স্টিফেন হকিং ঈশ্বরের মন ও ভিনগ্রহে বসতি by সৈয়দ আবদাল আহমদ
‘তারাদের মাঝে আনন্দে থাকুন’।
বর্তমান বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী স্টিফেন উইলিয়াম হকিংয়ের মৃত্যু সংবাদ শোনার পর তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে টুইটে এই কথাগুলো লেখেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। আর যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার টুইট ছিল- ‘শূন্য মধ্যাকর্ষণে আপনি সুপারম্যানের মতো উড়তে থাকুন’। বিশ্বনন্দিত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংকে চেনার জন্য ওই দু’টি টুইটই যথেষ্ট। বিজ্ঞানসাধনায় মহান এ বিজ্ঞানীর বেশির ভাগ কাজই ছিল মহাবিশ্বের রহস্য উদঘাটন ও আপেক্ষিকতা নিয়ে। টুইটের ছোট্ট বাক্যে হকিংয়ের এ পরিচয়ের দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। মহাবিশ্বের ধরন নিয়ে ছিল তার অসীম আগ্রহ। তিনি বলতেন, ‘আমার উদ্দেশ্য খুব ছোট। আর তা হলো মহাবিশ্বকে পুরোপুরি জানা। এটা এমন কেন এবং এর অস্তিত্বইবা আছে কেন- এসবের উত্তর খুঁজতে চাই।’ মহাবিশ্বের সৃষ্টি কোত্থেকে, কেমন করেইবা তা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে, মহাবিশ্বের ক্ষুদ্র কণা কেমন করে কাজ করে- এসব নিয়েই ছিল তার ভাবনা। তেমনি মানবজাতিকে মহাবিশ্বের দিকে আগ্রহী করতেও তিনি উৎসাহ জুগিয়েছেন। পৃথিবীর বাইরে অন্য গ্রহেও কিভাবে বসতি স্থাপন করা যায় সে কথা বলেছেন। বলেছেন ব্ল্যাব হোল বা কৃষ্ণগহবরের কথা, তারকারাজির কথা। আমাদের এবং আমাদের আগের প্রজন্মের এই মহান বিজ্ঞানীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই এ লেখা। বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে স্টিফেন হকিং এবং তার বিজ্ঞানসাধনা সম্পর্কে জানার সুযোগ হয় ছাত্রজীবনেই। বিশেষ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিষয়ে অনার্স করতে গিয়ে ‘ফোর্থ সাবজেক্ট’ বা চতুর্থ বিষয় হিসেবে পদার্থবিজ্ঞান পড়তে হয়েছে। এ সময় পদার্থবিজ্ঞানের বেশ কয়েকজন গুণী শিক্ষক অধ্যাপক রকিবউদ্দিন, অধ্যাপক আবদুল কাদের, অধ্যাপক এম সলিমুল্লাহ, ডক্টর আফরোজী ইউনূসের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। তারা ক্লাসের পাশাপাশি সমসাময়িক বিজ্ঞান বিষয়ে জনপ্রিয় বক্তৃতা অনুষ্ঠানেও অংশ নিতেন। বিজ্ঞান সংগঠন বিজ্ঞান মুকুরের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার কারণে বিজ্ঞানবিষয়ক এসব অনুষ্ঠানের আয়োজনও করতে হয়েছে। সেখানে বিশ্বনন্দিত বিজ্ঞানীদের মহৎ কাজগুলো আলোচিত হতো। সেসব আলোচনায় বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের কাজও বাদ যায়নি। পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক এম সলিমুল্লাহ নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী অধ্যাপক আবদুস সালামের সাথে কাজ করেছেন। অধ্যাপক সালামের পাশাপাশি তিনি বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের মহাবিশ্ব তত্ত্ব আলোচনায় তুলে ধরতেন। বাংলাদেশের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের চট্টগ্রামের বাসায় গিয়ে ২০০৪ সালে তার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। দৈনিক আমার দেশ-এ সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়। অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের ঘনিষ্ঠ পারিবারিক বন্ধু। মনে পড়ছে লন্ডনের জীবন সম্পর্কে বলতে গিয়ে সেদিন অধ্যাপক জামাল নজরুল বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের অনেক মজার কাহিনী শুনিয়েছিলেন। ক্যামব্রিজ এলাকাতেই ছিল তাদের বাসা। একজন আরেকজনের বাসায় নিমন্ত্রণে যেতেন। অধ্যাপক জামাল নজরুলের কাছে শুনেছি বিজ্ঞানী হকিং ছিলেন খুব রসবোধ সম্পন্ন মানুষ। নিজের অসুস্থতা নিয়েও রসপূর্ণ মন্তব্য করতে ছাড়তেন না। তার বাসায় বাঙালি রান্না উপভোগ করতেন। তারা পদার্থবিজ্ঞানের বিষয় বিশেষ করে মহাবিশ্বের উদ্ভব, এর পরিণতি এবং মহাশূন্য তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতেন। উল্লেখ্য, অধ্যাপক জামাল নজরুলও ছিলেন একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী। বিজ্ঞানের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন স্টিফেন হকিং। গত ১৪ মার্চ ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজে নিজ বাড়িতে ৭৬ বছর বয়সে তিনি মারা যান। তার দুই সন্তান লুসি ও টিম হকিং এক বিবৃতিতে বিশ্বের মানুষকে মৃত্যু সংবাদটি জানিয়ে বলেন- ‘আমরা গভীরভাবে মর্মাহত, কারণ আজ আমাদের প্রিয় বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।’ সন্তানেরা স্টিফেন হকিংয়ের একটি উক্তি উল্লেখ করে বলেন- বাবা বলতেন, এই মহাবিশ্বটা যদি তোমাদের প্রিয় মানুষদের আবাস না হতো, তাহলে এটি মহাবিশ্বই হয়ে উঠত না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মাত্র ২২ বছর বয়সে তিনি স্নায়বিক রোগ মটর নিউরন ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। যেটা তাকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে অচল করে দেয়। মটর নিউরন রোগের একটি ধরন অ্যামিওট্রফিক লেটারেল স্কেলরোসিতে (এএলএস) আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৬৪ সালে যখন তিনি তার প্রথম স্ত্রী জেনকে বিয়ে করার প্রস্তুতি নেন, তখন চিকিৎসকেরা রোগটি শনাক্ত করে জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি মাত্র দু-তিন বছর বাঁচবেন; কিন্তু সেই মানুষটি জগৎকে অবাক করে দিয়ে আরো ৫৪ বছর বেঁচে ছিলেন। তার মৃত্যু এমন একটি তারিখে হয়েছে, যে তারিখটির সাথে আরো দুইজান মহান বিজ্ঞানীর নাম জড়িয়ে আছে। ইটালির বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি ৩০০ বছর আগে ঠিক এই দিনে মারা যান। অন্য দিকে ১৩৯ বছর আগের ঠিক একই দিনে জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করেন বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন। কৈশোরে স্টিফেন হকিং ভালো ছাত্র ছিলেন না। নয় বছর বয়সে ক্লাসে তার স্থান ছিল শেষের দিকে। বাবা ছিলেন জীববিজ্ঞানের একজন গবেষক। বাবা চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়তে উদ্বুদ্ধ করলেও হকিং পদার্থ বিদ্যায় উচ্চতর শিক্ষা নেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে ডিগ্রি অর্জনের পর হকিং ক্যামব্রিজে কসমোলজির ওপর স্নাতকোত্তর গবেষণা করেন। তার বড় অবদান মহাবিশ্ব তত্ত্ব। কৃষ্ণগহবর ও আপেক্ষিকতা নিয়ে গবেষণার জন্য তিনি বিখ্যাত। ১৯৬৪ সালে রজার পেনরোজের সাথে তিনি বিকিরণ আপেক্ষকতার সিঙ্গুলারিটি তত্ত্ব দেন। তার আবিষ্কার হলো ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর শূন্য কিছু নয়, এর থেকেও বিকিরণ বেরিয়ে আসছে। অর্থাৎ ব্ল্যাকহোলে সবকিছু হারিয়ে যায় না। সেখান থেকে বের হওয়া যায়। হকিং বলেন, আপনি যদি মনে করেন যে, আপনি কৃষ্ণগহ্বরে পড়েছেন তবে আশাহত হবেন না। বের হওয়ার পথও আছে। ব্ল্যাকহোল থেকে যে বিকিরণ বেরিয়ে আসছে, বিজ্ঞানীরা এই কণাস্রোতের নাম দেন হকিং বিক িরণ। একে আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের পরিপূরক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্য ‘বিগ ব্যাং থিওরি’র প্রবক্তাও হকিং।মনীষীরা বলে থাকেন ১০০ বছর কিংবা তারও বেশি সময়ের ব্যবধানে এই পৃথিবীতে একজন বিস্ময়কর প্রতিভার আবির্ভাব ঘটে। তিনি হন হয়তো কোনো বিজ্ঞানী, না হয় শিল্পী, সাহিত্যিক, দার্শনিক বা রাজনীতিক। তার মেধা ও সৃজনশীলতায় এই সুন্দর পৃথিবী আরো সুন্দর হয়। তার অবদানে উপকৃত হয় মানবজাতি। বর্তমান যুগের এমনই এক বিজ্ঞানী ছিলেন স্টিফেন হকিং। তিনি বর্তমান বিশ্বের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীই ছিলেন না, ছিলেন এক বিস্ময়কর প্রতিভা। আলবার্ট আইনস্টাইনের পর তাকেই সবচেয়ে প্রভাব সৃষ্টিকারী বিজ্ঞানী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কেউ যদি নিজের সব মনোযোগ নিবিষ্ট করে, তাহলে যেকোনো কিছু অর্জন করা সম্ভব। প্রতিকূলতাকে কিভাবে জয় করতে হয় পৃথিবীকে দেখিয়ে গেছেন বিজ্ঞানী হকিং। