২৭ বছরে ৩০৮৬ মৃত্যু : চলতি মাসে ব্যাপক বজ্রপাতের শঙ্কা
বজ্রপাতে মরছে মানুষ, হচ্ছে মারাত্মকভাবে আহত। সারা দেশে গত ২৭ বছরে বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছে তিন হাজার ৮৬ জন। আর আহত হয়েছে দুই হাজার ৪৫০ জন। গড়ে প্রতি বছরে প্রায় ১১৪ জন বজ্রপাতে প্রাণ হারাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্ষা শুরুর আগে দেশে বজ্রপাত বেড়ে যায়। চলতি মাসে এ জন্য ব্যাপক বজ্রপাতের আশঙ্কা করছেন তারা। তাই খোলা জায়গা, মাঠ জলাশয়ে চলাচলে সতর্ক থাকতে হবে। এসব তথ্য জানা গেছে, অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আশরাফ দেওয়ান এবং ঢাবি ভূগোল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো: ফারুক হোসেনের যৌথ গবেষণায়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে আমেরিকার মেট্রোলজিক্যাল সোসাইটির সেমিনারে এটি উপস্থাপিত হয়। লাইটিনিং ফ্যাটালিটিজ ইন বাংলাদেশ ফ্রম ১৯৯০ থেকে ২০১৬ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে বর্ষা শুরুর আগে বজ্রপাত বেশি হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত হচ্ছে প্রাক-বর্ষা মওসুম। গত ২৬ বছরে এ সময়ে সারা দেশে এক হাজার ৯১৬ জন প্রাণ হারিয়েছে বজ্রপাতে। অপর দিকে ভরা বর্ষা মওসুম অর্থাৎ জুন-জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বর রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোরে বজ্রপাত বেশি হয়। ১৯৯০ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ভরা মওসুমে বজ্রপাতে ৯৯৮ জন প্রাণ হারিয়েছে। আর বর্ষার শেষের দিকে গত ২৬ বছরে বজ্রপাতে প্রাণ হরায় ১২৭ জন। শীতেও বজ্রপাত রেহাই দিচ্ছে না। দেখা গেছে ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে প্রায় ৪৫ জন প্রাণ হারিয়েছে। কেন এ বজ্রপাত? বিশেষজ্ঞদের মতে, তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, বায়ুচাপ ও আর্দ্রতার বিশ্লেষণ জলবায়ুর তারতম্যের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ ক্রান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলে পড়েছে। তাই ভৌগোলিক কারণে এসব অঞ্চলে বজ্রপাত বেশি হয়ে থাকে। খুলনার পশ্চিম-উত্তরের কিছু এলাকা, যশোর-কুষ্টিয়ার পশ্চিম ভাগের সঙ্কীর্ণাংশ, রাজশাহী ও দিনাজপুরের পশ্চিমাংশের বেশকিছু এলাকা ক্রান্তীয় উপক্রান্তীয় শুষ্কপ্রায় জলবায়ুর মধ্যে পড়েছে। বাংলাদেশের এ অঞ্চল সর্বাপরি উষ্ণ ও শুষ্ক। কোনো কোনো সময় মে মাসের তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সাধারণভাবে এক ৪০০ মিলিমিটারের কম। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটা বজ্রপাতের জন্য সহায়ক আবহাওয়া পরিবেশ। বুয়েটের সহযোগী অধ্যাপক ড. নাসরীন আক্তার বলেন, বজ্রঝড় এক ধরনের ঝড় যার মধ্যে প্রচণ্ড বায়ুর অস্থিরতা এবং বজ্রপাত সংঘটিত হয়। সাধারণত এতে অতি বৃষ্টি বা শিলাবৃষ্টি দেখা দেয়। বজ্রঝড়ে যে মেঘ দিয়ে তৈরি হয় তারা নাম হচ্ছে কিউমুলোনিমবাস বা ঘন কালো মেঘ। এটা ভূ-পৃষ্ঠের উপরে ৪৫০ থেকে ৬০০ মিটারে তৈরি হয় এবং উচ্চতায় প্রায় ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত হয়। আমাদের দেশে বর্ষা শুরুর আগে পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব দিক থেকে বজ্রঝড় হয় বলে একে কালবৈশাখী হিসেবে পরিচিত পেয়েছে। এ সময়ে পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব থেকে গভীর শুষ্ক ও গরম বাতাস এবং বঙ্গোপসাগর থেকে অগভীর বাতাস মিলিত হয়ে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে, যা বজ্রঝড় তৈরিতে সহায়ক। যেহেতু মেঘের আকৃতি বেশ বড় হয় সে জন্য এর মধ্যে তুষার-কণা, শিলাকণা, অতিমাত্রায় ঠাণ্ডা পানি সহাবস্থান করে। এরা মেঘের মধ্যে চলমান অবস্থায় থাকে। উপরে থাকা শিলাকণাগুলো যখন ভারী হয়ে যায় তখন প্রাকৃতিক নিয়মে সেগুলো নিচে দ্রুত বেগে নামতে শুরু করে। এর সাথে তুষারকণার সংঘর্ষের কারণে শিলাকলাগুলো ঋণাত্মক চাপে রূপান্তরিত হয়ে মেঘের নিচের অংশে চলে আসে। অপর দিকে তুষারকণা ধনাত্মক চার্জ প্রাপ্ত হয়ে মেঘের ওপরে অবস্থান করে, যা অনেকটা ব্যাটারির মতো।
এ ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জের জন্য বজ্রপাতের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য পরিবেশের আর্দ্র বাতাসের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এ আর্দ্র বাতাস বজ্রঝড়কে আরো বেশি শক্তিশালী করে তুলে বজ্রপাতের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় বলে ড. নাসরীন আক্তার অভিমত ব্যক্ত করেন। তবে এ নিয়ে আরো গবেষণার দরকার বলে তিনি মত দেন। তবে অধ্যাপক ড. আশরাফ দেওয়ান বলেন, বাংলাদেশে ভূমি সমতল বেশি। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকায় অতিরিক্ত জ্বলীয়বাষ্পের উৎপত্তি ঘটেছে, এবং বায়ুমণ্ডল কর্তৃক এ জ্বলীয়বাষ্প গৃহীত হচ্ছে। ঊর্ধ্বমুখী এবং নি¤œমুখী চাপও বেড়ে যাচ্ছে এতে। দিনের দৈর্ঘ্য বেড়ে যাচ্ছে সাথে সাথে। এ ছাড়া পানি বাষ্পীভূতের হারও বেড়ে যাচ্ছে। এ কারণে বায়ুমণ্ডল অস্থিতিশীল হয়ে বর্জপাত সংঘটিত হচ্ছে। কারা প্রাণ হারাচ্ছে? অধ্যাপক ড. আশরাফ দেওয়ান ও মো: ফারুক হোসেনের গবেষণায় দেখা গেছে, কৃষিকাজে নিয়োজিত ছিল এমন ব্যক্তিদের মধ্যে গত ২৭ বছরে এক হাজার ২২৫ জন প্রাণ হারিয়েছে। ঘরের ভেতরে ছিল এমন ব্যক্তিদেরও বজ্রপাতে প্রাণ হারাতে হচ্ছে। গত ২৬ বছরে ঘরের মধ্যে অবস্থান করেও বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছে ৭৩৭ জন। বাড়ি ফেরার পথে বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছে ৩৩২ জন। অপর দিকে মাছ ধরার সময় গত ২৬ বছরে বজ্রপাতে প্রাণ হরায় ২৩৩ জন। একই সময়ে গরু বা ছাগল চরানোর সময় প্রাণ হারায় ১১০ জন। ফুটবল খেলার সময় গত ২৬ বছরে বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছে ৭১ জন। গাড়ির ভেতরে থেকেও বজ্রপাতের শিকার হয়ে প্রাণ হারায় ৪৭ জন। এমনকি স্কুল ঘরে অবস্থান করে প্রাণ হরায় ৩২ জন। গাছের নিচে অবস্থান করে বজ্রপাতের শিকার হয়ে প্রাণ হারায় ২৮ জন। বজ্রপাতে আক্রান্তদের বয়স গবেষণায় দেখা গেছে, বজ্রপাতে মৃত্যু হচ্ছে অপেক্ষাকৃত কমবয়সী ও কর্মক্ষমরাই। গত ২৬ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সীরা বজ্রপাতে মারা যাচ্ছে বেশি। বজ্রপাতে গত ২৬ বছরে এ বয়সের মারা গেছে ৪৫০ জন। অপর দিকে গত ২৬ বছরে ৩১ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত এ বয়সে বজ্রপাতে মারা গেছে ৪০০ জন।
No comments