আবারো আটকে গেল চীনা বিনিয়োগ প্রস্তাব
বাংলাদেশে
চীনের কৌশলগত বিনিয়োগ প্রস্তাবগুলো একের পর এক আটকে যাচ্ছে। চট্টগ্রামের
সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ ও জ্বালানি খাতে একটি বড় বিনিয়োগের
প্রস্তাব নাকচ হওয়ার পর সর্বশেষ ঢাকা স্টক একচেঞ্জে প্রায় এক হাজার কোটি
টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব আটকে গেছে। কৌশলগত অংশীদার পতে চার মাস আগে ঢাকা
স্টক একচেঞ্জের (ডিএসইর) আহ্বানে চীন ও ভারতের দুটি কনসোর্টিয়াম দরপত্র জমা
দেয়। কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে ডিএসইর প্রতি শেয়ারের জন্য চীনা
প্রতিষ্ঠান শেনজেন ও সাংহাই স্টক একচেঞ্জ দরপ্রস্তাব করেছে ২২ টাকা।
বিপরীতে প্রায় একই পরিমাণ শেয়ার কেনার জন্য ১৫ টাকা দরপ্রস্তাব করে ভারতীয়
ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের (এনএসই) নেতৃত্বাধীন বিনিয়োগকারীদের আরেকটি
কনসোর্টিয়াম। চীনের প্রতিষ্ঠানটি ২৫ শতাংশ শেয়ারের দাম ধরেছে ৯৯২ কোটি
টাকা। এ ছাড়া কারিগরি সহায়তা বাবদ ৩০০ কোটি টাকা দেয়ার প্রস্তাব করে। অপর
দিকে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানটির দর ছিল ৬৭৬ কোটি টাকা। ঢাকা স্টক একচেঞ্জ
যাচাই-বাছাইয়ের পর ১০ ফেব্রুয়ারি চীনের কনসোর্টিয়ামের প্রস্তাব গ্রহণ করার
সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর সে প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয় পুঁজিবাজার
নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশনতে (বিএসইসি)। গত সোমবার
বিএসইসি চীনের শেনজেন ও সাংহাই স্টক একচেঞ্জ নিয়ে গঠিত কনসোর্টিয়ামের
প্রস্তাব সংশোধন করতে ফেরত পাঠিয়েছে। এর মাধ্যমে মূলত চীনের বিনিয়োগ
প্রস্তাবটি আটকে গেল। শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
আবু আহমেদ এ প্রসঙ্গে গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন চীনের কনসোর্টিয়ামের চেয়ে আর
কোনো ভালো প্রস্তাব ছিল না। বিএসইসি প্রস্তাবটি গ্রহণ করেও সংশোধন করা
যেত। ফলে পুরো প্রক্রিয়াটি ঝুলে গেল। তিনি বলেন শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের
ক্ষেত্রে বাংলাদেশ স্বার্থরক্ষা করতে পারছে কি না সে প্রশ্ন উঠেছে। এসব
সিদ্ধান্তের পেছনে ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা থাকতে পারে বলে মনে
করেন তিনি। তিনি বলেন কৌশলগত বিনিয়োগ নেয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের অবস্থান
শেয়ারবাজারের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এর আগে ডিএসইর শেয়ার বিক্রি নিয়ে
আলোচনার জন্য ভারতের অন্যতম শেয়ারবাজার ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান
নির্বাহী কর্মকর্তা বিক্রম লিমা ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আসেন। তিনি ডিএসইর
ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাজেদুর রহমানের সাথে বৈঠক করে নানাভাবে তাদের দেশের
প্রতিষ্ঠানের কাছে শেয়ার বিক্রিতে চাপ প্রয়োগ করেন বলে অভিযোগ ওঠে।
শেয়ারবাজারে চীনা বিনিয়োগ প্রস্তাব ফেরত পাঠানোর পর চীনের আরো কিছু বিনিয়োগ
প্রস্তাব বাস্তবায়ন না হওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়
বাণিজ্য অংশীদার চীন। মেগা প্রকল্প পদ্মা সেতুসহ দেশের অনেক প্রকল্পে চীনের
বিনিয়োগ আছে। বিশেষ করে অবকাঠামো খাতে চীন বিনিয়োগে বেশি আগ্রহী। কিন্তু