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি শারীরিক সব অক্ষমতা জয় করে বিজ্ঞান সাধনা অব্যাহত রাখেন। অদম্য সাধনা ও অধ্যাবসায় দিয়ে হকিং নিজেকে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। বিজ্ঞানই ছিল হকিংয়ের নিয়তি; কিন্তু নিয়তি তার সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করেছে। তার প্রায় পুরো জীবনই কেটেছে হুইলচেয়ারে। মটর নিউরন রোগ তাকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে ফেলে। তবে কথা বলা ও চলার বিশাল বাধা কাটিয়েছিলেন তিনি। পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েও কম্পিউটার স্পিচ সিনথেসাইজারের মাধ্যমে কথা বলতেন। ১৯৮৫ সালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে তার ভোকাল কর্ড ও ল্যারিংস নষ্ট হয়। এ অবস্থায় তার হুইলচেয়ারে বসানো হয় কি-বোর্ড চালিত ইলেকট্রনিক স্পিচ সিনথেসাইজার। এর মাধ্যমেই তিনি কথা বলেন। এই বিখ্যাত যান্ত্রিক হুইলচেয়ারটি নিয়েই তিনি বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেরিয়েছেন এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে নবীনদের বিজ্ঞানচর্চায় আরো বেশি মনোযোগী হতে বলেছেন। মটর নিউরন রোগটি সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলতেন, এ রোগ যে আমার আছে তা অনুভবই করি না। আমাকে কাজ করতে বাধা দেয় এমন বিষয় আমলেই নেই না। অক্সফোর্ডে ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি জন্ম নেয়া এই অনন্যসাধারণ প্রতিভা স্টিফেন হকিং যার ডাকনাম ছিল স্টিভ, ১৯৭৯ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগের লুকেসিয়ান প্রফেসর হন। সপ্তদশ শতাব্দীর ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন এ পদে ছিলেন। সেখান থেকে হকিং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তাত্ত্বিক জ্যোতির্বিদ্যা ও মহাজাগতিক বিদ্যা পড়াতে যান। বিজ্ঞানকে তিনি বিপুল মানুষের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৮৮ সালে তার বিখ্যাত বই ‘অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ প্রকাশিত হয়। বইটি সর্বকালের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া বইয়ের একটি। বইটি বিক্রি হয় এক কোটি কপি। এ বইয়ে হকিং সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত মহাবিশ্বের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন যুক্তি, তথ্য ও তত্ত্বের নিরিখে। মাত্র কয়েক দিন আগে অনলাইনে প্রকাশ করা হয় তার পিএইচডি থিসিস। ২০ লাখের বেশি মানুষ তা দেখেছেন। কোনো গবেষণাপত্র নিয়ে এত আগ্রহ এর আগে কখনোই দেখা যায়নি। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত ১২ মার্চ হকিংয়ের পিএইচডি থিসিস অনলাইনে দেয়া হলে প্রথম দিনেই এত লোক এটা পড়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েন যে, ওয়েবসাইটটি ক্র্যাশ করে। ‘সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্ব’ নামের ১৩৪ পাতার এ থিসিস লেখার সময় স্টিফেন হকিং ছিলেন ক্যামব্রিজ ট্রিনিটি হলের পোস্ট গ্রাজুয়েটের ছাত্র।
ঈশ্বরের মন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ভিন্ন গ্রহে বসতি
স্টিফেন হকিং বিশ্বটাকে বদলে দিতে চেয়েছিলেন, হয়তো তিনি সেটা পারেননি। তবে তিনি মানুষের চিন্তার জগৎকে পাল্টে দিয়েছেন। আগেই বলেছি, তার ছিল অদম্য দৃঢ়তা। এ কারণে প্রতিনিয়ত মৃত্যুকে সঙ্গী করেও গত ৫০ বছর ধরে তিনি মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনে এক আইকনে পরিণত হন। অদম্য ইচ্ছাশক্তি না থাকলে বহু আগে তিনি নিজেই কৃষ্ণগহবরে হারিয়ে যেতেন। বিজ্ঞানের একজন জনপ্রিয় দূত হিসেবে তিনি সবসময় নিশ্চিত করতেন, যেন তার কাজ সাধারণ মানুষ সহজে বুঝতে পারে। তার থিওরি অব এভরিথিং বা ‘সবকিছুর তত্ত্ব’ মানুষকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে যেখানে তিনি ধারণা দেন যে, মহাবিশ্ব কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যেই বিবর্তিত হয়। মহাবিশ্বের শুরু কিভাবে হলো এমন সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে এসব নিয়ম। তার মতে, মহাবিশ্ব কবে শেষ হবে, কিভাবে শেষ হবে এসবের উত্তর যদি আমরা জানতে পারি, তাহলে আসলেই আমরা ঈশ্বরের মনও বুঝতে পারব। ২০১৪ সালে ‘থিওরি অব এভরিথিং’ নামে তার জীবন নিয়ে একটি চলচ্চিত্র তৈরি হয়। ২০০৭ সালে হকিং প্রথম চলৎশক্তিহীন ব্যক্তি হিসেবে একটি বিশেষ বিমানে ওজনশূন্যতার অভিজ্ঞতা নিয়েছিলেন। মানুষকে মহাকাশ ভ্রমণে উৎসাহ দেয়ার জন্যই তিনি এ কাজটি করেন। তার বিশ্বাস এবং আশঙ্কা পারমাণবিক যুদ্ধ, জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে তৈরি ভাইরাস অথবা অন্য কোনো কারণে পৃথিবীতে প্রাণের অবসান