ব্যাপক ক্ষমতার ভ্যাট আইন : ব্যবসায়ীরা আতঙ্কিত
বকেয়া কর আদায়ে নতুন আইনে ভ্যাট কর্মকর্তাদের দেওয়ানি আদালতের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ ভ্যাট কর্মকর্তা চাইলেই দেওয়ানি আদালত পরিচালনার মাধ্যমে অর্থ আদায় করতে পারবেন। আর ভ্যাট ফাঁকি দিলে এক বছরের কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড, দলিলাদিতে মিথ্যা তথ্য দিলে ৬ মাসের কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড এবং আইন প্রয়োগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে অনূর্ধ্ব ৬ মাসের কারাদণ্ড বা সর্বনিন্ম ১০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এমনকি করদাতার আত্মীয়, ব্যবসায়িক অংশীদার ও প্রতিনিধিকেও দায়বদ্ধ করা হয়েছে। ব্যবসায়ী নেতাদের অনেকে মনে করেন, এসব ধারা মানবাধিকার লংঘনের শামিল। প্রচলিত আইন ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী আখ্যা দিয়ে আইন বাস্তবায়নের আগে তা সংশোধনের জোর দাবি জানিয়েছেন তারা। যদিও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দাবি করছে, পুরনো আইনের চেয়ে নতুন আইনে ভ্যাট কর্মকর্তাদের ক্ষমতা অনেক হ্রাস করা হয়েছে। এ বিষয়ে এফবিসিসিআইয়ের প্রথম সহসভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, নতুন আইনের কিছু ধারা নিয়ে ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন থেকে আপত্তি জানিয়ে আসছেন। ট্যারিফ মূল্য, সম্পূরক শুল্ক, সেবা খাতের ভ্যাট হার, সংকুচিত ভিত্তিমূল্য, ইসিআর ইস্যুতে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। কিন্তু সুরাহা হয়নি। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে আইন বাস্তবায়নের আগে ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট করতে বলা হয়েছে। সেটিও করা হয়নি। তিনি বলেন, খেলাপির জন্য আত্মীয়দের দায়বদ্ধ করার বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু এ আত্মীয় কারা হবেন সে বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়নি। করদাতার খেলাপির জন্য তো তার স্ত্রী দায়বদ্ধ হতে পারেন না? তিনি বলেন, এ ধরনের সামরিক আইন মানুষ মানলে তো দেশে ওয়ান-ইলেভেন স্থায়িত্ব পেত। এ ছাড়া এনবিআর বলছে, দেশে ৮ লাখ ব্যবসায়ীর মধ্যে ৩২ হাজার দাখিলপত্র জমা দেয়। প্রশ্ন হল- এ ব্যর্থতা কি ব্যবসায়ীদের নাকি এনবিআরের? ফলে এসব কথা বলে এনবিআর নিজেদের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
ব্যবসায়ীরা তো ভ্যাটজাল বাড়াতেই বলছেন। তিনি আরও বলেন, এমনিতেই দেশে বিনিয়োগ কমে গেছে। এ অবস্থায় ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের আস্থা ফিরিয়ে আনা কঠিন ব্যাপার। কিন্তু কোনো ব্যক্তির কারণে আস্থা নষ্ট হওয়া উচিত হবে না। মনে রাখতে হবে, ব্যক্তির চেয়ে দেশের অর্থনীতি বড়। সূত্র জানায়, নতুন ভ্যাট আইনের কিছু ধারায় ভ্যাট কর্মকর্তাদের সীমাহীন বিচারিক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। যদিও এনবিআর দাবি করছে- ভ্যাট কর্মকর্তাদের ক্ষমতা কমানো হয়েছে। অথচ পুরনো আইনের যেসব ধারা দিয়ে ব্যবসায়ীদের হয়রানি করা হতো নতুন আইনেও তা বলবৎ রাখা হয়েছে। উল্টো নতুন কিছু ধারায় শাস্তির বিধান যোগ করা হয়েছে। যাতে করদাতাদের হয়রানি কমার চেয়ে বাড়বে। এসব