দুই দেশের কৌশলগত স্বার্থ আছে এমন দীর্ঘ মেয়াদি বড় প্রকল্পে চীনা বিনিয়োগ
নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম চট্টগ্রামের সোনাদিয়ায় গভীর
সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রস্তাব। ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরকালে গভীর
সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীন সরকারের সহায়তা চাওয়া হলে চীন আগ্রহ প্রকাশ করে।
একই বছর অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ আর্থিক সহায়তা চেয়ে চীন সরকারকে চিঠি দেয়।
এরপর এই প্রকল্প নিয়ে আলোচনা এগোতে থাকে। ২০১২ সালে চীন সরকারের যোগাযোগ
মন্ত্রণালয় ও চায়না মার্চেন্ট হোল্ডিং কোম্পানির প্রতিনিধিরা প্রস্তাবিত
গভীর সমুদ্রবন্দরের স্থান পরিদর্শন করেন। সমুদ্রবন্দরকে ঘিরে অন্যান্য
অবকাঠামো নির্মাণ নিয়ে আলোচনা হয়। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন
সফরের সময় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য চীনের সাথে একটি সমঝোতা স্মারক
(এমওইউ) স্বারের কথা থাকলেও তা শেষ মুহূর্তে বাতিল হয়ে যায়।
এরপর বাংলাদেশ
সোনাদিয়ার পরিবর্তে পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ শুরু করে। যদিও
এখন পর্যন্ত এই বন্দর নির্মাণে বিদেশী বিনিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত হয়নি। এ
ব্যাপারে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল
(অব:) এম সাখাওয়াত হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ নিয়ে
ভূরাজনৈতিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব আছে। চীন ইতোমধ্যে মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও
পাকিস্তানে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। মালদ্বীপের সাম্প্রতিক
পরিস্থিতিতে চীনের প্রভাব সুস্পষ্ট। চীনের এই প্রভাবকে ভারত চ্যালেঞ্জ
হিসেবে মনে করছে। এমন পরিস্থিতিতে চীনের বড় প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশ হয়তো এখন
এগোতে চাইছে না। আগামী নির্বাচন আগে সরকার এসব প্রকল্প নিয়ে না-ও এগোতে
পারে। এ ছাড়া বাংলাদেশে জ্বালানি খাতে বিনিয়োগে চীন আগ্রহ দেখিয়ে আসছে।
বাংলাদেশে তিনটি গ্যাস ক্ষেত্রের ২০০ কোটি ডলারের সম্পদ চীনের হিমালয়
এনার্জির কাছে বিক্রয়ে চুক্তি করেছিল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক
প্রতিষ্ঠান শেভরন। উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তি (পিএসসি) অনুযায়ী জ্বালানি
খাতে এ ধরনের বিনিয়োগ হস্তান্তরের ক্ষেত্রে সরকারের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়।
শেভরনের এই সম্পদ চীনা কোম্পানির কাছে বিক্রির ব্যাপারে সম্মত হয়নি সরকার।
চীনা প্রতিষ্ঠানটির অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে পেট্রোবাংলা। শেষ পর্যন্ত
শেভরন সম্পদ বিক্রির পরিকল্পনা পরিত্যাগ করে। একের পর এক চীনা বিনিয়োগ
প্রস্তাব আটকে যাওয়ার বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন
কবীর গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দেশের স্বার্থ ও
প্রক্রিয়াগত নানা জটিলতা থাকে। তবে বড় বিনিয়োগ থমকে যাওয়ায় এমন ধারণা আছে
যে আমরা চীন ও ভারতের টানাটানির মধ্যে পড়ছি কি না। কারণ যা-ই থাকুক না কেন
বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের দিকটি প্রাধান্য পাবে এটাই
কাম্য।
No comments