হতে পারে। তার মতে, মানুষ যদি মহাকাশে না যায় তাহলে মানবজাতির কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এ কারণেই তিনি মানুষকে মহাকাশে যাওয়ার বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে বিশেষ বিমানে করে ওজনশূন্যতায় অভিজ্ঞতা নেন। ডিসকভারি চ্যানেলের সাথে একবার স্টিফেন হকিং একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, পৃথিবীর বাইরে অন্য গ্রহে কোনো বুদ্ধিমান জীবনের উপস্থিতি আছে এমন ধারণা করাটা যৌক্তিক। তিনি এও মনে করেন, এলিয়েন বা ভিনগ্রহবাসীরা প্রাকৃতিক সম্পদের খোঁজে পৃথিবীতে অভিযান চালাতে পারে। শুধু পৃথিবী নামক গ্রহেই সব মানুষের বাস করার বিষয়টি স্টিফেন হকিং মেনে নিতে পারেননি। তাই তিনি কয়েক দশক ধরেই মানুষকে পৃথিবী ছাড়াও অন্য গ্রহে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করার আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন। তার মতে, বড় গ্রহাণুর আঘাতে পৃথিবী ধ্বংস হবে এমন উদ্বেগের পাশাপাশি মানুষের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণেও এমনটি ঘটতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগ্রগতি বিশাল সুযোগ সৃষ্টি করবে স্বীকৃতি দিলেও এর ভয়াবহতা নিয়েও তিনি সতর্কবাণী উচ্চারণ করে গেছেন। বলেছেন, মানুষ যদি কম্পিউটার ভাইরাস তৈরি করতে পারে, তবে কেউ একদিন এমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি করে বসবে যে, সেটা তাকেই সরিয়ে দেবে। এটা জীবনের আরেকটি রূপ। এটা বুদ্ধির দিক থেকে মানুষকে ছাড়িয়ে যাবে। তাকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল আমরা কি কখনো আমাদের পরিবেশগত সমস্যা ও মানব সঙ্ঘাতের সমস্যার সমাধান করতে পারব? জবাবে হকিং বলেছিলেন, পৃথিবী নামক গ্রহে আমাদের দিন হিসেবের। আমার মনে হয় বিবর্তন মানুষের মনের ক্ষোভ ও সহিংসতা জাগিয়ে তুলছে। মানব সঙ্ঘাত কমার কোনো লক্ষণ নেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় উদ্ভাবিত প্রযুক্তি বিশেষ করে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রযুক্তির বিকাশ এবং মারাত্মক অস্ত্রগুলো মানুষের জন্য ধ্বংসাত্মক হতে পারে যেকোনো সময়। সেজন্য মানবজাতির বেঁচে থাকার সবচেয়ে ভালো উপায় হতে পারে মহাকাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে স্বাধীনভাবে উপনিবেশ স্থাপন। তিনি মানবমণ্ডলীকে এই বলে সতর্ক করেন যে, আকস্মিক দুর্ঘটনায় যেমন পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি কোনো এক দিন ফের মহাদুর্ঘটনায় পৃথিবী ধ্বংসও হয়ে যেতে পারে। সেজন্য মানবজাতির উচিত হবে সেই ধ্বংসের আগেই নতুন কোনো আশ্রয় খোঁজে নেয়া। সেটা হতে পারে ভিনগ্রহে বসতি স্থাপন। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে লন্ডনের দ্য ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায় ‘দুঃসময় পার করছে আমাদের গ্রহ’ শিরোনামে তার একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। এতে লিখেন, আমাদের সামনে কয়েকটি ত্রাসোদ্দীপক চ্যালেঞ্জ এসে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমান বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী স্টিফেন উইলিয়াম হকিংয়ের মৃত্যু সংবাদ শোনার পর তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে টুইটে এই কথাগুলো লেখেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। আর যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার টুইট ছিল- ‘শূন্য মধ্যাকর্ষণে আপনি সুপারম্যানের মতো উড়তে থাকুন’। বিশ্বনন্দিত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংকে চেনার জন্য ওই দু’টি টুইটই যথেষ্ট। বিজ্ঞানসাধনায় মহান এ বিজ্ঞানীর বেশির ভাগ কাজই ছিল মহাবিশ্বের রহস্য উদঘাটন ও আপেক্ষিকতা নিয়ে। টুইটের ছোট্ট বাক্যে হকিংয়ের এ পরিচয়ের দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। মহাবিশ্বের ধরন নিয়ে ছিল তার অসীম আগ্রহ। তিনি বলতেন, ‘আমার উদ্দেশ্য খুব ছোট। আর তা হলো মহাবিশ্বকে পুরোপুরি জানা। এটা এমন কেন এবং এর অস্তিত্বইবা আছে কেন- এসবের উত্তর খুঁজতে চাই।’ মহাবিশ্বের সৃষ্টি কোত্থেকে, কেমন করেইবা তা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে, মহাবিশ্বের ক্ষুদ্র কণা কেমন করে কাজ করে- এসব নিয়েই ছিল তার ভাবনা। তেমনি মানবজাতিকে মহাবিশ্বের দিকে আগ্রহী করতেও তিনি উৎসাহ জুগিয়েছেন। পৃথিবীর বাইরে অন্য গ্রহেও কিভাবে বসতি স্থাপন করা যায় সে কথা বলেছেন। বলেছেন ব্ল্যাব হোল বা কৃষ্ণগহবরের কথা, তারকারাজির কথা। আমাদের এবং আমাদের আগের প্রজন্মের এই মহান বিজ্ঞানীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই এ লেখা। বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে স্টিফেন হকিং এবং তার বিজ্ঞানসাধনা সম্পর্কে জানার সুযোগ হয় ছাত্রজীবনেই। বিশেষ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিষয়ে অনার্স করতে গিয়ে ‘ফোর্থ সাবজেক্ট’ বা চতুর্থ বিষয় হিসেবে পদার্থবিজ্ঞান পড়তে হয়েছে। এ সময় পদার্থবিজ্ঞানের বেশ কয়েকজন গুণী শিক্ষক অধ্যাপক রকিবউদ্দিন, অধ্যাপক আবদুল কাদের, অধ্যাপক এম সলিমুল্লাহ, ডক্টর আফরোজী ইউনূসের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। তারা ক্লাসের পাশাপাশি সমসাময়িক বিজ্ঞান বিষয়ে জনপ্রিয় বক্তৃতা অনুষ্ঠানেও অংশ নিতেন। বিজ্ঞান সংগঠন বিজ্ঞান মুকুরের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার কারণে বিজ্ঞানবিষয়ক এসব অনুষ্ঠানের আয়োজনও করতে হয়েছে। সেখানে বিশ্বনন্দিত বিজ্ঞানীদের মহৎ কাজগুলো আলোচিত হতো। সেসব আলোচনায় বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের কাজও বাদ যায়নি। পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক এম সলিমুল্লাহ নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী অধ্যাপক আবদুস সালামের সাথে কাজ করেছেন। অধ্যাপক সালামের পাশাপাশি তিনি বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের মহাবিশ্ব তত্ত্ব আলোচনায় তুলে ধরতেন। বাংলাদেশের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের চট্টগ্রামের বাসায় গিয়ে ২০০৪ সালে তার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। দৈনিক আমার দেশ-এ সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়। অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের ঘনিষ্ঠ পারিবারিক বন্ধু। মনে পড়ছে লন্ডনের জীবন সম্পর্কে বলতে গিয়ে সেদিন অধ্যাপক জামাল নজরুল বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের অনেক মজার কাহিনী শুনিয়েছিলেন। ক্যামব্রিজ এলাকাতেই ছিল তাদের বাসা। একজন আরেকজনের বাসায় নিমন্ত্রণে যেতেন। অধ্যাপক জামাল নজরুলের কাছে শুনেছি বিজ্ঞানী হকিং ছিলেন খুব রসবোধ সম্পন্ন মানুষ। নিজের অসুস্থতা নিয়েও রসপূর্ণ মন্তব্য করতে ছাড়তেন না। তার বাসায় বাঙালি রান্না উপভোগ করতেন। তারা পদার্থবিজ্ঞানের বিষয় বিশেষ করে মহাবিশ্বের উদ্ভব, এর পরিণতি এবং মহাশূন্য তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতেন। উল্লেখ্য, অধ্যাপক জামাল নজরুলও ছিলেন একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী। বিজ্ঞানের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন স্টিফেন হকিং। গত ১৪ মার্চ ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজে নিজ বাড়িতে ৭৬ বছর বয়সে তিনি মারা যান। তার দুই সন্তান লুসি ও টিম হকিং এক বিবৃতিতে বিশ্বের মানুষকে মৃত্যু সংবাদটি জানিয়ে বলেন- ‘আমরা গভীরভাবে মর্মাহত, কারণ আজ আমাদের প্রিয় বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।’ সন্তানেরা স্টিফেন হকিংয়ের একটি উক্তি উল্লেখ করে বলেন- বাবা বলতেন, এই মহাবিশ্বটা যদি তোমাদের প্রিয় মানুষদের আবাস না হতো, তাহলে এটি মহাবিশ্বই হয়ে উঠত না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মাত্র ২২ বছর বয়সে তিনি স্নায়বিক রোগ মটর নিউরন ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। যেটা তাকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে অচল করে দেয়। মটর নিউরন রোগের একটি ধরন অ্যামিওট্রফিক লেটারেল স্কেলরোসিতে (এএলএস) আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৬৪ সালে যখন তিনি তার প্রথম স্ত্রী জেনকে বিয়ে করার প্রস্তুতি নেন, তখন চিকিৎসকেরা রোগটি শনাক্ত করে জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি মাত্র দু-তিন বছর বাঁচবেন; কিন্তু সেই মানুষটি জগৎকে অবাক করে দিয়ে আরো ৫৪ বছর বেঁচে