ধারার মাধ্যমে কর্মকর্তাদের জন্য ঘুষ-দুর্নীতির পথ আরও সুপ্রশস্ত করা হয়েছে। যা নতুন আইনের মূলনীতি যেমন- স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, হয়রানিমুক্ত ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ সৃষ্টির পথকে বাধাগ্রস্ত করবে। ভ্যাটের জুলুম বাড়বে। উদাহরণস্বরূপ নতুন আইনের সংজ্ঞায় ‘সহযোগী’ হিসেবে করদাতার আত্মীয়, অংশীদারি কারবারের অংশীদার, কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার, ট্রাস্ট এবং ওই ট্রাস্টের সুবিধাভোগী, সম্পত্তি উন্নয়নে যৌথ উদ্যোগ এবং উদ্যোগের অংশীদার ভূমি মালিক, নির্মাতা বা অন্য কোনো ব্যক্তিকে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ করদাতা ভ্যাট আইনের অধীনে দায়বদ্ধ থাকলে সহযোগী হিসেবে তার দায় ওই ব্যক্তিদের নিতে হবে। এই সংজ্ঞার অপব্যবহারের মাধ্যমে ভ্যাট কর্মকর্তারা শুধু করদাতার আত্মীয় নন, তার সমগ্র ব্যবসা-বাণিজ্যের অংশীদারদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারবেন, যা হয়রানির শামিল। ব্যবসায়ীরা বলছেন, করদাতার দায় তার আত্মীয়দের ওপর চাপানো যুক্তির মধ্যে পড়ে না। এটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। এ ছাড়া কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের ক্ষেত্রে কোম্পানি আইনের বিধান মোতাবেক দায়বদ্ধতার অতিরিক্ত দায়িত্ব গ্রহণ অযৌক্তিক। সংজ্ঞায় পরিবর্তন না আনলে তার অপব্যবহার হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এফবিসিসিআইয়ের উপদেষ্টা মনজুর আহমেদ বলেন, নতুন আইনে সর্বাঙ্গে বিষ। এসব ছাড়াও আরও সমস্যা আছে। যেগুলো একাধিক বৈঠকে এনবিআরকে বলা হয়েছে। কিন্তু ফল হচ্ছে না। আইনটির বিভিন্ন ধারা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বকেয়া কর আদায়ের ক্ষেত্রে ৯৬ ধারায় বলা আছে, দেওয়ানি কার্যবিধির অধীনে অর্থ আদায়ের ক্ষেত্রে দেওয়ানি আদালতের যে ক্ষমতা আছে, বকেয়া কর আদায়ের উদ্দেশ্যে নতুন আইনে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ভ্যাট কর্মকর্তাকে সে ধরনের ক্ষমতা দেয়া আছে। অর্থাৎ কর আদায়ে ভ্যাট কর্মকর্তারা দেওয়ানি আদালতের মতো কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবেন। ১০১ ধারার ২ উপধারায় বলা আছে, খেলাপি করদাতার যে পরিমাণ সম্পত্তি বা অর্থ প্রতিনিধির দখল বা নিয়ন্ত্রণে আছে বকেয়া কর আদায়ে প্রতিনিধির কাছ থেকে তা আদায় করা যাবে। বকেয়া করের জন্য প্রতিনিধিও ব্যক্তিগতভাবে দায়ী থাকবেন যদি তার দখলে থাকা খেলাপি করদাতা কোনো অর্থ বা তহবিল উত্তোলন করেন বা অন্য কোনো ব্যক্তিকে দেন। এখানে প্রতিনিধি অর্থ হচ্ছে অক্ষম ব্যক্তির ক্ষেত্রে অভিভাবক বা তার নিযুক্ত ব্যবস্থাপক, কোম্পানি ও সরকারি সত্তার ক্ষেত্রে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা। অর্থাৎ এ ধারার অধীনে এনবিআর চাইলে সরকারি সংস্থার মুখ্য নির্বাহীকেও দায়বদ্ধ করতে পারবে। ১১১ ধারায় বলা আছে, জাল বা ভুয়া চালানপত্র, ডেভিড নোট, ক্রেডিট নোট, সমন্বিত কর চালানপত্র ও উৎসে কর কর্তনের সনদপত্র তৈরি বা ব্যবহার করলে অথবা অন্য কোনো উপায়ে কর ফাঁকি দিলে অথবা প্রাপ্য না হওয়া সত্ত্বেও কর ফেরত দাবি করলে ওই ব্যক্তিকে এক বছরের কারাদণ্ড বা প্রদেয় করের সমপরিমাণ অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ১১২ ধারায় বলা আছে, দলিলাদিতে মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর বিবরণ বা বিকৃতি প্রদান করলে অনূর্ধ্ব ছয় মাসের কারাদণ্ড বা প্রদেয় করের সমপরিমাণ অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ১১৩ ধারায় বলা আছে, ভ্যাট কর্মকর্তাদের আইন প্রয়োগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে অনূর্ধ্ব ছয় মাসের কারাদণ্ড বা অন্যূন ১০ হাজার টাকা বা অনূর্ধ্ব দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। নতুন আইনের ৮৩ ধারায় কর্মকর্তাদের প্রবেশ ও তল্লাশির ক্ষমতা দেয়া আছে। ওই ধারায় বলা আছে, কমিশনারের অনুমতি সাপেক্ষে সহকারী কমিশনার পর্যায়ের কর্মকর্তারা এ ধারায় ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন। তারা ব্যবসা কেন্দ্র, অঙ্গন, ঘরবাড়ি, যানবাহনে প্রবেশ ও তল্লাশি করতে পারবেন। এ ছাড়া ব্যবসা কেন্দ্র পরিদর্শন করে তার রেকর্ডপত্র, নথিপত্র, দলিলাদি ও হিসাব পরীক্ষা করতে পারবেন। এ ছাড়া কোনো ব্যক্তি এই আইনে প্রণীত বিধির বিধান লঙ্ঘন করলে সহকারী কমিশনার বা তার ঊর্ধ্বের কর্মকর্তারা ব্যাংক হিসাব অপরিচালনযোগ্য করতে পারবেন। ৯১ ধারায় ভ্যাট কর্মকর্তা করদাতাদের রেকর্ডপত্র ফটোকপি করতে পারবেন।
এ ছাড়া রেকর্ডপত্র জব্দ ও পণ্য সিল ও ব্যাংক হিসাব অপরিচালনযোগ্য করতে পারবেন। ৯৫ ধারার ৫ উপধারায় বলা আছে, খেলাপি করদাতার অর্থ অপর কোনো ব্যক্তি বা সহযোগী বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংকের কাছে থাকলে তা ওই ব্যক্তি বা ব্যাংককে পরিশোধ করার জন্য কমিশনার নির্দেশ দিতে পারবেন। এ ছাড়া খেলাপি করদাতার ব্যবসা স্থান থেকে পণ্য বা সেবার সরবরাহ বন্ধের আদেশ দেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি কমিশনার চাইলে করদাতার ব্যবসাস্থান তালাবদ্ধ করে রাখার আদেশ দিতে পারবেন। প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা শনাক্তকরণ নম্বর (বিআইএন) বন্ধ বা ব্যাংক হিসাব অপরিচালনযোগ্য করা যাবে। এ ছাড়া খেলাপি করদাতার স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক বা অবস্থার সম্পত্তি জব্দ করে নির্ধারিত পদ্ধতিতে তা বিক্রির মাধ্যমে বকেয়া কর আদায়ের বিধান রাখা হয়েছে। ৯৯ ধারায় বলা আছে, যদি কোনো করদাতা নির্ধারিত তারিখে বকেয়া কর পরিশোধে ব্যর্থ হন তাহলে ওই করদাতার মালিকানাধীন সব সম্পত্তি জব্দ করতে পারবেন কমিশনার এবং ওই সম্পত্তির ওপর সরকারের অনুকূলে অগ্রাধিকার সম্পন্ন পূর্বস্বত্ব সৃষ্টি হবে। অর্থাৎ সম্পত্তি থেকে অর্জিত আয় সরকারের কোষাগারে জমা হবে। সেটি বকেয়া কর পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। ১০০ ধারার ৩ উপধারায় বলা আছে, যদি কোনো খেলাপি করদাতা সময়মতো কর পরিশোধ না করেন অথবা বকেয়া করের বিপরীতে কোনো জামানত দেয়া না হয় অথবা খেলাপি কর কিস্তিতে পরিশোধে সম্মত হয়েও প্রথম কিস্তির অর্থ পরিশোধ না করেন তাহলে কমিশনার জব্দকৃত পণ্য বিক্রি করে কর আদায় করতে পারবেন। ১১৭ ধারায় বলা আছে, যদি কোনো ব্যক্তি অপরাধ সংঘটনে সহায়তা বা সহযোগিতা করেন বা প্ররোচিত বা প্রলুব্ধ করেন তাহলে ওই ব্যক্তি অপরাধ সংঘটনকারীর মতো একই অপরাধে অপরাধী হিসেবে গণ্য হবেন। পাশাপাশি অপরাধীর মতো একই দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
No comments