকাল বর্ষা ও প্লাবনের ফলে বিস্তীর্ণ এলাকা ডুবে গেছে। শস্য, গবাদিপশু
ধ্বংস হয়েছে। এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে আমেরিকা বাংলাদেশের সঙ্গে খাদ্য সরবরাহ
চুক্তি করেও যথাসময়ে খাদ্যবাহী জাহাজ বাংলাদেশে পাঠায়নি। মুজিব সরকারের
পতন ঘটানোই ছিল উদ্দেশ্য। এই দুর্ভিক্ষে বহু নর-নারী মারা যায়। শেষ
পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সরকার এই দুর্ভিক্ষের মোকাবেলা করে। এ সময় একদিন গণভবনে
গেছি। তিনি শোবার ঘরে বিছানায় শুয়েছিলেন। এ কথা-সে কথার পর বললেন,
'গাফ্ফার তুমি বিশ্বাস করবে, এই দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে না পারলে আমি আত্মহত্যা
করব ভেবেছিলাম। করিনি কেন জান? আমি একজন মুসলমান। আত্মহত্যা করা ইসলাম
ধর্মে মহাপাপ। দ্বিতীয়ত, বাংলার মানুষের আমার প্রতি বিশ্বাস আছে। আমি তাদের
অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে বিশ্বাসহন্তার কাজ করতে পারি না।' কত বছর আগের
কথা, তবু তার এই কথাগুলো এখনও কানে বাজে। চোখে অশ্রু দেখা দেয়। আরেক দিন
তিনি আমাকে ইংরেজিতে বলেছিলেন- ও ঐধাব পৎবধঃবফ ধ যরংঃড়ৎু. ও ধিহঃ :ড় ংবব
রঃং ংঁপপবংং. ওভ ও ভধরষ ও রিষষ মড় :ড় ড়নষরারড়হ ভড়ৎ ধ ষড়হম :রসব. (আমি একটি
ইতিহাস সৃষ্টি করেছি। এর সাফল্য দেখে যেতে চাই। যদি ব্যর্থ হই, তাহলে
দীর্ঘদিনের জন্য বিস্মৃতির আড়ালে চলে যাব)। বঙ্গবন্ধু বিস্মৃতির আড়ালে
যাননি। তাকে বিস্মৃতির আড়ালে ঠেলে দেওয়ার বহু চেষ্টা হয়েছিল। এই মহানায়কের
স্থলাভিষিক্ত করার চেষ্টা হয়েছিল এক খলনায়ককে। সেই শঠতা ও চক্রান্ত ব্যর্থ
হয়েছে। ইতিহাস বঙ্গবন্ধুর কপালে রক্ততিলক পরিয়েছে। তা চিরদিনের। প্রতি
জন্মদিনে তিনি নতুন করে জন্ম নেন বাঙালির হৃদয়ে।
No comments