ছিলেন। তার মৃত্যু এমন একটি তারিখে হয়েছে, যে তারিখটির সাথে আরো দুইজান মহান বিজ্ঞানীর নাম জড়িয়ে আছে। ইটালির বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি ৩০০ বছর আগে ঠিক এই দিনে মারা যান। অন্য দিকে ১৩৯ বছর আগের ঠিক একই দিনে জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করেন বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন। কৈশোরে স্টিফেন হকিং ভালো ছাত্র ছিলেন না। নয় বছর বয়সে ক্লাসে তার স্থান ছিল শেষের দিকে। বাবা ছিলেন জীববিজ্ঞানের একজন গবেষক। বাবা চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়তে উদ্বুদ্ধ করলেও হকিং পদার্থ বিদ্যায় উচ্চতর শিক্ষা নেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে ডিগ্রি অর্জনের পর হকিং ক্যামব্রিজে কসমোলজির ওপর স্নাতকোত্তর গবেষণা করেন। তার বড় অবদান মহাবিশ্ব তত্ত্ব। কৃষ্ণগহবর ও আপেক্ষিকতা নিয়ে গবেষণার জন্য তিনি বিখ্যাত। ১৯৬৪ সালে রজার পেনরোজের সাথে তিনি বিকিরণ আপেক্ষকতার সিঙ্গুলারিটি তত্ত্ব দেন। তার আবিষ্কার হলো ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর শূন্য কিছু নয়, এর থেকেও বিকিরণ বেরিয়ে আসছে। অর্থাৎ ব্ল্যাকহোলে সবকিছু হারিয়ে যায় না। সেখান থেকে বের হওয়া যায়। হকিং বলেন, আপনি যদি মনে করেন যে, আপনি কৃষ্ণগহ্বরে পড়েছেন তবে আশাহত হবেন না। বের হওয়ার পথও আছে। ব্ল্যাকহোল থেকে যে বিকিরণ বেরিয়ে আসছে, বিজ্ঞানীরা এই কণাস্রোতের নাম দেন হকিং বিক িরণ। একে আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের পরিপূরক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্য ‘বিগ ব্যাং থিওরি’র প্রবক্তাও হকিং।মনীষীরা বলে থাকেন ১০০ বছর কিংবা তারও বেশি সময়ের ব্যবধানে এই পৃথিবীতে একজন বিস্ময়কর প্রতিভার আবির্ভাব ঘটে। তিনি হন হয়তো কোনো বিজ্ঞানী, না হয় শিল্পী, সাহিত্যিক, দার্শনিক বা রাজনীতিক। তার মেধা ও সৃজনশীলতায় এই সুন্দর পৃথিবী আরো সুন্দর হয়। তার অবদানে উপকৃত হয় মানবজাতি। বর্তমান যুগের এমনই এক বিজ্ঞানী ছিলেন স্টিফেন হকিং। তিনি বর্তমান বিশ্বের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীই ছিলেন না, ছিলেন এক বিস্ময়কর প্রতিভা। আলবার্ট আইনস্টাইনের পর তাকেই সবচেয়ে প্রভাব সৃষ্টিকারী বিজ্ঞানী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কেউ যদি নিজের সব মনোযোগ নিবিষ্ট করে, তাহলে যেকোনো কিছু অর্জন করা সম্ভব। প্রতিকূলতাকে কিভাবে জয় করতে হয় পৃথিবীকে দেখিয়ে গেছেন বিজ্ঞানী হকিং। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি শারীরিক সব অক্ষমতা জয় করে বিজ্ঞান সাধনা অব্যাহত রাখেন। অদম্য সাধনা ও অধ্যাবসায় দিয়ে হকিং নিজেকে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। বিজ্ঞানই ছিল হকিংয়ের নিয়তি; কিন্তু নিয়তি তার সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করেছে। তার প্রায় পুরো জীবনই কেটেছে হুইলচেয়ারে। মটর নিউরন রোগ তাকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে ফেলে। তবে কথা বলা ও চলার বিশাল বাধা কাটিয়েছিলেন তিনি। পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েও কম্পিউটার স্পিচ সিনথেসাইজারের মাধ্যমে কথা বলতেন। ১৯৮৫ সালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে তার ভোকাল কর্ড ও ল্যারিংস নষ্ট হয়। এ অবস্থায় তার হুইলচেয়ারে বসানো হয় কি-বোর্ড চালিত ইলেকট্রনিক স্পিচ সিনথেসাইজার। এর মাধ্যমেই তিনি কথা বলেন। এই বিখ্যাত যান্ত্রিক হুইলচেয়ারটি নিয়েই তিনি বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেরিয়েছেন এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে নবীনদের বিজ্ঞানচর্চায় আরো বেশি মনোযোগী হতে বলেছেন। মটর নিউরন রোগটি সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলতেন, এ রোগ যে আমার আছে তা অনুভবই করি না। আমাকে কাজ করতে বাধা দেয় এমন বিষয় আমলেই নেই না। অক্সফোর্ডে ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি জন্ম নেয়া এই অনন্যসাধারণ প্রতিভা স্টিফেন হকিং যার ডাকনাম ছিল স্টিভ, ১৯৭৯ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগের লুকেসিয়ান প্রফেসর হন। সপ্তদশ শতাব্দীর ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন এ পদে ছিলেন। সেখান থেকে হকিং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তাত্ত্বিক জ্যোতির্বিদ্যা ও মহাজাগতিক বিদ্যা পড়াতে যান। বিজ্ঞানকে তিনি বিপুল মানুষের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৮৮ সালে তার বিখ্যাত বই ‘অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ প্রকাশিত হয়। বইটি সর্বকালের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া বইয়ের একটি। বইটি বিক্রি হয় এক কোটি কপি। এ বইয়ে হকিং সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত মহাবিশ্বের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন যুক্তি, তথ্য ও তত্ত্বের নিরিখে। মাত্র কয়েক দিন আগে অনলাইনে প্রকাশ করা হয় তার পিএইচডি থিসিস। ২০ লাখের বেশি মানুষ তা দেখেছেন। কোনো গবেষণাপত্র নিয়ে এত আগ্রহ এর আগে কখনোই দেখা যায়নি। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত ১২ মার্চ হকিংয়ের পিএইচডি থিসিস অনলাইনে দেয়া হলে প্রথম দিনেই এত লোক এটা পড়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েন যে, ওয়েবসাইটটি ক্র্যাশ করে। ‘সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্ব’ নামের ১৩৪ পাতার এ থিসিস লেখার সময় স্টিফেন হকিং ছিলেন ক্যামব্রিজ ট্রিনিটি হলের পোস্ট গ্রাজুয়েটের ছাত্র।
ঈশ্বরের মন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ভিন্ন গ্রহে বসতি
স্টিফেন হকিং বিশ্বটাকে বদলে দিতে চেয়েছিলেন, হয়তো তিনি সেটা পারেননি। তবে তিনি মানুষের চিন্তার জগৎকে পাল্টে দিয়েছেন। আগেই বলেছি, তার ছিল অদম্য দৃঢ়তা। এ কারণে প্রতিনিয়ত মৃত্যুকে সঙ্গী করেও গত ৫০ বছর ধরে তিনি মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনে এক আইকনে পরিণত হন। অদম্য ইচ্ছাশক্তি না থাকলে বহু আগে তিনি নিজেই কৃষ্ণগহবরে হারিয়ে যেতেন। বিজ্ঞানের একজন জনপ্রিয় দূত হিসেবে তিনি সবসময় নিশ্চিত করতেন, যেন তার কাজ সাধারণ মানুষ সহজে বুঝতে পারে। তার থিওরি অব এভরিথিং বা ‘সবকিছুর তত্ত্ব’ মানুষকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে যেখানে তিনি ধারণা দেন যে, মহাবিশ্ব কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যেই বিবর্তিত হয়। মহাবিশ্বের শুরু কিভাবে হলো এমন সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে এসব নিয়ম। তার মতে, মহাবিশ্ব কবে শেষ হবে, কিভাবে শেষ হবে এসবের উত্তর যদি আমরা জানতে পারি, তাহলে আসলেই আমরা ঈশ্বরের মনও বুঝতে পারব। ২০১৪ সালে ‘থিওরি অব এভরিথিং’ নামে তার জীবন নিয়ে একটি চলচ্চিত্র তৈরি হয়। ২০০৭ সালে হকিং প্রথম চলৎশক্তিহীন ব্যক্তি হিসেবে একটি বিশেষ বিমানে ওজনশূন্যতার অভিজ্ঞতা নিয়েছিলেন। মানুষকে মহাকাশ ভ্রমণে উৎসাহ দেয়ার জন্যই তিনি এ কাজটি করেন। তার বিশ্বাস এবং আশঙ্কা পারমাণবিক যুদ্ধ, জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে তৈরি ভাইরাস অথবা অন্য কোনো কারণে পৃথিবীতে প্রাণের অবসান হতে পারে। তার মতে, মানুষ যদি মহাকাশে না যায় তাহলে মানবজাতির কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এ কারণেই তিনি মানুষকে মহাকাশে যাওয়ার বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে বিশেষ বিমানে করে ওজনশূন্যতায় অভিজ্ঞতা নেন। ডিসকভারি চ্যানেলের সাথে একবার স্টিফেন হকিং একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, পৃথিবীর বাইরে অন্য গ্রহে কোনো বুদ্ধিমান জীবনের উপস্থিতি আছে এমন ধারণা করাটা যৌক্তিক। তিনি এও মনে করেন, এলিয়েন বা ভিনগ্রহবাসীরা প্রাকৃতিক সম্পদের খোঁজে পৃথিবীতে অভিযান চালাতে পারে। শুধু পৃথিবী নামক গ্রহেই সব মানুষের বাস করার বিষয়টি স্টিফেন হকিং মেনে নিতে পারেননি। তাই তিনি কয়েক দশক ধরেই মানুষকে পৃথিবী ছাড়াও অন্য গ্রহে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করার আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন। তার মতে, বড় গ্রহাণুর আঘাতে পৃথিবী ধ্বংস হবে এমন উদ্বেগের পাশাপাশি মানুষের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণেও এমনটি ঘটতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগ্রগতি বিশাল সুযোগ সৃষ্টি করবে স্বীকৃতি দিলেও এর ভয়াবহতা নিয়েও তিনি সতর্কবাণী উচ্চারণ করে গেছেন। বলেছেন, মানুষ যদি কম্পিউটার ভাইরাস তৈরি করতে পারে, তবে কেউ একদিন এমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি করে বসবে যে, সেটা তাকেই সরিয়ে দেবে। এটা জীবনের আরেকটি রূপ। এটা বুদ্ধির দিক থেকে মানুষকে ছাড়িয়ে যাবে। তাকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল আমরা কি কখনো আমাদের পরিবেশগত সমস্যা ও মানব সঙ্ঘাতের সমস্যার সমাধান করতে পারব? জবাবে হকিং বলেছিলেন, পৃথিবী নামক গ্রহে আমাদের দিন হিসেবের। আমার মনে হয় বিবর্তন মানুষের মনের ক্ষোভ ও সহিংসতা জাগিয়ে তুলছে। মানব সঙ্ঘাত কমার কোনো লক্ষণ নেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় উদ্ভাবিত প্রযুক্তি বিশেষ করে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রযুক্তির বিকাশ এবং মারাত্মক অস্ত্রগুলো মানুষের জন্য ধ্বংসাত্মক হতে পারে যেকোনো সময়। সেজন্য মানবজাতির বেঁচে থাকার সবচেয়ে ভালো উপায় হতে পারে মহাকাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে স্বাধীনভাবে উপনিবেশ স্থাপন। তিনি মানবমণ্ডলীকে এই বলে সতর্ক করেন যে, আকস্মিক দুর্ঘটনায় যেমন পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি কোনো এক দিন ফের মহাদুর্ঘটনায় পৃথিবী ধ্বংসও হয়ে যেতে পারে। সেজন্য মানবজাতির উচিত হবে সেই ধ্বংসের আগেই নতুন কোনো আশ্রয় খোঁজে নেয়া। সেটা হতে পারে ভিনগ্রহে বসতি স্থাপন। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে লন্ডনের দ্য ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায় ‘দুঃসময় পার করছে আমাদের গ্রহ’ শিরোনামে তার একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। এতে লিখেন, আমাদের সামনে কয়েকটি ত্রাসোদ্দীপক চ্যালেঞ্জ এসে দাঁড়িয়েছে।
তা হচ্ছে
জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য উৎপাদন, জনসংখ্যার আধিক্য, নানা প্রজাতির প্রাণীর
বিলুপ্তি, মহামারী রোগ, মহাসাগর দূষিত হয়ে যাওয়া। এগুলো মনে করিয়ে দিচ্ছে
মানব সভ্যতার অগ্রগতির পথে আমরা ভয়াবহতম সময়ে আছি। যে গ্রহে আমরা বাস করি,
সেটি ধ্বংস করার প্রযুক্তি আমরা আবিষ্কার করে ফেলেছি; কিন্তু এই গ্রহ থেকে
বেরিয়ে যাওয়ার প্রযুক্তি এখনো আমরা বের করতে পারিনি। হয়তো কয়েক শ’ বছরের
মধ্যে আমরা অন্য গ্রহে পাড়ি জমাতে পারব। তবে এই মুহূর্তে আমাদের গ্রহ
একটাই- এই পৃথিবী। এ কারণে পৃথিবীকে রক্ষার স্বার্থেই আমাদের মিলেমিশে কাজ
করা দরকার। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম প্রত্যাহারের ঘটনায় স্টিফেন হকিং
ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত
পৃথিবীকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে পারে। পৃথিবী উত্তপ্ত গ্রহে পরিণত হতে
পারে। গত বছর হকিং তার ৭৫তম জন্মদিনে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত
অনুষ্ঠানে বিবিসিকে বলেছিলেন- ট্রাম্পের এমন সিদ্ধান্ত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের
জন্য পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে হতে পারে। আমরা গ্লোবার ওয়ার্মিংয়ের এমন এক
পর্যায়ে আছি যা আরেকটু বেশি হলে সেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব নয়। ট্রাম্পের এ
সিদ্ধান্ত পৃথিবীকে আরেকটি ভেনাস বা শুক্র গ্রহে পরিণত করতে পারে, যেখানে
থাকবে দুই শ’ পঞ্চাশ ডিগ্রি তাপমাত্রা এবং সালফিউরিক এসিডের বৃষ্টিপাত।
জলবায়ু পরিবর্তনকে তিনি পৃথিবীতে বিদ্যমান সবচেয়ে ‘বড় বিপদ’ বলেও উল্লেখ
করেছিলেন। স্টিফেন হকিং বাংলাদেশে আসেননি। তবে বাংলাদেশের অনেকের সাথে
বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞানীদের সাথে তার পরিচয় ছিল। ২০০৯ সালে মার্কিন
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কাছ থেকে তিনি কংগ্রেশনাল মেডেল অব ফ্রিডম গ্রহণ
করেন। বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসও একই মেডেল নেন।
হকিংয়ের সাথে ড. ইউনূস যে ছবি তুলেছেন, সেটি বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় ছাপা
হয়। পদার্থবিদ্যার ইতিহাসে অন্যতম সেরা তাত্ত্বিক হকিংয়ের কাজ অমূল্য
সম্পদ। মানুষ তাকে এজন্য সবসময় স্মরণ করবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব
No comments